প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে কিছু লিখতে গেলে আমরা যারা দেশেই থাকি, তাদের প্রতি আমাদের প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্ব টের পাওয়া যায়। অনেকের অভিযোগ , প্রবাসীদের নানা কথাবার্তায় ও আচরণে দেশের ব্যাপারে করুণা বা ক্ষেত্র বিশেষে তাচ্ছিল্য প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়াটা স্বাভাবিক। পশ্চিমের যে কোন একটা মানবিক, উন্নত অত্যাধুনিক দেশের তুলনায় আমাদের রাষ্ট্র-যন্ত্র, প্রশাসন ও ছোট্ট ভূমিতে এই বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে আমরা তো জঙ্গলেই বাস করছি।

দুর্নীতি, অপশাসন, দুর্বৃত্তায়ন, ট্রাফিক জ্যাম, ভেজাল খাবার, রাজনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা যে দিকে তাকানো যায় –এক সীমাহীন হতাশার হাহাকার। মৌলিক চাহিদার অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার মধ্যে মনে হয় বস্ত্র নিয়েই তেমন কোন অভিযোগ শুনি না । গার্মেন্টস শিল্পে রফতানির পরে বেঁচে থাকা বাড়তি কাপড় ও পোশাকে বাজার সয়লাব। আগে দুই ঈদ ছাড়া মানুষ পোশাক কেনার কথা চিন্তাও করত না। এখন ধনী দরিদ্র সবাই সারাবছর নানা জামা কাপড়ের ভিতরে থাকে।

অন্যদিকে দেশে যারা থাকে, তারাও সুযোগ পেলেই প্রবাসীদের আত্মীয় পরিজনহীন বিচ্ছেদকাতরতা ও নানা বেদনা নিয়ে কটাক্ষ করার সুযোগ পেলে ছাড়ে না। প্রবাস মানেই উন্মুক্ত কারাগার । সব আছে , তবুও বন্দিদশা, ইত্যাদি।

আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রবাস ও দেশ– দুই জায়গার বাংলাদেশীদের সাধুবাদ দিতে চাই। যারা প্রবাসে স্থায়ী হয়েছেন, তাঁরা এই দেশের যোগ্যতর। যোগ্যতা, সাহস, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার জোরেই তাঁরা বিদেশে গিয়ে থিতু হয়েছেন। দূর পরবাসে অসংখ্য ছোট্ট ছোট্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন। আরেক বিশাল জনগোষ্ঠী, যাঁরা শ্রমিক, তাঁদের আর্থিক প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বেদনা ও বঞ্চনার গল্প আরো মর্মান্তিক। পরিবারের সুখের জন্য জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়টুকু বিলিয়ে দিয়ে শেষ জীবনে রিক্তহাতে ফিরে আসতে হয় দেশের মাটিতেই।

এই যে দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে করুণা ও কটাক্ষের চাপানউতোর চলে, তার কারণ সম্ভবত: তাঁদের নিজ নিজ অবস্থানের গভীর অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার ঈর্ষা।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসে একটা ঘটনা আছে।
ঘটনা এই যে মাঘী পূর্ণিমায় চামুণ্ডা পূজার মেলায় কবিগানের পাল্লা হয়। নোটনদাস ও মহাদেব পাল—দুজনেই খ্যাতনামা কবিয়াল। মেলার দিনে মহাদেবের দল এসে আসরে বসল, কিন্তু নোটনদাসের সন্ধান নেই। একজন এসে জানালো নোটনদাস নেই। ‘বাসাতে কোথাও কেউ নাই মশায়—লোক না – জন না—জিনিস না , পত্তর না—সব ভো-ভোঁ করছে। কেবল শতরঞ্জিটা পড়ে রয়েছে—যেটা আমরা দিয়েছিলাম। শুনিয়া মেলা কর্ত্তৃপক্ষ স্তম্ভিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেল। লোকেরা হৈ হৈ করিয়া গোলমাল করিয়া উঠিল।’

তবে লেখক নোটনদাসের দোষ দেখেন না, গত মেলা থেকেই দুই কবিয়ালের টাকা পাওনা ছিল। আয়োজকরা বরাবর মাথায় আশীর্বাদ করে চলছিলেন। নোটন ও মহাদেব যেহেতু এই মেলায় বহুদিন ধরে গাওনা করে সেই কৃতজ্ঞতা ও চক্ষুলজ্জাতেই গতবার কিছু বলে নাই। কিন্তু এবারেও যখন নোটন প্রণাম করে হাত পাতল, তখন মোহান্ত টাকার পরিবর্তে তার হাতে দিলেন তাজা টকটকে একটা জবাফুল এবং আশীর্বাদ করলেন—‘ বেঁচে থাক বাবা, মঙ্গল হোক।’

ওজনদার দক্ষিণা ও নগদ বায়না পেয়ে সে দশ ক্রোশ দূরের মেলায় তার লোকজন নিয়ে ফিরতি ট্রেনে কেটে পড়ে।
“নোটন ভাগিয়াছে শুনিয়া অপর পাল্লাদার কবি মহাদেব আসরে বসিয়া মনে মনে আপসোস করিতেছিল। আজও পর্য্যন্ত নোটনের সহিত পাল্লায় কখনও সে পরাজয় স্বীকার করে নাই, কিন্তু আজ সে সর্ব্বান্তঃকরণে নীরবে পরাজয় স্বীকার করিল—সঙ্গে সঙ্গে নোটনকে বেইমান বলিয়া গালও দিল। তাহাকে বলিলে কি সেও যাইত না !”

দেশে যারা আছে, তাদের অনেকের অবস্থা সেই মহাদেবের মতো! সুযোগ পেলে সেও কি নোটনদসের মতো কেটে পড়ত না !

প্রকাশকালঃ ২রা ডিসেম্বর,২০১৯