আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও জনগণ।

আমার গার্মেন্টস চাকরীর প্রথমদিকে। ক্লিনটন সাহেব আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
মনিকা লিউন্সকির ওরালসেক্স নিয়া রীতিমত ইম্পিচমেন্টের অবস্থায় ক্লিনটন।
আমেরিকান এক ক্রেতা বন্ধুকে বললাম, ‘তোমাদের চেয়ে ভণ্ড জাতি দুনিয়াতে আরেকটা নাই।’
সে বলল, ‘কেন ?’
‘তোমরা ফ্রি সেক্সের দেশে গে ,লেসবিয়ান, অ্যানিম্যাল , ওরাল, অ্যানাল কিছুই বাদ দেও না। আর বেচারা ক্লিনটন সামান্য এক ওরালসেক্স কেসে চাকরিটা হারায় হারায় !’

উল্লেখ্য, তখন আমার এই ইয়ং ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্টকে বেশ ভালো লাগতো। যুদ্ধবাজ বুশের জায়গায় সে আসাতে আমাদের প্রজন্ম খুশিই ছিলাম।
আমেরিকান বন্ধু বলল, ‘ তোমাকে একটু বুঝিয়ে বলি। আমার ধারনা তুমি ব্যাপারটা বুঝবে।’
‘শোন জাহিদ, ধরো তুমি ব্যক্তিজীবনে উচ্ছৃঙ্খল, অনাচারী, বহুগামী, লম্পট , মাতাল অনেক কিছুই হতে পারো। তোমার পথের পথিক যারা, আশপাশের সবাইকে তুমি অবলীলায় মেনেও নিতে পারো।
কিন্তু, ধরো তোমার বাবা যিনি তোমার শ্রদ্ধার জায়গায়, তিনি যদি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তোমার সামনে লম্পটগিরি করে, পারবে মেনে নিতে ? আমরা আমেরিকানরা নিজেরা যতোই ভণ্ডামি যতই করি না কেন , প্রেসিডেন্টকে আমরা পিতার মতো দেখি। তাঁর সামান্য স্খলনও আমরা মেনে নিতে পারি না। ’
আমি আমার উত্তর পেয়ে গেলাম।

প্রথম প্রকাশঃ ২রা এপ্রিল ২০১৩

বাংলাদেশের ধনী: অবদান ও সমালোচনা

রচনার সারসংক্ষেপ:

‘বাংলাদেশের ধনী: অবদান ও সমালোচনা’ প্রবন্ধে গত কয়েক শতাব্দী আগে থেকে শুরু করে ১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের ধনী ও দরিদ্রশ্রেণির অভ্যুদয় ও পারস্পরিক বিবর্তনের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

বিদেশি পর্যটক, ঐতিহাসিক ও পরিব্রাজকদের চোখে পূর্ব বাংলার যে চিত্র ইতিহাসে দেখা যায়, সেখানে নানা অসঙ্গতি আছে। অবিরাম দারিদ্র্যের পাশাপাশি পূর্ব বাংলা স্থানীয় আকাল, খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়েছে বারবার। ইতিহাসের কয়েক পর্যায়ে ধনীদের অভ্যুদয়, কর্মযজ্ঞ , অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে অবদান ও সামাজিক মানবিক ক্ষেত্রে নিশ্চেষ্ট থাকার সমালোচনা -পর্যালোচনা পাঠককে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের আগের পূর্ব বাংলা, সর্বভারতে তার বাণিজ্যিক অবস্থান। মুঘল আমলে নৌবাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচিতি, রপ্তানিবাণিজ্যে মুনাফা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পুঁজির অনুপ্রবেশ। ভূস্বামী ও সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী প্রথার আবির্ভাব। পাটের স্বর্ণযুগে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল মুৎসুদ্দিদের পুঁজির আবির্ভাব। ৪৭ এর দেশভাগের পরে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে বড় একটা পুঁজির পশ্চিমবঙ্গে প্রস্থানে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজির সংকট। সেই সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানী অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের পূর্ব বাংলায় অনুপ্রবেশ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বিমাতাসুলভ আচরণে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকারে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতায়, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রও সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূলে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কলকারখানার সিদ্ধান্তে ব্যক্তি পর্যায়ে ধনী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রাদুর্ভাব। পরের দশকগুলোতে বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাংক-নির্ভর আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় নব্যধনীদের উত্থান। আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পের শুরু। ব্যবসায়িক পরিবার ও সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন ধনীদের পাশাপাশি একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিশাল এক শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণির অভ্যুদয়। বিরামহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক শাসনে জর্জরিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অনুপ্রবেশ। আমলাতান্ত্রিক দুর্বল রাষ্ট্র, প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির দুর্ভেদ্য চক্র গড়ে ওঠা। কর্মসংস্থানের ফলে একটা উদীয়মান জাতির কর্মক্ষমতা বেড়েছে, গার্মেন্টস সেক্টরের প্রসারে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বেড়েছে। শিল্পোদ্যোক্তা এই ধনীদের অবদানে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু সামাজিক ও মানবিকক্ষেত্রে এঁদের অবদান অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এবং অকিঞ্চিৎকর।

মূল প্রবন্ধ:

পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব বাংলা, পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে গত দুইশ বছরে ধনীরা বাইরে থেকে এসেছে । আর্মেনীয় থেকে শুরু করে ইংরেজ, মাড়োয়ারী, বোম্বাইয়া বা পাকিস্তানী । খুব সামান্য অংশ থিতু হয়েছে, বেশির ভাগই চলে গিয়েছে। খাঁটি স্বদেশী ধনীদের অভ্যুদয় স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে।

প্রবন্ধে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী ধনীরা আকাঙ্ক্ষিত আলোচ্য হলেও ইতিহাসের ধারাবাহিকতার স্বার্থে অনুক্রম বিবেচনায় চলে আসে। প্রবন্ধে ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে অধিক পরিচিত ‘পূর্ব বাংলা’ব্যবহার করা হয়েছে।

ভারতীয় ঐতিহাসিকদের চোখে দেখা বাংলার সঙ্গে বিদেশি পর্যটকের দেখার পার্থক্য ছিল। তাদের চোখে সোনার বাংলা ছিল সুজলা,সুফলা , শস্যশ্যামলা। চৌদ্দ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা কিংবা চীনা পরিব্রাজক ওয়াং তু ওয়ান সবাই বাংলায় সস্তা দ্রব্যমূল্যের কথা বলেছেন, সমৃদ্ধ জীবনের কথা বলেছেন। এঁদের পর্যবেক্ষণে বাংলায় কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের সস্তামূল্য বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রমাণ। কিন্তু অর্থনীতির সূক্ষ্ণ মারপ্যাঁচে একটি দেশের দ্রব্যমূল্য অন্য দেশের চেয়ে সস্তা হতে পারে, কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থেকে যায়। বস্ত্রের মূল্য সস্তা হলে সেখানে তাঁতির মজুরি কম হয়। কৃষিপণ্যের মূল্য সস্তা হলে শ্রমিকের মজুরি কম হয়। আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিকভাবে একটা দেশ সমৃদ্ধ মনে হলেই সেখানে দারিদ্র পুরোপুরি দূরীভূত হয় না, যদি না সম্পদের সুষম বণ্টন না হয়। ধনী দেশেও দারিদ্র্যের সুযোগ থাকে।আমাদের বাংলায় ধনী দরিদ্র্যের প্রকট বৈষম্য গত কয়েকশ বছরের ধারাবাহিকতা।

