প্রেমিক।। বুদ্ধদেব বসু। আলোচনা।।

৯১ সালে এসে হঠাৎ করে বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। ঠিক সহজবোধ্য নয় ; কিন্তু আলাদা একটা মধ্যবিত্ত মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর কবিতায়। আমাদের তখন দুর্দমনীয় অস্থির কৈশোর। পড়াশোনায় একবার ভালো করলে যা হয়, গায়ে ‘ভালছাত্র’ লেবেল লেগে গেল তো , জীবন শেষ! যদিও জানি দুইটা রচনা পড়লেই পরীক্ষায় কমন পড়বে ; তবু নিশ্ছিদ্র প্রিপারেশন, সবার আগে থাকার জন্য গুচ্ছের আরো বারো-তেরোটা রচনা পড়রে, আলাদা নোট বানাও রে , উফ !
বিদ্যালয়ের বালিকা শাখাটি রাস্তার ওই পাশে। ‘ভালছাত্র’ লেবেলধারীরা ঘুণাক্ষরেও ওমুখো হতাম না। কোনক্রমে আমাদের বালক শাখার কোন শিক্ষকের চোখে যদি পড়ে যাই, লজ্জার সীমা থাকবে না। সুতরাং সাদা পোশাকের সেই কিশোরীরা আমার চোখের আড়ালেই কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে গেল। ওই কিশোরীদের কেউ কেউ , যখন চল্লিশোর্ধ ‘ভদ্রমহিলা’আমার সঙ্গে তাঁদের নতুন করে পরিচয় হল স্কুল রি-ইউনিয়নে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে। চল্লিশোর্ধা কাউকে দেখে তো আর বলা যায় না, “ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘ এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
মূল কবিতার প্রসঙ্গে আসি। অস্থিরতা, পড়াশোনার চাপ, বাবা-মা-সমাজের এক্সপেক্টেশনে আমাদের কয়েকজনের অবস্থা চিঁড়েচ্যাপটা! একে নবযৌবনের উদ্গমে আমাদের অবস্থা নাজুক ; এর মাঝখানে চারিদিকের ওই ঐশ্বরিক স্বর্গের কিশোরীদের আমাদের সামনে দিয়ে যাতায়াত ! ‘জীবন’ যতোখানি রহস্যময়, আমারতো মনে হয় যৌবন তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী ও রহস্যময়।
বুদ্ধদেবের “প্রেমিক”কবিতাকে আমার চিরন্তন মনে হয়েছে আজ নতুন করে পড়ে। সেই সময়ে কেন ভাল লাগল? কারণ ওই অস্থির বৈপিরত্যে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করছে স্বর্গীয় কিশোরীদের অথচ সামাজিক অনুশাসন আমাকে রাখছে সেই ঐশ্বরিক অনুভূতি থেকে লক্ষ মাইল দূরে। তাই দূরে থাকার জন্য , ভেবে নিলাম নারী হোক কিশোরী হোক –“ , তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –” । ওটা ছিল একধরণের সামাজিক অবদমন। আমার চির আকাঙ্ক্ষিতকে “ আঙ্গুর ফল টক” ভেবে দূরে থাকা আর কী !
আজ বহুদিন পরে সকালে আবার সেই কবিতার মুখোমুখি। এবার পরিপূর্ণ রূপে ধরা পড়ল বুদ্ধদেবের চিরন্তন বক্তব্যকে। হায় ! আমি যতো দূরেই যাই, নারীর সেই রহস্যময়তাকে অবহেলা করার মতো ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দেয় নি। আমাকে/আমাদেরকে বার বার ফিরে আসতে হয় সেই ননীর মতো তনুর কাছে !
