ভারতবর্ষ। রমাপদ চৌধুরী ।।

ফৌজী সংকেতে নাম ছিল বি এফ থ্রি-থার্টি-টু, সেটা আদপে কোনো স্টেশনই ছিলো না, না প্ল্যাটফর্ম, না টিকিটঘর । শুধু একদিন দেখা গেল ঝকঝকে নতুন কাঁটাতার দিয়ে রেল লাইনের ধারটুকু ঘিরে দেওয়া হয়েছে। ব্যস্‌ , ঐটুকুই। সারা দিনে আপ-ডাউনের একটা ট্রেনও থামতো না। থামতো শুধু একটি বিশেষ ট্রেন। হঠাৎ এক-একদিন সকালবেলায় এসে থামত। কবে কখন সেটা থামবে, তা শুধু আমরাই আগে থেকে জানতে পেতাম, বেহারী কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমরা পাঁচজন।

স্টেশন ছিলো না, ট্রেন থামতো না, তবু রেলের লোকদের মুখে মুখে একটা নতুন নাম চালু হয়ে গিয়েছিলো। তা থেকে আমরাও বলতাম ‘আণ্ডাহল্ট’।

আন্ডা মানে ডিম। আণ্ডাহল্টের কাছ ঘেঁষে দুটো বেঁটেখাটো পাহাড়ী টিলার পায়ের নীচে একটা মাহাতোদের গ্রাম ছিল, গ্রামে-ঘরে মুর্গী চরে বেড়াতো দূরে, অনেক দূরে ভূরকুণ্ডার শনিচারী হাটে-হাটে সেই মুর্গী কিংবা মুর্গীর ডিম বেচতেও যেতো মাহাতোরা। কখনো সাধের মোরগ বগলে চেপে মোরগ-লড়াই খেলতে যেতো। কিন্তু সেজন্য বি এফ থ্রি থার্টি টু-র নাম আণ্ডাহল্ট হয়ে যায়নি।

আসলে মাহাতোগাঁয়ের ডিমের ওপর আমাদের কোনো লোভই ছিলো না।

আমাদের ঠিকাদারের সঙ্গে রেলওয়ের ব্যবস্থা ছিল, একটা ঠেলা-ট্রলিও ছিলো তার, লাল শালু উড়িয়ে সেটা রেলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে এসে মালপত্র নামিয়ে দিয়ে যেতো। নামিয়ে দিয়ে যেতো রাশি রাশি ডিম। বেহারী কুক ভগোতীলাল আগের রাত্রে সেগুলো সেদ্ধ করে রাখতো।

কিন্তু সেজন্যেও নাম আণ্ডাহল্ট হয়নি। হয়েছিল ফুল-বয়েলড ডিমের খোসা কাঁটাতারের ওপারে ক্রমশ স্তূপীকৃত হয়ে জমেছিলো বলে। ডিমের খোসা দিনে দিনে পাহাড় হচ্ছিল বলে।

ফৌজী ভাষার বি এফ থ্রি থার্টি টু-র প্রথমেই যে দুটো অ্যালফাবেট, আমাদের ধারণা ছিলো তা কোনো সংকেত নয়, ব্রেকফাস্ট কথাটার সংক্ষিপ্ত রূপা।

রামগড়ে তখন পি ও ডবলু ক্যাম্প, ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দীরা সেখানে বেয়নেটে আর কাঁটাতারে ঘেরা। তাদেরই মাঝে মাঝে একটা ট্রেনে বোঝাই করে এ পথ দিয়ে কোথায় যেন চালান করে দিতো। কেন এবং কোথায়, আমরা কেউ জানতাম না।

শুধু আমরা খবর পেতাম ভোরবেলায় একটা ট্রেন এসে থামবে। ঠিকাদারের চিঠি পড়ে আগের দিন ডিমের ঝুড়িগুলো দেখিয়ে কুক ভগোতীলালকে বলতাম, তিনশো তিশ ব্রেকফাস্ট।

ভগোতীলাল গুনে গুনে ছ’শো ষাট আর গোটা পঁচিশ ফাউ বের করে নিতো। যদি পচা বের হয়। তারপর সেগুলো জলে ফুটিয়ে শক্ত ইট হয়ে গেলে তিনটে সার্ভার কুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোসা ছাড়াতো।

কাঁটাতারের ওপারে সেগুলোই দিনে দিনে স্তূপীকৃত হতো।

সক্কাল বেলায় ট্রেন এসে থামতো, আর সঙ্গে সঙ্গে কামরা থেকে ট্রেনের দু পাশে ঝুপঝাপ নেমে পড়তো মিলিটারি গার্ড। সঙ্গিন উঁচু-করা রাইফেল নিয়ে তারা যুদ্ধবন্দীদের পাহারা দিতো।

ডোরাকাটা পোশাকের বিদেশী বন্দীরা একে একে কামরা থেকে নেমে আসতো বড়সড়ো মগ আর এনামেলের থালা হাতে

দুটো বড়-বড় ড্রাম উলটে রেখে সে দুটোকেই টেবিল বানিয়ে সার্ভার কুলি তিনজন দাঁড়াত। আর ওরা লাইন দিয়ে একে-একে এগিয়ে এসে ব্রেকফাস্ট নিতো। একজন কফি ঢেলে দিতো মগে, একজন দু পিস করে পাঁউরুটি দিতো, আরেকজন দিত দুটো করে ডিম। ব্যস্‌, তারপর ওরা গিয়ে গাড়িতে উঠতো। কাঁধে আই-ই. খাকি বুশ-শার্ট পরা গার্ড হুইস্‌ল্‌ দিতো, ফ্লাগ নাড়তো, ট্রেন চলে যেতো।

মাহাতোরা কেউ কাছে আসতো না, দূরে দূরে ক্ষেতিতে জনারের বীজ রুইতে রুইতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখতো।

ট্রেন চলে যাওয়ার পরে ভগোতীলালের জিম্মায় টেস্ট রেখে আমরা কোনো কোনো দিন মাহাতোদের গ্রামের দিকে চলে যেতাম সবজির খোঁজে। পাহাড়ের ঢালুতে পাথুরে জমিতে ওরা সর্ষে বুনতো, বেগুন আর ঝিঙেও।

আণ্ডাহল্ট একদিন হল্ট-স্টেশন হয়ে গেল রাতারাতি। মোরম ফেলে লাইনের ধারে কাঁটাতারে ঘেরা জায়গাটুকু উঁচু করা হলো প্ল্যাটফর্মের মতো।

তখন আর শুধু পি-ও-ডব্লু নয়, মাঝে মাঝে মিলিটারি স্পেশালও এসে দাঁড়াতো। গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরা হিপ পকেটে টাকার ব্যাগ গোঁজা আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল মিলিটারি পুলিশ ট্রেন থেকে নেমে পায়চারি করতো, দু-একটা ঠাট্টাও ছুঁড়তো, আর সৈনিকের দল তেমনি সারি দিয়ে মগ আর থালা হাতে একে একে রুটি নিতো, ডিম নিতো, মগভরতি কফি। তারপরে যে যার কামরায় আবার উঠতো, খাকি বুশ-শার্টের গার্ড হুইস্‌ল্‌ বাজিয়ে ফ্লাগ নাড়তো, আমি ছুটে গিয়ে সাপ্লাই ফর্মে মেজরকে দিয়ে ও-কে করাতাম।

ট্রেন চলে যেতো, কোথায় কোন্‌দিকে আমরা কেউ জানতে পারতাম না।

সেদিনও এমনি আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন এসে দাঁড়াল। সার্ভার কুলি তিনটে ডিম রুটি কফি সার্ভ করছিলো। ভগোতীলাল নজর রাখছিলো কেউ ডিম পচা কিংবা রুটি স্লাস-এন্ড বলে ছুঁড়ে দেয় কি না।

ঠিক সেই সময় আমার হঠাৎ চোখ গেল কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে।

কাঁটাতার থেকে আরো খানিক দূরে নেংটি-পরা মাহাতোদের একটি ছেলে চোখ বড়ো করে তাকিয়ে দেখছে। কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা ছেলেটাকে একটা বাচ্চা মোষের পিঠে বসে যেতে দেখেছি একদিন।

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো ট্রেনটা। কিংবা রাঙামুখ আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিল।

একজন সৈনিক তাকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ ‘হে-ই’ বলে চিৎকার করলো, আর সঙ্গে সঙ্গে নেংটি-পরা ছেলেটা পাঁইপাঁই করে ছুটে পালালো মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে কয়েকটা আমেরিকান সৈনিক তখন হা-হা করে হাসছে।

ভেবেছিলাম ছেলেটা আর কোনো দিন আসবে না।

মাহাতোরা কেউ আসতো না, কেউ না। ক্ষেতিতে কাজ করতে করতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওরা শুধু অবাক-অবাক চোখ মেলে দূর থেকে দেখতো।

কিন্তু তারপর আবার যেদিন ট্রেন এলো, ট্রেন থামল, সেদিন আবার দেখি কোমরের ঘুনসিতে লোহা বাঁধা ছেলেটা কাঁটাতারের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে আরেকটা ছেলে, তার চেয়ে আরেকটু বেশী বয়েস। গলায় লাল সুতোয় ঝুলোনো দস্তার তাবিজ, ভূরকুণ্ডার হাটে একদিন গিয়েছিলাম, রাশি রাশি বিক্রি হয় মাটিতে ঢেলে, রাশি রাশি সিঁদুর, তাবিজ, তামার পিতলের দস্তার, বাঁশে ঝোলানো থাকে রঙিন সুতলি, পুঁতির মালা। একটা ফেরিওলাকে দেখেছি কখনো কখনো এক হাঁটু ধুলো নিয়ে, কাঁধে অগুন্তি পুঁতির ছড়, দূর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে যায়।

ছেলে দুটো অবাক-অবাক চোখ মেলে কাঁটাতারের ওপারে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সৈনিকদের দেখছিলো। প্রথম দিনের বাচ্চাটার চোখে একটু ভয়, হাঁটু তৈরি, কেউ চোখে একটু ধমক মাখালেই সে চট করে হরিণ হয়ে যাবে।

আমি হাতে ফর্ম নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম, সুযোগ পেলে হেসে হেসে মেজরকে তোয়াজ করছিলাম। একজন সৈনিক তার কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মগে চুমুক দিতে দিতে ছেলে দুটোকে দেখে পাশের জি আই-কে বললে, অফুল!

আমার এতদিন মনে হয়নি। ওরা তো দিব্যি ক্ষেতে-খামারে কাজ করে, গুল্‌তি নয়তো তীরধনুক নিয়ে খাটাশ মারে, নাটুয়া গান শোনে, হাঁড়িয়া খায়, ধনুকের ছিলার মতো কখনো টান টান হয়ে রুখে দাঁড়ায়। নেংটি-পরা সরু শরীর, কালো, রুক্ষ। কিন্তু ব্যাটা জি আই-এর ‘অফুল’ কথাটা যেন আমাকে খোঁচা দিলো। ছেলে দুটোর ওপর আমার খুব রাগ হলো।

সৈনিকদের কে একজন গলা ছেড়ে এক কলি গান গাইলো, দু-একজন হা-হা করে হাসছিলো, একজন চটপট কফির মগে চুমুক দিয়ে সার্ভার কুলিটাকে চোখ মেরে আবার ভরতি করে দিতে বললে। গার্ড এগিয়ে দেখতে এলো আর কত দেরি পাঞ্জাবী গার্ড কিন্তু দিব্যি চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে কথা বললে মেজরের সঙ্গে।

তারপর হুইস্‌ল্‌ বাজলো, ফ্ল্যাগ নড়লো, সবাই চটপট উঠে পড়লো ট্রেনে, হাতে চওড়া লাল ফিতে বাঁধা মিলিটারি পুলিশরাও।

ট্রেন চলে গেলে আবার সেই শূন্যতা, ধু-ধু বালির মধ্যে ফণিমনসার গাছের মতো শুধু সেই কাঁটাতারের বেড়া।

দিন কয়েক পরেই আবার একটা ট্রেন এলো। এবার পি-ও-ডবলু গাড়ি, ইটালিয়ান যুদ্ধবন্দীরা রামগড় থেকে আবার কোথাও চালান হচ্ছে। কোথায় আমরা জানতাম না, জানতে চাইতাম না।

ওদের পরনে স্ট্রাইপ-দেওয়া অন্য পোশাক, মুখে হাসি নেই, রাইফেল উঁচিয়ে সারাক্ষণ ওদেরই ট্রেনটা চারদিক থেকে গার্ড দেওয়া হতো। আমাদেরও একটু ভয় ভয় করতো। ভূরকুণ্ডায় গল্প শুনে এসেছিলাম, একজন নাকি ধুতিপাঞ্জাবি পরে পালাবার চেষ্টা করেছিলো, পারেনি। বাঙালী বলেই আমার আরো ভয়-ভয় করতো।

ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, কাঁটাতারের ওপারে শুধু সেই বাচ্চা ছেলে দুটো, খাটো কাপড়ের একটা বছর পনেরোর মেয়ে, দুটো পুরুষ ক্ষেতের কাজ ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওরা নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করলো, হাসলো, কলকল করতে করতে ঝরনার জলের মতো মাহাতোদের গাঁয়ের দিকে চলে গেল।

একজন, দুজন, পাঁচজন সেদিন দেখি জন দশেক মাহাতোগাঁয়ের লোক ট্রেন আসতে দেখেই মাঠ থেকে দৌড়তে শুধু করেছে। ট্রেনের জানালায় জানালায় খাকি রঙ দেখেই বোধ হয় ওরা বুঝতে পারতো। দিনে দুখানা প্যাসেঞ্জার মেল ট্রেনের মতো হুস করে বেরিয়ে যেতো, দু একখানা গুডস ট্রেন ঠুং-ঠুং করতে করতো তখন তো কই থামবে ভেবে মাহাতোগাঁয়ের লোক আসতো না ভিড় করে!

একদিন গিয়ে বলেছিলাম মাহাতোবুড়োকে, লোক পাঠিয়ে আমাদের আণ্ডাহল্টের তাঁবুতে বেচে আসতে সবজি আর চিংড়ি, সরপুঁটি, মৌরলা।

বুড়ো হেসে বলেছিল–ক্ষেতির কাজ ছেড়ে যাবো নাই।

তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কালো কালো নেংটি-পরা লোকগুলোকে, খাটো শাড়ির মেয়েগুলোকে। শুধু খালি-গা মাহাতোবুড়োর পায়ে একটা টাঙি জুতো, গেঁয়ো মৃধার কাছে বানানো টাঙি জুতো, এসে সারি দিয়ে ওরা কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে দাঁড়ালো।

ট্রেন ততক্ষণে এসে গেছে। ঝুপঝাপ নেমে পড়ে আমেরিকান সৈনিকের দল সারি দিয়ে চলেছে মগ আর থালি হাতে

দুশো আঠারো ব্রেকফাস্ট তখন রেডি বি এফ থ্রি থার্টি টু-তো বি এফ থ্রি থার্টি টু মানে আণ্ডাহল্ট।

তখন একটু শীত-শীত পড়তে শুরু করেছে। দূরের পাহাড়ে কুয়াশার মাফলার জড়ানো গাছগাছালি শিশির-ধোয়া সবুজ।

একজন সৈনিক ইয়াঙ্কি গলায় মুগ্ধতা প্রকাশ করলো।

আরেকজন কামরার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁটাতারের ওপারের রিক্ততার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ কফির মগটা ট্রেনের পা-দানিতে রেখে সে হিপ পকেটে হাত দিলো। ব্যাগ থেকে একটা চকচকে আধুলি বের করে ছুঁড়ে দিলো মাহাতোদের দিকে।

ওরা অবাক হয়ে সৈনিকটার দিকে তাকালো, কাঁটাতারের ভিতরে মোরামের ওপর পড়ে থাকা চকচকে আধুলিটার দিকে তাকালো, নিজেরা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো, তারপর অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই রইলো।

ট্রেনটা চলে যাবার পর ওরা নিঃশব্দে ফিরে চলে যাচ্ছিলো দেখে আমি বললাম, সাহেব বখশিস দিয়েছে, বখশিস তুলে নে ।

সবাই সকলের মুখের দিকে তাকালো, কেউ এগিয়ে এলো না।

আমি আধুলিটা তুলে মাহাতোবুড়োর হাতে দিলাম। সে বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর সবাই নিঃশব্দে চলে গেল। কারও মুখে কোনো কথা নেই।

আমার এই ঠিকাদারের তাঁবেদারি একটুও ভালো লাগতো না। জনমনুষ্য নেই, একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন দাঁড়ায় না, তাঁবুতে ভগোতীলাল আর তিনটে কুলি। নির্জন, নির্জন মাটি রুক্ষ, দুপুরের আকাশ রুক্ষ, রুক্ষ আমার মন।

মাহাতোগাঁয়ের লোকরাও কাছে ঘেঁষতো না। মাঝে মাঝে গিয়ে সবজি কিংবা চুনো মাছ কিনে আনতাম। ওরা বেচতে আসতো না, কিন্তু ভূরকুণ্ডার হাটে যেতো তিন ক্রোশ পথ হেঁটে।

দিন কয়েক কোনো ট্রেনের খবর ছিলো না। চুপচাপ, চুপচাপ।

হঠাৎ সেই কোমরের ঘুনসিতে লোহা-বাঁধা ছেলেটা একদিন এসে জিগ্যেস করলো, টিরেন আসবে না বাবু?

হেসে ফেলে বললাম, আসবে, আসবে।

ছেলেটার আর দোষ কি, বেঁটে বেঁটে পাহাড়, রুক্ষ জমি, একটা দেহাতী ভিড়ের বাস দেখতে হলেও দু’ ক্রোশ হেঁটে যেতে হয় খয়েরগাছের ঝোপের মধ্যে দিয়ে। সকালে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন একটুও স্পীড না কমিয়ে হুস করে বেরিয়ে যেতো, বিকেলের ডাউন ট্রেনটাও থামতো না, তবু কয়েক মুহূর্ত জানালায় জানালায় ঝাপসা মুখ দেখার জন্যে আমরা তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতাম মানুষ না দেখে আমরা হাঁপিয়ে উঠতাম।

তাই আমেরিকান সৈনিকদের স্পেশাল ট্রেন আসছে শুনলে যেমন বিব্রত বোধ করতাম তেমনি আবার স্বস্তিও ছিলো।

দিন কয়েক পরেই প্রথমে এলো খবর, তার পরদিন মিলিটারি স্পেশাল ঝুপঝাপ করে জি আইরা নামলো, সারি দিয়ে সব ডিম রুটি মগ-ভরতি কফি নিলো।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে মাহাতোগাঁয়ের ভিড় ভেঙে পড়েছে। বিশ হতে পারে, তিরিশ হতে পারে, হাঁটুসমান বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কত কে জানে। খাটো শাড়ির মেয়েগুলোও বোকা-বোকা চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলো। ওদের দেখে আমার কেমন ভয়-ভয় করলো। ভগোতীলাল কিংবা সার্ভার কুলি তিনটে মাহাতোগাঁয়ের দিকে যেতে চাইলে আমার বড় ভয়-ভয় করতো।

প্ল্যাটফর্ম তো ছিলো না, শুধু উঠতে নামতে সুবিধের জন্যে লাইনের ধারটুকু মোরম ফেলে উঁচু করা হয়েছিলো। আমেরিকান সৈনিকরা কফির মগে চুমুক দিতে দিতে পায়চারি করছিলো। দু একজন স্থির দৃষ্টিতে মাহাতোগাঁয়ের কালো কালো মানুষগুলোকে দেখছিল।

হঠাৎ একজন ভগোতীলালের দিকে এগিয়ে গিয়ে হিপ পকেট থেকে ব্যাগ বের করলো, ব্যাগ থেকে একখানা দু’ টাকার নোট, তারপর জিগ্যেস করলে, কয়েনস আছে? নোটভাঙানো খুচরো সৈনিকরা কেউ রাখতেই চাইতো না, পয়সা ফেরত না নিয়ে দোকানী কিংবা ফেরিওয়ালা কিংবা ট্যাকসি ড্রাইভারকে বলতো, ঠিক আছে, ঠিক আছে। রাঁচিতে গিয়ে কয়েকবার দেখেছি।

এক-আনি, দু-আনি আর সিকি মিলিয়ে ভগোতীলাল ভাঙিয়ে দিচ্ছিলো, হঠাৎ দেখি কাঁটাতারের বেড়ার ওধারে ভিড়ের ভিতর থেকে কোমরের ঘুনসিতে লোহার টুকরো বাঁধা সেই ছেলেটা হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে কি চাইছে।

সঙ্গে সঙ্গে ভগোতীলালের কাছ থেকে সেই খুচরো আনি-দুয়ানিগুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে সেই আমেরিকান সৈনিক মাহাতোদের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

আমার তখন সাপ্লাই ফর্ম ও-কে করানো হয়ে গেছে, গার্ড হুইস্‌ল্‌ দিয়েছে।

ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অমনি মাহাতোদের দিকে ফিরে তাকালাম।

ওরা তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো, তাকিয়ে ছিলো। তারপর হঠাৎ, লাল মোরামের ওপর, ছড়ানো পয়সাগুলোর ওপর কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোমরের ঘুনসিতে লোহা বাঁধা ছেলেটা আর গলায় লাল সুতলিতে দস্তার তাবিজ-বাঁধা ছেলেটা।

সেই মুহূর্তে টাঙি-জুতো পরা মাহাতোবুড়ো ধমক দিয়ে বলে উঠলো, খবর্দার ! এমন জোরে চিৎকার করলো যে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম।

কিন্তু বাচ্চা দুটো ওর কথা শুনলো না। তারা দুজনে তখন যে যত পেরেছে আনি দু-আনি কুড়িয়ে নিয়েছে। মুখ খোসা-ছাড়ানো কচি ভুট্টার মতো হাসছে। মেয়েপুরুষের সমস্ত ভিড় হাসছে।

টাঙি-জুতো পরা মাহাতোবুড়ো রেগে গিয়ে তাদের ভাষায় অনর্গল কি সব বলে গেল। মেয়েপুরুষের ভিড় হাসলো।

মাহাতোবুড়ো রাগে গজগজ করতে করতে গাঁয়ের দিকে চলে গেল একাই। মাহাতোগাঁয়ের লোকগুলোও চলে গেল কলকল কথা বলতে বলতে, খলখল হাসতে হাসতে

ওরা চলে যেতেই আণ্ডাহল্ট আবার নির্জন নিস্তব্ধ শূন্যতা আমার এক-এক সময় ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেতো। দূরে দূরে পাহাড়, মহুয়ার বন, খয়েরের ঝোপ পার হয়ে একটা ছোট্ট জল চোঁয়ানো ঝরনা, মাহাতোগাঁয়ের সবুজ ক্ষেত। চোখ জুড়িয়ে যায়, চোখ জুড়িয়ে যায় তার মধ্যে। কালো কালো নেংটি-পরা মানুষ।

এদিকে মাঝে মাঝেই আমেরিকান সোলজারদের ট্রেন আসে, থামে, ডিম রুটি মগ-ভরতি কফি খেয়ে চলে যায়। মাহাতোগাঁয়ের লোক ভিড় করে আসে, কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে সারি দিয়ে দাঁড়ায়।

–সাব বখশিস, সাব বখশিস!

একসঙ্গে অনেকগুলো দেহাতী গলা চিৎকার করে উঠল।

মেজরের কাছে ফর্ম ও-কে করাতে গিয়ে আমি চমকে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, শুধু বাচ্চা ছেলে দুটো নয়, কয়েকটা জোয়ান পুরুষও হাত বাড়িয়েছে। খাটো শাড়ির একটা তুখোড় শরীরের মেয়েও ।

একদিন সবজি নিতে গিয়েছিলাম, ঐ মেয়েটা হেসে হেসে জিগ্যেস করেছিলো, টিরেন কবে আসবে ?

এক-একদিন অকারণেই ওরা দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো, অপেক্ষা করে করে চলে যেতো।

কাঁধে-স্ট্রাইপ তিন-চারটে আমেরিকান ততক্ষণে হিপ পকেট থেকে মুঠো মুঠো আনি দু-আনি বের করে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করেনি, ওরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো পয়সাগুলোর ওপর। হুড়োহুড়িতে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে হাত-পা ছড়ে গেল কারও, কারও বা নেংটির কাপড় ফেঁসে গেল।

ট্রেন চলে যাওয়ার পর ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম ওদের। মনে হলো মাহাতোগাঁয়ের আধখানাই এসে জড় হয়েছে। সবারই মুখে স্ফুর্তির হাসি, সবাই কিছু-না-কিছু পেয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেই টাঙি-জুতোর মাহাতোবুড়োকে দেখতে পেলাম না। মাহাতোবুড়ো আসেনি। সেদিন ওর আপত্তি, ওর ধমক শুনেও পয়সাগুলো ফেলে দেয়নি ছেলে দুটো। তাই বোধ হয় রেগে গিয়ে আর আসেনি।

আমার ভাবতে ভালো লাগল বুড়োটা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে একা-একা মাটি কোপাচ্ছে।

আমাদের দিন, কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমাদের পাঁচজনের দিন আণ্ডাহল্টের তাঁবুর মধ্যে কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে এক-একদিন সৈনিক-বোঝাই ট্রেন আসছিলো, থামছিলো, চলে যাচ্ছিলো। মাহাতোগাঁয়ের লোক ভিড় করে এসে কাঁটাতারের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়াতো, হাত বাড়িয়ে সবাই ‘সাব বখশিস, সাব বখশিস’ চেঁচাতো।

হঠাৎ এক-একদিন মাহাতোবুড়োকে দেখতে পেতাম কোনো দিন ক্ষেতের কাজ ফেলে দু হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হনহন করে এগিয়ে আসতো, রেগে গিয়ে ধমক দিতে সকলকে ওর কথা শুনছে না বলে কখনো বা অসহায় প্রতিবাদের চোখে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো।

কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না। সৈনিকরা হিপ পকেটে হাত দিয়ে হা-হা করে হাসতে হাসতে মুঠো-ভরতি পয়সা ছুঁড়ে দিতো। মাহাতোগাঁয়ের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেই পয়সাগুলোর ওপর, নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ঝগড়া বাধাতো। তা দেখে সৈনিকরা হা-হা করে হাসতো।

শেষে পর পর কয়েক দিন লক্ষ্য করলাম টাঙি-জুতো পরা মাহাতোবুড়ো আর আসে না মাহাতোবুড়ো ওদের দেখে রেগে যেতে বলে, মাহাতোবুড়ো আর আসতো না বলে আমার এক ধরনের গর্ব হতো। কারণ, এক-একসময় ঐ লোকগুলোর ব্যবহারে আমরা—আমি আর ভগোতীলাল খুব বিরক্তি বোধ করতাম ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেতাম ওদের কালেকুলো দীন দরিদ্র বেশ দেখে সৈনিকের দল নিশ্চয় ওদের ভিখিরী ভাবতে ভাবতো বলেই আমার খুব খারাপ লাগতো।

সেদিন কাঁটাতারের ওপার থেকে ওরা বখশিস বখশিস বলে চিৎকার করছে, কাঁধে আই ই খাকি বুশশার্টের গার্ড জানকীনাথের সঙ্গে আমি গল্প করছি, আমাদের পাশ দিয়ে একজন অফিসার মচমচ করে যেতে যেতে চিৎকার শুনে থুতু ফেলার মতো গলায় বলে উঠলো, ব্লাডি বেগার্স ।

আমি আর জানকীনাথ পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম আমাদের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল মাথা তুলে তাকাতে পারলাম না। শুধু অক্ষম রাগে ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠলাম

ব্লাডি বেগার্স, ব্লাডি বেগার্স।

সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো মাহাতোদের ওপর। ট্রেন চলে যেতেই আমি ভগোতীলালকে সঙ্গে নিয়ে ওদের তাড়া করে গেলাম। ওরা কুড়োনো পয়সা ট্যাঁকে গুঁজে হাসতে হাসতে পালালো।

তবু ওদের জন্যে সমস্ত লজ্জা আমি একটা অহঙ্কারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে সেই অহঙ্কারটা আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো মাহাতোবুড়োর চেহারা নিয়ে।

কিন্তু সেদিন আমার বুকের মধ্যের সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে গেল।

ভূরকুণ্ডায় ঠিকাদারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই খবর পেয়েছিলাম।

সার্ভার দুজন কুলি তখন টেবিল বানানো ড্রাম দুটোকে পায়ে ঠেলে ঠেলে আণ্ডাহল্টের কাঁটাতারের ওপারে সরিয়ে দিচ্ছিলো। তাঁবুর দড়ি খুলছিলো আরেকজন। ভগোতীলাল ড্রামটার গায়ে একটা জোর লাথি মেরে বললে, খেল খতম, খেল খতম।

হঠাৎ হই-হল্লা শুনে চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখি মাহাতোগাঁয়ের লোক ছুটতে ছুটতে আসছে।

আমরা অবাক হয়ে তাকালাম তাদের দিকে। ভগোতীলাল কি জানি কেন হেসে উঠলো।

ততক্ষণে কাঁটাতারের ওপারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেছে ওরা।

সঙ্গে সঙ্গে একটা হুইস্‌ল্‌ শুনতে পেলাম, ট্রেনের শব্দ কানে এলো।

ফিরে তাকিয়ে দেখি ট্রেনটা বাঁক দিয়ে আণ্ডাহল্টের দিকেই আসছে, জানালায় জানালায় খাকি পোশাক।

আমরা বিব্রত বোধ করলাম, আমরা অবাক হলাম। তা হলে কি খবর পাঠাতেই ভুলে গেছে ভূরকুণ্ডার আপিস? না যে খবর শুনে এসেছি সেটাই ভুল?

ট্রেনটা যত এগিয়ে আসছে ততই একটা অদ্ভুত গমগম আওয়াজ আসছে। আওয়াজ নয়, গান। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল সমস্ত ট্রেন, ট্রেন-ভরতি সৈনিকের দল পরস্পরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে।

বিভ্রান্তের মতো আমি একবার ট্রেনটার দিকে তাকালাম, একবার কাঁটাতারের ভিড়ের দিকে। আর সেই মুহূর্তে চোখ পড়লো সেই মাহাতোবুড়োর দিকে। সমস্ত ভিড়ের সঙ্গে মিশে গিয়ে মাহাতোবুড়োও হাত বাড়িয়ে চিৎকার করছে, সাব বখশিস, সাব বখশিস !

উন্মাদের মতো, ভিক্ষুকের মতো তারা চিৎকার করছে। তারা এবং সেই মাহাতোবুড়ো। কিন্তু আমেরিকান সৈনিকদের সেই ট্রেনটা অন্যদিনের মতো এবারে আর আণ্ডাহল্টে এসে থামলোনা। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর মতোই আণ্ডাহল্টকে উপেক্ষা করে হুস্‌ করে চলে গেল।

আমরা জানতাম ট্রেন আর থামবে না। ট্রেনটা চলে গেল। কিন্তু মাহাতোগাঁয়ের সবাই ভিখিরি হয়ে গেল। ক্ষেতিতে চাষ করা মানুষগুলো সব—সব ভিখিরি হয়ে গেলো।

দেশ । বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ৩। ৩০ কার্তিক ১৩৭৫ । ১৬ নভেম্বর ১৯৬৮

কসাই।। নির্মলেন্দু গুণ

একদিন এক বিজ্ঞ কসাই
ডেকে বললোঃ ‘এই যে মশাই,
বলুন দেখি, পাঁঠা কেন
হিন্দুরা খায়,
গরু কেন মুসলিমে?’
আমি বললামঃ ‘ সে অনেক কথা,
ফ্রেশ করে তা লিখতে হবে
কর্ণফুলীর এক রীমে।‘
কসাই শুনে মুচকি হাসেঃ
‘বেশ বলেছেন খাঁটি,
আমি কিন্তু একি ছোরায়
এই দুটোকেই কাটি।’

উদয়ের পথে ।। জয়দেব বসু

ছেলেটির বয়স যখন সাত-
চাঁদা দিতে না পারায় চোখের সামনে তাঁর বাবাকে
সপাটে চড় কষিয়েছিল পাড়ার এক নেতা ;
কেউ কোন প্রতিবাদ করেনি।
দু’বছর—
সরকারী জমিতে শনি-মন্দির তুলতে বাধা দেবার জন্য
‘প্রকাশ্য দিবালোকে’ তার দাদাকে ফেলে পিটিয়েছিল
যেসব ছেলেরা,
একদা তারা অন্য দলের হলেও, এখন ওই নেতারই
অনুগামী।
ছেলেটি এসব দেখেছিল।
সে দেখেছিল—
১)একটা লোকও বাধা দিতে আসেনি। ২) অজ্ঞান
দাদার মুখে জলের ঝাপটা দিতেও পারেনি কোন বন্ধু,
কারণ ‘পাঞ্জা’ কেটে নেওয়ার ভয় ছিল।৩) পাড়ার ডাক্তার
প্রাথমিক চিকিৎসাও করতে আসেনি। ৪) থানা কোন
এফ-আই-আর নেয় নি।৫)পুরপিতা তার কোঁচকানো মুখের
বাবাকে বলেছিলেন, ‘দোষ তো আপনার ছেলেরই , সে কেন
লাগতে যায়…!’

