সত্তুরের দশকে শিল্পীর স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিবৃতিগুলো চীন-ভারত সীমান্ত জট প্রসঙ্গে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল। কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুকে সেই লেখকমণ্ডলীর মধ্যে দেখা গেল না। নিস্পৃহ থেকে তিনি নিজের অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘লেখার স্বাধীনতা যদি থাকে, না-লেখার স্বাধীনতাও আছে।’
সমরেশ বসুর এই বোধ আমি নিজেও ধারণ করি। আমিও ‘ না-লেখার স্বাধীনতায়’ বিশ্বাস করি। হতে পারে, আমার নিস্পৃহতা , হতে পারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর ব্যাপারে আমার চিরআলস্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চলতি হাওয়ার তথাকথিত দায়বদ্ধতায় দায়বদ্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক লেখা আমার পক্ষে কখনই হয়ে ওঠেনি। আমি হয় আগে বলে ফেলি অথবা পরে বলি। এতোদিনে আমার স্বল্প পরিচিতরাও জেনে গেছেন যে, আমি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে পারিনা, আর এই বয়সে এসে এই দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা নাই বা করলাম।
তো যাই হোক, প্রতিবছর বিসিএস-এর ফলপ্রকাশের সময় ইলেকট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রাশিরাশি সাফল্যের গল্প প্রকাশ করে। মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়া দিনমজুরের ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে; দারোয়ানের ছেলে কাস্টমস অফিসার হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব সাফল্যকীর্তি আমাদের আশাবাদী করে। মনে হয়, বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ, মানুষের সম্ভাবনাও অপরিসীম। মনে হয়, পুঁজিবাদীদের ঠাকুর আধুনিক আমেরিকার মতোই বাংলাদেশও সবসময় ‘ল্যান্ড অব অপরচুনিটি’ ! এখানে সমাজের সকল শ্রেণির, স্বতন্ত্র ব্যক্তির একই রকম সম্ভাবনা আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশীদার হওয়ার। ‘আজ যে ফকির কাল সে রাজা।’ এইসব বিচ্ছিন্ন মিথ নিয়ে আমরা আশাবাদে বুঁদ হয়ে থাকি।
প্রসঙ্গত আব্রাহাম মাসলো তাঁর সুবিখ্যাত Maslow’s hierarchy of needs (মাসলো’র চাহিদার সোপান তত্ত্ব ) যে কথাগুলো বলেছেন, সেখান থেকে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ এবং নির্দিষ্ট করে বাঙাল সমাজ বের হতে পারেনি। মৌলিক জৈবিক চাহিদা, নিরাপত্তা, পারিবারিক ভালোবাসার পর্যায়গুলো পেরিয়ে যেতে পারলেই সে আত্মমর্যাদা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণান্ত করে।
বাঙালের চাহিদা তার ধারাবাহিক প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে। মোটা দাগে আমার মতো মুর্খ লোকেও বলতে পারে যে, পিরামিডের উপরের দিকে এসেই বাঙাল ক্ষমতাবান হতে চায়, জনপ্রিয় হতে চায়। যেনতেন প্রকারে বিত্ত তো চলে আসেই। কিন্তু ক্ষমতা ও সম্মানের দুইটিই একসঙ্গে একজীবনে পাওয়ার একটিমাত্র উপায় আছে, সেটি সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়া। ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস থেকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস হয়ে অধুনা বিসিএস অফিসার হওয়ার সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাদের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিতশ্রেণির ও শিক্ষানুরাগী জনগণের বহুবছরে আরাধ্য। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে শুরু করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস অবধি এই ইম্পেরিয়াল ওরফে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসকেই জীবনের মোক্ষ করেছিলেন। ( উল্লেখ্য, দেশমাতৃকার টানে নেতাজী কয়েকবছর পরে সিভিল সার্ভিস থেকে স্বেচ্ছায় সরে পড়েন।)
