ঢাকার বৃষ্টি আর ঢাকার গরম

কয়েক দশকের ভিতরেই ঢাকা হয়ে গেছে একটা নিষ্প্রাণ ইটকাঠপাথর, কাচ-লোহা আর ধাতব একটা শহর। সারিসারি দালানকোঠাগুলোর উপরে সারাদিন সূর্যের যে তাপ পড়ে তা নিচে জমে থেকে আমাদের নাগরিক জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে। সূর্যের তাপ বাতাসের তোড়ে সরে যেতে পারে না, সরবে কীভাবে, গায়ে গায়ে লাগানো বিল্ডিং এতোটুকু বাতাস প্রবাহের জায়গা রাখিনি আমরা ভদ্রলোকের সন্তানেরা। শহর ঢাকা একটা ধাতব চিমনির মতো বয়লারের মতো –সবকিছুকে তাতিয়ে রাখছে। হারিকেন, কড়াই বা জ্বলন্ত তাওয়াতে একফোঁটা পানি পড়লে যেমন তা ছ্যাঁত করে বাষ্প হয়ে যায়, আমাদের হচ্ছে তাই।

এর সঙ্গে গত তিন দশকে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গায়ে গা লাগানো দালানগুলোর চারপাশ জুড়ে সংখ্যাহীন এসি আর এসি। এই এসিগুলো ঢাকার তাপমাত্রাকে আরো কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিয়েছে। গনগণে চিমনির উপরে আকাশের উড়ো মেঘ এসে ঘনীভূত হতে পারে না, থিতু হতে পারে না। বাতাসের পালে চেপে ভুল করে মেঘগুলো ঢাকার আকাশে আসে মাঝে মাঝেই – কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হলকা আগুনের তাপে বাষ্পীভূত হয়ে সরে যায়, ঘনীভূত হয়ে নিচে আর পড়তে পারে না। আকাশ-জুড়ে খুব মেঘ করলেও ঢাকায় গত এক দশক ১০-১৫ মিনিটের বেশি একটানা বৃষ্টি হয় না। বছরে দুই একটা নিম্নচাপের প্রভাবে মাঝেসাঁঝে একটানা বৃষ্টি চোখে পড়ে।

অথচ, ঢাকার শৈশবে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বৃষ্টি হতো। আম্মা বলতেন, ‘সোমে সাত, মঙ্গলে তিন আর সব দিন দিন।’ মানে, সোমবারে বৃষ্টি শুরু হলে সাতদিন থাকতো , মঙ্গলে তিন দিন টানা বৃষ্টি হত তাঁদের সময়ে। আমরা সত্তর আশির দশকেও কিছুটা পেয়েছি, টানা দুই-তিন দিনের বৃষ্টি। এখন তো হা হতোস্মি !

পুরনো ঢাকার বৃষ্টি স্মৃতিতে নেই। পুরনো ঢাকা থেকে মিরপুরে প্রথম কিছুদিন আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন গুদারাঘাটে ছিলাম। তারপরের কয়েকবছর মিরপুর ১ নং সেকশনের পাইকপাড়া। তখনকার পাইকপাড়া ছিল এ যুগের অসম্পূর্ণ হাউজিং সোসাইটির মতো । কিছু বাড়ি হয়েছে, চারপাশে দেয়াল ঘেরা কিছু প্লট, পাশেই বিএডিসি কলোনি, অবারিত খোলা জায়গা। বর্ষা আসলেই চারপাশ আর বাড়ির সামনের গলি পানিতে থৈ থৈ। বাড়ির পিছনের ডোবা জলে উপচে পড়ে ভেতরবাড়ির আঙিনায় স্বচ্ছ জলের ধারা। ছোট নাম না জানা মাছের ছানা আর ব্যাঙাচি। গাছগুলো জবুথুবু হয়ে আছে, কার্নিশে ভেজা চড়ুই আর কাক। আমি , ভাইয়া আর ছোটমামা স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে সারাদিন লুডো, কার্ড, খিচুড়ি আর আলসেমি করে সন্ধ্যে নামাতাম। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেও কখনো আব্বাকে জুতো পলিব্যাগে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে ছাতা নিয়ে কোর্টের পথে যেতে দেখতাম। মাঝপথে একটা রিকশার সাড়া পেলে বাড়ীওয়ালা ডাক্তার চাচা চিৎকার করতে করতে ছুটতেন, ‘ও উকিল সাহেব, আরে ও উকিল সাহেব আমাকে বাস-স্ট্যান্ড পর্যন্ত নিয়ে যান।’ আব্বা আবার রিকশার পলি সরিয়ে ডাক্তার চাচাকে রিকশায় উঠিয়ে নিতেন।