পুরো কবিতা অনুলিখন করার মতো ধৈর্য হচ্ছে না। প্রিয় লাইনগুলো পূনর্লিখন করছি। বাকীটা উৎসাহীদের জন্য ছবি আকারে রইল। উল্লেখ্য, কবিতার রচনাকাল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ।
“প্রেমিক।। বুদ্ধদেব বসু।”
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –
(ওগো কঙ্কাবতী)
মৃত-পীত বর্ণ তারঃ খড়ির মত সাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী –
জানি, সে কিসের মূর্তি ।নিঃশব্দ বীভৎস এক রুক্ষ অট্টহাসি-
নিদারুণ দন্তহীন বিভীষিকা ।
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে সেই কঠিন কাঠামো;
হরিণ-শিশুর মতো, করুণ আঁখির অন্তরালে
ব্যাধিগ্রস্থ উন্মাদের দুঃস্বপ্ন যেমন।
তবু ভালোবাসি।
নতুব ননীর মতো তব তনু খানি
স্পর্শিতে অগাধ সাধ, সাহস না পাই।
সিন্ধুগর্ভে ফোটে যত আশ্চর্য, কুসুম
তার মতো তব মুখ, তার পানে তাকাবার ছল
খুঁজে নাহি পাই।
মনে করি, কথা ক’ব আকুলিবিকুলি করে কত কথা রক্তের ঘুর্ণিতে;
(ওগো কঙ্কাবতী!)
বারেক তাকাই যদি তব মুখ-পানে,
পৃথিবী টলিয়া ওঠে, কথাগুলি কোথায় হারায়,
খুঁজে নাহি পাই।
দুর থেকে দেখে তাই ফিরে যাই; (যদি কাছে আসি, তব রুপ অটুট রবে কি?)
ফিরে চলে যাই।
দুর থেকে ভালোবাসি দেহখানি তব-
রাতের ধূসর মাঠে নিরিবিলি বটের পাতারা
টিপটাপ শিশিরের ঝরাটুকু
যেমন নীরবে ভালোবাসে।
________________________
জানি, তুমি ভুলে যাবে সে-উৎকন্ঠা সে- বেদনা, সেই ভালেবাসা
প্রথম শিশুর জন্মদিনে।
তোমার যে-স্তনরেখা বঙ্কিম, মসৃণ, ক্ষীণ, সততস্পন্দিত-
দেখেছি অস্পষ্টতম আমি শুধু আভাস যাহার,
যাহার ঈষৎ স্পর্শ আনন্দে করেছে মোরে উন্মাদ- উন্মাদ,
জানি, তাহা স্ফীত হবে সদ্যেজাত অধরের শোষণ-তিয়াষে।
আমারে করিতে, মুগ্ধ যে- সুসুগ্ধি সুষমায় আপনারে সাজাতে সর্বদা,
তোমার যে- সৌন্দর্যরে ভালোবাসি (তোমারে তো নয়!),
জানি, তা ফেলিয়া দেবে অঙ্গ হতে টেনে-
কারণ, তখন তব জীবনের ছাঁচ
চিরতরে গড়া হয়ে গেছে;
কিছুতেই হবে নাকো তার আর কোনো ব্যতিক্রম।
________________________
তোমার বাদামি চোখ- চকচকে, হালকা, চটুল
তাই ভালোবাসি।
তোমার লালচে চুল –এলোমেলো , শুকনো , নরম
তাই ভালোবাসি।
সেই চুল, সেই চোখ, তাহারা আমার কাছে অরণ্য গভীর,
সেথা আমি পথ খুঁজে নাহি পাই,
নিজেরে হারায়ে ফেলি সেই চোখে, সেই চুলে- লালচে বাদামি,
নিজের ভুলিয়া যাই, আমারে হারাই-
তাই ভালোবাসি।
আর আমি ভালোবাসি নতুন ননীর মতো তনুলতা তব,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
আর আমি ভালোবাসি তোমার বাসনা মোরে ভালোবাসিবার,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
ওগো কঙ্কাবতী!
[ প্রথম প্রকাশ ১৪ই নভেম্বর ২০১৬]

