by Jahid | Nov 25, 2020 | শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য
ইতিমধ্যে বাড়িতে পরে পরে কয়েকটি মৃত্যুঘটনা ঘটিল। ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। মা’র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প। [{ সারদাদেবীর মৃত্যু, ১২৮১, ২৫ ফাল্গুন, [১৮৭৫, ৮ মার্চ]— র-কথা ]} অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়— তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!” তখনই বউঠাকুরানী [{ ↓কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী↓]} তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন— পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না;— সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর-দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শশ্মান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম— তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন।
বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ [{ ↓কাদম্বরী দেবী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী↓]} ছিলেন তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন। তিনিই আমাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া, আমাদের যে কোনো অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিনরাত্রি চেষ্টা করিলেন। যে-ক্ষতি পূরণ হইবে না, যে-বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ;— শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোনো আঘাতকে গভীরভাবে গ্রহণ করে না, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া রাখে না। এইজন্য জীবনে প্রথম যে-মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দপদে চলিয়া গেল। ইহার পরে বড়ো হইলে যখন বসন্তপ্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম— তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত;— আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম যে-স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার আর অন্ত নাই— তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি।
কিন্তু আমার চব্বিশবছর বয়সের সময় মৃত্যুর [{ ↓কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু, ১২৯১, ৮ বৈশাখ [১৮৮৪, ১৯ এপ্রিল]— রবীন্দ্র-জীবনী ১, পৃ ১৫০↓]} সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়েসের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়— কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।
জীবনের মধ্যে কোথাও যে কিছুমাত্র ফাঁক আছে, তাহা তখন জানিতাম না; সমস্তই হাসিকান্নায় একেবারে নিরেট করিয়া বোনা। তাহাকে অতিক্রম করিয়া আর-কিছুই দেখা যাইত না, তাই তাহাকে একেবারে চরম করিয়াই গ্রহণ করিয়াছিলাম। এমনসময় কোথা হইতে মৃত্যু আসিয়া এই অত্যন্ত প্রত্যক্ষ জীবনটার একটা প্রান্ত যখন এক মুহূর্তের মধ্যে ফাঁক করিয়া দিল, তখন মনটার মধ্যে সে কী ধাঁধাই লাগিয়া গেল। চারিদিকে গাছপালা মাটিজল চন্দ্রসূর্য গ্রহতারা তেমনি নিশ্চিত সত্যেরই মতো বিরাজ করিতেছে, অথচ তাহাদেরই মাঝখানে তাহাদেরই মতো যাহা নিশ্চিত সত্য ছিল— এমন-কি, দেহ প্রাণ হৃদয় মনের সহস্রবিধ স্পর্শের দ্বারা যাহাকে তাহাদের সকলের চেয়েই বেশি সত্য করিয়াই অনুভব করিতাম সেই নিকটের মানুষ যখন এত সহজে এক নিমিষে স্বপ্নের মতো মিলাইয়া গেল তখন সমস্ত জগতের দিকে চাহিয়া মনে হইতে লাগিল, এ কী অদ্ভুত আত্মখণ্ডন! যাহা আছে এবং যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে কোনোমতে মিল করিব কেমন করিয়া! [{ ↓তুমি কোথায় (ভারতী, ১২৯১ পৌষ), কড়ি ও কোমল, রচনাবলী ২ ‘পুষ্পাঞ্জলি (ভারতী, ১২৯২ বৈশাখ) এবং ‘প্রথম শোক’ (‘কথিকা’, সবুজপত্র, ১৩২৬ আষাঢ়), লিপিকা↓]}
জীবনের এই রন্ধ্রটির ভিতর দিয়া যে একটা অতলস্পর্শ অন্ধকার প্রকাশিত হইয়া পড়িল, তাহাই আমাকে দিনরাত্রি আকর্ষণ করিতে লাগিল। আমি ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল সেইখানে আসিয়া দাঁড়াই, সেই অন্ধকারের দিকেই তাকাই এবং খুঁজিতে থাকি— যাহা গেল তাহার পরিবর্তে কী আছে। শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস করিতে পারে না। যাহা নাই তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই। এইজন্যই যাহা দেখিতেছি না তাহার মধ্যে দেখিবার চেষ্টা, যাহা পাইতেছি না তাহার মধ্যেই পাইবার সন্ধান কিছুতেই থামিতে চায় না। চারাগাছকে অন্ধকার বেড়ার মধ্যে ঘিরিয়া রাখিলে, তাহার সমস্ত চেষ্টা যেমন সেই অন্ধকারকে কোনোমতে ছাড়াইয়া আলোকে মাথা তুলিবার জন্য পদাঙ্গুলিতে ভর করিয়া যথাসম্ভব খাড়া হইয়া উঠিতে থাকে— তেমনি, মৃত্যু যখন মনের চারিদিকে হঠাৎ একটা ‘নাই’-অন্ধকারের বেড়া গাড়িয়া দিল, তখন সমস্ত মনপ্রাণ অহোরাত্র দুঃসাধ্য চেষ্টায় তাহারই ভিতর দিয়া কেবলই ‘আছে’-আলোকের মধ্যে বাহির হইতে চাহিল। কিন্তু সেই অন্ধকারকে অতিক্রম করিবার পথ অন্ধকারের মধ্যে যখন দেখা যায় না তখন তাহার মতো দুঃখ আর কী আছে।
তবু এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, তাহাতে আমি নিজেই আশ্চর্য হইতাম। জীবন যে একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত নহে, এই দুঃখের সংবাদেই মনের ভার লঘু হইয়া গেল। আমরা যে নিশ্চল সত্যের পাথরে-গাঁথা দেয়ালের মধ্যে চিরদিনের কয়েদি নহি, এই চিন্তায় আমি ভিতরে ভিতরে উল্লাস বোধ করিতে লাগিলাম। যাহাকে ধরিয়াছিলাম তাহাকে ছাড়িতেই হইল, এইটাকে ক্ষতির দিক দিয়া দেখিয়া যেমন বেদনা পাইলাম তেমনি সেইক্ষণেই ইহাকে মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি বোধ করিলাম। সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণপূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে-ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চাপিয়া রাখিয়া দিবে না— একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না— এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন যেন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম।
সেই বৈরাগ্যের ভিতর দিয়া প্রকৃতির সৌন্দর্য আরও গভীররূপে রমণীয় হইয়া উঠিয়াছিল। কিছুদিনের জন্য জীবনের প্রতি আমার অন্ধ আসক্তি একেবারেই চলিয়া গিয়াছিল বলিয়াই, চারিদিকে আলোকিত নীল আকাশের মধ্যে গাছপালার আন্দোলন আমার অশ্রুধৌত চক্ষে ভারি একটি মাধুরী বর্ষণ করিত। জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে-দূরত্বের প্রয়োজন মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম তাহা বড়ো মনোহর।
সেই সময়ে আবার কিছুকালের জন্য আমার একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ দেখা দিয়াছিল। সংসারের লোকলৌকিকতাকে নিরতিশয় সত্য পদার্থের মতো মনে করিয়া তাহাকে সদাসর্বদা মানিয়া চলিতে আমার হাসি পাইত। সে-সমস্ত যেন আমার গায়েই ঠেকিত না। কে আমাকে কী মনে করিবে, কিছুদিন এ-দায় আমার মনে একেবারেই ছিল না। ধুতির উপর গায়ে কেবল একটা মোটা চাদর এবং পায়ে একজোড়া চটি পরিয়া কতদিন থ্যাকারের [{১↓Thacker Spink & Co.↓]} বাড়িতে বই কিনিতে গিয়াছি। আহারের ব্যবস্থাটাও অনেক অংশে খাপছাড়া ছিল। কিছুকাল ধরিয়া আমার শয়ন ছিল বৃষ্টি বাদল শীতেও তেতালায় বাহিরের বারান্দায়; সেখানে আকাশের তারার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হইতে পারিত এবং ভোরের আলোর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিলম্ব হইত না।
এ-সমস্ত যে বৈরাগ্যের কৃচ্ছ্রসাধন তাহা একেবারেই নহে। এ যেন আমার একটা ছুটির পালা, সংসারের বেত-হাতে গুরুমহাশয়কে যখন নিতান্ত একটা ফাঁকি বলিয়া মনে হইল তখন পাঠশালার প্রত্যেক ছোটো ছোটো শাসনও এড়াইয়া মুক্তির আস্বাদনে প্রবৃত্ত হইলাম। একদিন সকালে ঘুম হইতে জাগিয়াই যদি দেখি পৃথিবীর ভারাকর্ষণটা একেবারে অর্ধেক কমিয়া গিয়াছে, তাহা হইলে কি আর সরকারি রাস্তা বাহিয়া সাবধানে চলিতে ইচ্ছা করে। নিশ্চয়ই তাহা হইলে হ্যারিসন রোডের চারতলা-পাঁচতলা বাড়িগুলা বিনা কারণেই লাফ দিয়া ডিঙাইয়া চলি এবং ময়দানে হাওয়া খাইবার সময় যদি সামনে অক্টর্লনি মনুমেণ্ট্টা আসিয়া পড়ে তাহা হইলে ওইটুকুখানি পাশ কাটাইতেও প্রবৃত্তি হয় না, ধাঁ করিয়া তাহাকে লঙ্ঘন করিয়া পার হইয়া যাই। আমারও সেই দশা ঘটিয়াছিল— পায়ের নিচে হইতে জীবনের টান কমিয়া যাইতেই আমি বাঁধা রাস্তা একেবারে ছাড়িয়া দিবার জো করিয়াছিলাম।
বাড়ির ছাদে একলা গভীর অন্ধকারে মৃত্যুরাজ্যের কোনো-একটা চূড়ার উপরকার একটা ধ্বজপতাকা, তাহার কালো পাথরের তোরণদ্বারের উপরে আঁক-পাড়া কোনো-একটা অক্ষর কিংবা একটা চিহ্ন দেখিবার জন্য আমি যেন সমস্ত রাত্রিটার উপর অন্ধের মতো দুই হাত বুলাইয়া ফিরিতাম। আবার, সকালবেলায় যখন আমার সেই বাহিরের পাতা বিছানার উপরে ভোরের আলো আসিয়া পড়িত তখন চোখ মেলিয়াই দেখিতাম, আমার মনের চারিদিকের আবরণ যেন স্বচ্ছ হইয়া আসিয়াছে; কুয়াশা কাটিয়া গেলে পৃথিবীর নদী গিরি অরণ্য যেমন ঝলমল করিয়া ওঠে, জীবনলোকের প্রসারিত ছবিখানি আমার চোখে তেমনি শিশিরসিক্ত নবীন ও সুন্দর করিয়া দেখা দিয়াছে।
by Jahid | Nov 25, 2020 | শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য
আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর কেন ।
আদা জাহাজে করিয়া বিদেশে রপ্তানী হয় না; স্থানীয় হাটে বাজারেই খরিদ বিক্রয় হয়। সেইজন্য আদা ব্যবসায়ীর জাহাজের খবর জানিবার কোন প্রয়োজন নাই। অনধিকারচর্চাস্থলে এই প্রবাদ প্রযুক্ত হয়। “ The Cobbler must stick to his last.” Or “ Let the Cobbler(মুচি) stick to his last.”
আহার নিদ্রা ভয়, যত বাড়াও তত হয়।
আহার , নিদ্রা ও ভয় ইহাদিগকে যত বাড়াইবে ততই বাড়িবে।
উড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ ।
বাতাসে খৈ উড়িয়ে নিয়ে যাইতেছে, তাহা আর সংগ্রহ করিবার উপায় নাই দেখিয়া সেইগুলি গোবিন্দায় নমঃ বলিয়া দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করিয়া দিল। প্রতিকূল অবস্থায় পড়িইয়া বাধ্য হইয়া কোন সৎ কার্য করা। “ Making a virtue of necessity ”
উসকো মাটিতে বিড়াল হাগে।
নরম লোক পাইলে সকলেই তাহার উপর আধিপত্য প্রকাশ করে।
হিন্দিতে আছে, বিল্লি শাক্তি পার নেহি হাগ্তি।
এক যাত্রার পৃথক ফল।
একসঙ্গে একই কার্য আরম্ভ করিয়া একজনকে যদি পুরস্কৃত এবং অপরজন যদি তিরস্কৃত হয়, তাহা হইলে তাহাদের এক যাত্রায় পৃথক ফল বলা হয়।
এঙ যায়, ব্যাঙ যায়,
খোল্সে বলে আমিও যাই।
চ্যাং মাছ ও ব্যাঙকে লাফাইতে দেখিয়া খোল্সে মাছও সেইরূপ লাফ দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কৃতকার্য হইল না। যে যে কাজ করিতে অক্ষম, সমর্থ অপরের অনুকরণ করিতে গিয়া সে সকলের হাস্যভাজন হয়।
[ প্রকাশকালঃ ৫ই জুন, ২০১৫ ]
by Jahid | Nov 25, 2020 | শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রয়েল লাইব্রেরী থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এটি আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায়।
এর রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রীস্টাব্দে আর ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ থেকে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর পদগুলো রচিত হয়। সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পন্ডিতই ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন।
অনেকে বলেন , চর্যাপদের রচনাকাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী।তা না থাকলে দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে চর্যাপদের ভাষার নাম – সন্ধ্যা ভাষা বা আলো- আঁধারি ভাষা।
যেহেতু , চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন ‘সন্ধ্যাভাষা ’। তাঁর মতে, “সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই। ”
সুনীতিকুমার ১৯২৬ সালে ‘Origin and Development of the Bengali Language'(ODBL) গ্রন্থ রচনা করে চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের বলে প্রমাণ করেন।
৩৩ নং পদে আবহমান বাঙালির চিরায়ত দারিদ্র্যের ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমনঃ
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী।।
আধুনিক বাংলায় : “লোক শূণ্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি / হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।”
চর্যার (তেত্রিশ নং) পদটির চরয়িতা মতভেদে ‘ঢেণ্ডণপা’ অথবা ‘ভুসুকুপা’ । ঢেণ্ডণপার জন্মস্থান অবন্তিনগরের উজ্জয়িনীতে। তার জীবৎকাল ৮৪৫ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তার আসল নাম হল ঢেণ্ঢস। খ্রিষ্ট্রীয় নবম শতকে তিনি বর্তমান ছিলেন। এক্ষেত্রে বলা যায় তিনি দেবপাল-বিগ্রহপালের সমকালে ছিলেন। ঢেণ্ডণপা মূলত তাঁতি এবং সিদ্ধা ছিলেন। তার পদে বাঙালি জীবনের চিরায়ত দারিদ্রের চিত্র পাওয়া যায়।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে উপরের পদটির রচয়িতা ছিলেন ‘ভুসুকপা’ । ভুসুকপা ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক। তাঁর রচিত ৪৯ নং পদে পদ্মা (পঁউআ) খালের নাম আছে, ‘বাঙ্গাল দেশ’ ও ‘বাঙ্গালী’র কথা আছে। তাঁর রচিত পদসমুহের মাঝে বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। ভুসুকপা রচিত অতিপরিচিত একটি পদঃ অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।।
[ প্রকাশকালঃ ১২ই মে, ২০১৫ ]
by Jahid | Nov 25, 2020 | সাহিত্য
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী , অপু, দুর্গা, নিশ্চিন্দিপুর, হরিহর, সর্বজয়া, ইন্দির ঠাক্রুন , আম আঁটির ভেঁপু – আমার মনে হয়, আমরাই শেষ আলোড়িত প্রজন্ম । ১৯২৯ সালে লেখা এই উপন্যাস গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির সারাজীবনের অংশ হয়ে গেছে । কৈশোরে আমরা প্রত্যেকেই অপু বা দুর্গা। আমাদের বাবাদের কেউ কেউ হরিহর , মায়েদের কেউ সর্বজয়া !
পথের পাঁচালীর শেষের কয়েক লাইন আমাদের বার বার পড়তে হয়।
“পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন – মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নিতোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে, ঠাঙাড়ে বীরু রায়ের বটতলায় কি ধলচিতেরখেয়াঘাটের সীমানায়? তোমাদের সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে, পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিলের পাশ কাটিয়ে, বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে, পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সুর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গন্ডি এড়িয়ে অপরিচয়েরউদ্দেশ্যে…
দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম মরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মনন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে যায়… তোমাদের মর্মর জীবন-সপ্ন শেওলা-ছাতারদলে ভরে আসে, পথ আমার তখনো ফুরোয় না… চলে… চলে… চলে… এগিয়েই চলে…
অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ…
সে পথের বিচিত্র আনন্দ-যাত্রার অদৃশ্য তিলক তোমার ললাটে পরিয়েই তো তোমাকে ঘরছাড়া করে এনেছি!…
চল এগিয়ে যাই”
কয়েকটাদিন কবিতা নিয়ে মেতে ছিলাম। ‘দেশ ’ পত্রিকার কবিতা সংকলনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তারাপদ রায়ের কবিতাটা ভালো লেগে গেলো।
শতবার্ষিকীর ছায়াপদ্য
তারাপদ রায়
‘Ah , did you once see Shelley , plain….?’
সত্যি, আপনি বিভূতিভূষণকে মুখোমুখি দেখেছিলেন?
সাদামাটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়?
বনগ্রাম স্টেশনে একদিন দুপুর পার হয়ে প্রায় বিকেলে ,
প্রায় ফাঁকা যশোহর লোকালে উঠে আপনি দেখলেন
ওদিকের সীটে জানালার ধারে তিনি বসে আছেন ?
অল্পদিন আগে কোথায় এক সাহিত্যসভায় দেখেছিলেন,
তাই তাঁকে চিনতে আপনার অসুবিধা হল না।
সেই হালকা-নীল কলারফাটা হাফশার্ট ,
আধময়লা মিলের ধুতি ,তাপ্পি মারা ক্যাম্বিসের জুতো ।
অনেকদিন আগের কথা
তবু মনে আছে আপনার ?
যশোহর রোড কোনাকুনি ভাবে কাটিয়ে
শিয়ালদহ চলেছে দুপুরের নিঝুম রেলগাড়ি ।
জানালার পাশে বিভূতিভূষণ, আপনার মুখোমুখি ।
রেলগাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে ধলচিতের খেয়াঘাট ,
সোনাডাঙ্গার মাঠ, পদ্মফুলে ভঁরা মধুখালির বিল,
নীলকুঠির সাহেবের আমলের তুঁতগাছ পড়ে থাকছে পিছনে ।
বিভূতিভূষণের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন ?
আশ্চর্য ! কী বলেছিলেন আপনি , সেটা মনে নেই?
বিভূতিভূষণ আপনার কথার উত্তর দিয়েছিলেন ,
কী বলেছিলেন বিভূতিভূষণ – তাও আপনি ভুলে গেছেন ?
তা হলে আপনার শুধুই মনে আছে,
চলন্ত রেলগাড়ির কামরায় জানালার পাশে,
পুরনো নীল জামা গায়ে বসে আছেন বিভূতিভূষণ ।
বিকেল গড়িয়ে পড়ছে রেলপথের পাশে
বন অপরাজিতার নীলফুলে ছাওয়া বনের মাথায় ,
পাখি ডাকছে শিরীষ-সোঁদালি বনে,
রেলগাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে সোনাডাঙ্গার মাঠ,
মধুখালির বিল, ধলচিতের খেয়াঘাট ।
অপরাহ্ণের রাঙা রোদ জানালা দিয়ে ঢুকেছে কামরায়
নীল নির্জন আকাশ পথে গাঙচিলের ডাক
বাঁশঝাড়ের মাথায় দিনের শেষ আলো
দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মৃত্যু পার হয়ে
মাস, বার, মন্বন্তর , মহাযুগ পার হয়ে,
ঝোঁপে ঝোঁপে নাটা-কাঁটা বনকলমির ফুল
যশোহর লোকালের ফাঁকা কামরায় কাঠের বেঞ্চিতে
বসে আছেন নিঃসঙ্গ ; নির্লিপ্ত বিভূতিভূষণ ।
সত্যি, আপনার মনে আছে ?
সত্যি, আপনি দেখেছিলেন বিভূতিভূষণকে ?
by Jahid | Nov 25, 2020 | সাহিত্য
এ পৃথিবী বড়ো , তবু তার চেয়ে ঢের বেশি এই
সময়ের ঢেউগুলো- অনিঃশেষ সমুদ্রের থেকে
অন্তহীন সাগরের অভিমুখে কোথায় চলেছে ।
রাত্রি আসে –রাত্রি শেষ হয়ে গেলে আলো;
আলো আরো মৃদু হ’লে তার চেয়ে বেশি
স্নিগ্ধ অন্ধকার সব—আকাঙ্ক্ষিত মেয়েটির হাতের মতন
কাছে এসে ,সংবরণ ক’রে তবু, যেন নেপথ্যের
ওপারের থেকে তার কথা বলে ।
অগাধ আয়ুর শিশু এরা সব ঃ এই দিন, এই রাত্রি ,
বাতাসের আসা-যাওয়া , নীল নক্ষত্রের ফুটে ওঠা,
শিশির ঝরার শব্দ , আশ্চর্য পাখির
ডিম প্রসবের সাড়া ; আবার রোদের দিন মাঘ ফাল্গুনের ;
সহসা বৃষ্টির রাত্রি,– হেমন্তের ঠান্ডা নিঃশব্দতা
কবের আয়ুর শিশু এরা সব ;– ম্যামথ দেখেছে।
শতাব্দীর সন্ধিপথে আজ মানুষের
আধো-আলো আধো- আশা অপরূপ অধঃপতনের
অন্ধকারে অবহিত অন্তর্যামীদের মতন ভোরের সূর্য ;
দূরতম সমুদ্রের হাওয়া এসে ছুঁয়ে কিছু ভালো ব’লে যেতে চায় ;
নগরীর বিদগ্ধ লোকেরা কথা ভেবে—ব’লে
প্রেরণা জাগাতে চায় ;
সহজ ত্যাগীরা কাজ করে ;
রক্তে দেশ অন্ধকার হয়ে পড়ে ;
কথা ভাষা স্বপ্ন সাধ সংকল্পের ব্যবহারে
মানুষেরা মানুষের প্রিয়তর না হ’য়ে শুধু দূরতর হয় ;
হৃদয় মলিন হ’য়ে যেতে থাকে ;
নিয়ন্ত্রিত জ্ঞানেরো আকাশ ঢেকে কুয়াশা বাড়ছে;
মুক্ত হতে গিয়ে সুধী কেবলি রোমাঞ্চকর রূঢ় সায়েন্সের
জন্ম দেয় ; চারিদিকে অগণন মানুষের মৃত্যু তার বড়ো কাহিনীর
যবনিকাপাতের প্রাক্কালে ক্লান্তির মতো ;
তখন শতাব্দী অন্ধ—অবসন্ন—ব্যর্থ ।–
হয়তো এ পৃথিবীতে মানবের অনন্ত চারণ,
লোভ থেকে লোভে শুধু –ব্যাথা থেকে ব্যাথার ভিতরে,
ভুল থেকে উল্লোল ক্ষমতাময় ভুলের গহ্বরে;
চাঁদের কুয়াশা থেকে অঘ্রাণ রাতের
নক্ষত্রের অন্ধকারে ;-
তারপর নক্ষত্রেরা নেই।
নবীন প্রয়াণে স্পর্শে মানুষেরা একদিন চীন পিরামিড
গড়েছিল ; সূর্যঘড়ি চিনেছিল ; প্রিয়তর উজ্জ্বল সূর্যকে
দিব্য দিয়ে নগরীর ভাঙ্গা হাড়ে কেবলি গড়েছে
নতুন খিলান স্তম্ভ ফ্যাক্টরি এঞ্জিন ক্রেনঃ
এ সব বিচিত্র নীড় কুশলতা কল
সময়ের থেকে দূর বড় সময়ের কাছে
মানুষের যেই পরিচয় রেখে যায়
তা তার আবেগ বুদ্ধি উৎকণ্ঠার;-
যেন তা কল্যাণ সত্য চায় –তবু অগাধ হিংসার—
রিরংসার পাকে ঘুরে –ঘুরে ঘুরে শূন্য হয়ে যায় ;
অন্ধকার থেকে মৃদু আলোর ভিতরে
আলোর ভিতর থেকে আঁধারের দিকে
জ্ঞানের ভিতর থেকে শোকাবহ আশ্চর্য অজ্ঞানে
বারে- বারে আসা- যাওয়া শেষ ক’রে ।
চিরকাল ইতিহাসবহনের পথে
রক্ত ক্ষয় নাশ ক’রে সে এক জগতে
মানুষের দিকচিহ্ন মাঝে মাঝে মুক্ত হ’য়ে পড়ে ;
তা কোন প্রশান্তি নয় , মৃত্যু নয়, অপ্রেমের মতো নয়,
কোনো হেঁয়ালির শেষ মীমাংসার বার্তা নয়,
অচিহ্নিত সাগরের মতন তা , দূরতম আকাশের মতো ;
পেছনের পার্শ্বের দ্রুতগতি চিহ্ন ও বলয়
অন্তর্হিত হ’য়ে গেলে কূলহীন পটভূমি জেগে ওঠে
ব্যক্তি ও জাতির নাম সময়ের দিগন্তরে শেষ হ’লে
শূন্য নীল আকাশের – মহাসাগরের শূন্যে মেশে ;
চিনে নিতে পারে তার হৃদয়ের অসীম ভূগোলে
আরো শুদ্ধ আরো গাঢ় অনির্বচনীয় সম্মিলন
মানুষ ও মানুষেরঃ চারিদিকে গ্লোবমাস্টারের শব্দে
অন্তহীন অন্ধকারে হাঙর মকর মৃত্যু কুজ্ঝটিকায়
মৃত মূঢ় এরিয়েল ও বেতারের ব্যর্থতায়
যদিও প্রত্যাশা সব সর্বশান্ত ব’লে মনে হয়—
আশার আস্থার আধার তবু নিজেই মানুষ
মহাকাশ কিংবা মহাসাগরের চিহ্নগুলো নয়।
by Jahid | Nov 25, 2020 | সাহিত্য
[ ১৯৯০ সালের কোন এক দুপুরে এই গল্পটি পড়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্পের একটি । কলেজ কর্মসূচিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার পড়তে দিয়েছিলেন। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক ও দুর্যোগে মানুষের অসহায়ত্ব। ইন্টারনেট থেকে কপি করা, বানান ভুল থাকতে পারে ; ক্ষমার্হ। ]
তারিণী মাঝির অভ্যাস মাথা হেঁট করিয়া চলা। অস্বাভাবিক দীর্ঘ তারিণী ঘরের দরজায়,গাছের ডালে, সাধারণ চালাঘরে বহুবার মাথায় বহু ঘা খাইয়া ঠেকিয়া শিখিয়াছে। কিন্তু নদীতে যখন সে খেয়া দেয়,তখন সে খাড়া সোজা। তালগাছের ডোঙার উপর দাঁড়াইয়া সুদীর্ঘ লগির খোঁচা মারিয়া যাত্রী বোঝাই ডোঙাকে ওপার হইতে এপারে লইয়া আসিয়া সে থামে।
আষাঢ় মাস। অম্বুবাচী উপলক্ষ্যে ফেরত যাত্রীর ভিড়ে ময়ুরাক্ষীর গনুটিয়ার ঘাটে যেন হাট বসিয়া গিয়াছিল। পথশ্রমকাতর যাত্রীদলের সকলেই আগে পার হইয়া যাইতে চায়।
তারিণী তামাক খাইতে খাইতে হাঁক মারিয়া উঠিল,আর লয় গো ঠাকরুণরা,আর লয়। গঙ্গাচান করে পুণ্যির বোঝায় ভারী হয়ে আইছ সব।
একজন বৃদ্ধ বলিয়া উঠিল,আর একটি নোক বাবা,এই ছেলেটি।
ওদিক হইতে একজন ডাকিয়া উঠিল,ওলো ও সাবি,উঠে আয় লো,উঠে আয়। দোশমনের হাড়ের দাঁত মেলে আর হাসতে হবে না।
সাবি ওরফে সাবিত্রী তরুণী,সে তাহাদের পাশের গ্রামের কয়টি তরুণীর সহিত রহস্যালাপের কৌতুকে হাসিয়া যেন ভাঙিয়া পড়িতেছিল। সে বলিল,তোরা যা,আসছে খেপে আমরা সব একসঙ্গে যাব।
তারিণী বলিয়া উঠিল,না বাপু,তুমি এই খেপেই চাপ। তোমরা সব একসঙ্গে চাপলে ডোঙা ডুববেই। মুখরা সাবি বলিয়া উঠিল,ডোবে তো তোর ওই বুড়িদের খেপই ডুববে মাঝি। কেউ দশ বার,কেউ বিশ বার গঙ্গাচান করেছে ওরা। আমাদের সবে এই একবার।
তারিণী জোড়হাত করিয়া বলিল,আজ্ঞে মা,একবারেই যে আপনকারা গাঙের ডেউ মাথায় করে আইছেন সব। যাত্রীর দল কলরব করিয়া আসিয়া উঠিল। মাঝি লগি হাতে ডোঙার মাথায় লাফ দিয়া উঠিয়া পড়িল। তাহার সহকারী কালাচাঁদ পারের পয়সা সংগ্রহ করিতেছিল। সে হাকিয়া বলিল,পারের কড়ি ফাঁকি দাও নাই তো কেউ,দেখ,এখনও দেখ।–বলিয়া সে ডোঙাখানা ঠেলিয়া দিয়া ডোঙায় উঠিয়া পড়িল। লগির খোঁচা মারিয়া তারিণী বলিল,হরি হরি বল সব-হরিবোল। যাত্রীদল সমস্বরে হরিবোল দিয়া উঠিল-হরিবোল। দুই তীরের বনভূমিতে সে কলরোল প্রতিধ্বনিত হইয়া ফিরিতেছিল। নিম্নে খরস্রোতা ময়ূরাক্ষী নিম্নস্বরে ক্রুর হাস্য করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। তারিণী এবার হাসিয়া বলিল,আমার নাম করলেও পার,আমিই তো পার করছি।
এক বৃদ্ধা বলিল,তা তো বটেই বাবা। তারিণী নইলে কে তরাবে বল?
একটা ঝাঁকি দিয়া লগিটা টানিয়া তুলিয়া তারিণী বিরক্তিভরে বলিয়া উঠিল,এই শালা কেলে,-এঁটে ধর্ দাঁড়, হ্যাঁ-সেঙাত,আমার ভাত খায় না গো! টান দেখছিস না?
সত্য কথা,ময়ূরাক্ষীর এই খরস্রোতই বিশেষত্ব। বারো মাসের মধ্যে সাত-আট মাস ময়ূরাক্ষী মরুভূমি,এক মাইল দেড় মাইল প্রশস্ত বালুকারাশি ধূ-ধূ করে। কিন্তু বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্করী। দুই পার্শ্বে চার-পাঁচ মাইল গাঢ় পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতে পরিব্যাপ্ত করিয়া বিপুল স্রোতে সে তখন ছুটিয়া চলে। আবার কখনও কখনও আসে“হড়পা” বান, ছয়-সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়ি-ঘর’ক্ষেত-খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায়। কিন্তু সে সচরাচর হয় না । বিশ বৎসর পূর্বে একবার হইয়াছিল।
মাথার উপর রৌদ্র প্রখর হইয়া উঠিয়াছিল। একজন পুরুষ যাত্রী ছাতা খুলিয়া বসিল। তারিণী বলিল,পাল খাটিও না ঠাকুর,পাল খাটিও না। তুমিই উড়ে যাবা।
লোকটি ছাতা বন্ধ করিয়া দিল। সহসা নদীর উপরের দিকে একটা কলরব ধ্বনিত হইয়া উঠিল—আর্ত কলরব।
ডোঙার যাত্রীসব সচকিত হইয়া পড়িল। তারিণী ধীরভাবে লগি চলাইয়া বলিল, এই সব হুঁশ করে। তোমাদের কিছু হয় নাই। ডোঙা ডুবেছে ওলকুড়োর ঘাটে। এই বুড়ি মা, কাঁপছ কেনে,ধর ধর ঠাকুর,বুড়িকে ধর। ভয় কি? এই দেখ,আমরা আর-ঘাটে এসে গেইছি।
নদীও শেষ হইয়া আসিয়াছিল।
তারিণী বলিল, কেলে!
কি?
নদীবক্ষের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়া তারিণী বলিল,লগি ধর দেখি।
কালাচাঁদ উঠিয়া পড়িল। তাহার হাতে লগি দিতে দিতে তারিণী বলিল,হুই-দেখ-হুই-হুই ডুবল।-বলিতে বলিতেই সে খরস্রোতা নদীগর্ভে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। ডোঙার উপর কয়েকটি বৃদ্ধা কাঁদিয়া উঠিল,ও বাবা তারিণী,আমাদের কি হবে বাবা।
কালাচাঁদ বলিয়া উঠিল,এই,বুড়িরা পেছু ডাকে দেখ দেখি। মরবি মরবি,তোরা মরবি।
পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতের মধ্যে শ্বেতবর্ণের কি একটা মধ্যে মধ্যে ডুবিতেছিল,আবার কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিতেছিল। তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই তারিণী ক্ষিপ্রগতিতে স্রোতের মুখে সাঁতার কাটিয়া চলিয়াছিল। সে চলার মধ্যে যেন কত স্বচ্ছন্দ গতি। বস্তুটার নিকটেই সে আসিয়া পড়িয়াছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সেটা ডুবিল। সঙ্গে সঙ্গে তারিণীও ডুবিল। দেখিতে দেখিতে সে কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিল। এক হাতে তাহার ঘন কালো রঙের কি রহিয়াছে। তারপর সে ঈষৎ বাঁকিয়া স্রোতের মুখেই সাঁতার কাটিয়া ভাসিয়া চলিল।
দুই তীরের জনতা আশঙ্কাবিমিশ্র ঔৎসুক্যের সহিত একাগ্রদৃষ্টিতে তারিণীকে লক্ষ্য করিতেছিল। এক তীরের জনতা দেখিতে দেখিতে উচ্চরোলে চীৎকার করিয়া উঠিল, হরিবোল।
অন্য তীরের জনতা চীৎকার করিয়া প্রশ্ন করিতেছিল,উঠেছে? উঠেছে?
কালাচাঁদ তখন ডোঙা লইয়া ছুটিয়াছিল।
তারিণীর ভাগ্য ভালো। জলমগ্ন ব্যক্তিটি স্তানীয় বর্ধিষ্ণু ঘরেরই একটি বধূ। ওলকুড়ার ঘাটে ডোঙা ডুবে নাই, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনাবৃতা বধূটি ডোঙার কিনারায় ভর দিয়া সরিয়া বসিতে গিয়া এই বিপদ ঘটাইয়া বসিয়াছিল। অবগুণ্ঠনের জন্যই হাতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া সে টলিয়া জলে পড়িয়া গিয়াছিল। মেয়েটি খানিকটা জল খাইয়াছিল। কিন্তু তেমন বেশি কিছু নয়-অল্প শুশ্রূষাতেই তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল।
নিতান্ত কচি মেয়ে-তের চৌদ্দ বৎসরের বেশি বয়স নয়। দেখিতে বেশ সুশ্রী,দেহে অলঙ্কারও কয়খানা রহিয়াছে-কানে মাকড়ি,নাকে টানা-দেওয়া নথ,হাতে রুলি,গলায় হার। সে তখনও হাঁপাইতেছিল। অল্পক্ষণ পরেই মেয়েটির স্বামী ও শ্বশুর আসিয়া পৌঁছিলেন।
তারিণী প্রণাম করিয়া বলিল,পেনাম ঘোষ মশাই।
মেয়েটি তাড়াতাড়ি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল।
তারিণী বলিল,আর সান কেড়ো না মা,দম লাও,দম লাও। সেই যে বলে-লাজে মা কুঁকুড়ি,বেপদের ধুকুড়ি।
ঘোষ মহাশয় বলিলেন,কি চাই তোর তারিণী,বল্?
তারিণী মাথা চুলকাইয়া সারা হইল,কি তাহার চাই,সে ঠিক করিতে পারিল না। অবশেষে বলিল,এক হাড়ি মদের দাম-আট আনা।
জনতার মধ্য হইতে সেই সাবি মেয়েটি বলিয়া উঠিল,আ মরণ তোমার। দামী কিছু চেয়ে নে রে বাপু!
তারিণীর যেন এতক্ষণে খেয়াল হইল,সে হেঁট মাথাতেই সলজ হাসি হাসিয়া বলিল, ফাঁদি লত একখানা ঘোষ মশাই।
জনতার মধ্য হইতে সাবিই আবার বলিয়া উঠিল,হ্যাঁ বাবা তারিণী,বউমা বুঝি খুব নাক নেড়ে কথা কয়?
প্রফুল্লচিত্ত জনতার হাস্যধ্বনিতে খেয়াঘাট মুখরিত হইয়া উঠিল।
বধূটি ঘোমটা খুলে নাই,দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের মধ্য হইতে তাহার গৌরবর্ণ কচি হাতখানি বাহির হইয়া আসিল-রাঙা করতলের উপর সোনার নথখানি রৌড্রভায় ঝকঝক করিতেছে।
ঘোষ মহাশয় বলিলেন,দশহরার সময় পার্বণী রইল তোর কাপড় আর চাদর,বুঝলি তারিণী? আর এই নে-পাঁচটা টাকা।
তারিণী কৃতজ্ঞতায় নত হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল,আজ্ঞ হুজুর চাদরের বদলে যদি শাড়ি—
হাসিয়া ঘোষ মহাশয় বলিলেন,তাই হবে রে,তাই হবে।
সাবি বলিল,তোর বউকে একবার দেখতাম তারিণী।
তারিণী বলিল,নেহাত কালে কুচ্ছিত মা।
তারিণী সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরিল আকণ্ঠ মদ গিলিয়া। এখানে পা ফেলিতে পা পড়িতেছিল ওখানে। সে বিরক্ত হইয়া কালাচাঁদকে বলিল, রাস্তায় এত নেলা কে কাটলে রে কেলে? শুধুই নেলা–শুধুই–অ্যা–অ্যাই–একটো—নেলা
কালাচাঁদও নেশায় বিভোর,সে শুধু বলিল,হুঁ।
তারিণী বলিল,জলাম্পয়-সব জলাম্পয় হয়ে যায়,সাঁতরে বাড়ি চলে যাই। শালা খাল নাই,নেলা নাই,সমান–স–ব সমান।
টলিতে টলিতেই সে শূন্যের বায়ুমণ্ডলে হাত ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া সাঁতারের অভিনয় করিয়া চলিয়াছিল।
গ্রামের প্রান্তেই বাড়ি। বাড়ির দরজায় একটি আলো জ্বালিয়া দাঁড়াইয়াছিল –তারিণীর স্ত্রী।
তারিণী গান ধরিয়া দিল,– লো-তুন হয়েছে দেশে ফাঁদিলতের আমদানি-
সুখী তাহার হাত ধরিয়া বলিল,খুব হয়েছে,এখন এস। ভাত কটা জুড়িয়ে কড়কড়ে হিম হয়ে গেল।
হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কোমরের কাপড় খুঁজিতে খুঁজিতে তারিণী বলিল,আগে তোকে লত পরতে হবে। লতা কই-কই-কোথা গেল শালার লত?
সুখী বলিল, কোন্ দিন ওই করতে গিয়ে আমার মাথা থাবে তুমি। এবার আমি গলায় দড়ি দোব কিন্তু।
তারিণী ফ্যালফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কেনে কি করলাম আমি?
সুখী দৃষ্টিতে তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিল,এই পাথার বান,আর তুমি—
তারিণি অট্টআসিতে বর্ষার রাত্রির সজল অন্ধকার ত্রস্ত হইয়া উঠিল।হাসি থামাইয়া সে সুখীর দিকে চাহিয়া বলিল,মায়ের বুকে ভয় থাকে? বল্,তু বল্,বলে যা বলছি। পেটের ভাত ওই ময়ূরাক্ষীর দৌলতে। জবাব দে কথার-অ্যাই!
সুখী তাহার সহিত আর বাক্যব্যয় না করিয়া ভাত বাড়িতে চলিয়া গেল।
তারিণী ডাকিল,সুখী,অ্যাই সুখী,অ্যাই!
সুখী কোন উত্তর দিল না। তারিণী টলিতে টলিতে উঠিয়া ঘরের দিকে চলিল। পিছন হইতে ভাত বাড়িতে ব্যস্ত সুখীকে ধরিয়া বলিল,চল,এখুনি তোকে যেতে হবে।
সুখী বলিল,ছাড়,কাপড় ছাড়। তারিণী বলিল,আলবত যেতে হবে। হাজার বার-তিনশো বার।
সুখী কাপড়টা টানিয়া বলিল,কাপড় ছাড়-যাব,চল। তারিণী খুশি হইয়া কাপড় ছাড়িয়া দিল। সুখী ভাতের থালাটা লইয়া বাহির হইয়া গেল।
তারিণী বলিতেছিল,চল,তোকে পিঠে নিয়ে ঝাঁপ দোব গনুটের ঘাটে,উঠব পাঁচথুপীর ঘাটে।
সুখী বলিল,তাই যাব,ভাত খেয়ে লাও দেকিন। বাহির হইয়া আসিতে গিয়া দরজার চৌকাঠে কপালে আঘাত পাইয়া তারিণীর আস্ফালনটা একটু কমিয়া আসিল।
ভাত খাইতে খাইতে সে আবার আরম্ভ করিল,তুলি নাই সেবার এক জোড়া গোরু? পনেরো টাকা-পাঁচ টাকা কম এক কুড়ি,শালা মদন গোপ ঠকিয়ে লিলে? তোর হাতের শাঁখা-বাঁধা কি করে হল? বল্,কে-তোর কোন্ নানা দিলে?
সুখী ঘরের মধ্যে আমানি ছাঁকিতেছিল,ঠাণ্ডা জিনিস নেশার পক্ষে ভাল। তারিণী বলিল, শালা মদনা–লিলি ঠকিয়ে–লে। সুখীর শাঁখা-বাঁধা তো হয়েছে,ব্যস্,আমাকে দিস আর না দিস। পড়ে শালা এক দিন ময়ূরাক্ষীর বানে-শালাকে গোটাকতক চোবল দিয়ে তবে তুলি।
সম্মুখে আমানির বাটি ধরিয়া দিয়া সুখী তারিণীর কাপড়ের খুঁট খুলিতে আরম্ভ করিল, বাহির হইল নথখানি আর তিনটি টাকা ।
সুখী প্রশ্ন করিল,আর দু টাকা কই? তারিণী বলিল,কেলে,ওই কেলে,দিয়ে দিলাম কেলেকে–যা,লিয়ে যা ।
সুখী এ কথায় কোন বাদ-প্রতিবাদ করিল না,সে তাহার অভ্যাস নয়। তারিণী আবার বকিতে শুরু করিল,সেবার সেই তোর যখন অসুখ হল,ডাক পার হয় না,পুলিস সায়েব ঘাটে বসে ভাপাইছে, হুঁ হুঁ বাবা-সেই বকশিশে তোর কানের ফুল। যা,তু যা,এখুনি ডাক লদীর পার থেকে,এই,উঠে আয় হারামজাদী লদী। উঠে আসবে,যা যা।
সুখী বলিল,দাঁড়াও আয়নাটো লিয়ে আসি,লতটো পারি। তারিণী খুশি হইয়া নীরব হইল। সুখী আয়না সম্মুখে রাখিয়া নাথ পরিতে বসিল। সে হাঁ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল,ভাত খাওয়া তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে। নথ পরা শেষ হইতেই সে উচ্ছিষ্ট হাতেই আলোটা তুলিয়া ধরিয়া বলিল,দেখি দেখি।
সুখীর মুখে পুলকের আবেশ ফুটিয়া উঠিল,উজ্জল শ্যামবর্ণ মুখখানি তাহার রাঙা হইয়া উঠিল।
তারিণী সাবি-ঠাকরুণকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিল। সুখী তণ্বী,সুখী সুশ্রী,উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা,সুখীর জন্য তারিণীর সুখের সীমা নাই।
তারিণী মত্ত অবস্থাতে বলিলেও মিথ্যা বলে নাই। ওই ময়ূরাক্ষীর প্রসাদেই তারিণীর অন্নবস্ত্রের অভাব হয় না। দশহরার দিন ময়ূরাক্ষীর পূজাও সে করিয়া থাকে। এবার তেরো শো বিয়াল্লিশ সালে দশহরার দিন তারিণী নিয়মমত পূজা-অর্চনা করিতেছিল। তাহার পরনে নূতন কাপড়,সুখীর পরনেও নূতন শাড়ি-ঘোষ মহাশয়ের দেওয়া পার্বণী। জলহীন ময়ূরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝিকমিক করিতেছিল। তখনও পর্যন্ত বৃষ্টি নামে নাই। ভোগপুরের কেষ্ট দাস নদীর ঘাটে নামিয়া একবার দাঁড়াইল। সমস্ত দেখিয়া একবার আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল,তাই ভাল করে পুজো কর তারিণী,জল-টল হোক,বান-টান আসুক, বান না এলে চাষ হবে কি করে?
ময়ূরাক্ষীর পলিতে দেশে সোনা ফলে।
তারিণী হাসিয়া বলিল,তাই বল বাপু। লোকে বলে কি জান দাস,বলে,শালা বানের লেগে পুজো দেয়। এই মায়ের কিপাতেই এ মুলুকের লক্ষ্মী। ধর্ ধর্ কেলে,ওরে,পাঠা পালাল,ধর। বলির পাঠাটা নদীগর্তে উত্তপ্ত বালুকার উপর আর থাকিতে চাহিতেছিল না।
পূজা-অর্চনা সুশৃঙ্খলেই হইয়া গেল। তারিণী মদ খাইয়া নদীর ঘাটে বসিয়া কালাচাঁদকে বলিতেছিল,হড়হড়-কলকল-বান,লে কেনে তু দশদিন বাদ।
কালাচাঁদ বলিল,এবার মাইরি,তু কিন্তুক ভাসা জিনিস ধরতে পাবি না। এবার কিন্তুক আমি ধরব,হ্যাঁ।
তারিণী মন্ত হাসি হাসিয়া বলিল,বড় ঘুরণ-চাকে তিনটি বুটবুটি,বুক-বুক-বুক, বাস-কালাচাঁদ ফরসা।
কালাচান্দ অপমানে আগুন হইয়া উঠিল,কি বললি শালা?
তারিণী খাড়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু সুখী মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া সব মিটাইয়া দিল। সে বলিল,ছোট বানের সময়-হুই পাকুড়গাছ পর্যন্ত বানে দেওর ধরবে,আর পাকুড়গাছ ছাড়লেই তুমি।
কালাচাঁদ সুখীর পায়ের ধূলা লইয়া কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়া দিল,বউ লইলে ই বলে কে?
পরদিন হইতে ডোঙা মেরামত আরম্ভ হইল,দুইজনে হাতুড়ি নেয়ান লইয়া সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করিয়া ডোঙাখানাকে প্রায় নূতন করিয়া ফেলিল।
কিন্তু সে ডোঙায় আবার ফাট ধরিল রৌদ্রের টানে। সমস্ত আষাঢ়ের মধ্যে বান হইল না। বান দূরের কথা,নদীর বালি ঢাকিয়া জলও হইল না। বৃষ্টি অতি সামান্য-দুই-চারি পশলা। সমস্ত দেশটার মধ্যে একটা মৃদু কাতর ক্রন্দন যেন সাড়া দিয়া উঠিল। প্রত্যাসন্ন বিপদের জন্য দেশ যেন মৃদুস্বরে কাঁদিতেছিল। কিংবা হয়তো বহুদূরের যে হাহাকার আসিতেছে, বায়ুস্তরবাহিত তাহারই অগ্রধ্বনি এ। তারিণীর দিন আর চলে না। সরকারী কর্মচারীদের বাইসিকল ঘাড়ে করিয়া নদী পার করিয়া দুই-চারিটা পয়সা মেলে,তাহাতেই সে মদ খায়। সরকারী কর্মচারীদের এ সময়ে আসা-যাওয়ার হিরিক পড়িয়া গিয়াছে -তাহারা আসেন দেশে সত্যই অভাব আছে কি না,তাহারই তদন্তে। আরও কিছু মেলে-সে তাঁহাদের ফেলিয়া-দেওয়া সিগারেটের কুটি।
শ্রাবণের প্রথমেই প্রথম বন্যা আসিল। তারিণী হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। বন্যার প্রথম দিন বিপুল আনন্দে সে তালগাছের মত উঁচু পাড়ের উপর হইতে ঝাঁপ দিয়া নদীর বুকে পড়িয়া বন্যার জল আরও উজ্জ্বল ও চঞ্চল করিয়া তুলিল।
কিন্তু তিনদিনের দিন নদীতে আবার হাঁটু-জল হইয়া গেল। গাছে বাঁধা ডোঙাটা তরঙ্গাঘাতে মৃদু মৃদু দোল খাইতেছিল। তাহারই উপর তারিণি ও কালাচাঁদ বসিয়া ছিল-যদি কেহ ভদ্র যাত্রী আসে তাহারই প্রতীক্ষায়,সে হাঁটিয়া পার হইবে না। এ অবস্থায় তাহারা দুইজনে মিলিয়া ডোঙ্গাটা ঠেলিয়া লইয়া যায়।
সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছিল। তারিণী বলিল,ই কি হল বল দেখি কেলে?
চিন্তাকুলভাবে কালাচাঁদ বলিল,তাই তো। তারিণী আবার বলিল,এমন তো কখনও দেখি নাই।
সেই পূর্বের মতই কালাচাঁদ উত্তর দিল,তাই তো।
আকাশের দিকে চাহিয়া তারিণী বলিল,আকাশ দেখ কেনে-ফরসা লী-ল। পচি দিকেও তো ডাকে না!
কালাচাঁদ এবারও উত্তর দিল,তাই তো।
ঠাস করিয়া তাহার গালে একটা চড় কসাইয়া দিয়া তারিণী বলিল-তাই তো! “তাই তো’ বলতেই যেন আমি ওকে বলছি। তাই তো! তাই তো! তাই তো!
কালাচাঁদ একান্ত অপ্রতিভের মত তারিণীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কালাচাঁদের সে দৃষ্টি তারিণী সহ্য করিতে পারিল না,সে অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল। কিছুক্ষণ পর অকস্মাৎ যেন সচেতনের মত নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া সে বলিয়া উঠিল,বাতাস ঘুরেছে লয় কেলে,পচি বইছে,না? বলিতে বলিতে সে লাফ দিয়া ডাঙ্গায় উঠিয়া শুষ্ক বালি এক মুঠ ঝুরঝুর করিয়া মাটিতে ফেলিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু বায়ুপ্রবাহ অতি ক্ষীণ,পশ্চিমের কি না ঠিক বুঝা গেল না। তবুও সে বলিল,হুঁ পচি থেকে ঠেলা বইছে-একটুকুন। আয় কেলে,মদ খাব,আয়। দু আনা পয়সা আছে আজ। বার করে লিয়েছি আজ সুখীয় খুঁট খুলে।
সস্নেহ নিমন্ত্রণে কালাচাঁদ খুশি হইয়া উঠিয়াছিল। সে তারিণীর সঙ্গ ধরিয়া বলিল, তোমার বউয়ের হাতে টাকা আছে দাদা।বাড়ি গেলে তোমার ভাত ঠিক পাবেই। মলাম আমরাই।
তারিণী বলিল,সুখী বড় ভাল রে কেলে,বড় ভাল। উ না থাকলে আমার‘হাড়ির ললাট ডোমের দুগগতি’ হয় ভাই। সেবার সেই ভাইয়ের বিয়েতে-
বাধা দিয়া কালাচাঁদ বলিল,দাঁড়াও দাদা,একটা তাল পড়ে রইছে,কুড়িয়ে লি।
সে ছুটিয়া পাশের মাঠে নামিয়া পড়িল।
একদল লোক গ্রামের ধারে গাছতলায় বসিয়া ছিল,তারিণী প্রশ্ন করিল,কোথা বাবা যে তোমরা,বাড়ি কোথা?
একজন উত্তর দিল,বীরচন্দপুর বাড়ি ভাই আমাদের,খাটতে যাব আমরা বদ্ধমান।
কাঁলাচান্দ প্রশ্ন করিল,বদ্ধমানে কি জল হইছে নাকি?
জল হয় নাই,ক্যানেল আছে কিনা।
দেখিতে দেখিতে দেশে হাহাকার পড়িয়া গেল। দুর্ভিক্ষ যেন দেশের মাটির তলেই আত্মগোপন করিয়া ছিল,মাটির ফাটলের মধ্য দিয়া পথ পাইয়া সে ভয়াল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়া বসিল! গৃহস্থ আপনার ভাণ্ডার বন্ধ করিল;জনমজুরের মধ্যে উপবাস শুরু হইল। দলে দলে লোক দেশ ছাড়িতে আরম্ভ করিল।
সেদিন সকালে উঠিয়া তারিণী ঘাটে আসিয়া দেখিল কালাচাঁদ আসে নাই। প্রহর গড়াইয়া গেল,কালাচাঁদ তবুও আসিল না। তারিণী উঠিয়া কালাচাঁদের বাড়ি গিয়া ডাকিল,কেলে !
কেহ উত্তর দিল না। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল,ঘর দ্বার শূন্য-খাঁ খাঁ করিতেছে,কেহ কোথাও নাই। পাশের বাড়িতে গিয়া দেখিল,সে বাড়িও শূন্য। শুধু সে বাড়িই নয়,কালাচাঁদের পাড়াটাই জনশূন্য। পাশের চাষাপাড়ায় গিয়া শুনিল,কালাচাঁদের পাড়ার সকলেই কাল রাত্রে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে।
হারু মোড়ল বলিল,বললাম আমি তারিণী,যাস না সব,যাস না। তা শুনলে না, বলে,বড়নোকের গায়ে ভিখ করব।
তারিণীর বুকের ভিতরটা কেমন করিতেছিল;সে ওই জনশূন্য পল্লীটার দিকে চাহিয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
হারু আবার বলিল,দেশে বড়ানোক কি আছে? সব তলা-ফাঁক। তাদের আবার বড় বেপদ। পেটে না খেলেও মুখে কবুল দিতে পারে না। এইতো কি বলে-গাঁয়ের নাম,ওই যে পলাশডাঙ্গা, পলাশডাঙ্গার ভদ্ধরনোক একজন, গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। শুধু অভাবে মরেছে।
তারিণী শিহরিয়া উঠিল।
পরদিন ঘাটে এক বীভৎস কাণ্ড! ঘাটের পাশেই এক বৃদ্ধার মৃতদেহ পড়িয়া ছিল। কতকটা তাহার শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়িয়া খাইয়াছে। তারিণী চিনিল,একটি মুচি পরিবারের বৃদ্ধ মাতা এ হতভাগিনী। গত অপরাহ্ণে চলচ্ছক্তিহীনা বৃদ্ধার মৃত্যু-কামনা বার বার তাহারা করিতেছিল। বৃদ্ধার জন্যই ঘাটের পাশে গত রাত্রে তাহারা আশ্রয় লইয়াছিল। রাত্রে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে ফেলিয়া তাহারা পালাইয়াছে।
সে আর সেখানে দাঁড়াইল না। বরাবর বাড়ি আসিয়া সুখীকে বলিল,লে সুখী,খান চারেক কাপড় আর গয়না কটা পেট-আঁচলে বেঁধে লে। আর ই গায়ে থাকব না,শহর দিকে যাব। দিন-খাটুনি তো মিলবে।
জিনিসপত্র বাঁধিবার সময় তারিণী দেখিল,হাতের শাখা ছাড়া আর কোন গহনাই সুখীর নাই। তারিণী চমকিয়া উঠিয়া প্রশ্ন করিল,আর?
সুখী ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল,এতদিন চলল কিসে,বল?
তারিণীও গ্রাম ছাড়িল।
দিন তিনেক পথ চলিবার পর সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রান্তে তাহারা রাত্রির জন্য বিশ্রাম লইয়াছিল। গোটা দুই পাকা তাল লইয়া দুইজনে রাত্রির আহার সারিয়া লইতেছিল। তারিণী চট করিয়া উঠিয়া খোলা জায়গায় গিয়া দাঁড়াইল। থাকিতে থাকিতে বলিল,দেখি সুখী, গামছাখানা। গামছাখানা লইয়া হাতে ঝুলাইয়া সেটাকে সে লক্ষ্য করিতে আরম্ভ করিল। ভোরবেলায় সুখীর ঘুম ভাঙিয়া গেল,দেখিল,তারিণী ঠায় জাগিয়া বসিয়া আছে। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল,ঘুমোও নাই তুমি?
হাসিয়া তারিণী বলিল,না,ঘুম এল না। সুখী তাহাকে তিরস্কার আরম্ভ করিল, ব্যামো-স্যামো হলে কি করব বল দেখি আমি? ই মানুষের বাইরে বেরুনো কেনে বাপু,
ছি-ছি-ছি!
তারিণী পুলকিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল,দেখেছিস,সুখী দেখেছিস?
সুখী বলিল,আমার মাথামুণ্ডু কি দেখব,বল?
তারিণী বলিল,পিঁপড়েতে ডিম মুখে নিয়ে ওপরের পানে চলল। জল এইবার হবে।
সুখী দেখিল,সত্যই লক্ষ লক্ষ পিপীলিকা শ্রেণীবদ্ধভাবে পোড়ো ঘরখানার দেওয়ালের উপরে উঠিয়া চলিয়াছে। মুখে তাহদের সাদা সাদা ডিম।
সুখী বলিল,তোমার যেমন-
তারিণী বলিল,ওরা ঠিক জানতে পারে,নিচে থাকলে যে জলে বাসা ভেসে যাবে। ইদিকে বাতাস কেমন বইছে,দেখেছিস? ঝাড়া পচ্চিম থেকে।
আকাশের দিকে চাহিয়া সুখী বলিল,আকাশ তো ফটফট-চকচক করছে।
তারিণী চাহিয়া ছিল অন্য দিকে,সে বলিল,মেঘ আসতে কতক্ষণ? ওই দেখ কাকে কুটো তুলছে-বাসার ভাঙা-ফুটো সারবে। আজ এই-খানেই থাক সুখী,আর যাব না;দেখি মেঘের গতিক।
খেয়া-মাঝির পর্যবেক্ষণ ভুল হয় নাই। অপরাহ্ণের দিকে আকাশ মেঘে ছাইয়া গেল,পশ্চিমের বাতাস ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিল।
তারিণী বলিল,ওঠ সুখী,ফিরব।
সুখী বলিল,এই অবেলায়?
তারিণী বলিল,ভয় কি তোর,আমি সঙ্গে রইছি। লে,মাথালি তু মাআয় দে।টিপিটিপি জল ভারি খারাপ।
সুখী বলিল,আর তুমি,তোমায় শরীল বুঝি পাথরের?
তারিণী হাসিয়া বলিল,ওরে ই আমার জলের শরীল,রোদে টান ধরে,জল পেলেই ফোলে। চল,দে,পুঁটুলি আমাকে দে।
ধীরে ধীরে বাদল বাড়িতেছিল। উতলা বাতাসের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ রিমিঝিমি বৃষ্টি হইয়া যায়,তারপর থামে। কিছুক্ষণ পর আবার বাতাস প্রবল হয়,সঙ্গে সঙ্গে নামে বৃষ্টি।
যে পথ গিয়াছিল তাহারা তিন দিনে,ফিরিবার সময় সেই পথ অতিক্রম করিল দুই দিনে। সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়াই তারিণী বলিল,
দাঁড়া,লদীর ঘাট দেখে আসি। ফিরিয়া আসিয়া পুলকিত চিত্তে তারিণী বলিল,লদী কানায় কানায়,সুখী।
প্রভাতে উঠিয়াই তারিণী ঘাটে যাইবার জন্য সাজিল। আকাশ তখন দুরন্ত দুর্যোগে আচ্ছন্ন,ঝড়ের মতো বাতাস,সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি।
দ্বিপ্রহরে তারিণী ফিরিয়া আসিয়া বলিল,কামার-বাড়ি চললাম আমি।
সুখী ব্যস্তভাবে বলিল,খেয়ে যাও কিছু।
চিন্তিত মুখে ব্যস্ত তারিণী বলিল,না,ডোঙার একটা বড় গজাল খুলে গেইছে। সে না হলে—উহুঁ অল্প বান হলে না হয় হত,লদী একেবারে পাথার হয়ে উঠেছে;দেখসে আয়। সুখীকে সে না দেখাইয়া ছাড়িল না। পালেদের পুকুরের উঁচু পাড়ের উপর দাঁড়াইয়া সুখী দেখিল,ময়ূরাক্ষীর পরিপূর্ণ রূপ। বিস্তৃতি যেন পারাপারহীন। রাঙা জলের মাথায় রাশি-রাশি পুঞ্জিত ফেনা ভাসা ফুলের মতো দ্রুতবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে। তারিণী বলিল,ডাক শুনছিল-সোঁ-সোঁ ? বান আরও বাড়বে! তু বাড়ি যা,আমি চললাম। লইলে কাল আর ডাক পার করতে পারব না।
সুখী অসন্তুষ্ট চিত্তে বলিল,এই জলঝড়—
তারিণী সে কথা কানেই তুলিল না। দুরন্ত দুর্যোগের মধ্যেই সে বাহির হইল।
যখন সে ফিরিল,তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। দ্রুতপদে সে আসিতেছিল । কি একটা‘ডুগডুগ’ শব্দ শোনা যায় না? হাঁ, ডুগডুগিাই বটে। এ শব্দের অর্থ তো সে জানে,আসন্ন বিপদ। নদীর ধারে গ্রামে গ্রামে এই সুরে ডুগডুগি যখন বাজে,তখনই বন্যার ভয় আসন্ন বুঝিতে হয়।
তারিণীর গ্রামের ও-পাশে ময়ূরাক্ষী,এ-পাশে ছোট একটা কাঁতার অর্থাৎ ছোট শাখা-নদী। একটা বাঁশের পুল দিয়া গ্রামে প্রবেশের পথ। তারিণী সঠিক পথ ধরিয়া আসিয়াও বাঁশের পুল খুঁজিয়া পাইল না। তবে পথ ভুল হইল নাকি? অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ পর সে ঠাহর করিল,সে পুলের মুখ এখনও অন্তত একশত বিঘা জমির পরে। ঠিক বন্যার জলের ধারেই সে দাঁড়াইয়া ছিল, আঙুলের ডগায় ছিল জলের সীমা। দেখিতে দেখিতে গোড়ালি পর্যন্ত জলে ডুবিয়া গেল। সে কান পাতিয়া রহিল,কিন্তু বাতাস ও জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না,আর একটা গর্জনের মতো গোঁ-গোঁ শব্দ। দেখিতে দেখিতে সর্বাঙ্গ তাহার পোকায় ছাইয়া গেল। লাফ দিয়া দিয়া মাটির পোকা পলাইয়া যাইতে চাহিতেছে।
তারিণী জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল ।
ক্ষিপ্রগতিতে মাঠের জল অতিক্রম করিয়া গ্রামে প্রবেশ করিয়া সে চমকিয়া উঠিল। গ্রামের মধ্যেও বন্যা প্রবেশ করিয়াছে। এককোমর জলে পথঘাট ঘরদ্বার সব ভরিয়া গিয়াছে। পথের উপর দাঁড়াইয়া গ্রামের নরনারী আর্ত চীৎকার করিয়া এ উহাকে ডাকিতেছে। গোরু ছাগল ভেড়া কুকুরের সে কি ভয়ার্ত চীৎকার। কিন্তু সে সমস্ত শব্দ আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল ময়ূরাক্ষীর গর্জন,বাতাসের অট্টহাস্য,আর বর্ষণের শব্দ;লুণ্ঠনকারী ডাকাতের দল অট্টহাস্য ও চীৎকারে যেমন করিয়া ভয়ার্ত গৃহস্থের ক্রন্দন ঢাকিয়া দেয়,ঠিক তেমনই ভাবে।
গভীর অন্ধকারে পথও বেশ চেনা যায় না ।
জলের মধ্যে কি একটা বস্তুর উপর তারিণীর পা পড়িল,জীব বলিয়াই বোধ হয়। হেঁট হইয়া তারিণী সেটাকে তুলিয়া দেখিল,ছাগলের ছানা একটা,শেষ হইয়া গিয়াছে। সেটাকে ফেলিয়া দিয়া কোনরূপে সে বাড়ির দরজায় আসিয়া ডাকিল,সুখী-সুখী!