এই যে একের ভিতর তিন– অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও সম্মানপ্রাপ্তির সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিকতা আমরা দেখছি, সেটির কিঞ্চিৎ ভাটা পড়েছিল সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক পর্যন্ত। সামরিক শাসনের যথেচ্ছ চাপে প্রশাসনের আমলাদের চেয়ে নব্যদালাল, রাজনৈতিক চামচা, সামরিকবাহিনীর দাপট ছিল বেশি। সরকারি বেতন বোনাসও তেমন বলার মতো ছিল না। সরকারি চাকরি মানে সরকারি চাকরিই, নিরপত্তা আজীবন—এটুকুই ছিল সান্ত্বনা। আমরা যখন নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কর্মজীবনে আসলাম, ততদিনে বাংলাদেশে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, নানাধরনের রপ্তানিমুখি শিল্পকারখানা, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি, বেসরকারি ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি ইত্যাদির কৈশোর কাল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্রকোপ বেড়ে গেল। সবকিছু মিলিয়ে, আমাদের প্রজন্ম যারা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমাদের গ্রাজুয়েশন করেছিলাম, তাদের পছন্দ ছিল প্রাইভেট সেক্টর। প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির নিরাপত্তা ও ক্ষমতার দাপট ছাড়া সবকিছুই পাওয়া যেত। ভালো বেতন, আধুনিক অফিস, ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম, বিদেশ সফর ইত্যাদি আমাদের সিংহভাগকে আকৃষ্ট করেছিল বেসরকারি সেক্টরে যোগদান করতে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলতে পারি, আমি নিতান্তই ঠেকায় পড়ে কয়েকবার কয়েকটি সরকারি কার্যালয়ে গেছিলাম সেই ৯০ দশকের শুরুতে। মাথার উপরে ব্রিটিশ আমলের ফ্যান ঘুরছে, ধুলাবালির মাঝে ফাইলের স্তূপ, পুরনো টেবিল চেয়ার, নোংরা শৌচাগার আর গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের দাপট ও অনাধুনিক কর্ম-পরিবেশ দেখে আমি যারপরনাই হতাশ ছিলাম। বিসিএস-কে জীবনের মোক্ষ করিনি বলে আমার বড়মামা বছর খানেক আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আসলে, তারা দেখেছেন যে, মফঃস্বল শহরে একজন সরকারি কর্মকর্তা মানে ছোটখাটো দেবতা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল তো আর আমি চাক্ষুষ করিনি ; তবে, আশির দশকে দেখেছি– উপজেলা , থানা পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা, টিএনও, ম্যাজিস্ট্রেট যদি দেবতার মতো হয়, তাহলে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার ছিলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু মহেশ্বরের সমতুল্য। বিশাল বাংলো, সামনে ফুলের বাগান, পিছনে পুকুরের সঙ্গে ছিল গুচ্ছের আর্দালি, কুক, দারোয়ান ইত্যাদি। আমি আমার পরিবারে তথাকথিত মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলাম। সুতরাং আমার বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে হলেও, আমার সিংহভাগ আত্মীয়-স্বজনদের স্বপ্ন ছিল বিসিএস দিয়ে পুলিশ, প্রশাসন বা কাস্টমস কর্মকর্তা হওয়া। সেই গুড়ে বালি দিয়ে আমি টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরে প্রায় তুচ্ছ, ক্ষমতাহীন ও অপাঙতেয় জীবন যাপন করে চলছি।
এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, যে আমাদের সময়ে ক্লাসের প্রথম-সারির ছেলেমেয়েরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়তো, আর তাঁদের গন্তব্য ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মেডিক্যাল কলেজ এবং কিয়দংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দামী কয়েকটি সাবজেক্ট পর্যন্ত। বাকীরা নিতান্তই আসনসংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতেন। আমার প্রকৌশলী বন্ধুদের ভিতরে হাতে গোনা কয়েকজন বিসিএস দিয়েছে কি দেয় নাই।
রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যখন ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে একটা প্রশাসননির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করল, তখন সমাজের বাকী মেধাবী অংশগুলো হয়ে পড়ল অবহেলিত। এই বছরের শুরুতে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘ সব দেশ প্রশাসকে ভরে গেছে। কোনো বিজ্ঞানী নেই। গবেষক নেই। দার্শনিক নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধুই প্রশাসন দেখতে পাবেন। ……. প্রশাসকনির্ভর জাতি হলে কী হবে ভবিষ্যতে, তার ইঙ্গিত তো দেখতে পাচ্ছি। কোনো চিন্তাবিদ আপনি দেখতে পাবেন ? নেই। গবেষক নেই। এমন একটি জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। প্রশাসকরা প্রশাসকই তৈরি করেন। তারা শিক্ষার মর্ম কী বুঝবেন ! তারা পরামর্শ দেবেন ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করার। ’
সারাদেশ যখন প্রশাসনের , যাঁদের ঘরে লক্ষ্ণী-সরস্বতী একসঙ্গে বসে চা খায়, তখন একজন মেধাবী প্রকৌশলী ও চিকিৎসক কেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কাস্টমস, ট্যাক্সে যেতে চাইবে না?
