প্রতীক্ষা।। রফিক আজাদ

এমন অনেক দিন গেছে
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো ব’লে
নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে-
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে
হয়তো বা ভবিষ্যতেও অপেক্ষা করবো…
এমন অনেক দিনই তো গেছে
কারো অপেক্ষায় বাড়ি ব’সে আছি-
হয়তো কেউ বলেছিলো, “অপেক্ষা ক’রো
একসঙ্গে বেরুবো।”

এক শনিবার রাতে খুব ক্যাজুয়ালি
কোনো বন্ধু ঘোরের মধ্যে গোঙানির মতো
উচ্চারণ করেছিলো, “বাড়ি থেকো
ভোরবেলা তোমাকে তুলে নেবো।”
হয়তো বা ওর মনের মধ্যে ছিলো
চুনিয়া অথবা শ্রীপুর ফরেস্ট বাংলো;
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি।

যুদ্ধের অনেক আগে
একবার আমার প্রিয়বন্ধু অলোক মিত্র
ঠাট্টা ক’রে বলেছিলো,
“জীবনে তো কিছুই দেখলি না
ন্যুব্জপীঠ পানশালা ছাড়া। চল, তোকে
দিনাজপুরে নিয়ে যাবো
কান্তজীর মন্দির ও রামসাগর দেখবি,
বিরাট গোলাকার চাঁদ মস্ত খোলা আকাশ দেখবি,
পলা ও আধিয়ারদের জীবন দেখবি,
গল্প-টল্প লেখার ব্যাপারে কিছু উপাদান
পেয়ে যেতেও পারিস,
তৈরী থাকিস- আমি আসবো”
-আমি অপেক্ষায় থেকেছি;

আমি বন্ধু, পরিচিত-জন, এমনকি- শত্রুর জন্যেও
অপেক্ষায় থেকেছি,
বন্ধুর মধুর হাসি আর শত্রুর ছুরির জন্যে
অপেক্ষায় থেকেছি-

কিন্তু তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো না,
-প্রতীক্ষা করবো।
‘প্রতীক্ষা’ শব্দটি আমি শুধু তোমারই জন্যে খুব যত্নে
বুকের তোরঙ্গে তুলে রাখলাম,
অভিধানে শব্দ-দু’টির তেমন কোনো
আলাদা মানে নেই-
কিন্তু আমরা দু’জন জানি
ঐ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য অনেক,
‘অপেক্ষা’ একটি দরকারি শব্দ—
আটপৌরে, দ্যোতনাহীন, ব্যঞ্জনাবিহীন,
অনেকের প্রয়োজন মেটায়।
‘প্রতীক্ষা’ই আমাদের ব্যবহার্য সঠিক শব্দ,
ঊনমান অপর শব্দটি আমাদের ব্যবহারের অযোগ্য,
আমরা কি একে অপরের জন্যে প্রতীক্ষা করবো না ?

আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো
দাঁড়িয়ে থাকবো-
ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের
জন্যে প্রতীক্ষমান,
আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো
আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,
দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে
আমার পায়ে শিকড় গজাবে…
আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না…

ঘরটা একটু অগোছাল।। প্রেমেন্দ্র মিত্র

ঘরটা একটু অগোছাল থাক,
উঠানে একটু ধূলো।
খাড়া দেওয়ালের কঠোর জ্যামিতি ভাঙতে
বন্য লতাটা তুলো।

অন্তরে কিছু সংশয় থাক
ভাষায় একটু দ্বিধা,
কিছু ভুলচুক কাটাকাটি নিয়ে
জীবনের মুসাবিদা।

নিরেট সত্য , নিখুঁত মাধুরী,
ছাপানো-ই মেলে কিনতে
শুধু নির্যাস চায় না হৃদয়
পুষ্পতরুর বৃন্তে।

কিছু ময়লা কিছু খাদ নিয়ে জেনো
সব মধুরের খেলা।
মর্ত্যের মাটি ময়লা বলেই
এখানে প্রাণের মেলা !