ঘরের মধ্য হইতে সাড়া আসিল-অপরিমেয় আশ্বস্ত কণ্ঠস্বরে সুখী সাড়া দিল,এই যে, ঘরে আমি।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তারিণী দেখিল,ঘরের উঠানে এক-কোমর জল। দাওয়ার উপর এক-হাঁটু জলে চালের বাঁশ ধরিয়া সুখী দাঁড়াইয়া আছে।
তারিণী তাহার হাত টানিয়া ধরিয়া বলিল,বেরিয়ে আয়,এখন কি ঘরে থাকে,ঘর চাপা পড়ে মরবি যে ।
সুখী বলিল,তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। কোথা খুঁজে বেড়াতে বল দেখি?
পথে নামিয়া তারিণী দাঁড়াইল,বলিল,কি করি বল দেখি সুখী?
সুখী বলিল,এইখানেই দাঁড়াও। সবার যা দশা হবে আমাদেরও তাই হবে।
তারিণী বলিল, বান যদি আরও বাড়ে সুখী? গোঁ-গোঁ ডাক শুনছিস না?
সুখী বলিল,আর কি বান বাড়ে গো? আর বান বাড়লে দেশের কি থাকবে? ছিষ্টি কি আর লষ্ট করবে ভগবান?
তারিণী এ আশ্বাস গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিল,কিন্তু পারিল না। একটা হুড়মুড় শব্দের সঙ্গে বন্যার জল ছটকাইয়া দুলিয়া উঠিল। তারিণী বলিল,আমাদেরই ঘর পড়ল সুখী। চল্, আর লয়,কোমরের ওপর উঠল,তোর তো এক-ছাতি হইছে তা হলে।
অন্ধকারে কোথায় বা কাহার কণ্ঠস্বর বোঝা গেল না,কিন্তু নারীকণ্ঠের কাতর ক্রন্দন ধ্বনিয়া উঠিল,ওগো,খোকা পড়ে গেইছে বুক থেকে। খোকা রে!
তারিণী বলিল,এইখানেই থাকবি সুখী,ডাকলে সাড়া দিস। সে অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। শুধু তাহার কণ্ঠস্বর শোনা যাইতেছিল,কে? কোথা? কার ছেলে পড়ে গেল,সাড়া দাও ওই!
ওদিক হইতে সাড়া আসিল,এই যি।
তারিণী আবার হাকিল,ওই!
কিছুক্ষণ ধরিয়া কলমস্বরের সঙ্কেতের আদান-প্রদান চলিয়া সে শব্দ বন্ধ হইয়া গেল। তাহার পরই তারিণী ডাকিল,সুখী!
সুখী সাড়া দিল,অ্যাঁ ?
শব্দ লক্ষ্য করিয়া তারিণী আসিয়া বলিল,আমার কোমর ধর সুখী। গতিক ভাল নয়।
সুখী আর প্রতিবাদ করিল না। তারিণীর কোমরের কাপড় ধরিয়া বলিল,কার ছেলে বটে? পেলে?
তারিণী বলিল,পেয়েছি,ভূপতে ভল্লার ছেলে।
সন্তর্পণে জল ভাঙিয়া তাহারা চলিয়াছিল। জল ক্রমশ যেন বাড়িয়া চলিয়াছে। তারিণী বলিল,আমার পিঠে চাপ সুখী। কিন্তু এ কোন্ দিকে এলাম সুখী,ই—ই—
কথা শেষ হইবার পূর্বেই অথই জলে দুইজনে ডুবিয়া গেল। পরক্ষণেই কিন্তু তারিণী ভাসিয়া উঠিয়া বলিল,লদীতেই বা পড়লাম সুখী। পিঠ ছেড়ে আমার কোমরের কাপড় ধরে ভেসে থাক ।
স্রোতের টানে তখন তাহারা ভাসিয়া চলিয়াছে। গাঢ় গভীর অন্ধকার,কানের পাশ দিয়া বাতাস চলিয়াছে-হু-হু শব্দে,তাহারই সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে ময়ূরাক্ষীর বানের হুড়দুড় শব্দ। চোখে মুখে বৃষ্টির ছাট আসিয়া বিঁধিতেছিল তীরের মতো। কুটার মতো তাহারা চলিয়াছে-কতক্ষণ,তাহার অনুমান হয় না;মনে হয়,কত দিন কত মাস তাহার হিসাব নাই-নিকাশ নাই। শরীরও ক্রমশ যেন আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছিল। মাঝে মাঝে ময়ূরাক্ষীর তরঙ্গ শ্বাসরোধ করিয়া দেয়। কিন্তু সুখীর হাতের মুঠি কেমন হইয়া আসে যে! সে যে ক্রমশ ভারী হইয়া উঠিতেছে! তারিণী ডাকিল,সুখী-সুখী !
উন্মত্তার মতো সুখী উত্তর দিল,অ্যাঁ?
ভয় কি তোর, আমি—
পর-মুহূর্তে তারিণী অনুভব করিল,অতল জলের তলে ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা ডুবিয়া চলিয়াছে। ঘূর্ণিতে পড়িয়াছে তাহারা। সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত করিয়া সে জল ঠেলিবার চেষ্টা করিল। কিছুক্ষণেই মনে হইল,তাহারা জলের উপরে উঠিয়াছে। কিন্তু সম্মুখের বিপদ তারিণী জানে,এইখানে আবার ডুবিতে হইবে। সে পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু এ কি,সুখী যে নাগপাশের মতো তাহাকে জড়াইয়া ধরিতেছে? সে ডাকিল,সুখী-সুখী
ঘুরিতে ঘুরিতে আবার জলতলে চলিয়াছে। সুখীর কঠিন বন্ধনে তারিণীর দেহও যেন অসাড় হইয়া আসিতেছে। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড যেন ফাটিয়া গেল। তারিণী সুখীর দৃঢ় বন্ধন শিথিল করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু সে আরও জোরে জড়াইয়া ধরিল। বাতাস-বাতাস! যন্ত্রণায় তারিণী জল খামচাইয়া ধরিতে লাগিল। পর-মুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়। দুই হাতে প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা পোষণ করিয়া ধরিল। সে কি তাহার উন্মত্ত ভীষণ আক্রোশ। হাতের মুঠিতেই তাহার সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে। যে বিপুল ভারটা পাথরের মতো টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়া চলিয়াছিল,সেটা খসিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে সে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল। আঃ,আঃ–বুক ভরিয়া বাতাস টানিয়া লইয়া আকুলভাবে সে কামনা করিল, আলো ও মাটি।
প্রকাশকালঃ ২৭শে মার্চ,২০২০
সাম্প্রতিক মন্তব্য