গত কয়েক সপ্তাহ বা কয়েকমাস ধরেই পড়ছে ভ্যাঁপসা গরম। আম্মা এই গরমকে ভাদ্রের তাল পাকানো গরম বলতেন। অফিস বাসার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বের হলেই গা জ্বালানো গরম। অনেকক্ষণ শীতল পরিবেশে থাকার পরে সামান্য কিছুক্ষণ বাইরের সাধারণ আবহাওয়া মানে–আগের সুখটুকুর যথার্থ জরিমানা।

একটু গরমেই ঘেমে নেয়ে ওঠার এই শারীরিক অস্বস্তিকর দুর্বলতা আম্মার কাছ থেকে জীন-বাহিত হয়ে পৌঁছেছে আমার কাছে। আব্বা কিংবা আমার অন্য সহোদরদের ঘেমে একসা হওয়ার প্রবণতা নেই একেবারেই। যে তাপমাত্রায় অনেকে দিব্যি শুকনা থাকেন, সেই একই তাপমাত্রায় আমি ভেজা কাক হয়ে যাই। আম্মাকেও দেখতাম, গরমে কুলকুল করে ঘামছেন। শাড়ীর আঁচল দিয়ে গলা মুছছেন , রান্না করছেন, খাবার বাড়ছেন, উপরে ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে ; কিন্তু কোন কূলকিনারা করতে পারছেন না। সেজে-গুজে বাইরে কোথাও যাবেন, বাসার দরোজা পার হওয়ার আগেই ঘেমে শেষ হতেন। বাসায় আম্মা যে সুতি শাড়িগুলো পড়তেন, সেগুলোর রং ঠিক থাকতে থাকতেই ব্লাউজগুলো ভিজে ভিজে, রং জ্বলে বাতিল হয়ে যেতো।

এক সময়ে দেখতাম গল্প- উপন্যাসে বলতো, তিরতির করে ঘাম হচ্ছে, পিন পিন করে ঘাম হচ্ছে, কুলকুল করে ঘাম হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে এগুলোর অর্থ সেভাবে ধরতে পারতাম না। কুল কুল করে কীভাবে ঘাম বের হয়– এখন বুঝতে পারি।

এই আর্দ্র ভ্যাঁপসা ঘামের দেশে গামছা আমাদের প্রাত্যহিক পোশাকের আবশ্যিক হওয়া উচিৎ। জাতীয় পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে গামছাকেও জাতীয় সহকারী পোশাকে ঘোষণা দেওয়া উচিৎ।

মাস কয়েক আগে, হুট করে আমার সতীর্থ প্রকৌশলী আনোয়ারের গ্রামের বাড়ির একটা পারিবারিক আয়োজনে আমরা কয়েকজন হাজির হই। জুন মাসের ভয়ঙ্কর গরম। গ্রামের বাড়িটির চারপাশে অনেক খোলামেলা জায়গা থাকলেও তাপমাত্রা অসহনীয়। হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার আমাদের সবাইকে একটা করে ফতুয়া আর একটা করে দেশি গামছা উপহার দিল। এই প্রথম একটা উপহার পেলাম, যেটা তাৎক্ষণিক আবহাওয়া উপযোগী। তো সারাদিন সেই অসহনীয় গরমে আমি ও আমরা গামছা কাঁধে করে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ালাম, ঘাম হোক আর খাবার পরে হাত মোছা, বিমলানন্দে করলাম। এক পর্যায়ে ওঁদের বাড়ির পাশের নদীতে নৌকাভ্রমণ করলাম। সারাদিনের শেষে সন্ধেবেলা আবার জঞ্জালের শহর ঢাকায় ফিরে এলাম।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: গরম ও বৃষ্টির প্রাসঙ্গিক কয়েকটা গামছাময় মুহূর্ত।