আজকে আমার শরীর খারাপ।। সমর কুমার সরকার

শরীরটা আজ ক্লান্ত ভারি,
ক’রছে গা ম্যাজম্যাজ,
ঠিক করেছি বিশেষ কিছুই
খাব না তাই আজ।
সকাল বেলায় চায়ের সাথে-
গামলা খানেক মুড়ি
তেল,লঙ্কা মাখিয়ে,
সাথে পেঁয়াজি,ফুলুরি।

সকাল, ধরো নয়’টা নাগাদ,
থাকলে মুখে রুচি,
খেতে পারি ঘি-য়ে ভাজা
গণ্ডা দশেক লুচি।
সঙ্গে আলু, বেগুন ভাজা,
আচার, আলুর দম,
রসগোল্লা গোটা বিশেক,
লাড্ডু ও চমচম।

দুপুরেতে কি আর খাব ?
শরীর ভাল নয় !
ভাতের সাথে কাতলা মাছের
টুকরো গোটা ছয়।
কচি পাঁঠার মাংস কষা
বড় দু-চার বাটি,
মিষ্টি দই আর চাটনি হ’লে
চলবে মোটামুটি।

বিকাল বেলায় খাব না হয়
আপেল, খেজু্র,‌ কলা,
গোটা পাঁচেক ডাবের জল,
আর অঙ্কুরিত ছোলা।
সন্ধ্যাবেলায় চায়ের সাথে,
প্রন কাটলেট, ফ্রাই,
এর বেশী আর খাবো না,পেট
খালি রাখা চাই।

রাত্রি বেলায় গুরুভোজন
আজ তো আমার মানা,
খাবো দুধের ক্ষীর মেখে ওই
রুটি পঁচিশ খানা।
সঙ্গে সরেস ছানার পায়েস
রাবড়ি আধা কিলো,
শরীর খারাপ,এর বেশী কি
খেতে পারি বলো ?

শরীরে আজ পাচ্ছি না জুত,
নাড়ীর গতি ক্ষীণ,
অল্প এমন খেয়েই কাটুক
আজকে সারা দিন।
এমনিতে ও খাওয়া আমার
কম-ই একেবারে,
পেটুক মানুষ দেখলে আমি,
লজ্জাতে যাই ম’রে।।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথোপকথন

” আরও বললেন, ও-সব কিছুই শেষ পর্যন্ত আলাদা দাগ কাটে না, ও-সব অভিজ্ঞতাই মানুষকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।
আমি জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, এই তো আমার ছেলে বসে আছে ( ওঁর পুত্র এবং ঔপন্যাসিক সনৎ বন্দোপাধ্যায় কাছেই বসেছিলেন), ওঁর সামনেই বলছি, আমি অনেক ভোগের মধ্যে গিয়ে দেখেছি, মদ খেয়েছি, নানান নেশা করেছি—কিন্তু এ-সব কোনো কিছুতেই অভিভূত হয়ে পড়িনি। দুঃখ-কষ্টই বলো আর ভোগই বলো, এর সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে নিজেকে প্রকাশের আনন্দ, এঁরা ‘গণদেবতা’র মতো পুরষ্কার দিয়েছে—মনে পড়ছে, ‘গণদেবতা’ আর ‘পঞ্চগ্রাম’ -এর লেখার দিনগুলোর কথা। ‘গণদেবতা’র এই পাতাগুলো যেদিন লিখি–‘গণদেবতা’ বইটি খুলে তারাশঙ্কর কয়েকটি পাতা পড়ে শোনালেন, তারপর বললেন, তারপরদিন সেই বিখ্যাত সাইক্লোন ওঠে, সেই ১৯৪২ সাল-এর সাইক্লোন—সাইক্লোনের দিকে আমার চোখ ছিল না , সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে আমি নিজের লেখার কথাই ভাবছিলুম—নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি, সেই ব্যাকুলতায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল.”

জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথোপকথন। [[ জীবনের বর্ণচ্ছটা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।। ]]

