বন্ধু-তালিকা পূর্ণ হয়নি, কিছু আছে বাকী।

কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকেও যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে হয়। যাঁদের লেখা আমাকে থমকে দেয়, চিন্তা করতে বাধ্য করে, মনে হয়, আরে ! এই লোকের সঙ্গে আমার আগে কেন যোগাযোগ হয়নি ! তাঁদেরকে বিনীতভাবে বন্ধুত্বের রিকোয়েস্ট পাঠাই, কেউ অ্যাকসেপ্ট করে , কেউ করে না তাঁদের বন্ধু-তালিকা জুকারবার্গের কোটা হিসাবে পূর্ণ হয়ে গেছে বলে। আমি তাঁদেরকে ফলো করি। কিছুদিন তাঁদের স্ট্যাটাস ‘সি ফার্স্ট’ করে রাখি। বিস্মিত হই, কীভাবে লেখেন এঁরা ! আমার বন্ধু-তালিকায় কিছু রিকোয়েস্ট পেন্ডিং আছে, তাঁদেরকে অ্যাড করতে পারছি না , মূলত: আমার নিজের সক্ষমতাই হারিয়ে যাবে বলে। দয়া করে ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

মুশকিল হচ্ছে, এখন যদি নতুন করে কাউকে অ্যাড করতে হয় , তবে – পুরনো কাউকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিছুদিন আগে কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেছিলাম। দেখা গেল, একই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে তিন চারটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, প্রতিবার রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন আর আমি অ্যাকসেপ্ট করেছি। একই লোকের কয়েকটা অ্যাকাউন্টের যুক্তিসঙ্গত কারণ কী কী থাকতে পারে আমি জানি না। তবে, আমার ধারণা, এঁরা হয়তো পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছিলেন অথবা নানাবিধ কারণে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে ; কিন্তু বহুবছর ধরে পুরনো অ্যাকাউন্টগুলো আর ব্যবহার করেন না। এরকম গোটা বিশেক কমিয়েছিলাম মাত্র। কাকে রেখে কাকে সরাবো , সেটা একটা কনফিউশনের ব্যাপার হয়ে গেল। সেই চেষ্টা বাদ দিলাম।

আমার বন্ধু-তালিকায় কেউ কেউ ফেসবুকে আছেন, কদাচিৎ ব্যবহার করেন না, হয়তো করবেন ও না ; কিন্তু সবার আছে বলে তাঁর নিজেরও একটা অ্যাকাউন্ট কেউ খুলে দিয়েছে। এঁদের কাছে ভার্চুয়াল জগতের চেয়ে বাস্তবের জগতে অনেক বেশী মূল্যবান।। সে রকম কাউকে মুছে ফেললে আশা করি তাঁরা মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার সুযোগ পাবেন না। কারণ তাঁরা সারাবছরে হ্যাপি নিউ ইয়ার, ঈদ মুবারক অথবা নিজের জন্মদিনের দিন ছাড়া ফেসবুকেই তো ঢোকেন না !

হয়েছে কী ! ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ফেসবুকে আসা। অন্য সবার মতো আমিও ‘মুরাদ টাকলা’ বাংলিশ ভাষায় ফেসবুকিং করতাম। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল কয়েকটা বছর , মাসে একটা ‘ Dosto Kemon Achis’ টাইপ স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক চালানো। মাঝে সাঝে পিকনিক ও গেট টুগেদারের ছবিটবি দিতাম। সেভাবে বাংলায় টাইপ করতে পারতাম না, বাংলিশ লিখে অন্যদের বিরক্তও করতাম না।

নিজেকে প্রকাশ করার আনন্দ আর সেই আনন্দে লেখালেখির ফ্লো আসল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে — গণজাগরণ মঞ্চের শুরু থেকে। আমার এক বন্ধু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মিঞা মোহম্মদ হুসাইনুজ্জামান শামীম( Miah M. Hussainuzzaman) যে একাধারে ব্লগার এবং সচলায়তনে লেখালেখি করত–সে আমাকে অভ্র শিখে বাংলা লেখায় উৎসাহিত করল। বাংলায় লেখালেখি শুরু হল। নানা অভিজ্ঞতা, যেগুলো আসলে দিনলিপির মতো ; সেগুলো ফেসবুকে দেওয়া শুরু করলাম। শামীমের মাধ্যমে প্রবাসী ও দেশী ব্লগার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হল। বাংলা ব্লগ যে এতো এগিয়েছে, লেখার মান যে এতোটা বেড়েছে — সেটা ‘সচলায়তন’ না পড়লে বুঝতাম না। দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা এই ব্লগিং এ জড়িত। ২০১৩ সাল আমার চোখের সামনে দিনরাত নানা মাপের বাংলা রম্যরচনা, কবিতা, প্রবন্ধ ঘুরতে লাগল। চরম উদাস নামের এক ছদ্মনামের ব্লগারের লেখারতো রীতিমত ভক্ত হয়ে গেলাম। সৈয়দ মুজতবা আলীর পরে এই লেভেলের স্যাটায়ার আরও কেউ লিখেছে কীনা জানি না। তবে, এই ভদ্রলোককে আমি আমার গুরুর কাতারে রাখলাম।