প্রথম প্রকাশঃ ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৫

উপলব্ধি: ৪৮

‘There is no set rule.’
পরিস্থিতি, ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, যুগ ও প্রযুক্তির প্রভাবে যে কোন একটা নিয়ম ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় প্রযোজ্য নয় অর্থাৎ একইভাবে কাজ করে না। এই সহজ ব্যাপারটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেউ বুঝে ফেলে, আবার ঠিক বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেউ ‘একই নিয়ম সব জায়গায় চলবে’ – এই ব্যাপারে ভয়ঙ্কর মৌলবাদী হয়ে পড়ে।

নিয়মের ব্যত্যয়, সংস্করণ, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন মেনে নেওয়ার ব্যাপারে উদার পন্থা কাম্য। একটি পরিবার যে নিয়মে চলে, পাশের বাসার পরিবার কিছুটা পরিবর্তিত রূপে চলে। এক অফিসে যে নিয়মে চলে, হুবহু একই ধরণের পাশের অফিসটিতে সেই নিয়ম চলে না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও বহুবিধ তন্ত্র একেক সমাজে, রাষ্ট্রে একেক রূপ ধারণ করে।
অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্মাচার, জাগতিক সকল আচার ও নিয়ম স্থান-কাল-ভেদে পরিবর্তিত হয়।

উপলব্ধি: ৪৭

সামান্যতম সুযোগ থাকলেও , যে কোন অস্পষ্টতায়, অজ্ঞতায় প্রশ্ন করুন, জিজ্ঞেস করুন। যাকে জিজ্ঞেস করছেন সে আপনার সহকর্মী হতে পারে, আপনার অধস্তন হতে পারে। আপনার অজ্ঞতায় সে হয়তো আপনাকে সাময়িক নির্বোধ ভাবতে পারে। কিন্তু একবার বোকা হয়ে আপনি সারাজীবনের জন্য কিছু একটা শিখে গেলেন। আর যদি না জিজ্ঞেস করেন তবে সারাজীবনের জন্য বোকাই রয়ে গেলেন। সামান্য সময়ের জন্যে বোকা হওয়া সারাজীবনের জন্য বোকা হয়ে থাকার চেয়ে ভাল।

উপলব্ধি: ৪৬

The Small Changes make big difference!

আমার এক ক্রেতার কাছ থেকে শেখা। ও আমাকে প্রায়ই মনে করিয়ে দিত। ছোট একটা বাক্য, সামান্য একটা হাসি যেমন কারো মনে আপনার ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনতে পারে ; তেমনি সামান্য একটু অবহেলা, কটু কথা ঠিক উল্টোটা করতে পারে।

যোগাযোগের মাধ্যম, বন্ধুত্ব, চুক্তি, সহযাত্রা কিংবা বিচ্ছেদ ও প্রস্থান যাই হোক না কেন, একটু সৌন্দর্যের ছোঁয়া থাকা ভাল।

উপলব্ধি: ৪৪

পরিমিতিবোধ বুদ্ধিবৃত্তিক লেখালেখি ও আলোচনায় ঐশ্বর্যময় একটা গুণ। লেখালেখিতে এবং কথা বলার সময়েও অল্প কথায় প্রকাশ করার অব্যাহত দুশ্চেষ্টার অনুপ্রেরণা হচ্ছে প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। অনাবশ্যক ব্যাখ্যা না দেওয়ার প্রবণতাও তাঁর কাছ থেকেই। পাঠককে বুদ্ধিমান ভাবা উচিৎ। যে পাঠক আপনার ইশারা বুঝবে সেই আপনার আসল পাঠক; যে বুঝবে না, তাকে হাজার পাতার ব্যাখ্যা দিলেও বুঝবে না।