বেলজিয়ামে বেআক্কেল

২০১২ সালের মে মাসে ইউরোপে অফিসের কাজে। বেলজিয়াম (ব্রাসেলস্) থেকে নেদারল্যান্ড যাবো দ্রুতগতির ট্রেনে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আরো দুই কলিগসহ। উপরে রৌদ্রে বেশ গরম লাগছিল। নীচে নেমে খোলা প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি বেশ শীত লাগছে। পরনের জ্যাকেটটা খুলে হ্যাভারস্যাক ব্যাগে রেখে দিয়েছি। সেই মুহূর্তে ট্রেন চলে আসলো। জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে স্যাম্পলের লাগেজটা, হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে হুড়োহুড়ি করে ট্রেনে উঠলাম।

ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেক পরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ গা দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমার হ্যাভারস্যাক ব্যাগটা প্লাটফর্মেই ফেলে এসেছি। আমার দুই কলিগের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন ! আমার ব্যাগে আমার পাসপোর্ট ছাড়াও আমার সবেধন নীলমণি অফিসের সব ডাটা ও ই-মেইল সহ নোটবুক আর পুরো ট্রাভেলের রাহা-খরচ হাজার পাঁচেক ইউরো ! ব্যাগের প্রথম জিপারটা খুললেই যে কেউ পেয়ে যাবে টাকার ওয়ালেট আর পাসপোর্ট। নোটবুক বাদ দিচ্ছি, ইউরোর পরিমাণ যা আছে, যে কোন লোককে লোভাতুর করতেই পারে।

প্রথমেই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলাম , বেলজিয়ামে কেউ পরিচিত আছে কীনা। আগের অফিসের ( মার্কেট ফিট ) পুরানা বস বেলজিয়ামের। ওই অফিসের ফ্রেন্ডরে ফোন দিলে সে নিশ্চয় আমাকে প্রাক্তন বসের নাম্বারটা দিবে। পাসপোর্ট বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াটা প্রথম জরুরী। আমি সবচেয়ে খারাপ কী কী হতে পারে তাই দিয়ে শুরু করলাম। এটুকু মনে আছে, ব্রাসেলস্ এর ওই প্লাটফর্মে আমি শ’খানেক স্টুডেন্ট দেখেছি। এরিয়াটা বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরা।

কলিগ বলল, ‘জাহিদ ভাই চেকাররে কইয়া দ্যাখেন হে কোন হেল্প করতে পারে কিনা।’
লম্বা চুলের দাড়িওয়ালা এক চেকাররে ধরলাম, বেটা বেলজিয়ান- তেমন ইংরেজিতে পারদর্শী না। তবে সে সমস্যাটা বুঝলো। ওয়ারলেসে আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলল। আমাদের কেনা দূর-যাত্রার টিকিটগুলো যেন ব্যবহার করতে পারি , সেই ব্যবস্থা করলো। উপদেশ দিল, তোমরা সামনের স্টেশনে নেমে গিয়ে আবার পিছনে ব্রাসেলস্ এ ফিরে যাও। আমি স্টেশনমাস্টারকে বলেছি, সে খোঁজ করবে। শুধুমাত্র কপাল ভালো হলেই ব্যাগটা পেতে পারো। এতো ব্যস্ত প্লাটফর্মে তোমার ব্যাগ এতক্ষণ পড়ে থাকার সম্ভাবনা কম।

যতো সময় যাচ্ছে, আমাদের টেনশন ততোই বেড়ে চলেছে।
ঘণ্টা খানেক পরে আমরা ষ্টেশনে ফিরে গেলাম। যে বেঞ্চিতে বসেছিলাম দেখলাম সেটা শূন্য !
লম্বা প্লাটফর্মের মাঝখানে ছোট্ট কাঁচঘেরা রুম থাকে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য , গার্ডদের বসার জন্য। ষ্টেশন মাস্টারের কাছে যাওয়ার আগে কী মনে করে একবার ঢুঁ মারলাম। দেখি আমার হ্যাভারস্যাক ব্যাগটা পড়ে আছে একপাশে। ভীষণ মোটা গার্ড বেশ কিছুক্ষণ ওদের ভাষায় আমাকে গালাগালি করলো। কিছু যেহেতু বুঝি নাই, গায়ে মাখলাম না। আমি তখন শাব্দিক অর্থেই ‘জানে পানি’ পেয়েছি।

এতো কিছুর পরে আমার দুটো ধারণা হয়েছে, ইউরোপের আইনশৃঙ্খলা ভালো এইটা সবাই জানে। আমার কলিগদের অনেককেই লাগেজ হারানোসহ ছিনতাইয়ের কবলেও পড়েছে। ইস্ট ইউরোপের গরীব দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ বেকারে পশ্চিম ইউরোপের বড় শহরগুলোতে ভরে গেছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ইউরোপিয়ানরা আগের মতো আর গর্ব করে না।
যা বলছিলাম, যেহেতু ওইটা ইউনিভার্সিটি এলাকা এবং শতশত ছেলেমেয়ে যাতায়াত করছে, হয়তো ব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখেও কেউ ধরেনি অন্য কোন স্টুডেন্টের বলে।

আর দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা মনে দাগ কেটেছে তা অন্য কারণে, আমি তেমন ধার্মিক নই। কিন্তু আমার ধার্মিক কলিগ এই দুর্বিষহ দেড় ঘণ্টার মধ্যে কয়েকবার বললো, ‘জাহিদ ভাই, আপনি ভালো মানুষ,আপনি এতো বড়ো বিপদে পড়তেই পারেন না।’

পুরো ঘটনার মধুরেনু সমাপেয়ু হওয়ার পরে সে আমার মনে করিয়ে দিল, ‘কইছিলাম না, আপনি বিপদে পড়তেই পারেন না!’
ভয়াবহ একটা ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে বেসিক্যালি সবাই আমার কাছে ধন্যবাদার্হ ছিলেন, টিকেট চেকার, গার্ড এবং আমার কলিগ দুইজন!

প্রথম প্রকাশঃ ২২শে এপ্রিল ২০১৩

প্রসঙ্গ সড়ক দুর্ঘটনা

আশির দশকের দৈনিক পত্রিকায় সরকারী-বেসরকারি নিউজের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহের লিড নিউজ কী হতো, কারো মনে আছে?
আমার মনে আছে। হয় আরিচা মহাসড়কের বা অন্যকোন মহাসড়কের দুর্ঘটনার ছবি, সারিবদ্ধ লাশ , নীচে ক্যাপশন “এভাবে আর কতোদিন?” অথবা, লঞ্চ দুর্ঘটনায় অর্ধশত নিহত, শতাধিক নিখোঁজ।

তো আমি তখন স্কুলের পোলাপান, থান্ডার ক্যাটস বা টম অ্যান্ড জেরি নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় লঞ্চডুবি হইলো ,কতোজন মারা গেল আমাকে অতোখানি স্পর্শ করতো না। বড়োজোর ফেলে রাখা সারি সারি লাশের ছবি দেখে একটু মন খারাপ হতো।

৮৭ তে আমার বড়মামা আর নানী লঞ্চডুবিতে পড়লেন। দিনের বেলা হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা কম। মোবাইলের যুগও নয়। বড়মামা ও নানী সঙ্গের মালপত্তর হারিয়ে কীভাবে যেন জানে বেঁচে গেলেন। আশে পাশের অনেক মাছ ধরা নৌকা অনেক যাত্রীর জীবন বাঁচায় সেবার। বড়মামা কারো সাহায্য করা একটা পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গি আর নানী এক-কাপড়ে যখন ঢাকায় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তখন আমি বুঝলাম লঞ্চডুবির ভয়াবহতা। মামা ও নানীর মুখে শোনা, লঞ্চ ডুবে যাওয়ার আগের প্রত্যেকটা মুহূর্ত কী যে ভয়ংকর আতংকের ছিল, এখন মনে পড়ে যাচ্ছে।
ভারতের বদান্যতায় নদীতে নাব্যতার অভাবে লঞ্চ নির্ভরতা অনেক কমে গেছে মনে হয়। যা দেখছি, আগের মতো মাসে ৭/৮টা লঞ্চডুবির কথা শুনতে হয় না। লঞ্চ দুর্ঘটনা এখন আরে লিড নিউজে নাই।

আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটলো আমার নিজের জীবনে। ২০০৫ এ বাস অ্যাকসিডেন্টে বিছানায়, ফিমার ছুটে গেছে টিবিউলার থেকে, মানে হিপ বা কোমরের সাথে ডান পায়ের জয়েনিং ফর্দাফাঁই । ট্রাকশন নিয়ে চিৎ হয়ে তিনমাসের অসহনীয় দিনগুলো , মাঝে আবার কোরবানির ঈদ গেল, হাসপাতালের বেডে শুয়ে অকথ্য যন্ত্রণা , অসহায় আক্রোশের প্রতিটা মুহূর্ত। ওই সময় আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। বিছানায় শুয়ে শুয়েই প্রথম কন্যার জন্মসংবাদ শুনতে হলো। কী জানি কী মনে করে ,ঈদে গ্রামমুখী মানুষের সড়ক দুর্ঘটনার নিউজগুলো মন দিয়ে শুনতাম। শুয়ে শুয়ে একটা ডাটাও বের করলাম। ২০০৬ এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে শুধুমাত্র টিভি নিউজে মোটামুটি শ দেড়েক বড় সড়ক দুর্ঘটনার নিউজ শুনলাম। মোটামুটি ১৫০ জনের অকালপ্রয়াণ আর হাজার খানেকের পঙ্গুত্ব।

আমি নিজে পা ভেঙ্গে পড়েছিলাম বলেই হয়তো এইগুলো মন দিয়ে দেখতাম। আর কতিপয় অসাবধানী শুয়োরের বাচ্চা ড্রাইভারের জন্য পঙ্গুত্ব বরন করা লোকগুলোর কথা চিন্তা করতাম। আমার ডাক্তার ছিলেন ডাঃ রুহুল হক ( বর্তমান স্বাস্থ্য মন্ত্রী)। কিন্তু , কয় জনের সাধ্য আছে, তাঁকে দিয়ে চিকিৎসা করানোর? পঙ্গুত্বতো এক অর্থে মৃত্যুর চেয়ে অকল্পনীয় যন্ত্রণার !মনুষ্যজীবনে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অসম্মানের আর কী থাকতে পারে ?

আমার আশে পাশের অনেককে দেখেছি হাজার তিনেক টাকা দিয়ে দু নাম্বার ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করতে। কেন জানিনা আমার জিদ চেপে গিয়েছিল আমি দু নম্বরি কোনকিছু করবো না। সুস্থ হয়ে আমি নিজে ড্রাইভিং শিখলাম এবং মাত্র ১৮০০ টাকা কুল্লে খরচ করে পর্যায়ক্রমে ৪/৫ দিন বিআরটিসি তে লিখিত, মৌখিক, ব্যাবহারিক দিয়ে ওরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিলাম। এইটুকু বুঝলাম যে একজন অপ্রশিক্ষিত ড্রাইভার কতজনের সারাজীবনের দুর্দশার কারণ হতে পারে।

দুইটা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা, আমাকে সচেতন করেছে মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশার কথা ভেবে দেখতে। আজ যারা রাজনীতিবিদ, দেশের মাথা , তাদের জন্য দোয়া করি তাঁদের নিকটাত্মীয় বা প্রিয়জনের এই অভিজ্ঞতা হোক। একজন প্রিয় মানুষের প্রস্থানে যদি ইলিয়াস কাঞ্চন, তারানা হালিমের মতো তারকা আজ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হতে পারেন । আমি প্রার্থনা করি, মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদদের প্রিয়জন অকালে বিল্ডিং চাপা পড়ুক, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাক, পুড়ে মরুক কোন বদ্ধ কারখানায়।

কয়েকজন মানুষের বিদায়ে যদি সারা বাংলাদেশে কিছু পজিটিভ পরিবর্তন হয়, আমি সেই প্রার্থনা করতেই পারি ! আপনারাও প্রার্থনা করেন , হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে করেন !

প্রথম প্রকাশঃ ২৬শে এপ্রিল ২০১৩

প্রসঙ্গ বিসিএস :