সর্বভারতে বাংলাদেশের পণ্যের সুনাম ছিল। বাংলার মসলিন ও বস্ত্র সারা ভারতেই যেতো। নৌপথে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া শ্রেষ্ঠ অবদান রাখে পর্তুগীজরা ষোলশ শতকের শেষের দিকে। কিন্তু কিছুদিন গেলেই দেখা যায় বাণিজ্যের চেয়ে এরা জলপথে দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। এরপরে আসে ওলন্দাজরা। ওলন্দাজদের রপ্তানি বাণিজ্যে শরিক হয় ফরাসী, ইংরেজ, ওস্টেন্ডার ( বেলজিয়ান) সহ বহু ইউরোপিয়ান নৌ-জাতি। এছাড়াও ছিল দিনেমার, আর্মেনীয়, হিন্দুস্থানি, মাড়োয়ারী, তামিলরা।

নৌবাণিজ্যের সুবাদে ও মুঘল আমলের আঠারো শতকে আমির-ওমরাহ, জমিদার শ্রেণির বাইরে আরেকটি শ্রেণি প্রভূত ধনসম্পদ অর্জন করে। মূলত বিদেশি বণিকদের সহায়তাকারী হিসাবে দেশীয় দালাল-মুৎসুদ্দির একটা ধনী শ্রেণি গড়ে ওঠে। বিদেশীরা এদেরকে বলত বেনিয়া। বেনিয়ারা ছাড়াও হাট-বাজার পর্যায়ে কয়েক শ্রেণির দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ছিল। লক্ষণীয় যে, এই রপ্তানি বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত মুনাফা দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপরে কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি ; যদিও এই মুনাফার উপর ভর করে কিন্তু শহরভিত্তিক একটা বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শ্রেণি তৈরি হয়েছিল।

১৭৯০ সালের দশকে ইউরোপে বিদ্যমান নেপোলীয়নীয় যুদ্ধের দামামায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপড়েনে বাংলার রপ্তানীবাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮১৩ সালে অবাধ বাণিজ্যনীতিতে বাংলার বস্ত্ররপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮২০ এর দশকে ইউরোপ থেকে বস্ত্র আমদানি শুরু হয়। খুব স্বল্প সময়ের এই রপ্তানি পতনে তাঁত শিল্পের সঙ্গের জড়িত তাঁতি সম্প্রদায় ছাড়াও বেনিয়া , আড়তদার, পাইকাররা বেকার হয়ে পড়ে।

এ সময়ে রপ্তানিবাণিজ্য থেকে যে বিপুল অর্থ বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল, সেই পুঁজি চলে আসে ভূমি নিয়ন্ত্রণে। নবাগত ভূস্বামী ও জমিদার শ্রেণিটি তাদের অর্জিত পুঁজির সামান্য অংশ ব্যয় করেছিলেন ভূমিক্রয়ে বাকী পুঁজি উজাড় হয়েছে রাজ্যের অনুৎপাদনশীল খাতে, যেমন বিবাহ, শ্রাদ্ধ, পূজা-পার্বণ, মন্দির, ঘাট, পুকুর , প্রাসাদ প্রভৃতি নির্মাণে। পুঁজির আরেক অংশ চলে আসে মহাজনী ঋণদান ও শস্যব্যবসায়।

বাংলার তৎকালীন অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে সবচেয়ে বড় যে সত্যটি আবিষ্কার করি আমরা , সেই সময়ের ধনীদের মনোভাব ছিল সামন্তবাদী, পুঁজিবাদীদের মতো নয়।

সমান্তরালভাবে , আঠারোশ শতকের শুরুতে তুলার চাহিদা হ্রাস পাওয়া শুরু করলে তার জায়গা নেয় নীলচাষ। আবার ১৮৫০ সালের দিকে কমতে থাকে নীলের চাহিদা। নীলচাষীদের সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে ইউরোপীয় নীলকরেরা বিনিয়োগ তুলে নেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাটচাষ নগণ্য ছিল। ব্যাপকহারে পাটচাষ এবং পাট-আঁশের বাণিজ্যিকিকরণ শুরু হয়ে ১৮৭০ এর দশকে। এই সময় থেকে শুরু করে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত পাটের স্বর্ণযুগ। ১৯৩০ এর বিশ্বমন্দাতে পাটের বাজার পুরোপুরি ধ্বসে পড়ে।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও আধুনিক পুঁজিবাদের চাপে বাংলার অর্থনীতি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। এক বিকৃত ঔপনিবেশিক অর্থনীতি তৈরি হয়, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্থবিরতা, দারিদ্র, বৈষম্য , ঘনঘন দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা। এই অর্থনীতিই ছিল পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাধিকার। এর সঙ্গে যুক্ত হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ কেন্দ্রীয় নীতি। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি হিসাবে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ১৯ লক্ষ্য ৩২ হাজার। এর মাঝে ৬৪টি মহকুমা শহরের অধিবাসী ছিল মাত্র ১৮ লক্ষ ২০ হাজার। শহরের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪.৩ শতাংশ ; মূলত তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পূর্ব বাংলায় খাজনাভোগী কাঠামো গড়ে ওঠে। ছোট আকারের ভূসম্পত্তির মালিক ও একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি , যারা অবাণিজ্যিক পেশায় নিয়োজিত হয়। একই পরিবারে খাজনাভোগী জমিদার ও চাকুরীজীবী উভয় ভূমিকায় থাকতে দেখা যায়।

দেশভাগের পরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বুর্জোয়া হিসাবে মুসলমানেরা ছিল অত্যল্প। এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্ট সামাজিক উৎপাদনে শ্রমবিভাগেরই ফল। বাঙালি মুসলমান ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের ধারক ও বাহক। আর বাঙালি হিন্দুরাই মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য , মহাজনী কারবার নিয়ন্ত্রণ করত। এমনকি ছোট ছোট শিল্পোৎপাদনেও এঁদের দখল বেশি ছিল। দেশভাগের পরে বহুসংখ্যক হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিপুল অর্থসম্পদসহ দেশত্যাগের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি বুর্জোয়াদের অবস্থান শূন্যতা তৈরি হয়। ১৯৪৭ থেকে ৫১ সালে এই শূন্যতার সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানি বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোগীরা এবং প্রবল সহযোগী হিসাবে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো জেঁকে বসে।

সর্বভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানে যে শিল্পায়ন হয় তার সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক। সমগ্র পাকিস্তানে এ সময় একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবারের জন্ম হয়। ১৯৬২ সালে সারা পাকিস্তানের ব্যক্তিমালিকানাধীন ফার্মের অধীনে মোট যতো সম্পদ ছিল তার ৭৩ শতাংশ ছিল ৪৩টি পরিবারের দখলে। এই ৪৩টি পরিবারের মধ্যে একটি মাত্র পরিবার ছিল বাঙালি – জনাব এ,কে, খানের পরিবার।

দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় ব্যবসায়িক ও লগ্নি পুঁজিকেই কৃষিতে মূলধন সঞ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে ধরা হয়। যদিও এখান থেকে মুনাফার সামান্য অংশই উৎপাদনে পুনঃ বিনিয়োগ করা হোত। সংগঠিত কৃষিঋণ অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় ছিল, কারণ প্রচলিত কৃষি আইনে জমি হস্তান্তর বা খণ্ডকরণের সীমাবদ্ধতার জন্য ঋণদানকারী সংস্থাগুলো জমি বন্ধক রেখে ঋণদানে আগ্রহ দেখাতো না। ফলে মহাজনী ঋণের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হত কৃষক। ঋণদাতা জমির স্বত্ব লাভ করে, অনেক সময় বন্ধকী জমির ফসল থেকেই ঋণ শোধ হয়ে গেলে, মূল মালিকের কাছে জমি ফেরত যায়। আবার জমির মালিকের অধীনে চাষবাস হয়, উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ঋণদাতাকে ঋণ কিস্তি হিসাবে দিতে হয়। মহাজনী ঋণ পাওয়ার জন্য কৃষক যে কোন শর্তেই রাজি হতে বাধ্য থাকত। আর ঋণের বেশিরভাগ অংশই ব্যয়িত হতো, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, কাপড়-চোপড়, ওষুধপত্রের মতো অত্যাবশ্যকীয় কাজে। যে কাজের জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছে, হালের বলদ, বীজ, সার তার জন্য সামান্য অংশই অবশিষ্ট থাকত। এই দুষ্টচক্রে পড়ে কৃষক ভূমিহীন হতো। ভূস্বামী মহাজনেরাও জমিতে অর্থ না খাটিয়ে নগদ ঋণদানেই আগ্রহী ছিল। জরিপে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে ৬৬ থেকে ৮৭% পরিবারই ঋণগ্রস্ত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের তুলনায় উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সারের ব্যবহারে পিছিয়ে থাকায় জমির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল অনেক কম। জমির স্বল্পতা ও বিক্ষিপ্ত অবস্থান পুরো কৃষি উৎপাদনের চক্রকে অনাধুনিক করে রেখেছিল।

পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক পরিবারের ধনী হওয়ার মূল বাসনা ছিল সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা। ধন-সম্পদ, পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান , উচ্চবংশে বৈবাহিক আত্মীয়তা সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। সঞ্চিত অর্থে জমি কিনে মর্যাদা বৃদ্ধির একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল সমাজে। আবার জমির পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক সচ্ছলতার উৎস হিসাবে দ্বিতীয় প্রধান সম্পদ ধরা হয় শিক্ষাকে। শিক্ষিত লোক স্থানীয় প্রশাসনে, শহরে চাকরি করে পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি করে।

দেশভাগের আগে সম্পদের বড়ো একটা অংশ ছিল হিন্দু জমিদার ও ধনিক শ্রেণির হাতে। হিন্দু ধনীদের পারলৌকিকতার চর্চা ছিল, পূজা পার্বনে দেখনদারি ও অনর্থক অপচয় ছিল। কিন্তু যেহেতু মুসলমানদের আগেই আধুনিক অগ্রসর চিন্তার সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছে সেই ১৮শ শতকের শুরুতেই, তাই পারলৌকিকতার বাইরেও তাঁদের সমাজের আধুনিক শিক্ষা, চিকিৎসায় দীর্ঘমেয়াদি । মুসলমান ধনী শ্রেণির হাতে নানা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পয়সা আসলেও সেটা তাদের অনগ্রসর মাদ্রাসা শিক্ষা এবং নয়নমনোহর মসজিদ তৈরিতে ব্যয়িত হয়েছে। পুর্ব বঙ্গের নানা ধরণের আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়ের পুরোটাই বলতে গেলে কয়েক শতাব্দী ধরে হিন্দু ধনী শ্রেণির করা। মুসলমান ধনী শ্রেণি যারা অধুনা বাংলাদেশের পরিচালনায় আছেন, মূলতঃ তারা সেই আগের শতাব্দীর পিতামহদের ধারা পালন করে যাচ্ছেন।

চৌধুরীদের গ্রামে মসজিদ আছে, মক্তব আছে, খোন্দকারদের সেটা ভালো লাগে না। একই গ্রাম ১০০ গজের ভিতরে আরেকটি সুদৃশ্য মসজিদ ও তাঁর সংলগ্ন মাদ্রাসা । অথচ নারী শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। দূর উপজেলার বাইরে আছে সরকারী চিকিৎসালয়। সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। এ এক অদ্ভুত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দ্যোতনার ভিতরে দিয়ে বাঙালি মুসলমানের হিসাব নিকাশ চলে।

দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার উৎপন্ন পাট কোলকাতার পাটকলে রপ্তানি হওয়ার যে নিয়ম প্রচলিত ছিল তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। সরকার নির্ধারিত পাটের ক্রয়মূল্যের চেয়ে রপ্তানিতে লাভ বেশি হয়, মুনাফা বাড়ে। পাটশিল্পের বড় ধরণের পুঁজি বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল যেমন আদমজি, বাওয়ানি, ইস্পাহানি। ‘ক্রিসেন্ট জুট মিলস লি ‘ এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল র‍্যালি ব্রাদার্স ও ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের খোজা গোষ্ঠী। শুরু থেকেই মুসলিম মেমন সম্প্রদায় ( আদমজি , বাওয়ানি) এবং ইসমাইলিয়া খোজা প্রধান পাট রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগকারি হিসাবে দেখা দেয়।

পূর্ববাংলা এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় শিল্পশক্তি ও অবকাঠামোতে পিছিয়ে ছিল। ব্যাংকিং ছিল অনুন্নত। দেশভাগের আগে পাকিস্তান ভূখণ্ডে ৪৮৭টি ব্যাংকের শাখা ছিল , সেটা কমে ৬৯টিতে দাঁড়ায়। হিন্দু ব্যাংক মালিকদের দেশত্যাগের ফলেই এটা হয়। শূন্যতা পূরণ হয় পাকিস্তানের তিনটি ব্যাংকের কার্যক্রমে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, ‘হাবিব ব্যাংক’, ‘মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক’, ও ‘স্টেট ব্যাংক’ । যদিও প্রত্যেকটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরে শিল্পোৎপাদন, যোগাযোগ ও পরিবহন, বৈদ্যুতিক শক্তি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রধান অংশই যে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তাই নয়, দেশের উচ্চতর বেসামরিক প্রশাসনের (Civil Administration ) পুরোটাই ছিল সেখানে। পূর্ববাংলার সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের প্রশাসনের সকল দায়িত্বশীল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারী নিয়োগ করে।

দেশভাগের পরেও পূর্ব বাংলার পুঁজির শতকরা ১৫ ভাগের মালিকানা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। ১৯৫৬ সাল পর্যন্তও কয়েকটি বৃহৎ কাপড়ের মিল, একমাত্র সিমেন্ট কারখানা, ১৭টি চা বাগান, কয়েকটি ব্যাংক হিন্দু মালিকানাধীন ছিল। কোন কোন তথ্যমতে, ৫০টির ও বেশি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান, ২০০ অন্যান্য ব্যবসা হিন্দু মালিকানাধীন ছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে প্রাদেশিক সরকার সেগুলো কুক্ষিগত করে।

মূলত: পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের শুরুর দিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই ছিল দেশের অর্থনৈতিক উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেই উদ্যোগ আবার পরিচালিত হতো প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিকাশেই। যেহেতু ১৯৪৭ এর পরে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ভিত্তি ছিল অনেক শক্তিশালী, পূর্ববাংলার তুলনায় শিল্পোৎপাদন, বৃহৎ পুঁজি, অবকাঠামো, বাজেটের সিংহভাগ আঞ্চলিক বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। কারণ এখানে মুদ্রা সঞ্চয় এবং পুঁজি বিনিয়োগ দুই ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়ে থাকে। জমির স্বল্পতা এবং শিল্পাঞ্চলে তার উচ্চমূল্য পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সেই দিকে বেশির ভাগ বাঙালি পুঁজিপতিই ছিল ছোট বা মাঝারি। অনগ্রসর অর্থনৈতিক কাঠামোতে সঞ্চয়ের সিংহভাগ আসতো কৃষিখাত এবং ক্ষুদ্র শিল্পখাত থেকে।

