৯১ সালে এসে হঠাৎ করে বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। ঠিক সহজবোধ্য নয় ; কিন্তু আলাদা একটা মধ্যবিত্ত মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর কবিতায়। আমাদের তখন দুর্দমনীয় অস্থির কৈশোর। পড়াশোনায় একবার ভালো করলে যা হয়, গায়ে ‘ভালছাত্র’ লেবেল লেগে গেল তো , জীবন শেষ! যদিও জানি দুইটা রচনা পড়লেই পরীক্ষায় কমন পড়বে ; তবু নিশ্ছিদ্র প্রিপারেশন, সবার আগে থাকার জন্য গুচ্ছের আরো বারো-তেরোটা রচনা পড়রে, আলাদা নোট বানাও রে , উফ !
বিদ্যালয়ের বালিকা শাখাটি রাস্তার ওই পাশে। ‘ভালছাত্র’ লেবেলধারীরা ঘুণাক্ষরেও ওমুখো হতাম না। কোনক্রমে আমাদের বালক শাখার কোন শিক্ষকের চোখে যদি পড়ে যাই, লজ্জার সীমা থাকবে না। সুতরাং সাদা পোশাকের সেই কিশোরীরা আমার চোখের আড়ালেই কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে গেল। ওই কিশোরীদের কেউ কেউ , যখন চল্লিশোর্ধ ‘ভদ্রমহিলা’আমার সঙ্গে তাঁদের নতুন করে পরিচয় হল স্কুল রি-ইউনিয়নে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে। চল্লিশোর্ধা কাউকে দেখে তো আর বলা যায় না, “ তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , ‘ এতোদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”
মূল কবিতার প্রসঙ্গে আসি। অস্থিরতা, পড়াশোনার চাপ, বাবা-মা-সমাজের এক্সপেক্টেশনে আমাদের কয়েকজনের অবস্থা চিঁড়েচ্যাপটা! একে নবযৌবনের উদ্গমে আমাদের অবস্থা নাজুক ; এর মাঝখানে চারিদিকের ওই ঐশ্বরিক স্বর্গের কিশোরীদের আমাদের সামনে দিয়ে যাতায়াত ! ‘জীবন’ যতোখানি রহস্যময়, আমারতো মনে হয় যৌবন তার চেয়েও ক্ষণস্থায়ী ও রহস্যময়।
বুদ্ধদেবের “প্রেমিক”কবিতাকে আমার চিরন্তন মনে হয়েছে আজ নতুন করে পড়ে। সেই সময়ে কেন ভাল লাগল? কারণ ওই অস্থির বৈপিরত্যে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করছে স্বর্গীয় কিশোরীদের অথচ সামাজিক অনুশাসন আমাকে রাখছে সেই ঐশ্বরিক অনুভূতি থেকে লক্ষ মাইল দূরে। তাই দূরে থাকার জন্য , ভেবে নিলাম নারী হোক কিশোরী হোক –“ , তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –” । ওটা ছিল একধরণের সামাজিক অবদমন। আমার চির আকাঙ্ক্ষিতকে “ আঙ্গুর ফল টক” ভেবে দূরে থাকা আর কী !
আজ বহুদিন পরে সকালে আবার সেই কবিতার মুখোমুখি। এবার পরিপূর্ণ রূপে ধরা পড়ল বুদ্ধদেবের চিরন্তন বক্তব্যকে। হায় ! আমি যতো দূরেই যাই, নারীর সেই রহস্যময়তাকে অবহেলা করার মতো ক্ষমতা প্রকৃতি আমাকে দেয় নি। আমাকে/আমাদেরকে বার বার ফিরে আসতে হয় সেই ননীর মতো তনুর কাছে !
