শরীর ঠিক সায় দিচ্ছে না।

আমার প্রিয়ভাজন প্রকৌশলী বড়ভাই একদিন বলেছিল, ‘ জাহিদ! চল্লিশ পার হলে শরীরের যত্ন নিও। সব মেশিনের পার্টস পত্তরের একটা নির্দিষ্ট ওয়ারেন্টি পিরিয়ড থাকে। সেই একইভাবে আমাদের দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওয়ারেন্টি পিরিয়ড আছে, চল্লিশের আগ পর্যন্ত। এর পরে কোন কিছু ড্যামেজ হলে, আর কিছু করার নাই !

সাময়িক এই অসুস্থতার কথা অফিসের কয়েকজন জানে। অনেক দূরে থাকে, কিন্তু যোগাযোগে খুব কাছের যারা, তাঁদের কয়েকজন– কুল্লে বড়জোর জনা দশেক জানে। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের কেউ কেউ আমার ভিতরে কিছুটা বিক্ষিপ্ততা, অসংলগ্নতা দেখেছেন। একটা অস্থিরতা আমি লুকিয়ে রাখতে পারছি না । কীভাবে এই অবস্থা হয়েছে, তাঁর একটা ডিজিটাল বর্ণনা ফেসবুকে রেখে দিলে মন্দ কিছু না। পরে নিজেই ফিরে এসে দেখতে পারব।

আবার কেউ নতুন করে জিজ্ঞেস করলে, ফেসবুকের পাতা খুলে দেখিয়ে দিতে পারব। বারবার বলতে হবে না ! হতে পারে, হয়তো খানিকটা ভার্চুয়াল সমবেদনা পাওয়ার সম্ভাবনায় আমার এই লেখা। এখন তো আর সেই দিন নাইরে ভাই , যে কারো অসুস্থতার সংবাদে ফলমূল হরলিকস নিয়ে বাসায় হাজির হবে শুভাকাঙ্ক্ষীরা। একেতো সব ফলেই ফরমালিন আতঙ্ক ; আর হরলিকসে যে ঘোড়ার ডিমের কোন পুষ্টিগুণই নাই– সেটা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে।

হয়েছে কী , গত ৮ তারিখ বুধবার উত্তরা থেকে মিরপুর বাসায় যাওয়ার পথে বিশ্বরোডের আগে জ্যামে পড়লাম। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দুই ঘণ্টা বসে থাকলাম, হাজারো গাড়ির সারি। এমনিতে সন্ধ্যায় নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার, বাসায় পৌঁছে রাতের খাবার খেয়ে নিই একবারে। একে ক্ষুধা, আরেকদিকে ঐ ভয়ংকর স্থবিরতায় আমার মাথা ধরে গেল। বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েও সেই মাথা ধরে থাকাটা আর গেল না। দুইদিন পরে শুক্রবার সকালে উত্তরা আসতে লাগল চার ঘণ্টা। ইজতেমার মুসল্লিদের চাপে রাস্তা প্রায় অচল। মাথা ধরা আরো বেড়ে চলল। এর কয়েকদিন পরে আরেকদিন সন্ধ্যায় একই অবস্থা।

১৬ তারিখ দুপুরে মনে হচ্ছিল মাথার পিছনের তীব্র ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। সহধর্মীনিকে ফোনে বলার পরে প্রেশার মাপাতে বলল। ডিজিটাল মেশিনের সবার ভরসা কম। অদ্ভুতুড়ে রিডিং ১৭৭/১১৫ । বোঝা গেল কিছু একটা হয়েছে। আমিও ভাবলাম ভুলভাল রিডিং, কিন্তু পরে দেখা গেল মেশিন ঠিক আছে, আমিই ঠিক নাই ! অফিসের নানাবিধ কাজের চাপ, কম ঘুম, জ্যাম সবকিছু মিলিয়ে শরীর বেঁকে বসেছে।
ওষুধের ব্যাপারে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপারে আমার আলস্য সুবিখ্যাত! আমার বিগত দুই যুগের নানা অনিয়মের কথা আমার স্ত্রী কী করে মনে রেখেছে কে জানে ! প্রতিটি অনিয়মের কথা মনে করিয়ে আমার চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করে ঠেলতে ঠেলতে সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে গেল। অপেক্ষার প্রহর শেষে ডাক্তারের মুখোমুখি , সে আমাকে যাই জিজ্ঞেস করে তাই তে আমি হ্যাঁ সূচক উত্তর দিই। সিগারেট খান ? হ্যাঁ। ওজন ৮৮ কেজি ! হ্যাঁ। বীফ-মাটন ? হ্যাঁ। কার্বোহাইড্রেট, মিষ্টি? হ্যাঁ।উনি খুব হতাশার স্বরে বললেন, আপনি শেষ কবে চেক-আপ করিয়েছেন। বললাম বছর দেড়েক হবে মনে হয়। তখন তো বড় কোন সমস্যা ছিল না। কোলেস্টরেল, ক্রিয়েটিনাইন সবতো ভালই ছিল।

ডাক্তার সাহেব, আরো গম্ভীরভাবে বললেন, আপনি কি জানেন আপনি সম্ভাব্য একটা স্ট্রোক থেকে মাত্র কিছুটা দূরে ছিলেন?
আমি হাসি হাসি মুখ করে কাঁধ ঝাঁকালাম। ডাক্তার-রোগীর পুরো কনভারসেশন চলার সময় আমার সহধর্মীনি আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে আমাকে ভস্মীভূত করে দিচ্ছিল । ডাক্তার সাহেব তিন ধরণের প্রেশারের ওষুধ দিলেন। তক্ষুনিই পারলে খাইয়ে দেন।

বাসায় এসে আমার সবচেয়ে কাছের চিকিৎসক বন্ধু যে নিউইয়র্ক প্রবাসী, তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। সে সব শুনে বলল, তোর এই ব্লাড প্রেশার আকস্মিক, অনেকগুলো অস্বস্তি মিলিয়ে হুট করে হয়েছে। এই ধরণের পেশেন্টকে একবারে এতোগুলো ওষুধ দেওয়াটা বেশি হয়ে যায় রে । তোর তো আবার ডাক্তার-ওষুধ নিয়ে বিতৃষ্ণা আছে ; বরং তুই প্রথম একটা ওষুধ খা, আর ঘুমের ওষুধ খেতে থাক। অফিস থেকে পুরো একটা সপ্তাহ ছুটি নিয়ে বাসায় সময় কাটা। সেরে যাবে। সকালে হাঁটার অভ্যাস ছিল, সেটাও কয়েকদিনের জন্য বাদ দিতে বলল।
অফিস থেকে ছুটি নিতে পারিনি। আজ অমুক ভাইস প্রেসিডেন্ট, কাল তমুক ডিরেক্টর অফিসে হাজির। এখন বিছানায় পড়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। চাকরির বাজার এমনিতেই মন্দা ! এক সপ্তাহ ধরে বিপি ওঠানামা করছে, প্রায়শ: মাপছি আবার ভুলে যাচ্ছি। নানা অস্বস্তিতে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছি।
ভয় পাচ্ছি না , তবে রুদ্রের সেই কবিতার মতো, ‘অজান্তেই চমকে ওঠি ; জীবন, ফুরালো নাকি!’

“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।।
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে।
জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র
সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর
আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা
তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে
নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে
সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়
সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…”

প্রকাশকালঃ ২৪শে জানুয়ারি, ২০২০