১৯৫০-৫২ সালের কোরিয়া যুদ্ধে পাট ও পাটজাত পণ্যের ভারতমুখী প্রবণতা কমে বিদেশি বাজারে চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে পাকিস্তানের পাট ও তুলার রপ্তানিবাজারের আকাল দেখা দেয়। কাঁচামালের দাম যায় কমে। এর মাঝে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে ৩৬টি নতুন পাটকল স্থাপিত হয়, কাঁচামাল হিসাবে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পাটের উৎপাদন ৬৫০ হাজার টনের মধ্যে রয়ে যায়। ফলে আভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রাধান্য দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাটবাজারের বিশ্ববাজার হারায়। সামগ্রিকভাবে পূর্বপাকিস্তানের নির্ভরতা এমন ছিল যে, পাটকলের যন্ত্রাংশ বড় কারখানাগুলোর মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে তৈরি হতো। আদমজি পাটকল, প্লাটিনাম জুবিলি এবং আরো কয়েকটি পাটকলের এ ধরণের ওয়ার্কশপ ছিল, কিন্তু কারখানাগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি বুর্জোয়ারা। সাধারণ বয়নশিল্প ব টেক্সটাইল শিল্পেরও একই অবস্থা , যন্ত্রাংশ নির্মাণের দশটি কারখানার আটটিই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে।

আদমজি, বাওয়ানি, ইস্পাহানি, আমিন গ্রুপ , খোজা ইসমাইলিরা ছাড়াও হাবিব পরিবার, দাউদ পরিবার, দাদা পরিবার, সায়গল পরিবার, মোহাম্মদ বশীর পরিবার, কলোনি গ্রুপ , নবাব হেতি পরিবার, মাওলা বক্স পরিবার, সাত্তার পরিবার। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আরো উল্লেখযোগ্য গ্রুপ গুলো হচ্ছে, রশিদ এজেন্সিজ, গুল এজেন্সিজ ও গ্লোব এজেন্সিজ নামের পশ্চিম পাকিস্তানি কোম্পানির সম্মিলিত গ্রুপ।

বেশির ভাগ অবাঙালি মালিকই ছিল কতগুলো সীমাবদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য যা গড়ে উঠেছিল পারিবারিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। এরা হলো গুজরাটি সম্প্রদায়, মেমন , খোজা ইসমাইলি,পাঞ্জাবি সম্প্রদায়, চিনিয়ট শেখ, বোহরা, পিরাঞ্চা প্রমুখ। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প বাণিজ্যের একটা বড় অংশ একেকজন পৃথক শিল্পপতি বা পরিবারের হাতে আসার মাধ্যমে সম্প্রদায়গত ভাবে অবাঙালি পুঁজিপতিদের ক্ষমতা পূর্ব বাংলার অর্থনীতিতে অনেক বেড়ে যায়। মেমন সম্প্রদায়ের সদস্যরাই অবাঙালি পুঁজিপতিদের মধ্যে সংখ্যায় বেশি এবং অধিকতর প্রভাবশালী ছিল। মেমনদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ এবং কমপক্ষে তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক এরকম যেসব পরিবারের নাম করা যায় তারা হলো দাদাভাই, বাবা, দাদা, বেঙ্গলি, দাগিয়া, তার মোহাম্মদ, জানু, হাশিম, তাবান, এলাহি, দিনার , দোসা, জিজি, গনি, মোহাম্মদ সেলিম এবং আরো অনেকে।

খোজা ইসমাইলিদের কিছু পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে এক পর্যায়ে বৃহৎ শিল্পপরিবার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, এদের কয়েকটি হলো, মোহাম্মদ আলী মেঘানা, সালেহ ম্যানেজমেন্ট, বরকত আলী পরিবার, আমলানি বরলাপ, আকবর আলী আফ্রিকাওয়ালা, স্টার গ্রুপ। এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ও বড় অংশের মালিকানা ছিল, এদের ইমাম প্রিন্স করিম আগা খান।

ধনী বাঙালি বুর্জোয়াদের উদ্ভব ছিল অসম প্রতিযোগিতায়। পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজিপতিদের তুলনায় বাঙালি মুসলমান বুর্জোয়ারা সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবে বাঙালি বুর্জোয়ারা পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহী ছিল না। এরা ব্যবসায়ের মধ্যস্থতা, সুদের কারবার ও জমির মালিকানাকেই প্রাধান্য দিত। যৎসামান্য বাঙালি বুর্জোয়াদের অধিকাংশই ছিল শিল্প-বাণিজ্য বুর্জোয়া। সামান্য কিছু শিল্পোৎপাদনে তারা জড়িত ছিল মূলত পাট, সুতা-বস্ত্র, কাগজ, ইট ও দিয়াশলাই এর মতো শিল্পে সীমাবদ্ধ। যেমন ১৯৭১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাঙালি মালিকানাধীন ৩৪ টি পাটকলের ২৮টিই কাজ শুরু করেছিল ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। এবং মালিকানার অংশীদার বাঙালি মালিকদের অভিজ্ঞতা ছিল কম, এরা পূর্বে কোন শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল না।

ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের পুঁজি দিয়ে তারা শিল্পে অংশগ্রহণ করত না বললেই চলে। এ ধরণের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো হয় সরকারী কর্পোরেশনের অধীনে ছিল, অথবা গুটিকয়েক অবাঙালি পরিবারের মালিকানাধীন। বাঙালিদের বিনিয়োগের অধিকাংশই ছিল ঋণপুঁজি। অংশীদারিত্বের মোট মূল্যের ৬০ শতাংশই ছিল ঋণ পুঁজি। ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটা এলিট শ্রেণি তৈরির নীতি কাজ করতে শুরু করে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে শুধু ২২ পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বৃহৎ ব্যবসায়ের সংস্পর্শে আসা প্রায় অসম্ভব ছিল।

১৯৭১ সালের জরিপ অনুযায়ী বস্ত্রশিল্পে ৪৫টি চালু শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি ছিল বাঙালি অংশীদারিত্বের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এ.কে খান ; ইসলাম ব্রাদার্স, আফিল, ফকিরচান্দ, হাওলাদার, বি রহমান, রহমান-কাউয়ুম, সাত্তার, আলহাজ মুসলিমউদ্দিন ও ফিল্স্ মাশরিকি।

লক্ষণীয় , বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণের প্রচুর ব্যবহার তাদেরকে অবশ্যম্ভাবী ঋণীতে পর্যবসিত করেছে। অধিকাংশ বাঙালি কোম্পানি বা গ্রুপের অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের সক্রিয় পুঁজির সামষ্টিক বিচারে যা মনে হতো, বাস্তবিকপক্ষে তা ছিল তার থেকে অনেক কম। আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে আমাদের শিল্পপতিরা।

পূর্ব বাংলা এই উপমহাদেশের মূল অর্থনৈতিক বিকাশে সবসময় আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তান হওয়ার পরে বৈষম্য প্রকট হয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের স্বেচ্ছাচারিতা ও নিয়ন্ত্রণহীণতা।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার আরেকটি কারণ ছিল, এই প্রদেশে ব্যক্তি পর্যায়ের পুঁজির বিকাশের দুর্বল অবস্থা। উল্টোদিকে পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়েছিল তার অভিজ্ঞ ব্যক্তিগত খাতের উদ্যোগ ও উঁচু প্রবৃদ্ধির হারের জন্য।

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতে কৃষিই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল খাত। জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশই বসবাস করতো গ্রামে। কর্মক্ষম জনশক্তির ৮০ ভাগ নিয়োজিত ছিল কৃষিকাজে। আর মোট জাতীয় উৎপাদনের ৫৫ ভাগই উৎপাদন করতো তারা। যে টুকু মূলধন সঞ্চিত হতো সেটা কৃষিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, এ,কে,খান ( আবুল কাশেম খান) ; ইসলাম গ্রুপ ( জহুরুল ইসলাম) ; ভুঁইয়া বাঁ গাওসিয়া গ্রুপ ( আলহাজ গুলবক্স ভুঁইয়া ) ; রহমান কাইউম গ্রুপ ( মকবুল রহমান, কাজী জহিরুল কাইউম); ফকির চাঁদ গ্রুপ ( আলহাজ মোহাম্মদ ফকির চাঁদ ), আলহাজ মুসলিমউদ্দিন গ্রুপ , নর্দান পিপলস , আফিল গ্রুপ, রহমান ব্রাদার্স, সাত্তার গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, ভাণ্ডারি গ্রুপ, ডেলটা , সবদার আলী, আনোয়ার নিউ স্টার, ইব্রাহিম মিয়াঁ অ্যান্ড সন্স।