বিধাতা।। বনফুল

বাঘের বড় উপদ্রব। মানুষ অস্থির হইয়া উঠিল। গরু বাছুর, শেষে মানুষ পর্যন্ত বাঘের কবলে মারা পড়িতে লাগিলো। সকলে তখন লাঠি সড়কি বর্শা বাহির করিয়া বাঘটাকে মারিল। একটা বাঘ গেল- কিন্তু আর একটা আসিল। শেষে মানুষ বিধাতার নিকট আবেদন করিল-
ভগবান, বাঘের হাত হইতে আমাদের বাঁচাও।
বিধাতা কহিলেন- আচ্ছা।
কিছু পরেই বাঘরা আসিয়া বিধাতার দরবারে নালিশ জানাইলো, আমরা মানুষের জ্বালায় অস্থির হইয়াছি। বন হইতে বনান্তরে পলাইয়া ফিরিতেছি। কিন্তু শিকারি কিছুতেই আমাদের শান্তিতে থাকিতে দেয় না। ইহার একটা ব্যবস্থা করুন।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
তৎক্ষনাৎ নেড়ার মা বিধাতার নিকট আবেদন পেশ করিলেন, বাবা, আমার নেড়ার যেন একটি টুকটুকে বউ হয়। দোহাই ঠাকুর , তোমায় পাঁচ পয়সার ছিন্নি দেব।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
হরিহর ভট্রাচার্য মামলা করিতে যাইতেছিল। সে বিধাতাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, আজীবন তোমার পুজো করে এসেছি।উপবাসে দেহ ক্ষীণ করেছি। শালা ভাইপোকে আমি দেখে নিতে চাই। তুমি আমার সহায় হও।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
সুশীল পরীক্ষা দিবে। সে রোজ বিধাতাকে বলে, ঠাকুর, পাস করিয়ে দাও। আজ সে বলিল, ঠাকুর, যদি স্কলারশিপ পাইয়ে দিতে পার, পাঁচ টাকা খরচ করে হরিলুট দেব।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
হরেন পুরকায়স্থ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান হইতে চায়। কালী পুরোহিতের মারফত সে বিধাতাকে ধরিয়া বসিল- এগারটা ভোট আমার চাই। কালী পুরোহিত মোটারকম দক্ষিণা খাইয়া ভুল সংস্কৃত মন্ত্রের চোটে বিধাতাকে অস্থির করিয়া তুলিল। ভোটং দেহি, ভোটং দেহি—
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা, আচ্ছা ।
কৃষক দুই হাত তুলিয়া কহিল, দেবতা, জল দাও।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
পীড়িত সন্তানের জননী বিধাতাকে প্রার্থনা জানাইল, আমার একটি মাত্র সন্তান, ঠাকুর কেড়ে নিও না।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
পাশের বাড়ির ক্ষেন্তি পিসি উপরোক্ত মাতার সম্পর্কে বলিলেন, বিধাতা মাগীর বড় দেমাক। নিত্য নতুন গয়না প’রে ধরাকে সরাজ্ঞান করছিল। ছেলের টুঁটিটি টিপে ধরে বেশ করেছ দয়াময়। মাগীকে বেশ একটু শিক্ষা দিয়ে দাও তো।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
দার্শনিক কহিলেন হে বিধাতা, তোমাকে বুঝিতে চাই ।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
চীন দেশ হইতে চীৎকার আসিল, জাপানিদের হাত হইতে বাঁচাও প্রভু।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
বাংলা দেশ হইতে এক তরুণ ধরিয়া বসিল, কোনও সম্পাদক আমার লেখা ছাপিতেছে না। প্রবাসী’তে লেখা ছাপাইতে চাই। রামানন্দবাবুকে সদয় হইতে বলুন।
বিধাতা কহিলেন, আচ্ছা।
একটু ফাঁক পড়িতেই বিধাতা পার্শ্বোপবিষ্ট ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার বাসায় খাঁটি সরষের তেল আছে?
ব্রহ্মা কহিলেন, আছে। কেন বলুনতো?
বিধাতা। আমার একটু দরকার। দেবেন কি?
ব্রহ্মা। (পঞ্চমুখে) অবশ্য, অবশ্য।
ব্রহ্মার বাসা হইতে ভাল সরিষার তৈল আসিল। বিধাতা তৎক্ষণাৎ তাহা নাকে দিয়া গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলেন।
আজও ঘুম ভাঙে নাই।

শ্রেষ্ঠ গল্প বনফুল । রচনাকাল ১৯৩৬।

নারী।। হুমায়ুন আজাদ ( ১৯৯২) আলোচনা

“প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক , আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমর্পণাত্মক ; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ্র নিয়ে বিব্রত। এটি যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্র মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচের থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে। ”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

তাঁকে কেন বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক বলা হয়—উপরের কয়েকটা লাইন সেটা জাস্টিফাই করার জন্য যথেষ্ট মনে হয় আমার কাছে। এই বলার ভঙ্গী এখনকার ফেসবুক সেলিব্রেটিদের কারো কারো আছে হয়তো। কিন্তু তাঁর সময়ে এটা ছিল কল্পনাতীত।