ফেসবুককে আমার তখন মনে হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মতো মুচমুচে স্বাদের। এখনো, তাই মনে হয় ; ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিপস চানাচুর খাওয়ার মতো। খেতে ভালোই লাগে, কিন্তু এতে না ভরে পেট, না আছে পুষ্টিগুণ।

২০১৩ সালের দিকে বন্ধু সংখ্যা বাড়ানো কিছুটা স্ট্যাটাসের ব্যাপার ছিল ! ওর ২০০ বন্ধু আর আমার মাত্র ১০০ ! আচ্ছা, দেখি কী করে বাড়ানো যায়। তো, সেভাবে চেনা অচেনা, কোন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড নাই, তাদেরকেও নিজের বসার ঘরে দাওয়াত দিলাম। কিছুদিন পরে লক্ষ্য করলাম হুজুগে সংখ্যাই শুধু বেড়েছে, অথচ অনেকের সঙ্গে মন মানসিকতা ও চিন্তা চেতনার বিন্দুমাত্র মিল নেই আমার ! আবার এমন অনেকে আছেন, যাঁদের সঙ্গে কোনকিছুতেই আমার মতের মিল হয় না , হবে না , হওয়ার সম্ভাবনা কম; কিন্তু তাঁদের বিপ্রতীপ চিন্তা, মাইক্রোস্কোপের উল্টো পাশ থেকে দেখার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে ।

ফেসবুক আমার জন্য শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। মোবাইল স্ক্রিনের চকচকে বিপ্লবী অথবা মোটিভেশনাল কথা বলা ভার্চুয়াল লোকটি আর সামনে জড়সড় হয়ে বসা লোকটির মাঝে হাজার মাইলের তফাৎ ! সেটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে।
ফেসবুকের বাইরে আমার অনেক বন্ধু আছে, যারা হয়তো আমার ফেসবুকে আছেন অথবা নাই ; আমার পোস্ট পড়েন অথবা পড়েন না ; লাইক কমেন্টস কখনো করেন না বা করবার মতো সময়ই নেই তাঁদের। তাঁদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত কথা হয়, হাসাহাসি হয়। লাইক, লাভ,ওয়াও , স্যাড, অ্যাংগ্রি ইমোর বাইরে আমাদের জান্তব সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ‘কী বোর্ডের’ এক ক্লিকে হয় নি। এক ক্লিকে যাবেও না। এই সব বন্ধুত্ব আমার কাছে অনেক মূল্যবান। এই সম্পর্কগুলো আমার গত ৩০ বছর ধরে গড়ে তুলতে হয়েছে। ফেসবুকের ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব আর লাইক কমেন্টস গুণে গুণে আমার জীবন কাটে না। কারো কাটা উচিৎও না। তাই, বন্ধুত্বের রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে রেসপন্স না পেলে ভাববেন না, আমি ‘ভাব’ দেখাচ্ছি। আমার ফেসবুক ও কমেন্টস পাবলিক করা আছে। ফ্রেন্ড লোগোর উপর টিক চিহ্ন না থাকলেও আমার যে কোন মন্তব্যে আপনি একমত ও দ্বিমত পোষণ করতে পারেন।

আগামী নতুন বছর, নতুন আশার আলো ভাসিয়ে দিক না চাইতে পাওয়া আমাদের এই একটি মাত্র জীবনকে। আমার মতো অধমের যে কোন ভুল ত্রুটি ক্ষমা করার মতো মহানুভব হয়ে উঠুন সবাই। শরীরের যত্ন নিন, পরিবারকে সময় দিন। সবার জন্য শুভকামনা। সবাইকে ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা।

প্রকাশকালঃ ৩১শে ডিসেম্বর,২০১৯