বাংলাদেশের ধনীদের মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়, প্রথম ভাগে আছে পারিবারিকভাবে যারা ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। ইস্পাহানি, ইসমাইলী, সওদাগর , সাহা গোত্রের লোক এই শ্রেণিতে । দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছে, রাজনৈতিক পরিবারগুলো। এঁদের কারো কারো পূর্বপুরুষ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন, সরকারে সকল সুবিধা নিয়ে নৈতিক-অনৈতিকভাবে ধনী হয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়ায় এদের শিল্পকারখানা ও স্থাবর সম্পত্তির হাতবদল হয়েছে। এঁদের অনেকেই কয়েক দশকের বেশি টিকে থাকতে পারে নি। তৃতীয় শ্রেণিতে আছেন তাঁরা , যারা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শুধুমাত্র উদ্যোগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে , নিজের যোগ্যতায় বিশাল শিল্প-কলকারখানা ও সাম্রাজ্য গড়েছেন। আধুনিক বাংলাদেশের এরাই বৃহত্তম। পূর্বাপর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশেষ কিছু অভূতপূর্ব সুযোগ এদের ধনসম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটা শ্রেণিকে ধনী করেছে। পাকিস্তানের অভ্যুদয় আরেক শ্রেণিকে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবারিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র, বৈদেশিক সাহায্য সবচেয়ে বড় অংশকে ধনী করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংকঋণ, আমদানি-রফতানি প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের নব্যধনী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। নব্য-ধনীদের অনেকেই দেশে টিকে গেছেন, কিন্তু অনোপার্জিত অর্থের উপর গড়ে ওঠা শিল্প-কলকারখানা অনেকেই ধরে রাখতে পারেন নাই।

বাংলাদেশের ধনীদের কিছু সাধারণ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। এঁরা সকলেই বুদ্ধিমান, সাহসী পরিশ্রমী এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। প্রথমদিকের ধনীরা ধর্মভীরু সাধারণ বাঙ্গালী। সকলেই ভাগ্যে বিশ্বাসী , ধার্মিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে নানাধরনের পীর ফকিরের ক্ষমতায়ও বিশ্বাসী।

আশির দশকে বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস সেকটর গড়ে ওঠে। সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিকভাবে পানির প্রাচুর্যতা টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরকে প্রসারিত করে। সরকার ও রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন ছাড়াও একেবারে শূন্য থেকে শিল্পোদ্যোক্তা একটি শ্রেণি গার্মেন্টস সেক্টরকে দাঁড় করিয়েছেন। দুর্বিষহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পরেও বাংলাদেশে এই নব্য-ধনীদের শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে সরকারের অবদান অতি সামান্য। বেসরকারিভাবে সংগঠিত এই কর্মসংস্থান আমাদেরকে বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্রেণিটির বড় অংশই দুর্নীতি না করেই নিজেদের মেধা ও অমানুষিক পরিশ্রমে গার্মেন্টসকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে দীর্ঘ কয়েকদশক পরিচিত করিয়েছে।

অন্যদিকে প্রতিবছর প্রবাস থেকে বৈদেশিক রেমিটেন্স এনেছে যে নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, এঁরা মূলত: তাঁদের পরিবারের শ্রেণি উত্তরণে নিয়ামকের মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। দেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণিটি মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার থেকে প্রতিবছর বিশাল অংকের রেমিটেন্স নিয়ে এসেছেন নিয়মিত। কিন্তু সেই উপার্জিত পুঁজি ও বিত্ত ভূসম্পত্তি ক্রয় ও নানা ভোগবিলাসে ব্যয়িত হয়ে থাকে। প্রবাস থেকে আসা যথেচ্ছ পুঁজি দেশের শিল্পবিনিয়োগে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না ; বরং মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের বিশাল নিম্নবিত্তদের বড় একটি অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি স্বল্পশিক্ষিত আরো একটি মধ্যবিত্ত সমাজ এখন সাড়া দেশ জুড়ে। পুরো পৃথিবী যখন পুঁজিবাদের চূড়ান্ত ফলন দেখতে পাচ্ছে, এই ভোগবাদী বস্তুতান্ত্রিক সমাজে ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল এই মধ্যবিত্তরা দেশের অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে বৈকি।

 

বাংলাদেশের ধনীদের ভেতরে সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছেন এমন দৃষ্টান্ত মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনের। এঁদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রণদা প্রসাদ সাহা। তিনি বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে খাদ্যশস্য ক্রয়ের চুক্তি পেয়ে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। একে একে পাটকল, ডকইয়ার্ড, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, পাওয়ার হাউজ, ট্যানারি ব্যবসা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষভাগে তাঁর সমস্ত ব্যবসা থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন। যা ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট’ নামে সুবিখ্যাত। এছাড়া, মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস্। কুমুদিনী হাসপাতালে স্কুল অব নার্সিং , কুমুদিনী কলেজ, এস,কে হাইস্কুল, দেবেন্দ্র কলেজ ইত্যাদি। তাঁর মতো সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ধনী বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে হিন্দু জমিদারদের পূজাপার্বণে যথেচ্ছ অপচয়ের পরেও হাসপাতাল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় করে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজকে এগিয়েছে। আধুনিক বাংলাদেশের ধনীদের মাঝে সামাজিক ও মানবিকখাতে অবদান রাখার কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না। রাজস্ব প্রদানেও এদের বড় ধরণের অনীহা কাজ করে। বেশিরভাগ ধনী পরিবার ও শিল্প গ্রুপগুলোর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সুসম্পর্ক থাকে দেয়া-নেয়ার। ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে রাজস্ববিভাগ খড়গহস্ত থাকলেও বড় ধনীদের ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য দেখায়। সামাজিক দুর্নীতির কথা আগে পত্রিকা অথবা মিডিয়াতে আসার সম্ভাবনা ছিল। জনসচেতনতা ছিল। এখনকার নব্যধনীদের নিজস্ব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থাকে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আশির দশকের আগে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর দূরত্ব ছিল। পরপর কয়েকটি সামরিক শাসনে জর্জরিত হতে হতে দেখা গেল , দেশের ব্যবসায়ী সমাজের একটি বড় অংশ রাজনীতিতে চলে এসেছে। গত কয়েকটি সংসদের সিংহভাগ সংসদসদস্য ব্যবসায়ী পরিবারের এবং তাদের প্রত্যেকের চলমান শিল্প ,কলকারখানা বিদ্যমান।