সত্তুরের দশকে শিল্পীর স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিবৃতিগুলো চীন-ভারত সীমান্ত জট প্রসঙ্গে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুকে সেই লেখকমণ্ডলীর মধ্যে দেখা গেল না। নিস্পৃহ থেকে তিনি নিজের অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘লেখার স্বাধীনতা যদি থাকে, না-লেখার স্বাধীনতাও আছে।’
সমরেশ বসুর এই বোধ আমি নিজেও ধারণ করি। আমিও ‘ না-লেখার স্বাধীনতায়’ বিশ্বাস করি। হতে পারে, আমার নিস্পৃহতা , হতে পারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারে আমার চিরআলস্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চলতি হাওয়ার তথাকথিত দায়বদ্ধতায় দায়বদ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক লেখা আমার পক্ষে কখনই হয়ে ওঠেনি। আমি হয় আগে বলে ফেলি অথবা পরে বলি। এতোদিনে আমার স্বল্প পরিচিতরাও জেনে গেছেন যে, আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারিনা, আর এই বয়সে এসে এই দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা নাই বা করলাম।
তো যাই হোক, প্রতিবছর বিসিএস-এর ফলপ্রকাশের সময় ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রাশিরাশি সাফল্যের গল্প প্রকাশ করে। মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়া দিনমজুরের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে; দারোয়ানের ছেলে কাস্টমস অফিসার হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব সাফল্যকীর্তি আমাদের আশাবাদী করে। মনে হয়, বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ, মানুষের সম্ভাবনাও অপরিসীম। মনে হয়, পুঁজিবাদীদের ঠাকুর আধুনিক আমেরিকার মতোই বাংলাদেশও সবসময় ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটি’ ! এখানে সমাজের সকল শ্রেণির, স্বতন্ত্র ব্যক্তির একই রকম সম্ভাবনা আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশীদার হওয়ার। ‘আজ যে ফকির কাল সে রাজা।’ এইসব বিচ্ছিন্ন মিথ নিয়ে আমরা আশাবাদে বুঁদ হয়ে থাকি।
প্রসঙ্গত আব্রাহাম মাসলো তাঁর সুবিখ্যাত Maslow’s hierarchy of needs (মাসলো’র চাহিদার সোপান তত্ত্ব ) যে কথাগুলো বলেছেন, সেখান থেকে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ এবং নির্দিষ্ট করে বাঙাল সমাজ বের হতে পারেনি। মৌলিক জৈবিক চাহিদা, নিরাপত্তা, পারিবারিক ভালোবাসার পর্যায়গুলো পেরিয়ে যেতে পারলেই সে আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত করে।
বাঙালের চাহিদা তার ধারাবাহিক প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে। মোটা দাগে আমার মতো মুর্খ লোকেও বলতে পারে যে, পিরামিডের উপরের দিকে এসেই বাঙাল ক্ষমতাবান হতে চায়, জনপ্রিয় হতে চায়। যেনতেন প্রকারে বিত্ত তো চলে আসেই। কিন্তু ক্ষমতা ও সম্মানের দুইটিই একসঙ্গে একজীবনে পাওয়ার একটিমাত্র উপায় আছে, সেটি সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়া। ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস থেকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস হয়ে অধুনা বিসিএস অফিসার হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাদের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিতশ্রেণির ও শিক্ষানুরাগী জনগণের বহুবছরে আরাধ্য। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে শুরু করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস অবধি এই ইম্পেরিয়াল ওরফে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসকেই জীবনের মোক্ষ করেছিলেন। ( উল্লেখ্য, দেশমাতৃকার টানে নেতাজী কয়েকবছর পরে সিভিল সার্ভিস থেকে স্বেচ্ছায় সরে পড়েন।)
এই যে একের ভিতর তিন– অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও সম্মানপ্রাপ্তির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতা আমরা দেখছি, সেটির কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছিল সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক পর্যন্ত। সামরিক শাসনের যথেচ্ছ চাপে প্রশাসনের আমলাদের চেয়ে নব্যদালাল, রাজনৈতিক চামচা, সামরিকবাহিনীর দাপট ছিল বেশি। সরকারি বেতন বোনাসও তেমন বলার মতো ছিল না। সরকারি চাকরি মানে সরকারি চাকরিই, নিরপত্তা আজীবন—এটুকুই ছিল সান্ত্বনা। আমরা যখন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কর্মজীবনে আসলাম, ততদিনে বাংলাদেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, নানাধরনের রপ্তানিমুখি শিল্পকারখানা, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি, বেসরকারি ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি ইত্যাদির কৈশোর কাল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রকোপ বেড়ে গেল। সবকিছু মিলিয়ে, আমাদের প্রজন্ম যারা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমাদের গ্রাজুয়েশন করেছিলাম, তাদের পছন্দ ছিল প্রাইভেট সেক্টর। প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির নিরাপত্তা ও ক্ষমতার দাপট ছাড়া সবকিছুই পাওয়া যেত। ভালো বেতন, আধুনিক অফিস, ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম, বিদেশ সফর ইত্যাদি আমাদের সিংহভাগকে আকৃষ্ট করেছিল বেসরকারি সেক্টরে যোগদান করতে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলতে পারি, আমি নিতান্তই ঠেকায় পড়ে কয়েকবার কয়েকটি সরকারি কার্যালয়ে গেছিলাম সেই ৯০ দশকের শুরুতে। মাথার উপরে ব্রিটিশ আমলের ফ্যান ঘুরছে, ধুলাবালির মাঝে ফাইলের স্তূপ, পুরনো টেবিল চেয়ার, নোংরা শৌচাগার আর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দাপট ও অনাধুনিক কর্ম-পরিবেশ দেখে আমি যারপরনাই হতাশ ছিলাম। বিসিএস-কে জীবনের মোক্ষ করিনি বলে আমার বড়মামা বছর খানেক আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আসলে, তারা দেখেছেন যে, মফঃস্বল শহরে একজন সরকারি কর্মকর্তা মানে ছোটখাটো দেবতা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল তো আর আমি চাক্ষুষ করিনি ; তবে, আশির দশকে দেখেছি– উপজেলা , থানা পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা, টিএনও, ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেবতার মতো হয়, তাহলে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার ছিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বরের সমতুল্য। বিশাল বাংলো, সামনে ফুলের বাগান, পিছনে পুকুরের সঙ্গে ছিল গুচ্ছের আর্দালি, কুক, দারোয়ান ইত্যাদি। আমি আমার পরিবারে তথাকথিত মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলাম। সুতরাং আমার বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে হলেও, আমার সিংহভাগ আত্মীয়-স্বজনদের স্বপ্ন ছিল বিসিএস দিয়ে পুলিশ, প্রশাসন বা কাস্টমস কর্মকর্তা হওয়া। সেই গুড়ে বালি দিয়ে আমি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরে প্রায় তুচ্ছ, ক্ষমতাহীন ও অপাঙতেয় জীবন যাপন করে চলছি।
এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, যে আমাদের সময়ে ক্লাসের প্রথম-সারির ছেলেমেয়েরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তো, আর তাঁদের গন্তব্য ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মেডিক্যাল কলেজ এবং কিয়দংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দামী কয়েকটি সাবজেক্ট পর্যন্ত। বাকীরা নিতান্তই আসনসংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতেন। আমার প্রকৌশলী বন্ধুদের ভিতরে হাতে গোনা কয়েকজন বিসিএস দিয়েছে কি দেয় নাই।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যখন ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে একটা প্রশাসননির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করল, তখন সমাজের বাকী মেধাবী অংশগুলো হয়ে পড়ল অবহেলিত। এই বছরের শুরুতে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ সব দেশ প্রশাসকে ভরে গেছে। কোনো বিজ্ঞানী নেই। গবেষক নেই। দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসন দেখতে পাবেন। ……. প্রশাসকনির্ভর জাতি হলে কী হবে ভবিষ্যতে, তার ইঙ্গিত তো দেখতে পাচ্ছি। কোনো চিন্তাবিদ আপনি দেখতে পাবেন ? নেই। গবেষক নেই। এমন একটি জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। প্রশাসকরা প্রশাসকই তৈরি করেন। তারা শিক্ষার মর্ম কী বুঝবেন ! তারা পরামর্শ দেবেন ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করার। ’
সারাদেশ যখন প্রশাসনের , যাঁদের ঘরে লক্ষ্ণী-সরস্বতী একসঙ্গে বসে চা খায়, তখন একজন মেধাবী প্রকৌশলী ও চিকিৎসক কেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কাস্টমস, ট্যাক্সে যেতে চাইবে না?
আরো দুটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
আশির দশকে আমার এক মামা বিসিএস দিয়ে কোন এক ক্যাডারে (যতদূর মনে পড়ে খাদ্য ক্যাডারে) যোগদান করলেন। জানি না তিনি বাড়িয়ে বলেছিলেন কীনা । তবে এটাও সত্য, শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলার লোক উনি নন। যোগদানের পরে তাঁর যে আসন এতোদিন ফাঁকা ছিল, সেটার বরাবরে চলমান দুর্নীতির ভাগের যে টাকা জমেছিল সেটা তাঁকে প্রথম দিনেই প্যাকেট করে দেওয়া হয়েছিল। ঐ কারণেই হোক , বা অন্য কারণে তিনি আর সরকারী চাকরি করেননি, শিক্ষকতায় চলে আসেন।
বছর দুয়েক আগে, আমাদের কয়েকজন টেক্সটাইল প্রকৌশলী বন্ধুরা মিলে এক বন্ধুর মামা, যিনি সরকারি দলের প্রাক্তন সংসদ সদস্য, তার রিসোর্টে গেলাম। একটা প্রাক-বনভোজনের জায়গা পছন্দের নিমিত্তে। আমরা যেয়ে দেখি, মামা ভীষণ ব্যস্ত জনৈক থানা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে। এই, ডাব আন রে, পানি আন রে , মিষ্টি আন রে , দুপুরের খাবারে বড় মাছ জোগাড় কর রে, সে এক হুলুস্থুল। এদিকে আমরা কয়েকজন যে গেছি, তার মধ্যে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, দুইজন বৃহদায়তন শিল্পকারখানার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও জেনারেল ম্যানেজার। সেই প্রশাসনিক দেবতার তোষণে মামা এতোই ব্যস্ত রইলেন যে, আমাদের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ পাচ্ছিলেন না। আমরা নিজেদের মতো ব্যস্ত রইলাম। দুপুরের খাবারের সময় পরিচয় পর্বে সেই সরকারি কর্মকর্তা বুঝতে পারলেন, আমাদেরকে তিনি যতোখানি তুচ্ছ জনগণ ভাবছিলেন, আমরা ঠিক ততোখানি তুচ্ছ নই।
বহুবছর আগে কবি নির্মলেন্দু গুণকে মাঝরাতে টহল পুলিশ ধরলে তিনি নিজেকে কবি হিসাবে পরিচয় দেন। তাতে কী আর হয়! রসিক পুলিশ বলেন,আপনি যে কবি তার প্রমাণ কি , একটা কবিতা বলেন। গুণ নাকি মুখে মুখে বলেছিলেন, ‘ মাছের রাজা ইলিশ, আর মানুষের রাজা পুলিশ !’ টহলপুলিশ কবিতা শুনে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন , আমার যদি আবার বয়স ২১/২২ হতো, আমি যদি আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পেতাম, আমিও কী মানুষের রাজা হতে চাইতাম না ! সেই চাওয়ার মধ্যে গলদ যদি কিছু থেকেই থাকে, সেটা দূর না করে প্রকৌশলীরা কেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যাচ্ছে ; কেন স্পেশালাইজড শিক্ষিতরা ( পড়ুন ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়াররা ) ক্যাডার সার্ভিসে গিয়ে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের ভাগ্য বিনষ্ট করছে –এইসব আহাজারি বন্ধ করুন।
প্রথম প্রকাশঃ ২রা এপ্রিল ২০২২

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও জনগণ।

আমার গার্মেন্টস চাকরীর প্রথমদিকে। ক্লিনটন সাহেব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
মনিকা লিউন্সকির ওরালসেক্স নিয়া রীতিমত ইম্পিচমেন্টের অবস্থায় ক্লিনটন।
আমেরিকান এক ক্রেতা বন্ধুকে বললাম, ‘তোমাদের চেয়ে ভণ্ড জাতি দুনিয়াতে আরেকটা নাই।’
সে বলল, ‘কেন ?’
‘তোমরা ফ্রি সেক্সের দেশে গে ,লেসবিয়ান, অ্যানিম্যাল , ওরাল, অ্যানাল কিছুই বাদ দেও না। আর বেচারা ক্লিনটন সামান্য এক ওরালসেক্স কেসে চাকরিটা হারায় হারায় !’

উল্লেখ্য, তখন আমার এই ইয়ং ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্টকে বেশ ভালো লাগতো। যুদ্ধবাজ বুশের জায়গায় সে আসাতে আমাদের প্রজন্ম খুশিই ছিলাম।
আমেরিকান বন্ধু বলল, ‘ তোমাকে একটু বুঝিয়ে বলি। আমার ধারনা তুমি ব্যাপারটা বুঝবে।’
‘শোন জাহিদ, ধরো তুমি ব্যক্তিজীবনে উচ্ছৃঙ্খল, অনাচারী, বহুগামী, লম্পট , মাতাল অনেক কিছুই হতে পারো। তোমার পথের পথিক যারা, আশপাশের সবাইকে তুমি অবলীলায় মেনেও নিতে পারো।
কিন্তু, ধরো তোমার বাবা যিনি তোমার শ্রদ্ধার জায়গায়, তিনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তোমার সামনে লম্পটগিরি করে, পারবে মেনে নিতে ? আমরা আমেরিকানরা নিজেরা যতোই ভণ্ডামি যতই করি না কেন , প্রেসিডেন্টকে আমরা পিতার মতো দেখি। তাঁর সামান্য স্খলনও আমরা মেনে নিতে পারি না। ’
আমি আমার উত্তর পেয়ে গেলাম।

প্রথম প্রকাশঃ ২রা এপ্রিল ২০১৩

বাংলাদেশের ধনী: অবদান ও সমালোচনা

রচনার সারসংক্ষেপ:

‘বাংলাদেশের ধনী: অবদান ও সমালোচনা’ প্রবন্ধে গত কয়েক শতাব্দী আগে থেকে শুরু করে ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের ধনী ও দরিদ্রশ্রেণির অভ্যুদয় ও পারস্পরিক বিবর্তনের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক ও পরিব্রাজকদের চোখে পূর্ব বাংলার যে চিত্র ইতিহাসে দেখা যায়, সেখানে নানা অসঙ্গতি আছে। অবিরাম দারিদ্র্যের পাশাপাশি পূর্ব বাংলা স্থানীয় আকাল, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়েছে বারবার। ইতিহাসের কয়েক পর্যায়ে ধনীদের অভ্যুদয়, কর্মযজ্ঞ , অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে অবদান ও সামাজিক মানবিক ক্ষেত্রে নিশ্চেষ্ট থাকার সমালোচনা -পর্যালোচনা পাঠককে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের আগের পূর্ব বাংলা, সর্বভারতে তার বাণিজ্যিক অবস্থান। মুঘল আমলে নৌবাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচিতি, রপ্তানিবাণিজ্যে মুনাফা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পুঁজির অনুপ্রবেশ। ভূস্বামী ও সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী প্রথার আবির্ভাব। পাটের স্বর্ণযুগে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল মুৎসুদ্দিদের পুঁজির আবির্ভাব। ৪৭ এর দেশভাগের পরে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে বড় একটা পুঁজির পশ্চিমবঙ্গে প্রস্থানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজির সংকট। সেই সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের পূর্ব বাংলায় অনুপ্রবেশ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বিমাতাসুলভ আচরণে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকারে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতায়, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রও সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কলকারখানার সিদ্ধান্তে ব্যক্তি পর্যায়ে ধনী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রাদুর্ভাব। পরের দশকগুলোতে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাংক-নির্ভর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় নব্যধনীদের উত্থান। আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পের শুরু। ব্যবসায়িক পরিবার ও সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন ধনীদের পাশাপাশি একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিশাল এক শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণির অভ্যুদয়। বিরামহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনে জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনুপ্রবেশ। আমলাতান্ত্রিক দুর্বল রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির দুর্ভেদ্য চক্র গড়ে ওঠা। কর্মসংস্থানের ফলে একটা উদীয়মান জাতির কর্মক্ষমতা বেড়েছে, গার্মেন্টস সেক্টরের প্রসারে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বেড়েছে। শিল্পোদ্যোক্তা এই ধনীদের অবদানে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু সামাজিক ও মানবিকক্ষেত্রে এঁদের অবদান অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এবং অকিঞ্চিৎকর।

মূল প্রবন্ধ:

পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে গত দুইশ বছরে ধনীরা বাইরে থেকে এসেছে । আর্মেনীয় থেকে শুরু করে ইংরেজ, মাড়োয়ারী, বোম্বাইয়া বা পাকিস্তানী । খুব সামান্য অংশ থিতু হয়েছে, বেশির ভাগই চলে গিয়েছে। খাঁটি স্বদেশী ধনীদের অভ্যুদয় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে।

প্রবন্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী ধনীরা আকাঙ্ক্ষিত আলোচ্য হলেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার স্বার্থে অনুক্রম বিবেচনায় চলে আসে। প্রবন্ধে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে অধিক পরিচিত ‘পূর্ব বাংলা’ব্যবহার করা হয়েছে।

ভারতীয় ঐতিহাসিকদের চোখে দেখা বাংলার সঙ্গে বিদেশি পর্যটকের দেখার পার্থক্য ছিল। তাদের চোখে সোনার বাংলা ছিল সুজলা,সুফলা , শস্যশ্যামলা। চৌদ্দ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা কিংবা চীনা পরিব্রাজক ওয়াং তু ওয়ান সবাই বাংলায় সস্তা দ্রব্যমূল্যের কথা বলেছেন, সমৃদ্ধ জীবনের কথা বলেছেন। এঁদের পর্যবেক্ষণে বাংলায় কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের সস্তামূল্য বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রমাণ। কিন্তু অর্থনীতির সূক্ষ্ণ মারপ্যাঁচে একটি দেশের দ্রব্যমূল্য অন্য দেশের চেয়ে সস্তা হতে পারে, কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়। বস্ত্রের মূল্য সস্তা হলে সেখানে তাঁতির মজুরি কম হয়। কৃষিপণ্যের মূল্য সস্তা হলে শ্রমিকের মজুরি কম হয়। আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিকভাবে একটা দেশ সমৃদ্ধ মনে হলেই সেখানে দারিদ্র পুরোপুরি দূরীভূত হয় না, যদি না সম্পদের সুষম বণ্টন না হয়। ধনী দেশেও দারিদ্র্যের সুযোগ থাকে।আমাদের বাংলায় ধনী দরিদ্র্যের প্রকট বৈষম্য গত কয়েকশ বছরের ধারাবাহিকতা।

সর্বভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সুনাম ছিল। বাংলার মসলিন ও বস্ত্র সারা ভারতেই যেতো। নৌপথে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া শ্রেষ্ঠ অবদান রাখে পর্তুগীজরা ষোলশ শতকের শেষের দিকে। কিন্তু কিছুদিন গেলেই দেখা যায় বাণিজ্যের চেয়ে এরা জলপথে দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। এরপরে আসে ওলন্দাজরা। ওলন্দাজদের রপ্তানি বাণিজ্যে শরিক হয় ফরাসী, ইংরেজ, ওস্টেন্ডার ( বেলজিয়ান) সহ বহু ইউরোপিয়ান নৌ-জাতি। এছাড়াও ছিল দিনেমার, আর্মেনীয়, হিন্দুস্থানি, মাড়োয়ারী, তামিলরা।

নৌবাণিজ্যের সুবাদে ও মুঘল আমলের আঠারো শতকে আমির-ওমরাহ, জমিদার শ্রেণির বাইরে আরেকটি শ্রেণি প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করে। মূলত বিদেশি বণিকদের সহায়তাকারী হিসাবে দেশীয় দালাল-মুৎসুদ্দির একটা ধনী শ্রেণি গড়ে ওঠে। বিদেশীরা এদেরকে বলত বেনিয়া। বেনিয়ারা ছাড়াও হাট-বাজার পর্যায়ে কয়েক শ্রেণির দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ছিল। লক্ষণীয় যে, এই রপ্তানি বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপরে কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি ; যদিও এই মুনাফার উপর ভর করে কিন্তু শহরভিত্তিক একটা বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শ্রেণি তৈরি হয়েছিল।

১৭৯০ সালের দশকে ইউরোপে বিদ্যমান নেপোলীয়নীয় যুদ্ধের দামামায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপড়েনে বাংলার রপ্তানীবাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮১৩ সালে অবাধ বাণিজ্যনীতিতে বাংলার বস্ত্ররপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮২০ এর দশকে ইউরোপ থেকে বস্ত্র আমদানি শুরু হয়। খুব স্বল্প সময়ের এই রপ্তানি পতনে তাঁত শিল্পের সঙ্গের জড়িত তাঁতি সম্প্রদায় ছাড়াও বেনিয়া , আড়তদার, পাইকাররা বেকার হয়ে পড়ে।

এ সময়ে রপ্তানিবাণিজ্য থেকে যে বিপুল অর্থ বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল, সেই পুঁজি চলে আসে ভূমি নিয়ন্ত্রণে। নবাগত ভূস্বামী ও জমিদার শ্রেণিটি তাদের অর্জিত পুঁজির সামান্য অংশ ব্যয় করেছিলেন ভূমিক্রয়ে বাকী পুঁজি উজাড় হয়েছে রাজ্যের অনুৎপাদনশীল খাতে, যেমন বিবাহ, শ্রাদ্ধ, পূজা-পার্বণ, মন্দির, ঘাট, পুকুর , প্রাসাদ প্রভৃতি নির্মাণে। পুঁজির আরেক অংশ চলে আসে মহাজনী ঋণদান ও শস্যব্যবসায়।

বাংলার তৎকালীন অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে সবচেয়ে বড় যে সত্যটি আবিষ্কার করি আমরা , সেই সময়ের ধনীদের মনোভাব ছিল সামন্তবাদী, পুঁজিবাদীদের মতো নয়।

সমান্তরালভাবে , আঠারোশ শতকের শুরুতে তুলার চাহিদা হ্রাস পাওয়া শুরু করলে তার জায়গা নেয় নীলচাষ। আবার ১৮৫০ সালের দিকে কমতে থাকে নীলের চাহিদা। নীলচাষীদের সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে ইউরোপীয় নীলকরেরা বিনিয়োগ তুলে নেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাটচাষ নগণ্য ছিল। ব্যাপকহারে পাটচাষ এবং পাট-আঁশের বাণিজ্যিকিকরণ শুরু হয়ে ১৮৭০ এর দশকে। এই সময় থেকে শুরু করে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত পাটের স্বর্ণযুগ। ১৯৩০ এর বিশ্বমন্দাতে পাটের বাজার পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও আধুনিক পুঁজিবাদের চাপে বাংলার অর্থনীতি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। এক বিকৃত ঔপনিবেশিক অর্থনীতি তৈরি হয়, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্থবিরতা, দারিদ্র, বৈষম্য , ঘনঘন দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা। এই অর্থনীতিই ছিল পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাধিকার। এর সঙ্গে যুক্ত হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ কেন্দ্রীয় নীতি। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি হিসাবে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ১৯ লক্ষ্য ৩২ হাজার। এর মাঝে ৬৪টি মহকুমা শহরের অধিবাসী ছিল মাত্র ১৮ লক্ষ ২০ হাজার। শহরের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪.৩ শতাংশ ; মূলত তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পূর্ব বাংলায় খাজনাভোগী কাঠামো গড়ে ওঠে। ছোট আকারের ভূসম্পত্তির মালিক ও একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি , যারা অবাণিজ্যিক পেশায় নিয়োজিত হয়। একই পরিবারে খাজনাভোগী জমিদার ও চাকুরীজীবী উভয় ভূমিকায় থাকতে দেখা যায়।

দেশভাগের পরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বুর্জোয়া হিসাবে মুসলমানেরা ছিল অত্যল্প। এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্ট সামাজিক উৎপাদনে শ্রমবিভাগেরই ফল। বাঙালি মুসলমান ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের ধারক ও বাহক। আর বাঙালি হিন্দুরাই মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য , মহাজনী কারবার নিয়ন্ত্রণ করত। এমনকি ছোট ছোট শিল্পোৎপাদনেও এঁদের দখল বেশি ছিল। দেশভাগের পরে বহুসংখ্যক হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিপুল অর্থসম্পদসহ দেশত্যাগের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি বুর্জোয়াদের অবস্থান শূন্যতা তৈরি হয়। ১৯৪৭ থেকে ৫১ সালে এই শূন্যতার সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানি বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোগীরা এবং প্রবল সহযোগী হিসাবে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো জেঁকে বসে।

সর্বভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানে যে শিল্পায়ন হয় তার সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক। সমগ্র পাকিস্তানে এ সময় একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবারের জন্ম হয়। ১৯৬২ সালে সারা পাকিস্তানের ব্যক্তিমালিকানাধীন ফার্মের অধীনে মোট যতো সম্পদ ছিল তার ৭৩ শতাংশ ছিল ৪৩টি পরিবারের দখলে। এই ৪৩টি পরিবারের মধ্যে একটি মাত্র পরিবার ছিল বাঙালি – জনাব এ,কে, খানের পরিবার।

দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় ব্যবসায়িক ও লগ্নি পুঁজিকেই কৃষিতে মূলধন সঞ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে ধরা হয়। যদিও এখান থেকে মুনাফার সামান্য অংশই উৎপাদনে পুনঃ বিনিয়োগ করা হোত। সংগঠিত কৃষিঋণ অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় ছিল, কারণ প্রচলিত কৃষি আইনে জমি হস্তান্তর বা খণ্ডকরণের সীমাবদ্ধতার জন্য ঋণদানকারী সংস্থাগুলো জমি বন্ধক রেখে ঋণদানে আগ্রহ দেখাতো না। ফলে মহাজনী ঋণের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হত কৃষক। ঋণদাতা জমির স্বত্ব লাভ করে, অনেক সময় বন্ধকী জমির ফসল থেকেই ঋণ শোধ হয়ে গেলে, মূল মালিকের কাছে জমি ফেরত যায়। আবার জমির মালিকের অধীনে চাষবাস হয়, উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ঋণদাতাকে ঋণ কিস্তি হিসাবে দিতে হয়। মহাজনী ঋণ পাওয়ার জন্য কৃষক যে কোন শর্তেই রাজি হতে বাধ্য থাকত। আর ঋণের বেশিরভাগ অংশই ব্যয়িত হতো, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, কাপড়-চোপড়, ওষুধপত্রের মতো অত্যাবশ্যকীয় কাজে। যে কাজের জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছে, হালের বলদ, বীজ, সার তার জন্য সামান্য অংশই অবশিষ্ট থাকত। এই দুষ্টচক্রে পড়ে কৃষক ভূমিহীন হতো। ভূস্বামী মহাজনেরাও জমিতে অর্থ না খাটিয়ে নগদ ঋণদানেই আগ্রহী ছিল। জরিপে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে ৬৬ থেকে ৮৭% পরিবারই ঋণগ্রস্ত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের তুলনায় উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সারের ব্যবহারে পিছিয়ে থাকায় জমির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল অনেক কম। জমির স্বল্পতা ও বিক্ষিপ্ত অবস্থান পুরো কৃষি উৎপাদনের চক্রকে অনাধুনিক করে রেখেছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক পরিবারের ধনী হওয়ার মূল বাসনা ছিল সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা। ধন-সম্পদ, পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান , উচ্চবংশে বৈবাহিক আত্মীয়তা সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। সঞ্চিত অর্থে জমি কিনে মর্যাদা বৃদ্ধির একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল সমাজে। আবার জমির পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক সচ্ছলতার উৎস হিসাবে দ্বিতীয় প্রধান সম্পদ ধরা হয় শিক্ষাকে। শিক্ষিত লোক স্থানীয় প্রশাসনে, শহরে চাকরি করে পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি করে।

দেশভাগের আগে সম্পদের বড়ো একটা অংশ ছিল হিন্দু জমিদার ও ধনিক শ্রেণির হাতে। হিন্দু ধনীদের পারলৌকিকতার চর্চা ছিল, পূজা পার্বনে দেখনদারি ও অনর্থক অপচয় ছিল। কিন্তু যেহেতু মুসলমানদের আগেই আধুনিক অগ্রসর চিন্তার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছে সেই ১৮শ শতকের শুরুতেই, তাই পারলৌকিকতার বাইরেও তাঁদের সমাজের আধুনিক শিক্ষা, চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি । মুসলমান ধনী শ্রেণির হাতে নানা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পয়সা আসলেও সেটা তাদের অনগ্রসর মাদ্রাসা শিক্ষা এবং নয়নমনোহর মসজিদ তৈরিতে ব্যয়িত হয়েছে। পুর্ব বঙ্গের নানা ধরণের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়ের পুরোটাই বলতে গেলে কয়েক শতাব্দী ধরে হিন্দু ধনী শ্রেণির করা। মুসলমান ধনী শ্রেণি যারা অধুনা বাংলাদেশের পরিচালনায় আছেন, মূলতঃ তারা সেই আগের শতাব্দীর পিতামহদের ধারা পালন করে যাচ্ছেন।

চৌধুরীদের গ্রামে মসজিদ আছে, মক্তব আছে, খোন্দকারদের সেটা ভালো লাগে না। একই গ্রাম ১০০ গজের ভিতরে আরেকটি সুদৃশ্য মসজিদ ও তাঁর সংলগ্ন মাদ্রাসা । অথচ নারী শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। দূর উপজেলার বাইরে আছে সরকারী চিকিৎসালয়। সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। এ এক অদ্ভুত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দ্যোতনার ভিতরে দিয়ে বাঙালি মুসলমানের হিসাব নিকাশ চলে।

দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার উৎপন্ন পাট কোলকাতার পাটকলে রপ্তানি হওয়ার যে নিয়ম প্রচলিত ছিল তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। সরকার নির্ধারিত পাটের ক্রয়মূল্যের চেয়ে রপ্তানিতে লাভ বেশি হয়, মুনাফা বাড়ে। পাটশিল্পের বড় ধরণের পুঁজি বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল যেমন আদমজি, বাওয়ানি, ইস্পাহানি। ‘ক্রিসেন্ট জুট মিলস লি ‘ এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল র‍্যালি ব্রাদার্স ও ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের খোজা গোষ্ঠী। শুরু থেকেই মুসলিম মেমন সম্প্রদায় ( আদমজি , বাওয়ানি) এবং ইসমাইলিয়া খোজা প্রধান পাট রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগকারি হিসাবে দেখা দেয়।