বাইবেলের হিতোপদেশ বলেছে, “ পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহার তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ” ; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, “ মৃত্যুর মতোই ব্যাভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।”
বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস বলেছেন, “ একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেঁয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।” এ বিয়ে পরিণত হয় এঙ্গেলসের মতে, স্থূল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ করে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস বলেছেন, “স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না,পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্বে ।”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

আমি বিবাহ/বিয়ে নামের এই সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখি। আমি হুমায়ুন আজাদের ও এঙ্গেলসের সাথে দ্বিমত পোষণ করি , কিন্তু এঁদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।

রবীন্দ্রনাথ , রুশো-রাসকিনদের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন,ও আরো অনেককে দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্রেম ,কবিতা,সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে চিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

“ রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। ” এতো স্পর্ধিত উচ্চারণ আমি আর কারো মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। সত্যি বলতে কী , এখানে আমি হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্র বিদ্বেষে মর্মাহত ।

প্রেম ও কাম পরস্পরসম্পর্কিত, দুটিই নারীপুরুষের জীবনের বিশেষ পর্বে প্রবলভাবে দেখা দেয়, যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাঁচে না, জীবনে প্রেম অপরিহার্য নয় ; প্রেম বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কোনো নরনারীর জীবনে জোয়ারের মতো দেখা দেয়, তাতে সব কিছু – অধিকাংশ সময় তারা নিজেরাই—ভেসে তলিয়ে যায়; তবে আজীবন মানুষ বাস করে নিষ্প্রেম ভাঁটার মধ্যে। প্রেম তীব্র আবেগ, তা ঝড় জোয়ার বন্যার স্রোত ঘুর্ণির মতোই ; ওগুলোর মতোই প্রেমও দীর্ঘস্থায়ী নয়, এবং বার বার দেখা দিতে পারে। ———-প্রেমের থেকে কামের আশ্লেষের আয়ু অনেক বেশী ; কাম দোলনা থেকে কবর চিতা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অপ্রেম জীবন দশকপরম্পরায় যাপন করে মানুষ, অধিকাংশের জীবনেই কখোনই প্রেমের ছোঁয়া লাগে না ; কিন্তু কামহীন জীবন অসম্ভব। যাদের কাম অচরিতার্থ, যারা সঙ্গী পায় না কামের, তারাও একান্ত কামযাপন করে। প্রেম বলতে গত আড়াইশো বছর ধরে পশ্চিমের পৃথিবী যা বোঝে , এবং পশ্চিম থেকে ঋণ করে আমরা যা বুঝি এক শতাব্দী ধরে, তা রোম্যানটিকদের আবিষ্কার।
পুরোনো পৃথিবীতে প্রেম ছিলোনা ; আজ আছে একটি বড়ো কিংবদন্তি হয়ে। যে- আবেগ প্রেম নামে নরনারীর মনে জেগে ওঠে বিপরীত লিঙ্গের কারো জন্যে, কিশোরতরুণের কাছে যা রক্তমাংসের অনেক ওপরের কোন স্বপ্ন বলে মনে হয়, তা আসলে মাংসের জন্য মাংসের সোনালী ক্ষুধা।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

আমার জন্য বহুশ্রুত, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রায়শঃ বলে থাকেন আমি বহুবার শুনেছি। ‘প্রেম এমনই এক তীব্র আবেগ যা এভারেস্টের চূড়ার মতো; সেখানে একই সময়ে একজনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। একসঙ্গে দুজনের জায়গা হয়না সেখানে!’

বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্য প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হতে বলে সুগৃহিনী ও সুমাতা, তাঁর কাছে দাবী করে সতীত্ব ও পাতিব্রত্য। ————–নারীর গর্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ। নারীকে কি চিরকালই ধারণ করে যেতে হবে গর্ভ, পালন করে যেতে হবে পশুর ভুমিকা? গর্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুর মতো, দৃশ্য হিসাবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। একদিন হয়তো গর্ভধারণ গন্য হবে আদিম ব্যাপার বলে, মানুষ বেছে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায় ; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তাঁর জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গর্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা পেলে আনন্দে তা গ্রহণ করবে ; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। একসময় নিয়ত গর্ভিনী থাকাই ছিল নারীর কাজ ; এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয়নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গর্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ বলে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।
——- নারীর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই। পুরুষ তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

হুমায়ুন আজাদের বিশাল ক্যানভাসের “ নারী ” গ্রন্থটি আমার মোটেও মৌলিক কিছু মনে হয় নি। এটি মূলতঃ নারীবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অসংখ্য গ্রন্থের একটি সম্মীলন । লেখক গ্রন্থপঞ্জীতে প্রায় আড়াইশো বিভিন্ন ভাষার বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, যেগুলো তাঁকে পড়তে হয়েছে, গবেষণা করতে হয়েছে দিনের পর দিন ; এই ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

পুরো গ্রন্থের যে বিশেষ দিকগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছে আমাকে আলোড়িত করেছে আমি তারই পুনরাবৃত্তি করলাম মাত্র।

প্রকাশকালঃ এপ্রিল, ২০১৫

শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার

আহমাদ মোস্তফা কামালঃ —- কিন্তু একজন লেখক হিসাবে বা একজন মানুষ হিসাবে মানুষের জীবনটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

শহীদুল জহিরঃ দার্শনিকভাবে আমি মনে করি, মানুষের জীবন হলো ফলের প্রত্যাশা না করে কাজ করে যাওয়া। কার একটা কাজের ফলাফল কী হবে আপনি তা জানেন না। এটা কোনো ঐশ্বরিক চিন্তা থেকে বলছি না, বলছি বাস্তব চিন্তা থেকেই। হ্যাঁ, নিশ্চিত ফল আপনি পেতে পারেন, যেমন ধরেন, একটা লোককে যদি একটা ঘরের মধ্যে আটকে আমি লাঠি দিয়ে পিটাই তাহলে সে নিশ্চিত মরে যাবে। সেটা আছে। কিন্তু এমনি সাধারণ জীবনে আপনি আসলে কোনো কাজ করে কী ফল লাভ করবেন, তার কিছুই বলা যায় না। ধরেন , আমি লেখাপড়া করছি, এইটা করে কী হবে আমি জানিনা। আমি চাকরি করছি কিন্তু সেটা নিয়ে আমি কত দূর যেতে পারব জানিনা। আমি এখন বেঁচে আছি, কতদিন বেঁচে থাকতে পারবো, জানি না। সর্বত্রই অনিশ্চয়তা। আসলে—আনসারটেইনিটি ইজ লাইফ। আমার এখন সেইরকমই মনে হয়, আগে অত হতো না, এখন মনে হয়। সাহিত্যের একটা ধারা ছিল, মার্ক্সিস্ট ধারা, সেটাতে অনেক ডেফিনিট ওয়েতে বলার ব্যাপার ছিল। জীবনকে জয়ী দেখানো, সমৃদ্ধ দেখানো , বা সম্ভাবনা আছে সেটা দেখানো ইত্যাদি। আমি যে সম্ভাবনা দেখাই না তা না, সঙ্গে ব্যর্থতাও দেখাই। কারণ জীবনের ব্যার্থতাগুলোর মধ্যে সম্ভাবনা থাকে। আমার তো মনে হয় যে , জীবনের ব্যর্থতাগুলোর একধরণের ঐশ্বর্য । এটা দারিদ্র্যকে মহান করার মতো কোনো ব্যাপার না। জয়ী হতে পারলে ভালো, না হতে পারলেও কিছু আসে যায় না। জীবনে কী হবে না হবে কিছুই যেহেতু পরিষ্কার করে বলা যায় না , যেহেতু এই অনিশ্চয়তা নিয়েই জীবন কাটাতে হয়, তাই এই জয়-পরাজয়, সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়গুলো আমার কাছে সমার্থক হয়ে ওঠে।

কামালঃ অনিশ্চয়তাই তাহলে জীবনের মূল কথা।

জহিরঃ হ্যাঁ । অনিশ্চয়তাই মূল ব্যাপার।

(শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার ; ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০০৫)