দেশের খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এ কে খান গ্রুপ, বেক্সিমকো , স্কয়ার, আনোয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, রহিম আফরোজ, প্রাণ আরএফএল , ইউনাইটেড গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ। দার্শনিকভাবে ধনী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মৌলিক প্রবণতা থাকে পুঁজি বাড়ানো, মুনাফাবৃদ্ধি করে জীবনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বাড়ানো। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগের সাথে সাথে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠে, সমাজের লাভ হয়, দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ এই ধনী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে খাদ্য উৎপাদনে নিত্যনতুন প্রযুক্তির দেখা পেয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ঔষধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বহু ক্ষেত্রে আমাদের আমদানি নির্ভরতা একেবারে কমে গেছে। আমরা হয়ে গেছি, রপ্তানিমুখি দেশ। আমাদের বস্ত্রশিল্প, চামড়াশিল্প , কুটিরশিল্প, ঔষধশিল্প দিয়ে বিশ্ববাজারে আমাদের নাম পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের ধনী সম্প্রদায়ের প্রধানতম অবদান হচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানের ফলে একটা উদীয়মান জাতির কর্মক্ষমতা বেড়েছে, গার্মেন্টস সেক্টরে প্রসারে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বেড়েছে এবং শিল্পোদ্যোক্তা এই ধনীদের অবদানে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু সামাজিক ও মানবিকক্ষেত্রে এঁদের অবদান অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এবং অকিঞ্চিৎকর।

সহায়ক তথ্যসূত্রঃ

১। পুর্ব বাংলাঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য ( ১৯৪৭-১৯৭১)। এস এস বারানভ। সাহিত্যপ্রকাশ। জুলাই ১৯৮৬
২। বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পোদ্যোগীর জীবনকাহিনী। সম্পাদনাঃ আবদুল্লাহ ফারুক। ব্যবসায় গবেষণা সংস্থা। সেপ্টেম্বর,১৯৮৪
৩। বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪ -১৯৭১ ; ১ম খণ্ড রাজনৈতিক ইতিহাস ; ২য় খণ্ড অর্থনৈতিক ইতিহাস ; ৩য় খণ্ড সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক ইতিহাস। সম্পাদকঃ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ ডিসেম্বর ,১৯৯৩
৪। দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গবেষণা।

পুরাতন পৃথিবী ও আধুনিক ভার্চুয়াল দুনিয়া

এই ধরেন, কয়েকবছর আগেও আরেক মহল্লার বন্ধু আত্মীয়রা কে কেমন ফাঁপরে আছে, কেমন যাচ্ছে দিনকাল ; সেটা জানার সহজ উপায় ছিল না। শাশুড়ির কেলানি, ননদের কূটনামি , স্বামীর সঙ্গে খিটমিট করে গিন্নীরা ডালে পাঁচফোড়ন দিত, বাচ্চাকে খাওয়াতো। আর মাঝেসাঁঝে সুযোগ পেলে বলতো, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে। ঘটক শালা থেকে শুরু করে বাপ ভাইকে শাপান্ত করতো, কোন অলক্ষুণের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে বলে ; বিড়াল পার করে আর খোঁজ নেয় না বলে। দুইবাড়ি পরের সমবয়সী কোন প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কোন এক বিকেলে দেখা হলে, খুব মেপে মেপে সেই সাধারণ কথাগুলোই শেয়ার করতো যেগুলো খুব বিপদজনক বড় মাপের না। যেগুলো সারা পাড়া ঘুরে নিজের কাছে উল্টো ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। আর রাত হলে স্বামী সোহাগে দিনের কূটকচাল, অভিমান ভুলে যেতে যেতে ভোর হলে, সেইসব গিন্নিরা আবার লেগে পড়তো সংসারে।

সদ্য কৈশোরের বয়ঃসন্ধিকালীন অস্থির , ছাত্রাবস্থায় হালকা ডাব্বা মেরে স্যারের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে পাড়ার মোড়ে বিড়ি ফুঁকত যে ছেলেগুলো। আর আড়ে ঠারে মহল্লার সুন্দরী কিশোরী কখন ব্যালকনিতে আসে সেই প্রতীক্ষায় থাকতো যে ছেলেগুলো। সেই ছেলেরাই আবার চাকরি করতে গিয়ে ট্র্যাফিক ঠেলতে ঠেলতে শাপান্ত করতো সরকারকে। অফিসে বসের ঝাড়ি খেয়ে , পকেটমার হয়ে, বাসের ভিড়ে শার্টের হাতা ছিঁড়ে, হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে দরোজায় কড়া নেড়ে প্রিয়মুখ দেখে সব যেতো ভুলে।

আমাদের চিরচেনা সেই ছেলেমেয়েদের বয়স হয়েছে। এখন তারা অবাধ , নিরবচ্ছিন্ন অনলাইন ভার্চুয়াল পৃথিবী পেয়ে চরমভাবাপন্ন হয়ে গেছে। একটা ‘অনাবশ্যক’ হুতাশন আর অস্থিরতায় কাটছে তাদের এইসব দিনরাত্রি।

মানুষতো জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই নিজেকে প্রকাশ ও প্রমাণ করতে চায়। দেখবেন – তুচ্ছ মানবশিশু হামাগুড়ি দিলেও সারা পরিবার উচ্ছ্বসিত হয় ; হাঁটি হাঁটি পা পা করলেও সারা পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আধো আধো অর্থহীন বুলি ফুটলেও উচ্ছ্বাস, খাবার উগড়ে দিলেও উচ্ছ্বাস , হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেও , বাবা রে সোনা রে, ওরে কে রে বলে উচ্ছ্বাস। এই যে, কোন একটা কিছু করেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা ও মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানবশিশু, বড় হতে হতে যখন দেখে, সে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই; বাড়ির বাইরে তো তার আর তেমন কোন পরিচয় নেই– তখন সে একটা কিছু হওয়ার জন্যে সে উঠে পড়ে লাগে। তারপর গুচ্ছের পড়াশোনা করে উপার্জনক্ষম হলেও কোথায় যেন মনোযোগের আকাল পড়ে। পাড়ার ডাকসাইটে সুন্দরী তরুণীদের বিয়ের কয়েক-দশক কেটে গেলে চারপাশে আর কোন মুগ্ধ চোখ কিংবা অকারণ উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য থাকে না। সেটা তারা মেনে নিতে শেখে। সংসারে মন দেয়, ঘরকন্না করে, বাচ্চাদের বড় করে, বিয়ে দেয়।

ভার্চুয়াল জগতের আগের জগত ছিল কিছুটা আলোড়নহীণ। ভার্চুয়াল জগতের অনাবশ্যক ক্রমাগত বিস্ফোরক আলোড়ন আর উচ্ছ্বাস সুযোগ এনে দিয়েছে হুমড়ি খেয়ে পড়া শিশুটিকে ! সেই বয়স্ক শিশুটি পড়ে গেছে যেন তেন প্রকারে মনোযোগ পাওয়ার অভ্যস্ততার চিরন্তন চক্রে।

যা ঘটছে, আর যা আপনি ভার্চুয়ালি প্রকাশ করছেন , সেখানে কিন্তু আগেও ফাঁক ছিল। সেই ফাঁক , মাপাহাসি চাপাকান্নার সেই মেকি প্রদর্শনকামিতা ও সহানুভূতিলিপ্সা একইরকম আছে । তেমন কিছু বদলায়নি । পুঁজিবাদ, ভোগবাদিতার অন্য সব সার্বজনীন সুবিধার মতো এ শুধু সংখ্যাতেই বেড়েছে, বিশাল সেই সংখ্যা ! দেখার চোখ থাকলে, সহজেই দুঃখবিলাসী , প্রদর্শনকামী , অতিআত্মপ্রেমি, অস্থির , বিভ্রান্ত, পরশ্রীকাতর,অনাবশ্যক হতাশ, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ঈর্ষাপরায়ণ সংখ্যাহীন মানুষকে দেখতে পাবেন।

যতোই ইমোজি থাকুক, মানুষের মৌলিক অনুভূতিগুলো কি আর বদলে যাবে এতো সহজে !

বাঙালি হাসে না কেন!