পূর্ববাংলা এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় শিল্পশক্তি ও অবকাঠামোতে পিছিয়ে ছিল। ব্যাংকিং ছিল অনুন্নত। দেশভাগের আগে পাকিস্তান ভূখণ্ডে ৪৮৭টি ব্যাংকের শাখা ছিল , সেটা কমে ৬৯টিতে দাঁড়ায়। হিন্দু ব্যাংক মালিকদের দেশত্যাগের ফলেই এটা হয়। শূন্যতা পূরণ হয় পাকিস্তানের তিনটি ব্যাংকের কার্যক্রমে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‘হাবিব ব্যাংক’, ‘মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক’, ও ‘স্টেট ব্যাংক’ । যদিও প্রত্যেকটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে শিল্পোৎপাদন, যোগাযোগ ও পরিবহন, বৈদ্যুতিক শক্তি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রধান অংশই যে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাই নয়, দেশের উচ্চতর বেসামরিক প্রশাসনের (Civil Administration ) পুরোটাই ছিল সেখানে। পূর্ববাংলার সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনের সকল দায়িত্বশীল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারী নিয়োগ করে।

দেশভাগের পরেও পূর্ব বাংলার পুঁজির শতকরা ১৫ ভাগের মালিকানা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। ১৯৫৬ সাল পর্যন্তও কয়েকটি বৃহৎ কাপড়ের মিল, একমাত্র সিমেন্ট কারখানা, ১৭টি চা বাগান, কয়েকটি ব্যাংক হিন্দু মালিকানাধীন ছিল। কোন কোন তথ্যমতে, ৫০টির ও বেশি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান, ২০০ অন্যান্য ব্যবসা হিন্দু মালিকানাধীন ছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে প্রাদেশিক সরকার সেগুলো কুক্ষিগত করে।

মূলত: পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের শুরুর দিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই ছিল দেশের অর্থনৈতিক উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেই উদ্যোগ আবার পরিচালিত হতো প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিকাশেই। যেহেতু ১৯৪৭ এর পরে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ভিত্তি ছিল অনেক শক্তিশালী, পূর্ববাংলার তুলনায় শিল্পোৎপাদন, বৃহৎ পুঁজি, অবকাঠামো, বাজেটের সিংহভাগ আঞ্চলিক বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। কারণ এখানে মুদ্রা সঞ্চয় এবং পুঁজি বিনিয়োগ দুই ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়ে থাকে। জমির স্বল্পতা এবং শিল্পাঞ্চলে তার উচ্চমূল্য পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সেই দিকে বেশির ভাগ বাঙালি পুঁজিপতিই ছিল ছোট বা মাঝারি। অনগ্রসর অর্থনৈতিক কাঠামোতে সঞ্চয়ের সিংহভাগ আসতো কৃষিখাত এবং ক্ষুদ্র শিল্পখাত থেকে।

১৯৫০-৫২ সালের কোরিয়া যুদ্ধে পাট ও পাটজাত পণ্যের ভারতমুখী প্রবণতা কমে বিদেশি বাজারে চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে পাকিস্তানের পাট ও তুলার রপ্তানিবাজারের আকাল দেখা দেয়। কাঁচামালের দাম যায় কমে। এর মাঝে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে ৩৬টি নতুন পাটকল স্থাপিত হয়, কাঁচামাল হিসাবে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পাটের উৎপাদন ৬৫০ হাজার টনের মধ্যে রয়ে যায়। ফলে আভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রাধান্য দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাটবাজারের বিশ্ববাজার হারায়। সামগ্রিকভাবে পূর্বপাকিস্তানের নির্ভরতা এমন ছিল যে, পাটকলের যন্ত্রাংশ বড় কারখানাগুলোর মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে তৈরি হতো। আদমজি পাটকল, প্লাটিনাম জুবিলি এবং আরো কয়েকটি পাটকলের এ ধরণের ওয়ার্কশপ ছিল, কিন্তু কারখানাগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি বুর্জোয়ারা। সাধারণ বয়নশিল্প ব টেক্সটাইল শিল্পেরও একই অবস্থা , যন্ত্রাংশ নির্মাণের দশটি কারখানার আটটিই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।

আদমজি, বাওয়ানি, ইস্পাহানি, আমিন গ্রুপ , খোজা ইসমাইলিরা ছাড়াও হাবিব পরিবার, দাউদ পরিবার, দাদা পরিবার, সায়গল পরিবার, মোহাম্মদ বশীর পরিবার, কলোনি গ্রুপ , নবাব হেতি পরিবার, মাওলা বক্স পরিবার, সাত্তার পরিবার। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আরো উল্লেখযোগ্য গ্রুপ গুলো হচ্ছে, রশিদ এজেন্সিজ, গুল এজেন্সিজ ও গ্লোব এজেন্সিজ নামের পশ্চিম পাকিস্তানি কোম্পানির সম্মিলিত গ্রুপ।

বেশির ভাগ অবাঙালি মালিকই ছিল কতগুলো সীমাবদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য যা গড়ে উঠেছিল পারিবারিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। এরা হলো গুজরাটি সম্প্রদায়, মেমন , খোজা ইসমাইলি,পাঞ্জাবি সম্প্রদায়, চিনিয়ট শেখ, বোহরা, পিরাঞ্চা প্রমুখ। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প বাণিজ্যের একটা বড় অংশ একেকজন পৃথক শিল্পপতি বা পরিবারের হাতে আসার মাধ্যমে সম্প্রদায়গত ভাবে অবাঙালি পুঁজিপতিদের ক্ষমতা পূর্ব বাংলার অর্থনীতিতে অনেক বেড়ে যায়। মেমন সম্প্রদায়ের সদস্যরাই অবাঙালি পুঁজিপতিদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি এবং অধিকতর প্রভাবশালী ছিল। মেমনদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ এবং কমপক্ষে তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক এরকম যেসব পরিবারের নাম করা যায় তারা হলো দাদাভাই, বাবা, দাদা, বেঙ্গলি, দাগিয়া, তার মোহাম্মদ, জানু, হাশিম, তাবান, এলাহি, দিনার , দোসা, জিজি, গনি, মোহাম্মদ সেলিম এবং আরো অনেকে।

খোজা ইসমাইলিদের কিছু পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে এক পর্যায়ে বৃহৎ শিল্পপরিবার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, এদের কয়েকটি হলো, মোহাম্মদ আলী মেঘানা, সালেহ ম্যানেজমেন্ট, বরকত আলী পরিবার, আমলানি বরলাপ, আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা, স্টার গ্রুপ। এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ও বড় অংশের মালিকানা ছিল, এদের ইমাম প্রিন্স করিম আগা খান।

ধনী বাঙালি বুর্জোয়াদের উদ্ভব ছিল অসম প্রতিযোগিতায়। পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজিপতিদের তুলনায় বাঙালি মুসলমান বুর্জোয়ারা সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবে বাঙালি বুর্জোয়ারা পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহী ছিল না। এরা ব্যবসায়ের মধ্যস্থতা, সুদের কারবার ও জমির মালিকানাকেই প্রাধান্য দিত। যৎসামান্য বাঙালি বুর্জোয়াদের অধিকাংশই ছিল শিল্প-বাণিজ্য বুর্জোয়া। সামান্য কিছু শিল্পোৎপাদনে তারা জড়িত ছিল মূলত পাট, সুতা-বস্ত্র, কাগজ, ইট ও দিয়াশলাই এর মতো শিল্পে সীমাবদ্ধ। যেমন ১৯৭১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাঙালি মালিকানাধীন ৩৪ টি পাটকলের ২৮টিই কাজ শুরু করেছিল ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। এবং মালিকানার অংশীদার বাঙালি মালিকদের অভিজ্ঞতা ছিল কম, এরা পূর্বে কোন শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল না।

ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের পুঁজি দিয়ে তারা শিল্পে অংশগ্রহণ করত না বললেই চলে। এ ধরণের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো হয় সরকারী কর্পোরেশনের অধীনে ছিল, অথবা গুটিকয়েক অবাঙালি পরিবারের মালিকানাধীন। বাঙালিদের বিনিয়োগের অধিকাংশই ছিল ঋণপুঁজি। অংশীদারিত্বের মোট মূল্যের ৬০ শতাংশই ছিল ঋণ পুঁজি। ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটা এলিট শ্রেণি তৈরির নীতি কাজ করতে শুরু করে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে শুধু ২২ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বৃহৎ ব্যবসায়ের সংস্পর্শে আসা প্রায় অসম্ভব ছিল।

১৯৭১ সালের জরিপ অনুযায়ী বস্ত্রশিল্পে ৪৫টি চালু শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি ছিল বাঙালি অংশীদারিত্বের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এ.কে খান ; ইসলাম ব্রাদার্স, আফিল, ফকিরচান্দ, হাওলাদার, বি রহমান, রহমান-কাউয়ুম, সাত্তার, আলহাজ মুসলিমউদ্দিন ও ফিল্স্ মাশরিকি।