দেখতে-দেখতেই ছেলেটার ষোলো বছর বয়স হল।
তার গাল এখন কচি দুর্বাঘাসের গালচে, হাড় হয়ে উঠছে
চওড়া
নাইন-টেনের মেয়েরা এখন তার দিকে আড়চোখে তাকায়,
কিন্তু তারা জানে না,
ঘাসের ঐ গালিচার নীচে তার চোয়াল হয়ে উঠেছে কঠিন,
চোখের কোনায় জমেছে রক্ত,যা সাদা চোখে দেখা যায় না।
গল্পে বা সিনেমায় এসব ছেলেরাই এখন রুখে দাঁড়ায়,
শোধ নেয় বাপ-দাদার অপমানের,
হাতে তুলে নেয় বিচার-
অমিতাভ বচ্চন থেকে শাহ্‌রুখ খান
আমাদের এমনটাই দেখিয়ে আসছেন।
কিন্তু, শিল্প ও জীবনের মধ্যে, কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে
অহর্নিশ যে লুকোচুরি চলে,
তাতে মাঝে-মাঝেই আমাদের শিল্প ও কল্পনা যে
মারাত্মক হোঁচট খায়, তাতে আর সন্দেহ কী !
ষোলো বছরের ঐ ছেলে , একদিন সামান্য বিবাদের জন্য,
আর তিন বন্ধুর সঙ্গে নিজের বাবার পেটেই ঢুকিয়ে দিল
চাকু।
খুব স্বাভাবিক,
কারণ, ছোট থেকেই সে দেখেছে,
এই লোকটাকে মারা যায়—কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।
বাধা দিতে এসেছিল তার দাদা—
ফালাফালা হয়ে গেল সেও।
কেননা, তাকেও তো মারা যায়,
মারলে কোন শাস্তি হয় না,
পুলিশ এফ-আই-আর-নেয় না,
পুরপিতা চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘দোষ তো ওরই…।’
তারপর, অস্ত্রগুলো ধুয়েমুছে পরিপাটি করে টেবিলে সাজিয়ে
স্বাভাবিক মুখে বেরিয়ে পড়ল চারজন।
ভোরের আগেই তিনজন সীমান্ত পেরিয়ে গেল,
দূরে কোথাও বৃষ্টি হওয়ায় তারা ঠান্ডা বাতাসও পেয়েছিল।
আর, চতুর্থজন—আমাদের নায়ক—আশ্রয় নিল
সেই নেতার কাছে,
একদা যিনি চড় মেরে তার বাবাকে সহবৎ শিখিয়েছিলেন।
কোন প্রত্যক্ষদর্শী নেই—ছেলেটি জামিন পেল।
প্রত্যক্ষদর্শী নেই—বেকসুর খালাস পেল।
প্রত্যক্ষদর্শী নেই—পিতৃসম্পত্তি পেতেও অসুবিধা হল না।
পাড়ার মোড়েই এখন তার আড্ডা,
চোখের রক্ত আরো গাঢ় হয়েছে, সাদা চোখে
যা বোঝা যায় না।
নাইন-টেনের মেয়েরা এখন তাকে দেখলেই
ঘরে ঢুকে পড়ে,
আবার দমচাপা সেই ভয়ের মধ্যে আকর্ষণও যে কিছু নেই
জোর দিয়ে বলা যায় না কিছু।
এরকম কেন হয় !
হে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাগণ,
এরকম কেন হয়—
এটাই তো আপনাদের প্রশ্ন?
তবে শুনুন,
এই মহতী বাস্তবতার অনুপম ভিত্তিটি
অমর্ত্য উদাসীনতায়, কুটোটুকুও না নেড়ে
আপনারাই এতদিন ধরে তৈরী করেছেন।
এখন আপনাদের ভেড়ুয়া বললে…
মাইরি বলছি… ভেড়ুয়াদেরই খিস্তি করা হয়।

‘দেশ’ বর্ষ ৬৩ সংখ্যা ১৯। ২৯ আষাঢ় ১৪০৩। ১৩ জুলাই ১৯৯৬

যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো? – শক্তি চট্টোপাধ্যায়।।

ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।

এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।

এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি

যে-কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?

সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো

যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
একাকী যাবো না অসময়ে।।

কুড়ি বছর পরে ।। জীবনানন্দ দাশ

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে!
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি- কুড়ি বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের- আমেরঃ
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠ হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশ্বত্থের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!

মজার মুশকিল।। সুনীল বসু

পৃথিবীতে উই পোকাও যা উচ্চিংড়েও যা পিঁপড়েও যা
মানুষও তাই, অবশ্য আমার কাছে
অবশ্য মন-মেজাজের—
অবশ্য আবহওয়া অনুসারে—

এখন মানুষের টাক নিয়ে হয়েছে একটা মুশকিল
স্বামীদের টাক কে কী রূপসী স্ত্রী-রা ভালবাসেন
নায়কের টাককে কি রূপসী নায়িকারা সহ্য করেন
আমি ভেবে দেখি কোন্‌ কোন্‌ বিখ্যাত মানুষদের
মাথা ভর্তি টাক ছিল—

টাক ছিল লেনিনের
টাক ছিল ওয়ালেস স্টীভেন্সের
টাক ছিল ভেরলেনের
টাক ছিল সোফিয়া লরেনের স্বামীর
এবং অতএব আমিও টাকের অধিকারী
স্ত্রীর মন্তব্যেঃ ইস্‌ যদি তোমার টাক না থাকত!

পৃথিবীতে আমিও একটা পোকা , পিপীলিকা অথবা উচ্চিংড়ে
যদি একটা টাক আমার থেকেই থাকে
তাতে এতো মুষড়ে পড়ার কি আছে?
আমি তো মোটেই বিখ্যাত না ।