২০১২ সালের মে মাসে ইউরোপে অফিসের কাজে। বেলজিয়াম (ব্রাসেলস্) থেকে নেদারল্যান্ড যাবো দ্রুতগতির ট্রেনে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আরো দুই কলিগসহ। উপরে রৌদ্রে বেশ গরম লাগছিল। নীচে নেমে খোলা প্ল্যাটফর্মে এসে দেখি বেশ শীত লাগছে। পরনের জ্যাকেটটা খুলে হ্যাভারস্যাক ব্যাগে রেখে দিয়েছি। সেই মুহূর্তে ট্রেন চলে আসলো। জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে স্যাম্পলের লাগেজটা, হ্যান্ড লাগেজটা নিয়ে হুড়োহুড়ি করে ট্রেনে উঠলাম।

ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেক পরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ গা দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমার হ্যাভারস্যাক ব্যাগটা প্লাটফর্মেই ফেলে এসেছি। আমার দুই কলিগের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন ! আমার ব্যাগে আমার পাসপোর্ট ছাড়াও আমার সবেধন নীলমণি অফিসের সব ডাটা ও ই-মেইল সহ নোটবুক আর পুরো ট্রাভেলের রাহা-খরচ হাজার পাঁচেক ইউরো ! ব্যাগের প্রথম জিপারটা খুললেই যে কেউ পেয়ে যাবে টাকার ওয়ালেট আর পাসপোর্ট। নোটবুক বাদ দিচ্ছি, ইউরোর পরিমাণ যা আছে, যে কোন লোককে লোভাতুর করতেই পারে।

প্রথমেই ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলাম , বেলজিয়ামে কেউ পরিচিত আছে কীনা। আগের অফিসের ( মার্কেট ফিট ) পুরানা বস বেলজিয়ামের। ওই অফিসের ফ্রেন্ডরে ফোন দিলে সে নিশ্চয় আমাকে প্রাক্তন বসের নাম্বারটা দিবে। পাসপোর্ট বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়াটা প্রথম জরুরী। আমি সবচেয়ে খারাপ কী কী হতে পারে তাই দিয়ে শুরু করলাম। এটুকু মনে আছে, ব্রাসেলস্ এর ওই প্লাটফর্মে আমি শ’খানেক স্টুডেন্ট দেখেছি। এরিয়াটা বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরা।

কলিগ বলল, ‘জাহিদ ভাই চেকাররে কইয়া দ্যাখেন হে কোন হেল্প করতে পারে কিনা।’
লম্বা চুলের দাড়িওয়ালা এক চেকাররে ধরলাম, বেটা বেলজিয়ান- তেমন ইংরেজিতে পারদর্শী না। তবে সে সমস্যাটা বুঝলো। ওয়ারলেসে আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলল। আমাদের কেনা দূর-যাত্রার টিকিটগুলো যেন ব্যবহার করতে পারি , সেই ব্যবস্থা করলো। উপদেশ দিল, তোমরা সামনের স্টেশনে নেমে গিয়ে আবার পিছনে ব্রাসেলস্ এ ফিরে যাও। আমি স্টেশনমাস্টারকে বলেছি, সে খোঁজ করবে। শুধুমাত্র কপাল ভালো হলেই ব্যাগটা পেতে পারো। এতো ব্যস্ত প্লাটফর্মে তোমার ব্যাগ এতক্ষণ পড়ে থাকার সম্ভাবনা কম।

যতো সময় যাচ্ছে, আমাদের টেনশন ততোই বেড়ে চলেছে।
ঘণ্টা খানেক পরে আমরা ষ্টেশনে ফিরে গেলাম। যে বেঞ্চিতে বসেছিলাম দেখলাম সেটা শূন্য !
লম্বা প্লাটফর্মের মাঝখানে ছোট্ট কাঁচঘেরা রুম থাকে শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য , গার্ডদের বসার জন্য। ষ্টেশন মাস্টারের কাছে যাওয়ার আগে কী মনে করে একবার ঢুঁ মারলাম। দেখি আমার হ্যাভারস্যাক ব্যাগটা পড়ে আছে একপাশে। ভীষণ মোটা গার্ড বেশ কিছুক্ষণ ওদের ভাষায় আমাকে গালাগালি করলো। কিছু যেহেতু বুঝি নাই, গায়ে মাখলাম না। আমি তখন শাব্দিক অর্থেই ‘জানে পানি’ পেয়েছি।

এতো কিছুর পরে আমার দুটো ধারণা হয়েছে, ইউরোপের আইনশৃঙ্খলা ভালো এইটা সবাই জানে। আমার কলিগদের অনেককেই লাগেজ হারানোসহ ছিনতাইয়ের কবলেও পড়েছে। ইস্ট ইউরোপের গরীব দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ বেকারে পশ্চিম ইউরোপের বড় শহরগুলোতে ভরে গেছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ইউরোপিয়ানরা আগের মতো আর গর্ব করে না।
যা বলছিলাম, যেহেতু ওইটা ইউনিভার্সিটি এলাকা এবং শতশত ছেলেমেয়ে যাতায়াত করছে, হয়তো ব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখেও কেউ ধরেনি অন্য কোন স্টুডেন্টের বলে।

আর দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা মনে দাগ কেটেছে তা অন্য কারণে, আমি তেমন ধার্মিক নই। কিন্তু আমার ধার্মিক কলিগ এই দুর্বিষহ দেড় ঘণ্টার মধ্যে কয়েকবার বললো, ‘জাহিদ ভাই, আপনি ভালো মানুষ,আপনি এতো বড়ো বিপদে পড়তেই পারেন না।’

পুরো ঘটনার মধুরেনু সমাপেয়ু হওয়ার পরে সে আমার মনে করিয়ে দিল, ‘কইছিলাম না, আপনি বিপদে পড়তেই পারেন না!’
ভয়াবহ একটা ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে বেসিক্যালি সবাই আমার কাছে ধন্যবাদার্হ ছিলেন, টিকেট চেকার, গার্ড এবং আমার কলিগ দুইজন!

প্রথম প্রকাশঃ ২২শে এপ্রিল ২০১৩