আশির দশকের দৈনিক পত্রিকায় সরকারী-বেসরকারি নিউজের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহের লিড নিউজ কী হতো, কারো মনে আছে?
আমার মনে আছে। হয় আরিচা মহাসড়কের বা অন্যকোন মহাসড়কের দুর্ঘটনার ছবি, সারিবদ্ধ লাশ , নীচে ক্যাপশন “এভাবে আর কতোদিন?” অথবা, লঞ্চ দুর্ঘটনায় অর্ধশত নিহত, শতাধিক নিখোঁজ।

তো আমি তখন স্কুলের পোলাপান, থান্ডার ক্যাটস বা টম অ্যান্ড জেরি নিয়ে ব্যস্ত। কোথায় লঞ্চডুবি হইলো ,কতোজন মারা গেল আমাকে অতোখানি স্পর্শ করতো না। বড়োজোর ফেলে রাখা সারি সারি লাশের ছবি দেখে একটু মন খারাপ হতো।

৮৭ তে আমার বড়মামা আর নানী লঞ্চডুবিতে পড়লেন। দিনের বেলা হওয়ায় হতাহতের সংখ্যা কম। মোবাইলের যুগও নয়। বড়মামা ও নানী সঙ্গের মালপত্তর হারিয়ে কীভাবে যেন জানে বেঁচে গেলেন। আশে পাশের অনেক মাছ ধরা নৌকা অনেক যাত্রীর জীবন বাঁচায় সেবার। বড়মামা কারো সাহায্য করা একটা পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গি আর নানী এক-কাপড়ে যখন ঢাকায় এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তখন আমি বুঝলাম লঞ্চডুবির ভয়াবহতা। মামা ও নানীর মুখে শোনা, লঞ্চ ডুবে যাওয়ার আগের প্রত্যেকটা মুহূর্ত কী যে ভয়ংকর আতংকের ছিল, এখন মনে পড়ে যাচ্ছে।
ভারতের বদান্যতায় নদীতে নাব্যতার অভাবে লঞ্চ নির্ভরতা অনেক কমে গেছে মনে হয়। যা দেখছি, আগের মতো মাসে ৭/৮টা লঞ্চডুবির কথা শুনতে হয় না। লঞ্চ দুর্ঘটনা এখন আরে লিড নিউজে নাই।

আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটলো আমার নিজের জীবনে। ২০০৫ এ বাস অ্যাকসিডেন্টে বিছানায়, ফিমার ছুটে গেছে টিবিউলার থেকে, মানে হিপ বা কোমরের সাথে ডান পায়ের জয়েনিং ফর্দাফাঁই । ট্রাকশন নিয়ে চিৎ হয়ে তিনমাসের অসহনীয় দিনগুলো , মাঝে আবার কোরবানির ঈদ গেল, হাসপাতালের বেডে শুয়ে অকথ্য যন্ত্রণা , অসহায় আক্রোশের প্রতিটা মুহূর্ত। ওই সময় আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। বিছানায় শুয়ে শুয়েই প্রথম কন্যার জন্মসংবাদ শুনতে হলো। কী জানি কী মনে করে ,ঈদে গ্রামমুখী মানুষের সড়ক দুর্ঘটনার নিউজগুলো মন দিয়ে শুনতাম। শুয়ে শুয়ে একটা ডাটাও বের করলাম। ২০০৬ এর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে শুধুমাত্র টিভি নিউজে মোটামুটি শ দেড়েক বড় সড়ক দুর্ঘটনার নিউজ শুনলাম। মোটামুটি ১৫০ জনের অকালপ্রয়াণ আর হাজার খানেকের পঙ্গুত্ব।

আমি নিজে পা ভেঙ্গে পড়েছিলাম বলেই হয়তো এইগুলো মন দিয়ে দেখতাম। আর কতিপয় অসাবধানী শুয়োরের বাচ্চা ড্রাইভারের জন্য পঙ্গুত্ব বরন করা লোকগুলোর কথা চিন্তা করতাম। আমার ডাক্তার ছিলেন ডাঃ রুহুল হক ( বর্তমান স্বাস্থ্য মন্ত্রী)। কিন্তু , কয় জনের সাধ্য আছে, তাঁকে দিয়ে চিকিৎসা করানোর? পঙ্গুত্বতো এক অর্থে মৃত্যুর চেয়ে অকল্পনীয় যন্ত্রণার !মনুষ্যজীবনে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে অসম্মানের আর কী থাকতে পারে ?

আমার আশে পাশের অনেককে দেখেছি হাজার তিনেক টাকা দিয়ে দু নাম্বার ড্রাইভিং লাইসেন্স জোগাড় করতে। কেন জানিনা আমার জিদ চেপে গিয়েছিল আমি দু নম্বরি কোনকিছু করবো না। সুস্থ হয়ে আমি নিজে ড্রাইভিং শিখলাম এবং মাত্র ১৮০০ টাকা কুল্লে খরচ করে পর্যায়ক্রমে ৪/৫ দিন বিআরটিসি তে লিখিত, মৌখিক, ব্যাবহারিক দিয়ে ওরিজিনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিলাম। এইটুকু বুঝলাম যে একজন অপ্রশিক্ষিত ড্রাইভার কতজনের সারাজীবনের দুর্দশার কারণ হতে পারে।

দুইটা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা, আমাকে সচেতন করেছে মানুষের অসহায়ত্ব ও দুর্দশার কথা ভেবে দেখতে। আজ যারা রাজনীতিবিদ, দেশের মাথা , তাদের জন্য দোয়া করি তাঁদের নিকটাত্মীয় বা প্রিয়জনের এই অভিজ্ঞতা হোক। একজন প্রিয় মানুষের প্রস্থানে যদি ইলিয়াস কাঞ্চন, তারানা হালিমের মতো তারকা আজ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হতে পারেন । আমি প্রার্থনা করি, মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদদের প্রিয়জন অকালে বিল্ডিং চাপা পড়ুক, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাক, পুড়ে মরুক কোন বদ্ধ কারখানায়।

কয়েকজন মানুষের বিদায়ে যদি সারা বাংলাদেশে কিছু পজিটিভ পরিবর্তন হয়, আমি সেই প্রার্থনা করতেই পারি ! আপনারাও প্রার্থনা করেন , হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে করেন !

প্রথম প্রকাশঃ ২৬শে এপ্রিল ২০১৩