আরো দুটি স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
আশির দশকে আমার এক মামা বিসিএস দিয়ে কোন এক ক্যাডারে (যতদূর মনে পড়ে খাদ্য ক্যাডারে) যোগদান করলেন। জানি না তিনি বাড়িয়ে বলেছিলেন কীনা । তবে এটাও সত্য, শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলার লোক উনি নন। যোগদানের পরে তাঁর যে আসন এতোদিন ফাঁকা ছিল, সেটার বরাবরে চলমান দুর্নীতির ভাগের যে টাকা জমেছিল সেটা তাঁকে প্রথম দিনেই প্যাকেট করে দেওয়া হয়েছিল। ঐ কারণেই হোক , বা অন্য কারণে তিনি আর সরকারী চাকরি করেননি, শিক্ষকতায় চলে আসেন।
বছর দুয়েক আগে, আমাদের কয়েকজন টেক্সটাইল প্রকৌশলী বন্ধুরা মিলে এক বন্ধুর মামা, যিনি সরকারি দলের প্রাক্তন সংসদ সদস্য, তার রিসোর্টে গেলাম। একটা প্রাক-বনভোজনের জায়গা পছন্দের নিমিত্তে। আমরা যেয়ে দেখি, মামা ভীষণ ব্যস্ত জনৈক থানা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাকে নিয়ে। এই, ডাব আন রে, পানি আন রে , মিষ্টি আন রে , দুপুরের খাবারে বড় মাছ জোগাড় কর রে, সে এক হুলুস্থুল। এদিকে আমরা কয়েকজন যে গেছি, তার মধ্যে একজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, দুইজন বৃহদায়তন শিল্পকারখানার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও জেনারেল ম্যানেজার। সেই প্রশাসনিক দেবতার তোষণে মামা এতোই ব্যস্ত রইলেন যে, আমাদের দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ পাচ্ছিলেন না। আমরা নিজেদের মতো ব্যস্ত রইলাম। দুপুরের খাবারের সময় পরিচয় পর্বে সেই সরকারি কর্মকর্তা বুঝতে পারলেন, আমাদেরকে তিনি যতোখানি তুচ্ছ জনগণ ভাবছিলেন, আমরা ঠিক ততোখানি তুচ্ছ নই।
বহুবছর আগে কবি নির্মলেন্দু গুণকে মাঝরাতে টহল পুলিশ ধরলে তিনি নিজেকে কবি হিসাবে পরিচয় দেন। তাতে কী আর হয়! রসিক পুলিশ বলেন,আপনি যে কবি তার প্রমাণ কি , একটা কবিতা বলেন। গুণ নাকি মুখে মুখে বলেছিলেন, ‘ মাছের রাজা ইলিশ, আর মানুষের রাজা পুলিশ !’ টহলপুলিশ কবিতা শুনে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল।
এখন , আমার যদি আবার বয়স ২১/২২ হতো, আমি যদি আবার নতুন করে জীবন শুরু করার সুযোগ পেতাম, আমিও কী মানুষের রাজা হতে চাইতাম না ! সেই চাওয়ার মধ্যে গলদ যদি কিছু থেকেই থাকে, সেটা দূর না করে প্রকৌশলীরা কেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যাচ্ছে ; কেন স্পেশালাইজড শিক্ষিতরা ( পড়ুন ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়াররা ) ক্যাডার সার্ভিসে গিয়ে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের ভাগ্য বিনষ্ট করছে –এইসব আহাজারি বন্ধ করুন।
প্রথম প্রকাশঃ ২রা এপ্রিল ২০২২