লক্ষণীয় , বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণের প্রচুর ব্যবহার তাদেরকে অবশ্যম্ভাবী ঋণীতে পর্যবসিত করেছে। অধিকাংশ বাঙালি কোম্পানি বা গ্রুপের অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের সক্রিয় পুঁজির সামষ্টিক বিচারে যা মনে হতো, বাস্তবিকপক্ষে তা ছিল তার থেকে অনেক কম। আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে আমাদের শিল্পপতিরা।

পূর্ব বাংলা এই উপমহাদেশের মূল অর্থনৈতিক বিকাশে সবসময় আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পরে বৈষম্য প্রকট হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়ন্ত্রণহীণতা।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার আরেকটি কারণ ছিল, এই প্রদেশে ব্যক্তি পর্যায়ের পুঁজির বিকাশের দুর্বল অবস্থা। উল্টোদিকে পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়েছিল তার অভিজ্ঞ ব্যক্তিগত খাতের উদ্যোগ ও উঁচু প্রবৃদ্ধির হারের জন্য।

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতে কৃষিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল খাত। জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশই বসবাস করতো গ্রামে। কর্মক্ষম জনশক্তির ৮০ ভাগ নিয়োজিত ছিল কৃষিকাজে। আর মোট জাতীয় উৎপাদনের ৫৫ ভাগই উৎপাদন করতো তারা। যে টুকু মূলধন সঞ্চিত হতো সেটা কৃষিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, এ,কে,খান ( আবুল কাশেম খান) ; ইসলাম গ্রুপ ( জহুরুল ইসলাম) ; ভুঁইয়া বাঁ গাওসিয়া গ্রুপ ( আলহাজ গুলবক্স ভুঁইয়া ) ; রহমান কাইউম গ্রুপ ( মকবুল রহমান, কাজী জহিরুল কাইউম); ফকির চাঁদ গ্রুপ ( আলহাজ মোহাম্মদ ফকির চাঁদ ), আলহাজ মুসলিমউদ্দিন গ্রুপ , নর্দান পিপলস , আফিল গ্রুপ, রহমান ব্রাদার্স, সাত্তার গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, ভাণ্ডারি গ্রুপ, ডেলটা , সবদার আলী, আনোয়ার নিউ স্টার, ইব্রাহিম মিয়াঁ অ্যান্ড সন্স।

বাংলাদেশের ধনীদের মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম ভাগে আছে পারিবারিকভাবে যারা ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। ইস্পাহানি, ইসমাইলী, সওদাগর , সাহা গোত্রের লোক এই শ্রেণিতে । দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছে, রাজনৈতিক পরিবারগুলো। এঁদের কারো কারো পূর্বপুরুষ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন, সরকারে সকল সুবিধা নিয়ে নৈতিক-অনৈতিকভাবে ধনী হয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ায় এদের শিল্পকারখানা ও স্থাবর সম্পত্তির হাতবদল হয়েছে। এঁদের অনেকেই কয়েক দশকের বেশি টিকে থাকতে পারে নি। তৃতীয় শ্রেণিতে আছেন তাঁরা , যারা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শুধুমাত্র উদ্যোগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে , নিজের যোগ্যতায় বিশাল শিল্প-কলকারখানা ও সাম্রাজ্য গড়েছেন। আধুনিক বাংলাদেশের এরাই বৃহত্তম। পূর্বাপর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশেষ কিছু অভূতপূর্ব সুযোগ এদের ধনসম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটা শ্রেণিকে ধনী করেছে। পাকিস্তানের অভ্যুদয় আরেক শ্রেণিকে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবারিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র, বৈদেশিক সাহায্য সবচেয়ে বড় অংশকে ধনী করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংকঋণ, আমদানি-রফতানি প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের নব্যধনী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। নব্য-ধনীদের অনেকেই দেশে টিকে গেছেন, কিন্তু অনোপার্জিত অর্থের উপর গড়ে ওঠা শিল্প-কলকারখানা অনেকেই ধরে রাখতে পারেন নাই।

বাংলাদেশের ধনীদের কিছু সাধারণ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। এঁরা সকলেই বুদ্ধিমান, সাহসী পরিশ্রমী এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। প্রথমদিকের ধনীরা ধর্মভীরু সাধারণ বাঙ্গালী। সকলেই ভাগ্যে বিশ্বাসী , ধার্মিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে নানাধরনের পীর ফকিরের ক্ষমতায়ও বিশ্বাসী।

আশির দশকে বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস সেকটর গড়ে ওঠে। সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিকভাবে পানির প্রাচুর্যতা টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরকে প্রসারিত করে। সরকার ও রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন ছাড়াও একেবারে শূন্য থেকে শিল্পোদ্যোক্তা একটি শ্রেণি গার্মেন্টস সেক্টরকে দাঁড় করিয়েছেন। দুর্বিষহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পরেও বাংলাদেশে এই নব্য-ধনীদের শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে সরকারের অবদান অতি সামান্য। বেসরকারিভাবে সংগঠিত এই কর্মসংস্থান আমাদেরকে বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্রেণিটির বড় অংশই দুর্নীতি না করেই নিজেদের মেধা ও অমানুষিক পরিশ্রমে গার্মেন্টসকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে দীর্ঘ কয়েকদশক পরিচিত করিয়েছে।

অন্যদিকে প্রতিবছর প্রবাস থেকে বৈদেশিক রেমিটেন্স এনেছে যে নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, এঁরা মূলত: তাঁদের পরিবারের শ্রেণি উত্তরণে নিয়ামকের মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। দেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণিটি মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার থেকে প্রতিবছর বিশাল অংকের রেমিটেন্স নিয়ে এসেছেন নিয়মিত। কিন্তু সেই উপার্জিত পুঁজি ও বিত্ত ভূসম্পত্তি ক্রয় ও নানা ভোগবিলাসে ব্যয়িত হয়ে থাকে। প্রবাস থেকে আসা যথেচ্ছ পুঁজি দেশের শিল্পবিনিয়োগে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না ; বরং মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের বিশাল নিম্নবিত্তদের বড় একটি অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি স্বল্পশিক্ষিত আরো একটি মধ্যবিত্ত সমাজ এখন সাড়া দেশ জুড়ে। পুরো পৃথিবী যখন পুঁজিবাদের চূড়ান্ত ফলন দেখতে পাচ্ছে, এই ভোগবাদী বস্তুতান্ত্রিক সমাজে ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল এই মধ্যবিত্তরা দেশের অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে বৈকি।

 

বাংলাদেশের ধনীদের ভেতরে সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছেন এমন দৃষ্টান্ত মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনের। এঁদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রণদা প্রসাদ সাহা। তিনি বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে খাদ্যশস্য ক্রয়ের চুক্তি পেয়ে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। একে একে পাটকল, ডকইয়ার্ড, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, পাওয়ার হাউজ, ট্যানারি ব্যবসা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষভাগে তাঁর সমস্ত ব্যবসা থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন। যা ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ নামে সুবিখ্যাত। এছাড়া, মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস্। কুমুদিনী হাসপাতালে স্কুল অব নার্সিং , কুমুদিনী কলেজ, এস,কে হাইস্কুল, দেবেন্দ্র কলেজ ইত্যাদি। তাঁর মতো সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ধনী বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে হিন্দু জমিদারদের পূজাপার্বণে যথেচ্ছ অপচয়ের পরেও হাসপাতাল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় করে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজকে এগিয়েছে। আধুনিক বাংলাদেশের ধনীদের মাঝে সামাজিক ও মানবিকখাতে অবদান রাখার কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না। রাজস্ব প্রদানেও এদের বড় ধরণের অনীহা কাজ করে। বেশিরভাগ ধনী পরিবার ও শিল্প গ্রুপগুলোর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সুসম্পর্ক থাকে দেয়া-নেয়ার। ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে রাজস্ববিভাগ খড়গহস্ত থাকলেও বড় ধনীদের ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য দেখায়। সামাজিক দুর্নীতির কথা আগে পত্রিকা অথবা মিডিয়াতে আসার সম্ভাবনা ছিল। জনসচেতনতা ছিল। এখনকার নব্যধনীদের নিজস্ব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থাকে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আশির দশকের আগে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর দূরত্ব ছিল। পরপর কয়েকটি সামরিক শাসনে জর্জরিত হতে হতে দেখা গেল , দেশের ব্যবসায়ী সমাজের একটি বড় অংশ রাজনীতিতে চলে এসেছে। গত কয়েকটি সংসদের সিংহভাগ সংসদসদস্য ব্যবসায়ী পরিবারের এবং তাদের প্রত্যেকের চলমান শিল্প ,কলকারখানা বিদ্যমান।

দেশের খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এ কে খান গ্রুপ, বেক্সিমকো , স্কয়ার, আনোয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, রহিম আফরোজ, প্রাণ আরএফএল , ইউনাইটেড গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ। দার্শনিকভাবে ধনী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মৌলিক প্রবণতা থাকে পুঁজি বাড়ানো, মুনাফাবৃদ্ধি করে জীবনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বাড়ানো। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগের সাথে সাথে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠে, সমাজের লাভ হয়, দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ এই ধনী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে খাদ্য উৎপাদনে নিত্যনতুন প্রযুক্তির দেখা পেয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ঔষধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বহু ক্ষেত্রে আমাদের আমদানি নির্ভরতা একেবারে কমে গেছে। আমরা হয়ে গেছি, রপ্তানিমুখি দেশ। আমাদের বস্ত্রশিল্প, চামড়াশিল্প , কুটিরশিল্প, ঔষধশিল্প দিয়ে বিশ্ববাজারে আমাদের নাম পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের ধনী সম্প্রদায়ের প্রধানতম অবদান হচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানের ফলে একটা উদীয়মান জাতির কর্মক্ষমতা বেড়েছে, গার্মেন্টস সেক্টরে প্রসারে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বেড়েছে এবং শিল্পোদ্যোক্তা এই ধনীদের অবদানে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু সামাজিক ও মানবিকক্ষেত্রে এঁদের অবদান অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এবং অকিঞ্চিৎকর।

সহায়ক তথ্যসূত্রঃ

১। পুর্ব বাংলাঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য ( ১৯৪৭-১৯৭১)। এস এস বারানভ। সাহিত্যপ্রকাশ। জুলাই ১৯৮৬
২। বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পোদ্যোগীর জীবনকাহিনী। সম্পাদনাঃ আবদুল্লাহ ফারুক। ব্যবসায় গবেষণা সংস্থা। সেপ্টেম্বর,১৯৮৪
৩। বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪ -১৯৭১ ; ১ম খণ্ড রাজনৈতিক ইতিহাস ; ২য় খণ্ড অর্থনৈতিক ইতিহাস ; ৩য় খণ্ড সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক ইতিহাস। সম্পাদকঃ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ ডিসেম্বর ,১৯৯৩
৪। দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গবেষণা।

আমেরিকার নির্বাচন ২০২০

আমি চাচ্ছিলাম ট্রাম্প ব্যাটাই আবার জিতুক।
প্রথমবার জেতার পর বিমলানন্দ পেয়েছিলাম। আম্রিকানরা সারাদুনিয়ার সবার পুটুতে আঙুল দিয়ে বেড়ায়। ট্রাম্প আসায়, নিজেদের পুটুতে, নিজেদের লোক আঙুল দিলে কেমন ব্যথা লাগে বুঝছে। এই যে আমরা বাকী দুনিয়াতে চুতিয়া সব নেতা-নেত্রীদের নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি, আমাদের ফিলিংসটা হ্লারপুতেরা বুঝুক। রাষ্ট্রনেতার মতো সর্বোচ্চ সন্মানের পদে বসে একজন যখন হুদামিছা, আউল-ফাউল কথা বলে সেটা তৃতীয় বিশ্বে একচেটিয়া হয়ে গিয়েছিল। এবার বোঝ, ঠ্যালা !

আগের ইলেকশনে ট্রাম্পকে কেন ভোট দিচ্ছ, এক সাদা আমেরিকান বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, ‘শোন জাহিদ, আমার সামনে দুইটা চয়েজ, একটা সুশীল ভণ্ড হিলারি ক্লিনটন আর আরেকদিকে পাগল-ছাগল ট্রাম্প। ভণ্ডের চেয়ে হৈহৈ রৈরৈ করা পাগল ভাল।’
এইবার সেই সাদা আমেরিকানের সঙ্গে কথাবার্তা হয় নাই।

তবে আমার মনে হয়েছে, ট্রাম্প একটা পাগলছাগল হলেও সারা দুনিয়ার পুটুতে আঙ্গুল দিয়ে বেড়ায় নাই। নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। বাইডেন সাহেব আসলে সারা পৃথিবীর বিশেষত: তৃতীয়বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের কোথায় কোন যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসবে কে জানে !
ট্রাম্পের ব্যাপারে আমার মন্তব্য, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত –টাইপ। এই লোক হাউকাউ যাই করুক তার শাসনামলে বড় ধরণের কোন ঝামেলা পাকায় নাই। না দিয়েছে মেক্সিকোর বর্ডারে দেয়াল ; না করেছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ।

কথায় বলে না, চেনা শত্রু অচেনা বন্ধুর চেয়ে অনেকসময় ভাল। কারণ, চেনা শত্রু কী কী করতে পারে, সে সম্বন্ধে একটা ধারণা তো থাকেই। কিন্তু এতোদিন পরে এই , ঘাঘুমাল বাইডেন এসে কী কী করবে কে জানে।
এনিওয়ে, সকল আম্রিকানবাসী সাদাকালোবাদামি ভাই-বেরাদারদের শুভেচ্ছা। গণতন্ত্র নিজেদের পুটুতে গেলে কেমন লাগে বোঝেন অ্যালা !

আম্রিকার ইলেকশনে আমি ও আমার প্রবাসী বাংলাদেশীদের অবস্থা অনেকটা এ রকম :
বহু শতাব্দী আগে কেউ কাউকে সুসংবাদ দিলে প্রশংসা ও বখশিশ পাওয়া যেতো।তো সেটা জেনে এক লোক নাসীরুদ্দীন হোজ্জাকে গিয়ে বলল,
: ‘তোমার জন্য খুব ভালো খবর আছে, মোল্লা-সাহেব।’
: ‘কী খবর?’
: ‘তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।’
: ‘তাতে আমার কী ?
: ‘তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলেছে।’
: ‘তাতে তোমার কী ?’

এই যে মোবারক ওরফে বারেক ভাইয়ের পরে জয়নাল ট্রাম্প এসে আম্রিকাকে হুলুস্থূল করল। একবার মেক্সিকোর বর্ডারে দেয়াল দেয়। আরেকবার উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমানবিক যুদ্ধ বাঁধায়। কিছু অভিযোগ করলেই মুখ বাঁকা করে বলে’ ফেইইইক ন্যুজ !’ ব্যাপারটা আমার বরাবর ভালো লাগতো।
সব সময় মনে হতো, আরে এই লোক তো আমাদের ওয়ার্ড কমিশনারের মতো উত্তর-দক্ষিণ কথা বার্তা বলে। ব্যাটাকে অনেক আপন আপন মনে হইত রে ভাই !

মোবারক ভাই বলেন আর জোবায়ের বাতেন ভাই বলেন, এদের মতো ওর কোন মিষ্টি মিষ্টি কথা নাই ; যা মনে আসতো তাই বলতো।
নির্বাচনে জিতে , আজ জোবায়ের বাতেন ভাই আর কমলা আপার সেই ‘মাপা হাসি চাপা কান্না’ দেখে মনে হচ্ছিল হলিউডের কোন সিনেমা দেখছি। খুব লম্বাচওড়া কথা ; অনেকটা আমাদের মোটিভেশনাল স্পিকাররা ইদানীং যেরকম করে দেয় আর কী! আম্রিকা হ্যান, আম্রিকা ত্যান, কিপ ফেইথ, স্প্রেড ফেইথ ইত্যাদি ইত্যাদি। মিষ্টি কথার আড়ালে আগামী চারবছরে এদের অমানবিক আগ্রাসী পুঁজিবাদের কবলে পড়ে কার কার সর্বনাশ হয় সেটাই দেখার ব্যাপার।

আমার মামার কাছে শুনেছিলাম জেনারেল জিয়ার প্রথম দিকের ইলেকশনে সবাই দলবেঁধে ধানের শীষে ভোট দিতে যেতো। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আওয়ামীলীগ তখন সাময়িক পরবাসে, নিভু নিভু করে জ্বলছে। যে কোন সামরিক শাসকের আবার জনপ্রিয়তা থাকে ১১০% । ভোট হলে অন্য কারো ভোট খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যাই হোক, কুষ্টিয়ার কোন এক আসনে ‘চিন্টু’ নামের  ( ডাকনাম, আসল নাম মনে নেই ) ভয়ংকর এক দুষ্টু লোক ভোটে দাঁড়িয়েছিল। কীভাবে কীভাবে যেন সে ধানের শীষ প্রতীকও ম্যানেজ করেছিল।
ভোট শেষে চিন্টু মিঞার বিজয়োৎসব শুরু হলে, এক লোক ক্ষোভে ফেটে পড়ল, ‘ভোট দিলাম ধানের শীষে, শালার চিন্টু হারামজাদা এমপি হোল কেম্মা কইরে !”

আমাদের নতুন চিন্টু মিঞা —জোবায়ের বাতেন ভাই এখন কী কী দুষ্টুমি করে সেটা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
আবারো অভিনন্দন জোবায়ের বাতেন ভাই এবং কমলা আপা ।

প্রকাশকালঃ ৫~৮ নভেম্বর,২০২০