বহুবছর আগে পড়েছিলাম। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প সংকলনের নাম ছিল ‘মাপা হাসি চাপা কান্না’।

আজ বিকালে বসে ভাবছিলাম– শিক্ষিত বাঙালি মেপে হাসে কেন ? হাসলে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বুদ্ধি বের হয়ে যাবে বলে কী কম হাসে অথবা হাসতেই চায় না। লক্ষণীয় যে, লেখক ও মানুষ হিসাবে যারা কৌতুকপ্রিয়, হাসিখুশি, সমাজে তাদেরকে খুব একটা উঁচু চোখে দেখা হয় না। এই যেমন আমাদের সামগ্রিক সাহিত্য , সিনেমা ও নাটকের সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় অনানুষাঙ্গিক চরিত্রটি হচ্ছেন তিনি, যিনি ফিলার হিসাবে গল্পে টিকে আছে আছেন কোনরকমে। তিনি – যিনি নাটক, সিনেমার মাঝেসাঁঝে কৌতুক করছেন, লোক হাসাতে চাচ্ছেন, বিনোদিত করতে চাচ্ছেন।

পাশ্চাত্যে চার্লি চ্যাপলিন একজনই ছিলেন।

আমাদেরকে খুঁজে পেতে একজনের কথাই মনে পড়বে, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রয়াত খান জয়নুল, আশীষ কুমার লোহ, আনিস, হাসমত, টেলিসামাদ, দিলদার ও নাম না জানা অনেকেই সারাজীবন পার্শ্বচরিত্রেই ছিলেন। প্রোটাগনিস্ট বা মূল অভিনেতা হতে পারেননি কখনো, কোন পরিচালক সেই সুযোগ করে দেননি।
চলচ্চিত্রে কেউ চরিত্রাভিনেতা হতে না পারলেও, নাটকে আশির দশকে আমজাদ হোসেন সেটা করতে পেরেছিলেন। সেই সময়ের ঈদের নাটকে ‘জব্বর আলী’ ছিলেন একজন সামাজিক টাউট, আদম-ব্যবসায়ী, মজুতদার। তাঁর নানা কীর্তিকাণ্ড ও ধরা খাওয়ায় দেখে দর্শক হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। জব্বর আলী নতুন কী কাণ্ড করে জেলে গিয়ে ঈদের সেমাই খাবে, সেটা দেখার জন্য প্রতি ঈদে আমরা বিটিভির সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম।

হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও সিনেমায় তাঁর জাদুকরী গল্প আর মধ্যবিত্তের আনন্দ-বেদনার কাব্যই ছিল মূল চরিত্র। একজন শান্তশিষ্ট বোকাবোকা বাবা, খুব কড়া মেজাজের মা ; তরল কথা বলা দেবর, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথাবার্তায় পটু কাজের লোক ; ভীরু প্রেমিক ও সাহসী প্রেমিকা নিয়ে তাঁর ঈদের নাটকগুলো ছিল অসম্ভব স্বাদু। কিছু নাটক নিখাদ আনন্দের, কিছু নাটকে প্রচ্ছন্ন সমাজ সচেতনতার মেসেজ।

হুমায়ূন আহমেদ জীবিতাবস্থায় তাঁর লেখালেখি দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ পাঠকের মন জয় করতে পারলেও, সমালোচক ও সাহিত্য-বোদ্ধারা তাঁর পুরো লেখালেখিকেই হালকা করে দেখেছেন। কেউ কেউ জিজ্ঞেসও করেছেন, কেন তিনি সিরিয়াস লেখা লেখেন না।

আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করছি, সিরিয়াস লেখা কয়জন পাঠকের কাছে যায়। কমলকুমার মজুমদার কি অধিক পঠিত? বিষ্ণু দের কবিতা কয়জন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে? শরৎচন্দ্র , মানিক, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, শিবরাম চক্রবর্তী, সুনীল , সঞ্জীব, সমরেশ, শীর্ষেন্দু জনপ্রিয় বলে কি তাঁরা সিরিয়াস সাহিত্যিক নন ? দুই-বাংলা তন্নতন্ন করে আমাদের একজনই সৈয়দ মুজতবা আলী আছেন ; যার অসম্ভব উইট সমৃদ্ধ প্রবন্ধ, উপন্যাস, সবধরনের লেখালেখি এক ফরমেটে ‘রম্যরচনা’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সরস, চটুল, হালকা ভঙ্গীর লেখালেখিকে , কথা বলাকে এতো তাচ্ছিল্য কেন বাঙালির ! নাকি , ছোটবেলা থেকে “ যত হাসি তত কান্না, বলে গেছেন রাম সন্না” শুনে শুনে বড় হওয়া বাঙালি অবচেতনে ধরেই নিয়েছে, হাসি ব্যাপারটা মোটেও ভালো কিছু না, হাসি হচ্ছে কান্নার প্রারম্ভিকতা। আর তাছাড়া আমরা শৈশবে দেখেছি, মন খুলে হো হো হাসির হুল্লোড় উঠলেই , চারপাশ থেকে বিশেষ একশ্রেণীর আত্মীয়, মুরব্বী হা রে রে করে ছুটে আসত, ‘এতো হাসি কীসের ! কপালে দুঃখ আছে !’

হ্যাঁ, রে ভাই, হাসির পরে দুঃখ আছে বলে কি আমাদের মেপে মেপেই হাসতে হবে। দুঃখ তো হাসলেও আসবে ; না হেসে সুকুমার রায়ের রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকলেও আসবে। জীবনযাপনের প্রাত্যহিক যন্ত্রণা, প্রিয়জন হারানোর শোক, দুঃখ, বেদনা, নানাবিধ ব্যর্থতা, চাওয়া না পাওয়ার টানাপড়েন, শারীরিক অসুস্থতা, বার্ধক্য আর অবশেষে অনিবার্য মৃত্যু তো আপনার হাসির তোয়াক্কা করে না। তবু, কেন এতো চাপা কান্না, বেদনার উদযাপন, শোকের উদযাপন ! বাঙালি মনুষ্যের আকাশে সারাক্ষণ চাপাকান্নার মেঘলা আবহাওয়াই থাকবে কেন ! গম্ভীর হয়ে, সিরিয়াস হয়েও নিয়তিকে কী কেউ এড়াতে পেরেছে ! পারেনি ; পারবেও না।

বাঙালির জীবনে হাসির সূর্যালোক দূর করুক সব অপ্রাপ্তির , বেদনার কালো মেঘ।
হে বাঙালি ! হাসতে হাসতেই না হয়, নিয়তির সঙ্গে লড়াই করা শিখুন !

প্রকাশকালঃ ২৮শে অক্টোবর,২০২০

কোভিড বনাম আরব্য রজনীর জেলে ও সুলাইমান বাদশাহের বোতলবন্দি জিনের গল্প

আরব্য রজনীর জেলে ও সুলাইমান বাদশাহের বোতলবন্দি জিনের গল্প সেই কবে শোনা।

ঘটনার বিশদ কিছুটা মনে ছিল। জেলের বিস্ময় ছিল, যে জিন দেড় হাজার বছর অভিশপ্ত নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে বন্দী ছিল তাকে উদ্ধার করার পর উদ্ধারকারীকেই সে কেন হত্যা করতে চাইল। অকৃতজ্ঞতারও তো একটা সীমা থাকে ! সত্যি বলতে কী, জিনের ক্ষোভ নিয়ে ছোটবেলায় আমার নিজেরও বিস্ময় ছিল।

কাহিনীতে জিন বলে, নবী সুলাইমানের বিরুদ্ধাচরণ করায় তাকে বোতলে বন্দী করে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। উদ্ধাররহিত সেই দীর্ঘ একাকীত্বে জিন প্রতিজ্ঞা করে, যে তাকে মুক্ত করবে তাকে সে অগাধ সম্পদের মালিক করে দেবে। দিন যায় , মাস যায়, বছর যায় ; এভাবে একশ বছর চলে যায়, কেউ উদ্ধার করে না। সে আবার প্রতিজ্ঞা করে এবার যে তাকে উদ্ধার করবে, তাকে পৃথিবীর সমস্ত গুপ্তধনের সন্ধান দেবে। তবুও কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসে না।

রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে অসহায় জিন বেচারা প্রতিজ্ঞা করে বসে যে, এইবার যে তাকে উদ্ধার করবে তাকে সে হত্যা করবে। অবশ্য , কীভাবে সেই উদ্ধারকারী মৃত্যুবরণ করতে চায় সেটা বিবেচনায় নেবে !

এর পরের কাহিনীও আমরা জানি, জেলে বুদ্ধি করে নবী সুলাইমানের কসম খেয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বিশাল দেহের জিন ঐ ছোট্ট বোতলে কীভাবে আঁটে ! বোকা জিন আবার সেই বোতলে ঢুকে দেখাতে গিয়ে চিরতরে আটকা পড়ে।
কেন জিন তাঁর চরম উপকারীকে হত্যা করার মতো এ রকম নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে পারল?

কারণ সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য মানুষ অনেক ভাল প্রতিজ্ঞা করে। সমস্যা জটিলতর হলে, সে প্রতিজ্ঞায় আরো নানা প্রণোদনা যুক্ত হয়। কিন্তু যখন দেখে কোন উপায়েই উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই, তখন হতাশায় আর ক্ষোভে চরম অবিমৃষ্য ও হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

কোভিড ভাইরাসের প্রথমদিকে মনে হচ্ছিল সবাই আগামীতে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে। আরো কিছুদিন যাওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, সেই প্রতিজ্ঞায় আরো অনেককিছু যুক্ত হচ্ছে। নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন। প্রকৃতির বিশ্রামে নিজেই আরোগ্যলাভের আশাবাদে আমরাও পাশে দাঁড়াবো ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু, এখন যতো দিন যাচ্ছে, সবাই সেই বোকা জিনের মতো ধৈর্যহারা, অবিবেচক, অসহনশীল আর নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছি।

প্রকাশকালঃ ১লা জুলাই,২০২০

নারী।। হুমায়ুন আজাদ ( ১৯৯২) আলোচনা

“প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক , আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমর্পণাত্মক ; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ্র নিয়ে বিব্রত। এটি যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্র মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচের থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে। ”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

তাঁকে কেন বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক বলা হয়—উপরের কয়েকটা লাইন সেটা জাস্টিফাই করার জন্য যথেষ্ট মনে হয় আমার কাছে। এই বলার ভঙ্গী এখনকার ফেসবুক সেলিব্রেটিদের কারো কারো আছে হয়তো। কিন্তু তাঁর সময়ে এটা ছিল কল্পনাতীত।

বাইবেলের হিতোপদেশ বলেছে, “ পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহার তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ” ; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, “ মৃত্যুর মতোই ব্যাভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।”
বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস বলেছেন, “ একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেঁয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।” এ বিয়ে পরিণত হয় এঙ্গেলসের মতে, স্থূল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ করে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস বলেছেন, “স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না,পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্বে ।”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

আমি বিবাহ/বিয়ে নামের এই সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখি। আমি হুমায়ুন আজাদের ও এঙ্গেলসের সাথে দ্বিমত পোষণ করি , কিন্তু এঁদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।

রবীন্দ্রনাথ , রুশো-রাসকিনদের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন,ও আরো অনেককে দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্রেম ,কবিতা,সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে চিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

“ রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। ” এতো স্পর্ধিত উচ্চারণ আমি আর কারো মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। সত্যি বলতে কী , এখানে আমি হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্র বিদ্বেষে মর্মাহত ।

প্রেম ও কাম পরস্পরসম্পর্কিত, দুটিই নারীপুরুষের জীবনের বিশেষ পর্বে প্রবলভাবে দেখা দেয়, যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাঁচে না, জীবনে প্রেম অপরিহার্য নয় ; প্রেম বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কোনো নরনারীর জীবনে জোয়ারের মতো দেখা দেয়, তাতে সব কিছু – অধিকাংশ সময় তারা নিজেরাই—ভেসে তলিয়ে যায়; তবে আজীবন মানুষ বাস করে নিষ্প্রেম ভাঁটার মধ্যে। প্রেম তীব্র আবেগ, তা ঝড় জোয়ার বন্যার স্রোত ঘুর্ণির মতোই ; ওগুলোর মতোই প্রেমও দীর্ঘস্থায়ী নয়, এবং বার বার দেখা দিতে পারে। ———-প্রেমের থেকে কামের আশ্লেষের আয়ু অনেক বেশী ; কাম দোলনা থেকে কবর চিতা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অপ্রেম জীবন দশকপরম্পরায় যাপন করে মানুষ, অধিকাংশের জীবনেই কখোনই প্রেমের ছোঁয়া লাগে না ; কিন্তু কামহীন জীবন অসম্ভব। যাদের কাম অচরিতার্থ, যারা সঙ্গী পায় না কামের, তারাও একান্ত কামযাপন করে। প্রেম বলতে গত আড়াইশো বছর ধরে পশ্চিমের পৃথিবী যা বোঝে , এবং পশ্চিম থেকে ঋণ করে আমরা যা বুঝি এক শতাব্দী ধরে, তা রোম্যানটিকদের আবিষ্কার।
পুরোনো পৃথিবীতে প্রেম ছিলোনা ; আজ আছে একটি বড়ো কিংবদন্তি হয়ে। যে- আবেগ প্রেম নামে নরনারীর মনে জেগে ওঠে বিপরীত লিঙ্গের কারো জন্যে, কিশোরতরুণের কাছে যা রক্তমাংসের অনেক ওপরের কোন স্বপ্ন বলে মনে হয়, তা আসলে মাংসের জন্য মাংসের সোনালী ক্ষুধা।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

আমার জন্য বহুশ্রুত, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রায়শঃ বলে থাকেন আমি বহুবার শুনেছি। ‘প্রেম এমনই এক তীব্র আবেগ যা এভারেস্টের চূড়ার মতো; সেখানে একই সময়ে একজনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। একসঙ্গে দুজনের জায়গা হয়না সেখানে!’

বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্য প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হতে বলে সুগৃহিনী ও সুমাতা, তাঁর কাছে দাবী করে সতীত্ব ও পাতিব্রত্য। ————–নারীর গর্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ। নারীকে কি চিরকালই ধারণ করে যেতে হবে গর্ভ, পালন করে যেতে হবে পশুর ভুমিকা? গর্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুর মতো, দৃশ্য হিসাবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। একদিন হয়তো গর্ভধারণ গন্য হবে আদিম ব্যাপার বলে, মানুষ বেছে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায় ; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তাঁর জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গর্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা পেলে আনন্দে তা গ্রহণ করবে ; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। একসময় নিয়ত গর্ভিনী থাকাই ছিল নারীর কাজ ; এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয়নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গর্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ বলে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।
——- নারীর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই। পুরুষ তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )

হুমায়ুন আজাদের বিশাল ক্যানভাসের “ নারী ” গ্রন্থটি আমার মোটেও মৌলিক কিছু মনে হয় নি। এটি মূলতঃ নারীবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অসংখ্য গ্রন্থের একটি সম্মীলন । লেখক গ্রন্থপঞ্জীতে প্রায় আড়াইশো বিভিন্ন ভাষার বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, যেগুলো তাঁকে পড়তে হয়েছে, গবেষণা করতে হয়েছে দিনের পর দিন ; এই ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

পুরো গ্রন্থের যে বিশেষ দিকগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছে আমাকে আলোড়িত করেছে আমি তারই পুনরাবৃত্তি করলাম মাত্র।

প্রকাশকালঃ এপ্রিল, ২০১৫