শিল্পের অনেক শক্তি ।
সহজবোধ্য শিল্প আরো বেশি শক্তিশালী। যে শিল্পের রস আস্বাদনের জন্য পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কালো অক্ষরের দুর্গম স্রোত পাড়ি দিতে হয় না ; যা সাধারণ মানুষ সহজেই চোখে দেখে,কানে শুনে আনন্দ পায় তার শক্তিমত্তা স্বীকার করতেই হয় !
একটা কালজয়ী উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন যতোগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায় ; মূল উপন্যাসটি তার শতকরা ১ ভাগ লোকের কাছেও পৌঁছায় কি?

এই যে আমাদের ভার্চুয়াল ইন্টারনেটের পৃথিবী — এটা সেই হিসাবে একটা সহজগম্য ও সহজবোধ্য শিল্প মাধ্যম। মূলত: অনেক শিল্পের ব্যবহারিক প্রয়োগ বা মূল্য থাকে না। কিন্তু এই প্রথম একটা শিল্প মাধ্যমের ব্যবহারিক ব্যাপ্তি দেখে পুরো পৃথিবী হতবাক ও বিস্মিত। যে দৃষ্টিতেই দেখি না কেন, আমাদের সমাজের ডোনাল্ড ট্রাম্প,নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে বাসার ড্রাইভার-দারোয়ানরাও এই প্রথম কোন মাধ্যমে বাধাহীনভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে।

 

ভুলে যাবেন না , ব্যক্তি মানুষের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা হল তার অস্তিত্বের সংকট। সে কে? কেন এই পৃথিবীতে, কোথায় যাচ্ছে সে , ইত্যাদি নানাবিধ সংকট। হাজার বছর ধরে ধর্ম ও দর্শন অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কে না জানে , অনেক প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যাবে। একই সংগে , ব্যক্তি-মানুষ সবচেয়ে বেশি যেটা আশৈশব চেয়েছে, সেটা হচ্ছে পরিপার্শ্বে তার নিজের আত্মপরিচয় থিতু করতে। সন্তান চেয়েছে মায়ের মনোযোগ, প্রেমিক- প্রেমিকার , বন্ধুর কাছে বন্ধু, রাষ্ট্রের কাছে জনগণ ! এমনকি প্রান্তিক দরিদ্রতম মানুষটিও নিজের পরিবারের চৌহদ্দির বাইরে সমাজে কাছে স্বীকৃতি ও মনোযোগ চেয়ে চলেছে সেই আদিকাল থেকে ! ইন্টারনেটের এই শিল্প সেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষটিকেও একটা দেওয়ার মতো পরিচয় দিয়েছে। আয়নায় নিজের চেহারা একটু ভালো দেখানোর আনন্দ আছে , তার চেয়েও গভীর আনন্দের আর বিস্ময়ের হচ্ছে আরো পাঁচজনের চোখে নিজেকে দেখার !

এই শিল্পের কারিগরেরা রাতদিন এক করে বাস্তবের খুব কাছাকাছি, কিন্তু ঠিক বাস্তব নয় এমন একটা পৃথিবী তৈরি করেছেন আমাদের জন্য। এই ভার্চুয়াল পৃথিবী এখন আমাদের অস্তিত্বের অংশ , অনিবার্য নিয়তি। এই শিল্পমাধ্যম এতোই সহজবোধ্য , সর্বত্রগামী ও সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে যে আমরা যারা দুই প্রজন্মের সেতুবন্ধন হিসাবে এখন মধ্যবয়সে, তারাও বুঝে উঠতে পারছি না , ঠিক কতোখানি কাছে থাকব আর কতোখানি দূরে থাকব !

কালো অক্ষরে কয়েক সারি লেখা আমার প্রকাশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সীমিত আরো কয়েকজনের কাছেও হতে পারে। কিন্তু আমার অস্তিত্বের সংকটের জায়গা থেকে আমি চাইব, সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে আমার চিন্তা পৌঁছাক । হোক সেই চিন্তা তুচ্ছ ও অর্থহীন, হোক সেটা বহুশ্রুত ! কিন্তু আমার কাছে যে সেই চিন্তা একেবারে নবীন !
আমার মুহূর্ত চিন্তার সঙ্গে দেওয়া এই ভাস্কর্যটি বিপরীতমুখী মনে হতে পারে। কারণ , আমি সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী এই নতুন শিল্পের শক্তিমত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করছি না। বরং আমি এর সর্বব্যাপিতার মুগ্ধ একজন মানুষ। তবে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতই শিল্প মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার ও আসক্তি আছে; সেটাও সবাই জানে। আমাদের দিনের সিংহভাগ সময় মোবাইল ফোনের নানা ধরণের সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করে চলে যাচ্ছে। আমরা যা দেখছি, পড়ছি শুনছি সেগুলো আমাদের কোন চিন্তা করাচ্ছে না। অনেকাংশে সেটা নিখাদ টাইমপাস আর সহজলভ্য, সহজপাচ্য বিনোদিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জর্জরিত। ঠিক যেন সিনেমার হলে বসে বিশাল প্যাকেটের পপকর্ন খাওয়া ; খাচ্ছি তো খাচ্ছি,কিন্তু আখেরে না ভরছে পেট, না হচ্ছে পুষ্টি।

এই শক্তিশালী শিল্পমাধ্যমগুলো মানুষকে যেমন সুযোগ করে দিয়েছে কাছাকাছি হওয়ার ; তুচ্ছ মানুষটিকেও প্রকাশিত হওয়ার; আবার একই সঙ্গে এর অতি ব্যবহার ক্রমশঃ সেই মানুষদের মাঝে অর্থহীন দূরত্ব তৈরি করে চলছে। দূরত্বের এই অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ শিল্পে রূপ দিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী Gali May Lucas এবং জার্মান ভাস্কর Karoline Hinz ! ভাস্কর্যটি নেদারল্যান্ডের আর্মস্টার্ডামে।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ই ডিসেম্বর,২০১৯