পুরো কবিতা অনুলিখন করার মতো ধৈর্য হচ্ছে না। প্রিয় লাইনগুলো পূনর্লিখন করছি। বাকীটা উৎসাহীদের জন্য ছবি আকারে রইল। উল্লেখ্য, কবিতার রচনাকাল ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ।
“প্রেমিক।। বুদ্ধদেব বসু।”
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি, তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে কুৎসিত কঙ্কাল –
(ওগো কঙ্কাবতী)
মৃত-পীত বর্ণ তারঃ খড়ির মত সাদা শুষ্ক অস্থিশ্রেণী –
জানি, সে কিসের মূর্তি ।নিঃশব্দ বীভৎস এক রুক্ষ অট্টহাসি-
নিদারুণ দন্তহীন বিভীষিকা ।
নতুন ননীর মতো তনু তব? জানি তার ভিত্তিমূলে রহিয়াছে সেই কঠিন কাঠামো;
হরিণ-শিশুর মতো, করুণ আঁখির অন্তরালে
ব্যাধিগ্রস্থ উন্মাদের দুঃস্বপ্ন যেমন।
তবু ভালোবাসি।
নতুব ননীর মতো তব তনু খানি
স্পর্শিতে অগাধ সাধ, সাহস না পাই।
সিন্ধুগর্ভে ফোটে যত আশ্চর্য, কুসুম
তার মতো তব মুখ, তার পানে তাকাবার ছল
খুঁজে নাহি পাই।
মনে করি, কথা ক’ব আকুলিবিকুলি করে কত কথা রক্তের ঘুর্ণিতে;
(ওগো কঙ্কাবতী!)
বারেক তাকাই যদি তব মুখ-পানে,
পৃথিবী টলিয়া ওঠে, কথাগুলি কোথায় হারায়,
খুঁজে নাহি পাই।
দুর থেকে দেখে তাই ফিরে যাই; (যদি কাছে আসি, তব রুপ অটুট রবে কি?)
ফিরে চলে যাই।
দুর থেকে ভালোবাসি দেহখানি তব-
রাতের ধূসর মাঠে নিরিবিলি বটের পাতারা
টিপটাপ শিশিরের ঝরাটুকু
যেমন নীরবে ভালোবাসে।
________________________
জানি, তুমি ভুলে যাবে সে-উৎকন্ঠা সে- বেদনা, সেই ভালেবাসা
প্রথম শিশুর জন্মদিনে।
তোমার যে-স্তনরেখা বঙ্কিম, মসৃণ, ক্ষীণ, সততস্পন্দিত-
দেখেছি অস্পষ্টতম আমি শুধু আভাস যাহার,
যাহার ঈষৎ স্পর্শ আনন্দে করেছে মোরে উন্মাদ- উন্মাদ,
জানি, তাহা স্ফীত হবে সদ্যেজাত অধরের শোষণ-তিয়াষে।
আমারে করিতে, মুগ্ধ যে- সুসুগ্ধি সুষমায় আপনারে সাজাতে সর্বদা,
তোমার যে- সৌন্দর্যরে ভালোবাসি (তোমারে তো নয়!),
জানি, তা ফেলিয়া দেবে অঙ্গ হতে টেনে-
কারণ, তখন তব জীবনের ছাঁচ
চিরতরে গড়া হয়ে গেছে;
কিছুতেই হবে নাকো তার আর কোনো ব্যতিক্রম।
________________________
তোমার বাদামি চোখ- চকচকে, হালকা, চটুল
তাই ভালোবাসি।
তোমার লালচে চুল –এলোমেলো , শুকনো , নরম
তাই ভালোবাসি।
সেই চুল, সেই চোখ, তাহারা আমার কাছে অরণ্য গভীর,
সেথা আমি পথ খুঁজে নাহি পাই,
নিজেরে হারায়ে ফেলি সেই চোখে, সেই চুলে- লালচে বাদামি,
নিজের ভুলিয়া যাই, আমারে হারাই-
তাই ভালোবাসি।
আর আমি ভালোবাসি নতুন ননীর মতো তনুলতা তব,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
আর আমি ভালোবাসি তোমার বাসনা মোরে ভালোবাসিবার,
(ওগো কঙ্কাবতী!)
ওগো কঙ্কাবতী!
[ প্রথম প্রকাশ ১৪ই নভেম্বর ২০১৬]