প্রকাশকালঃ শারদীয় দেশ ১৩৯৫। ১৯৮৮ (রচনাকাল ২রা এপ্রিল ১৯৬৫ )

সিদ্ধার্থ ।।মূলঃ হেরমান হেস( Hermann Hess) । অনুবাদ –জাফর আলম।

প্রিয় বই, নতুন করে পড়া।
সিদ্ধার্থ ।।মূলঃ হেরমান হেস( Hermann Hess) । অনুবাদ –জাফর আলম।

সিদ্ধার্থ উত্তর দিল , ‘ হ্যাঁ অনেক সময় নতুন ভাবনা এসেছে আমার মনে ; হয়তো উপলব্ধি করেছি নতুন কোন জ্ঞান ; কিন্তু আজ সব কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলা কঠিন হবে । গোবিন্দ, যে-কথাটি সবচেয়ে গভীর ছাপ দিয়েছে আমার মনে তা হল এইঃ জ্ঞান কাউকে শেখানো যায় না, দেওয়া যায় না । জ্ঞানী লোক যখন জ্ঞান বিতরণের চেষ্টা করেন তখন সে চেষ্টা আমার কাছে নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হয় ।’

‘ তুমি কি উপহাস করছ ? ’ গোবিন্দ জিজ্ঞাসা করল।
‘ না পরিহাস নয়। সারাজীবন খুঁজে যা আবিষ্কার করেছি, তোমাকে তাই বলেছি। বিদ্যা অন্যকে দেওয়া যায় , জ্ঞান দেওয়া যায় না। জ্ঞান নিজের সাধনা দ্বারা লাভ করতে হয় ; যিনি জ্ঞান লাভ করেছেন তাঁর জীবন পূর্ণ হলেও এবং জ্ঞানের সাহায্যে বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারলেও সে জ্ঞান কাউকে দান করতে পারবেন না । যোগ্যতম শিষ্যকেও শিখিয়ে দেওয়া যায় না জ্ঞানের রহস্য। যৌবনেই এ বিষয়ে আমার মনে সন্দেহ ছিল , তাই গুরুর শিক্ষা ত্যাগ করে চলে এসেছিলাম । গোবিন্দ, প্রত্যেক সত্যের বিপরীতটাও সমান সত্য – হয়তো এ-কথা তুমি পরিহাস বা আমার নির্বুদ্ধিতা বলে মনে করবে । কিন্তু আমার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এ-কথা বলছি। একমাত্র আংশিক সত্যকেই কথায় প্রকাশ করা যায় । যা-কিছু আমরা চিন্তা করি বা কথায় প্রকাশ করি তা সত্যের একাংশ মাত্র ; সত্যকে প্রকাশ করলেই তার সমগ্রতা , পূর্ণতা এবং ঐক্য ক্ষুণ্ণ হয় । বুদ্ধ যখন উপদেশ দিয়েছেন শিষ্যদের, তখন তিনি জগৎ কে ভাগ করে নিয়েছেন সংসার ও নির্বান, মায়া ও সত্য এবং দুঃখ ও মুক্তির মধ্যে। এছাড়া উপায় নেই ; যাঁরা দিতে চান তাঁদের এ পথই গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু যে জগতে আমরা বাস করি , যে জগ ৎ আমদের চারদিক থেকে বেষ্টন করে আছে তা তো খন্ডিত নয় । কোনো লোক বা কোনো কাজই সম্পূর্ণরূপে সংসার বা নির্বাণ নয় ; সম্পূর্ণরূপে সাধু বা পাপী কেউ নয় । অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সত্য— এই ভ্রান্ত ধারণার ফলেই আমরা ভুল করি । গোবিন্দ , সময়ের এই বিভাগ প্রকৃত নয় ; বারবার এ সত্য উপলব্ধি করেছি । সময় যদি সত্য না হয় , তাহলে বর্তমান জগত ও অনন্ত জগতের ব্যবধান , আনন্দ ও বেদনা , মঙ্গল ও অমঙ্গলের পার্থক্যও মিথ্যা ও মায়া ।’

‘………. গোবিন্দ , এই সৃষ্টি অসম্পূর্ণ নয়, ধীরে ধীরে পূর্ণতার পথে বিবর্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই এই সৃষ্টির। প্রতি মুহূর্তেই জগত পূর্ণ ; প্রত্যেক পাপের সাথে আছে ঈশ্বরের কৃপা ,প্রত্যকে বালকের মধ্যে আছে ভবিষ্যতের বৃদ্ধ ,প্রত্যেক দুগ্ধপোষ্য শিশুর মধ্যে আছে মৃত্যুর বীজ ,প্রত্যেক মুমূর্ষের মধ্যে আছে অনন্ত জীবনের ইঙ্গিত ।বুদ্ধ আছেন দস্যুর মধ্যে, জুয়ারীর অন্তরে ; আবার দস্যুর খোঁজ পাওয়া যাবে ব্রাহ্মণের মধ্যে। গভীর ধ্যানের সময়কালের ব্যবধান দূর করা সম্ভব হয় , যুগপৎ দেখা যায় সমগ্র অতীত ,বর্তমান ও ভবিষ্যতের অখন্ড রূপ । আমার তাই মনে হয় জগতের সবকিছুই শুভ ; জীবন ও মৃত্যু , পাপ ও পুণ্য , জ্ঞান ও নির্বুদ্ধিতা – সবই ভালো। এদের প্রত্যকেরই প্রয়োজন আছে আমাদের জীবনে; এদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে নিজেকে , স্বীকার করে নিতে হবে এদের , জগতের ভালো মন্দ সব কিছুই সহানুভূতির চোখে দেখতে হবে। ‘

মাতাল হও।। শার্ল বোদলেয়ার ; অনুবাদ- বিষ্ণু দে ।

সব সময় মাতাল হতে হবে। ওতেই সবঃ ঐ একমাত্র বিবেচ্য । যদি বোধ
করতে না চাও মহাকালের ভয়ঙ্কর ভার , যাতে তোমার ঘাড় ভেঙ্গে যায় আর
তুমি বেঁকে পড়ো মাটির দিকে , তবে তোমাকে মাতাল হতে হবে অবিরাম।
কিন্তু কিসে ? মদে, কবিতায়, সৎকার্যে , তোমার যা রুচি । কিন্তু মাতাল
হও।

“মাতাল হও।। শার্ল বোদলেয়ার ; অনুবাদ- বিষ্ণু দে ।”

বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ ।। সুবোধ সরকার

রূপমকে একটা চাকরি দিন– এম-এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে ওপারে গিয়ে বলবে , রূপম,
আজ চলি

তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন।
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যেন কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে।

তমাল বাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় ।
তমালবাবু মামাকে বললেন , রূপমের একটা চাকরি দরকার।
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে ,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে ।

মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে , সে বলল দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলল আগুনকে , আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে
আলিমুদ্দিন ছুটলো নদীকে বলার জন্য,
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল ;
রূপমকে একটা চাকরি দাও , এম-এ পাস করে বসে আছে
ছেলেটা

কয়েকমাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়ি ফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারাগায়ে ঘাস, খড়কুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন ।
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকার কয়েনের দিকে আমার চোখ
সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম-এ পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে।

একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম-এ পড়ান , কোন আহ্লাদে
আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন ? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল,ফোন বেজে চলল,
ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে , আরো কুড়ি বছর
বাজবে।

বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে উপকূলে আছড়ে পড়ে বললঃ
রূপমকে একটা চাকরি দিন।
কে রূপম ?
রূপ আচার্য , বয়স ২৬, এম-এ পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে।

অমলকান্তি ।। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

“অমলকান্তি ।। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী”