কর্পোরেট অবজার্ভেশন (বাংলাদেশের নবীন উদ্যোক্তাদের বর্তমান অবস্থা )

আমাদের কিংবদন্তী অর্থনীতিবিদদের কাছে ‘চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হও!’ ‘ সামাজিক ব্যবসা’ ইত্যাদি শুনে শুনে আমার মতো কুলি মজুরদেরও মাঝে সাঁঝে জানতে ইচ্ছে করে, এতো বড় একটা প্রযুক্তিনির্ভর প্রজন্ম উদ্যোক্তা হওয়ার পথে কি করছে ! তাঁদের মৌলিক বাধা কি কি ; নবীন উদ্যোক্তাদের কি অবস্থা ? আমাদের নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনা কি ?

সম্ভবত: ২০০৭/৮ এর পর থেকে শিল্প উদ্যোক্তাদের গ্যাসের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অধুনা কয়েকবছর যাবত তা দেওয়া হচ্ছে, এবং সেই গ্যাসের লাইন নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের কি পরিমাণ ‘ স্পিড মানি’ খরচ হচ্ছে ; সেটা শুনলে অনেকের চোখ কপালে উঠবে ! বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, আমাদের জ্বালানী সংকট, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশন ট্র্যাজেডি আমাদের বস্ত্রশিল্পকে খোলনলচে বদলে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে অন্যতম রপ্তানীমুখি শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা আসার পরিমাণ গেছে কমে । নতুন টেক্সটাইলে নতুন উদ্যোক্তাদের পদচারণ নেই বললেই চলে । যা হচ্ছে, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ! কারো ৬ লাখ গজ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল, সে এক ধাক্কায় ১২ লাখ গজ করে ফেলছে। কারো ৩০ লাইনের কারখানা ছিল, সে কয়েকবছরে ৬০ লাইন করে ফেলছে। অসম মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অসংখ্য ছোট মাপের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝারি মাপের গার্মেন্টসগুলোর মালিকানা বড় গ্রুপগুলোর কাছে চলে গেছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর আরও বৃহদায়তন হচ্ছে।

দেড় যুগ আগে আমার কর্মজীবনের শুরুতে দেখেছি , গার্মেন্টস-এর মালিকদের প্রধান উৎপাদন নির্ভরতা ছিল , কাপড় উৎপাদন করা ও সেলাই করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্যাক-ওয়ার্ড লিংকেজ বা অন্যান্য খুচরা পণ্যের সরবরাহ ছিল পুরোটাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে। বোতাম, টুইল টেপ, লেবেল, সুতা, কার্টন, পলি ব্যাগ, স্ক্রিন প্রিন্ট , এমব্রয়ডারি যাবতীয় সরবরাহ ছিল ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনেক লোকের কর্মসংস্থান হত।এখন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কারখানায় সব ধরণের সার্ভিস ও ব্যাক-ওয়ার্ড লিংকেজ ইউনিট খুলে বসে আছেন।
তাহলে ঐ ক্ষুদ্র- মাঝারি উদ্যোক্তাদের কি অবস্থা ? প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে, পুরনোরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন । এবং ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আবহাওয়ায় নতুন উদ্যোক্তারা নিজেদের নৌকার পাল না তুলে ‘ আরামদায়ক’ চাকরির বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন।

টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টর ছেড়ে অন্যদিকে আসি। স্কয়ার বা প্রাণ-আরএফএল এর মতো বড় প্রতিষ্ঠানকে উদাহরণের স্বার্থে উদাহরণ হিসাবে ধরছি। স্কয়ার-এর ফার্মাসিউটিক্যালস দিয়ে ব্যবসা শুরু। পরে টেক্সটাইল, তারপরে ফুড ও বেভারেজ, কসমেটিক্স, টয়লেট্রিজ, হাসপাতাল সব। দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠতায় তাঁদের সকল পণ্য একটা ব্র্যান্ড লেবেল পেয়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্যতা এমন পর্যায়ে গেছে, তাঁদের পণ্য চোখ বুজে ভোক্তারা কিনে থাকে। কিন্তু এমন অনেক পণ্য ছিল, যেগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা করে বেঁচে থাকত। সেগুলোও ধীরে ধীরে স্কয়ার দখল করে নিয়েছে। সামান্য ঝাল মুড়ি বা চীনাবাদামও যদি স্কয়ারের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করে, তাহলে সাধারণ ভোক্তাদের কেউ কি আর চলতি ঝাল মুড়িওয়ালার কাছ থেকে কিনবে ?

ঐদিকে প্রাণ-আরএফএল এর মূল পণ্য সম্ভবত: ছিল, একদিকে তরল পানীয় অন্যদিকে হেভি-লাইট মেশিনারিজ, নলকূপ ইত্যাদি। এখন তাঁরা সাধারণ প্লাস্টিকের চেয়ার থেকে শুরু করে সামান্য বালতি,বদনা পর্যন্ত উৎপাদন ও বাজারজাত করছেন। হাস্যকর হলেও সত্য, প্লাস্টিকের বদনা খুবই ছোট মাপের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা করে থাকতেন। যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্লাস্টিকের বদনা, বালতি তৈরি করত তাঁর ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া এখন গত্যন্তর নেই । ব্র্যান্ড ইমেজে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অনেক পিছিয়ে আছে। পেপার ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রমরমা বিজ্ঞাপনে সবকিছুই ব্র্যান্ডিং ও বিক্রি করা সম্ভব।

বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রচলিত পণ্য ছাড়াও ছোটখাটো সবরকম পণ্যের বাজার যেভাবে দখল করা শুরু করেছে; দেখে শুনে মনে হচ্ছে , সেই দিন আর বেশি দুরে নেই, কয়েকটি বড় কর্পোরেশন বাংলাদেশের তাবৎ পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকবেন। পুঁজি বাজার ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিজ্ঞাপনে নৈতিকতা পকেটে পুরে ফেলেছেন আমাদের বড় উদ্যোক্তারা।

আবার ফিরে আসি আমাদের টেক্সটাইল ও বস্ত্র খাতে। কেন নতুন উদ্যোক্তাদের দেখা নেই ?কেন এঁরা নতুন শিল্প স্থাপনে উৎসাহী হচ্ছেন না ?

প্রথমত: বড় উদ্যোক্তারা ছোটদের ডি-মার্কেটিং করছেন। বড় মাছ, পুকুরের সব ছোটমাছকে খেয়ে ফেলছে।

দ্বিতীয়ত: ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তাদের আগের মতো সহায়তা করছে না। ব্যাংক নিরাপদ বিনিয়োগে বড় ঋণ-খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে আবার নতুন করে ঋণ দিচ্ছে। আর আমাদের অসংখ্য মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকেরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না , তাঁদের চাকরি বাজার ও উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন আদৌ সম্ভব কীনা, হলেও সেটা কীভাবে ! তৃতীয়ত: (এটি আমার ব্যক্তিগত মতও বটে)—ব্রিটিশ কেরানি-নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদের অগুনতি কেরানী তৈরি করছে। শত শত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আমাদের বেশি দরকার – হাজার হাজার কারিগরি শিক্ষা নির্ভর শিক্ষালয়। যেখানে, একজন তরুণকে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ,আমাদেরকে মানসিক প্রতিবন্ধী করে ফেলছে। একটা চেয়ার ও টেবিলের বসার সুযোগের জন্য আমাদের সকল সম্ভাবনা জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত ।

বাংলাদেশ সরকারের ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু মাস্টার প্ল্যান হয়তো আছে। আমি জানি না । নানা ধরনের ফান্ড থাকে , এসএমই ( Small Medium Entrepreneur) ঋণ থাকে। সেটা কতখানি সঠিক জায়গায় পৌঁছায় , সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ অমূলক নয়। এবং প্রতিবছরে ওই ফান্ডের যথোপযুক্ত ব্যবহার হয় কিনা , সেটার কোন তথ্য কারো জানা নেই।

কিছুদিন আগে , বিশাল শিল্পকারখানার মালিক এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজেও চাইতেন, ছোট ছোট স্ক্রিন প্রিন্টিং কারখানা , লেবেল, পলি , টুইল টেপ, বাটন , কার্টন ফ্যাক্টরি ফ্যাক্টরি চালু থাক। কিছু লোকজন উদ্যোক্তা হোক। মুশকিল হচ্ছে, তাঁর অভিজ্ঞতা এই ব্যাপারে খুবই তিক্ত ! তিনি হয়তো ভালো মানের সুতা দিয়েছেন তাঁর টুইল টেপ করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু , ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অতি লোভে , মাঝপথেই গাড়ীসহ সেই ভালো মানের সুতা বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে, দুনিয়ার উচ্ছিষ্ট খোলা বাজারের সুতা কিনে তাঁর টুইল টেপ বানিয়ে দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় গুণগত মানে তাঁর গার্মেন্টস ফেল করেছে।

একই কথা অন্যসব বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য, এঁরা যে দামে কাজ ছোটদেরকে দেয়। তাঁরা যদি সঠিক উপাদান ব্যবহার করত তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু, কিছু অতিলোভী দ্রুত মুনাফা কামী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কৃতকর্মের দায় নিতে হচ্ছে অন্য সবাইকে। প্রায়শই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করে বড় প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলে দেয়। অনেকবার দেখেছি, সামান্য সুতা, বোতাম, কার্টন, টুইল টেপ, স্ক্রিন প্রিন্ট ফ্যাক্টরির গুণগত মানের সমস্যা অথবা সরবরাহে দেরী হওয়ার গার্মেন্টস মালিককে ডিসকাউন্ট ও এয়ার শিপমেন্টের জরিমানা গুনতে হয়েছে।

দ্রুত বড়লোক হওয়ার ও অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পড়ে ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বড় প্রতিষ্ঠানের ভরসা হারিয়েছেন। এখন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কারখানার অভ্যন্তরেই সব ছোট ব্যাক ওয়ার্ড লিংকেজ করে ফেলেছেন। কেননা, তাঁরা তাঁদের মিলিয়ন ডলারের শিপমেন্ট সামান্য কয়েক পয়সার অ্যাকসেসরিজের জন্য হুমকির মুখে ফেলতে চান না।

এই দুষ্টচক্র থেকে কীভাবে বের হওয়া সম্ভব , সেটা নিয়ে কী ধরণের গবেষণা হওয়া উচিৎ সেটা জানার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই শেষ করতে হচ্ছে আলোচনা।

প্রকাশকালঃ ১০ই মার্চ, ২০১৭

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( অভিনয় দক্ষতা )

পরিশ্রম, কাজের দক্ষতা, নিষ্ঠা, দায়িত্বজ্ঞান, দূরদর্শিতা, নিয়মানুবর্তিতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি গুণাবলী কর্পোরেট ঊর্ধ্বতনদের প্রাথমিক যোগ্যতা। এই গুণাবলী না থাকলে একটা অবস্থানে কেউই পৌঁছুতে পারেন না ! এই আবশ্যকীয়র পাশাপাশি মানুষ হিসাবে একজন ঊর্ধ্বতন কিভাবে তাঁর পরিপার্শ্বে বিচরণ করেন ও তাঁর আচরণের স্বল্প দীর্ঘমেয়াদী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কীভাবে অধস্তনদের উপরে পড়ে সেটা আজকের আলোচ্য।

মানবিক আবেগ আর কর্পোরেট আবেগের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। মানবিক আবেগ নিজের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দেখানো যায়। কিন্তু প্রায়শ: একটা নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলে সেই আবেগগুলো কর্পোরেট হয়ে যায়। কর্পোরেট আবেগ ও তার প্রকাশভঙ্গী যতোটা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিৎ ছিল , তা ততোখানি গুরুত্ব পায় নি । প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতনদের তাঁদের অবস্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবেগ ও তার প্রকাশভঙ্গীর ভারসাম্যের ব্যাপারটা শিখে নেওয়া উচিৎ । একই পরিস্থিতিতে একজন ঊর্ধ্বতন ও একজন মধ্যম সারির কর্মচারীর প্রকাশভঙ্গী আলাদা হওয়া উচিৎ। সেটা না হলে প্রতিষ্ঠানে বড় ধরণের সমস্যা তৈরি হয়। একজন দক্ষ ঊর্ধ্বতনের যদি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মতো সোজা বাংলায় ‘ ছোটলোক’- এর মতো আচরণ হয় তাহলে মুশকিল!

এই কর্পোরেট আবেগের বহিঃপ্রকাশকে অনেকেই অভিনয়ের সঙ্গে তুলনা করেন। আমার নিজের কথা বলি। আমার কয়েকজন ঊর্ধ্বতন আমাকে সরাসরি পয়েন্ট-আউট করে বলেছেন, আমার কর্পোরেট অভিনয় দক্ষতা নাকি খুবই নিম্নশ্রেণীর। আমি কোন একটা ব্যাপারে অখুশি হলে, আমার চেহারায় মুহূর্তেই সেটা ফুটে ওঠে। আমার ঊর্ধ্বতনরা সহজেই আমাকে ‘পড়ে’ ফেলতে পারেন। They can easily read me ! অথচ আমার সতীর্থ অনেক কর্মকর্তাকে দক্ষ অভিনেতার মত দিনের পর দিন অভিনয় করে যেতে দেখেছি। সবচেয়ে ভণ্ড, দুশ্চরিত্র, অর্থ-লোলুপ, ক্ষমতা-লোভী, স্বার্থপর , হীন বসের সামনেও তাঁদেরকে দিনের পর দিন হাত কচলে নতজানু হতে দেখেছি। ঊর্ধ্বতনের খুব নিম্নশ্রেণীর রসিকতায় উচ্চকিত হাসিতে ফেটে পড়তে দেখেছি। বিনিময়ে আমার সতীর্থদের পদন্নোতি ও নগদ নারায়ণ সবই মিলেছে। আমি থেকে গেছি ওই সৌভাগ্য থেকে যোজন যোজন দূরত্বে ! ওই কর্পোরেট অভিনয় আমাকে দিয়ে কখনো হয়নি; এখন এই শেষ বয়েসে এসে নতুন করে অভিনয় দক্ষতা বাড়ানোয় সচেষ্ট হতে ইচ্ছেও করে না আর !

কর্পোরেট অভিনয় বলি বা আবেগের প্রকাশ বলি ; সেটা কিন্তু নানা শ্রেণীর হয়। আমি- আপনি সারাক্ষণ অভিনয় করে চলেছি, পাশের মানুষের সঙ্গে, বসের সঙ্গে, চাকরি-প্রার্থীর সঙ্গে, এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে, ভাইবোন বা বাবা-মার সঙ্গেও। কিন্তু মনে রাখতে হবে , দর্শক বুঝে আপনাকে অভিনয় ডেলিভারি করতে হবে ! তৃতীয় শ্রেণীর দর্শকের জন্য যেমন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা ও অভিনয় দক্ষতার প্রয়োজন নেই। এর বিপরীতে প্রথমশ্রেণীর দর্শকের সামনে তৃতীয় শ্রেণীর অভিনয় একেবারে অশ্লীল ও কদর্য হয়ে ওঠে !

আবেগ প্রকাশের যেহেতু কোন বাঁধাধরা নিয়ম বা ম্যানুয়াল নেই ; তাই আমরা ধরে নিই সেটা ব্যক্তি তাঁর পরিবার,পরিবেশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করে আসবে। কেউ কেউ শিখে আসেন , অনেকে শেখেন না এবং শিখতেও চান না ; হয়তো তাঁদের শেখার দরকারও নাই ! সুযোগের সময়োচিত সদ্ব্যবহার করে অল্পসময়ে ক্ষমতার এমন একটা জায়গায় কেউ কেউ পৌঁছে গেছেন যে ; তাঁদের আচরণের ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলার অবকাশ কম। আবার এটাও ঠিক , আবেগ সেটা মানবিক হোক আর কর্পোরেট হোক –মানুষ যেখানে আছে, সেখানেই রাগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ,তাচ্ছিল্য, অবহেলা, উচ্চম্মন্যতা, হীনমন্যতা, ভয়, লোভ, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, অহংকার, আত্ম-প্রেম, ইত্যাদি থাকবেই। সেটা মাল্টিপারপাস কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে , পাইকার বাজার বা সেনাবাহিনী সবজায়গায় প্রায় একই রকমের ! আমার স্বল্পমেয়াদী জীবনে কেন জানি মনে হয়েছে , একজন মানুষ আসলে খুব কম সময়েই তাঁর মৌলিক অর্জিত চরিত্র থেকে বের হয়ে আসতে পারে। নানা চাপে তাপে তাঁর পারিবারিক অর্জিত চেহারা বের হয়ে আসে। সেটা প্রায়শ: মানবিক কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দৃষ্টিকটু-রকমের স্বার্থপরতায় আচ্ছন্ন।

আমি কয়েক রকম ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কাজ করেছি, এখনো করছি। তবে মোটা-দাগে যেটাকে আমরা বলি নিয়ন্ত্রিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ সেটা হাতে গোনা কয়েকজনের ছিল। অমায়িক, যুক্তিবাদী, পরিমিতি বোধসম্পন্ন , নিয়ন্ত্রিত আবেগী ছিলেন কয়েকজন। বদমেজাজি ছিলেন মাত্র একজন। তাঁর মধ্যে সেটারও পরিমিতিবোধ ছিল। ওই যে বললাম, এর মাঝখানে কয়েকজন ছিলেন, দুর্বোধ্য গিরগিটির মতো! ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানোর অলৌকিক গুণের শক্তিমত্তা ছিল এঁদের। কেউ কেউ ছিলেন জিঘাংসাপরায়ণ। কেউ কেউ ছিলেন গিরগিটি ও হিংস্রতার মিশেল।যতখানি বদমেজাজি হলে জিঘাংসাবৃত্তির সাময়িক প্রশমন ঘটতে পারত , তাঁরা সেই পরিমাণে মেজাজি ছিলেন না। মূলত: বদমেজাজি ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কাজ করার অসুবিধার পাশাপাশি প্রধান সুবিধা হচ্ছে, এঁদের তাৎক্ষণিক আবেগ প্রশমিত হলে ব্যাপারটা তাঁরা ভুলে যান। আপনি আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে পারবেন এঁদের সঙ্গে। কিন্তু মাঝামাঝি মিশ্রিত বিরল গোত্রটি ভয়ঙ্কর ! যাঁদের ক্রোধ কুটিলতাকে অতিক্রম করতে পারে না। আপনার বিশেষ কোন কাজ, প্রকাশভঙ্গী না প্রতিক্রিয়ার উপর উনি কতোখানি ক্রুদ্ধ, উনি সেটা আপনাকে তাৎক্ষণিক-ভাবে টের পেতে দেবেন না। এঁরা এঁদের জিঘাংসা পুষে রাখেন মনের গহীন কালোগহ্বরে ! সরীসৃপের মতো বেড়ে ওঠা সেই জিঘাংসার ছোবল দুর্বল অসতর্ক মুহূর্তে ছোবল দিয়ে বসে নিরীহ অধস্তনদের। সেই বিষে আমি অনেক কর্পোরেট কর্মকর্তাকে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছি।

ওই বিশেষ শ্রেণীর সঙ্গে টিকে থাকতে হলে আপনাকে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করে চলা শিখতে হবে। নয়তো তাঁদের বিজয়-রথের চাকায় আপনার ছোট-প্রাণ কখন পিষ্ট হয়ে যাবে আপনি টেরই পাবেন না !
আমার এক ঊর্ধ্বতন পেয়েছিলাম ক্যারিয়ারের শুরুতে। তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বলতাম , ভদ্রলোক কেন যে চলচ্চিত্রে গেলেন না ! শুধুমাত্র কর্পোরেট অভিনয়ের যদি কোন অস্কার পুরষ্কার থাকত ; আমি নিজে অস্কার নমিনেশনের জুরি বোর্ডকে রিকমেন্ড করতাম তাঁকে অন্তত: একটা লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার জন্য ! তিনি যেমন মুহূর্তেই কাউকে দেখে হেসে গলে পড়তে পারতেন ; পর মুহূর্তেই আরেকজনের ব্যাপারে তাঁর ভয়ঙ্কর বীভৎস চেহারা দেখা যেত। আবার কিছুক্ষণ পড়ে তিনি যখন তাঁর ঊর্ধ্বতনের সামনে যেতেন ; তাঁর বিনয়ী আচরণ ও অভিনয় দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম !

সকল সতীর্থ ,অনুজ কর্পোরেট কর্মকর্তাদের আরও অভিনয় দক্ষতা বাড়ুক। যারা দর্শক-শ্রেণীতে আছেন, তাঁরা মঞ্চের আলোয় এসে অভিনয় করার সুযোগ পান, এই শুভকামনা।

কর্পোরেট অবজার্ভেশন( ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার বিভ্রান্তিসমূহ)

টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ট্রেডে কিছুদিন কাটিয়ে ফেলেছি বলে , নবীন প্রজন্মের অনেকে ফোনে বা সরাসরি তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে সাজেশন চায়। কোথায় চাকরি করলে ভালো হয় ভাইয়া ; ওই খানে যোগ দিতে চাচ্ছি , আপনার সাজেশন কি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁদের বলি– কাজের ক্ষেত্রে সফল সিনিয়র ৪ জন ভাইয়ের সঙ্গে ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বললে পাঁচ রকমের সাজেশন পাওয়া যায়! আমাদের সময়েও তেমনটাই পেয়েছি, তোমাদের সময়েও পাবে । যেহেতু জীবন তোমাদের নিজের, সুতরাং সবার কথাই শোন, কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিজেই নাও।

কে না জানে , একই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসে কেউ কেউ সেই ডাক্তারের চৌদ্দ-গোষ্ঠী উদ্ধার করে। আবার ওই ডাক্তারের সুচিকিৎসায় কেউ ভাল হয়ে তাঁকে দেবতাতূল্য জ্ঞান করে পঞ্চমুখ হয়। যার সাথে কথা হচ্ছে, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি ক্যারিয়ারে ব্যাপারে কথা বলে থাকেন। সুতরাং তাঁর সময়কাল, প্রেক্ষিত তো তোমার সময়কাল ও প্রেক্ষিত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর অভিজ্ঞতার সেইটুকুই নাও, যেটা তোমার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হবে।

অতএব নীচের লেখাটিও আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার বিভ্রান্তির স্মৃতিচারণা। আমার সতীর্থ , অগ্রজ অনুজেরা যে যেখানে কর্মরত আছেন; তাঁদের পরিশ্রান্ত উদ্যমী চেহারার কথা আমি জানি। তাঁদের একেকজন টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির একেক স্পেশালাইজড সেক্টরে এমনভাবে দেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছেন ; যে এঁদের সামনাসামনি হলে আমি নিজেই খুব নুইয়ে পড়ি। আমিতো আসলে আমার ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনিক্যাল ডিগ্রীর তেমন কিছুই হাতে কলমে করে দেখতে পারিনি। নতুন কিছু আবিষ্কারও করিনি। কিভাবে কিভাবে চলে এসেছি মার্চেন্ডাইজিং, মার্কেটিং আর অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ একটা অবস্থানে। এখানে সারাদিন ধরে আমাকে গুচ্ছের কমার্শিয়াল আর হিজিবিজি কাজ নিয়ে থাকতে হয়। টেকনিক্যাল ডিসিশন মেকিংএর বলতে গেলে তেমন ছিটেফোঁটাও নেই।

আমি যখন জীবনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছি, তখন তেজগাঁও এর বেগুনবাড়ির বৃক্ষশোভিত খানিকটা গ্রাম্য ক্যাম্পাস দেখে বেশ আশাহত হয়েছিলাম। আমি তখনো বিখ্যাত লেখক ডঃ হুমায়ূন আহমেদ স্যারের রসায়ন বিভাগের ছাত্র, নতুন করে পদোন্নতি হয়েছে ফলিত রসায়নে। কিন্তু আমি না যাই কেমিস্ট্রির ক্লাসে , না যাই নতুন করে ফলিত রসায়নে ভর্তি হতে। বিভ্রান্ত ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করি। তো , নানা পারিবারিক চাপে টেক্সটাইলে ভর্তি হওয়ার পরে মিরপুর থেকে বাসে করে ফার্মগেটে নামতাম। রিকশাওয়ালাগুলো আবার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চেনে না। হয় তাঁদেরকে বলতে হয় পলিটেকনিক যাব অথবা বিজি প্রেসে যাব। টেক্সটাইল বললে হা করে চেয়ে থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। টেক্সটাইলে ভর্তি হওয়ার আগে আমি নিজেই কি চিনতাম যে কাপড়চোপড়ের উপরেও ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে ! আমার স্কুল-কলেজের বন্ধুরা সবাই খ্যাতনামা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে , কেউ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, কেউ বুয়েটে। আমি তখন বুয়েটে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার জন্য হেলে দুলে প্রিপারেশন নিচ্ছি ; সেও আরেক বিভ্রান্তি ! আর প্রিপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে, মন চাইলে একবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ক্যান্টিনে ১২ টাকার চিকেন বিরিয়ানি খাই, তো আরেক বেলা বুয়েটের এক হলে সিনিয়র ভাইয়ের কাছে গিয়ে মডেল টেস্ট দিই।পরের তিনদিন আবার মহল্লার এক বন্ধুর বাড়ীতে তাস পিটাই।

যাই হোক ভর্তি হওয়ার পরে ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হল। মনমরা করে মিরপুর থেকে রোজ ক্লাসে যাই আর ফিরে আসি। সঙ্গের স্কুল সতীর্থ হুমায়ুন কবির ওরফে লাবু উঠে পড়ে লেগে গেল ফার্মগেট এলাকার( মূলত: হলিক্রস কলেজের মোড়ের) রিকশাওয়ালাদের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চেনানোর অপচেষ্টায়। তাই কি হয়, ট্রাক-স্ট্যান্ড পার হয়েই , রিকশাওয়ালারা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করত, ‘মামা এইবার কই নামবেন পলিটেকনিকে ?’
পরে কি মনে করে শহীদ আজিজ হলে ১১২ নাম্বার রুমে কয়েকজন বুজুর্গ হুজুরের সঙ্গে উঠে পড়লাম।

রাতে ঘুমানোর সময় বাদ দিয়ে বাকী-সময় ঢাকা কলেজের পুরনো সতীর্থদের রুমে গিয়ে আড্ডা মারি । আর সেই সময় পলিটেকনিকের ছাত্ররাজনীতির দুর্বিষহ অবস্থা চলছে। সারাদিন কোনভাবে পার হলেও রাতে শুরু হয়ে যেত হুটোপুটি। ছাত্রদল একবার দৌড় দিচ্ছে ছাত্রলীগকে তো কিছুক্ষণ পরে তার বিপরীত চিত্র। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর কাঁচা টাকার স্রোতে মফঃস্বল থেকে আসা পলিটেকনিকের কম বয়সী ছাত্ররা জড়িয়ে পড়ছিল নোংরা টেন্ডার-বাজির রাজনীতিতে। এঁরা আবার ছিল তেজগাঁওয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের টেক্সটাইলের প্রত্যেক বর্ষে আসন সংখ্যায় ছিল গোটা পঞ্চাশেক করে। বছর ঘুরে দেখা যেত আছে ৩৫/৪০ জন। আমাদের সবগুলো বর্ষ মিলে যে ছাত্র সংখ্যা, পলিটেকনিকের একটা ডিপার্টমেন্টের নতুন ছাত্রের সংখ্যাও তার চেয়ে বেশী । সুতরাং যা হয়, আমরা মেধাবী ও সিনিয়র সিটিজেন হয়েও আমাদের কৌলীন্য বজায় রাখতে পারতাম না। ওদের নোংরামির আবর্জনা এসে পড়ত শহীদ আজিজ আবাসিক হলে। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। টিভি রুম থেকে শুরু করে , আমাদের ক্যান্টিনেও দেখা যেত ওদের অনাকাঙ্ক্ষিত চলাফেরা।
ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে ; কথা হচ্ছিল ক্যারিয়ার ট্র্যাক বা ক্যারিয়ার বিভ্রান্তি নিয়ে। মাঝের কয়েকবছরের টেক্সটাইলের পড়াশোনা আর অম্লমধুর স্মৃতির কথা আরেকদিন বলব। সেটার অভিজ্ঞতা বুটেক্সের যাঁরা এই লেখা পড়ছেন তাঁদের কমবেশি আছে।

তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত সবগুলো প্রধান বিষয়ে ( ইয়ার্ন, ফেব্রিক, ওয়েট প্রসেসিং, গার্মেন্টস) আমাদের যে সিলেবাস ছিল তা একজন প্রকৌশলীর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্লোর চালানোর জন্য যথেষ্ট । সমাপনী বর্ষে এসে আমাদের বেছে নিতে হত অ্যাডভান্স বা স্পেশালাইজড বিষয়টি। ইদানীং অনেকগুলো বিভাগ হয়েছে জানি। আমাদের কয়েকজন তখন অধ্যাপক মাসউদ স্যারের( পরবর্তীতে তিনি বুটেক্সের ভিসি হয়েছিলেন) অন্ধভক্ত ছিলাম। মাসউদ স্যার অধুনা টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওয়েট প্রসেসিং এক নাম্বার সাবজেক্ট হলেও আমাদের কয়েকজন বেছে নিলাম মাসউদ স্যারের ফেব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজিকে। সত্যি কথা বলতে কি , শেষ বর্ষের মাসউদ স্যারের ওই অ্যাডভান্স স্পেশালাইজড ক্লাসগুলোর টেকনিক্যাল গভীরতা আগের বছরের ফাঁকি দিয়ে বেড়ানো , অবহেলিত ক্লাসের বেদনা ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল। মনে হয়েছিল হ্যাঁ, আমরা এইবার সত্যিকারের টেকনোলজি শিখছি। স্যারের ক্লাস নেওয়ার মধ্যে তথ্যের দক্ষতা , মুগ্ধ করে রাখার ও মোটিভেট করার দারুণ একটা সমন্বয় ছিল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যারের কথা গিলতাম।

ক্যারিয়ার নিয়ে কাহিনী শুরু হল, ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগে থেকেই। তখনকার প্রচলন বা ট্রেন্ড ছিল কে কোথায় চাকরি করবে সেটা নিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ঠিকঠাক হয়ে যেত। মিল ট্রেনিং এর সময়ে অনেক বড়ভাই, আমাদের কাউকে পছন্দ হলে আগে ভাগেই তাঁকে বলে রাখতেন তাঁর টেক্সটাইলে যোগদান করতে। সুতরাং আমদের ৬০ ভাগ ছেলের কে কোথায় যোগ দিচ্ছে সেটা রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার আগেই ঠিক হয়ে যেত। বাকী ছিলাম আমাদের মতো ৪০ ভাগ যারা ছিলাম পুরোপুরি বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তরা বিভিন্ন সময়ে নানা সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করতাম কোথায় প্রসপেক্ট বেশী। মুশকিল হচ্ছে সফল বড়ভাইদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমাদের বিভ্রান্তি যেত বেড়ে। ‘আরে মিয়া হুদাই বইয়া রইছ ক্যা , যাও যাও ! নিটিং- এ জয়েন কর !ওইখানে তো কেউ নাই টেক্সটাইলের। ফিল্ড এক্কেবারে ফাঁকা।’ আরেকজন বলত, ‘আরে ধ্যাত ! উইভিং এ যাও। পাকিস্তানি মূর্খ ফিটাররা বড় বড় সুলজার রোটি, রেপিয়ার আর প্রজেক্টাইল লুম চালাচ্ছে। এখনতো আবার এয়ার জেট ওয়াটার জেটের মতো অত্যাধুনিক লুমও চলে আসছে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বড়বড় ফ্লোরে কাজের মজাই আলাদা!’ ‘ আরে প্রিন্টিং এ জয়েন কর। শ্যামলদারে দেখ কই গেছে গিয়া!’ ‘ আশ্চর্য, তোমরা ডেনিম প্ল্যান্টে জয়েন করতেছ না কেন ? জানো ডেনিমের ভবিষ্যৎ কতো উজ্জ্বল বাংলাদেশে !’ ‘ সোয়েটারে বা ফ্ল্যাট নিটিং এ টেকনিক্যাল লোক নাই, গুচ্ছের অশিক্ষিতদের দিয়ে প্রোডাকশন চলছে , ওই খানে যাও!’ ডায়িং ফিনিশিং এর কথা বলতে হত না, কারণ সেটা ছিল সেই সময়ের সর্বোচ্চ চাহিদার। ৯০ এর দশকে একটার পর একটা নিট কম্পোজিট হচ্ছে, বছর দুয়েকের সিনিয়র বড় ভাইয়েরা ঝকঝকে টয়োটা গাড়ীতে যাতায়াত করে। মাস শেষে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন পায়। সো, প্রতি ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেগুলো নিট কম্পোজিটে যোগ দিচ্ছিল। কিছুটা অবহেলিত ছিল স্পিনিং বা ইয়ার্ন ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরটা। স্পিনিং কারখানাগুলো অনেক দূরে দূরে। তুলার ডাস্ট আর মেশিনের আওয়াজ মিলিয়ে কর্ম পরিবেশ সম্পর্কিত অভিযোগ ছিল সবার।

তো বিভ্রান্ত কয়েকজনের একজন এই আমি, এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে এক মাস এইখানে দুইমাস ওইখানে চাকরি করে অবশেষে বেক্সিমকো টেক্সটাইলে এসে থিতু হলাম। আমার ক্যারিয়ার কাহিনী শুরু হল। প্রি-ট্রিটমেন্ট নামের এক ডিপার্টমেন্টে বিশাল আজদাহা টাইপের কয়েকটা ভয়ংকর মেশিনের ভয়ংকর তাপমাত্রার ও হাত ক্ষয় করা লিকুইড কস্টিকের ফ্লোরে শুরু হল আমার জীবন। আমার বস ছিল দুইজন। ছোটজন জাভেদ আর বড়জন খায়ের। দুইজনেই পাকিস্তানের ইম্পোর্টেড। এঁরা সবার সঙ্গে ভাঙ্গা বাংলা ও হিন্দি- উর্দু মেশানো ভাষায় কথা বলত। আমি যদিও অবাঙ্গালী বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে বড় হয়েছি এবং আমার উর্দু ও হিন্দি ভাষাজ্ঞান অনেকের চেয়ে ভাল ; কিন্তু আমার মধ্যে কিছুটা পাকিস্তান বিদ্বেষ ছিল! আমি এমন ভাব দেখাতাম যে আমি উর্দু –হিন্দি কিছুই বুঝিনা। ওটা ছিল আমার বিখ্যাত ঘাড়ত্যাড়ামি। সেই ঘাড়ত্যাড়ামির মাশুল আমাকে জীবনে কয়েকবার দিতে হয়েছে। দুঃখজনক-ভাবে সেই ঘাড়ত্যাড়ামি আমার মধ্যে এখনো আছে। আমার কথা সহজ, বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছ ; হয় বাংলায় কথা বল নইলে ইংরেজিতে । মধ্যবর্তী অন্য কোন ভাষা কেন বলছ বা আমাদেরকে দিয়ে বলাতে চাচ্ছ?

দিন যায় রাত আসে। মাসের পর মাস যায়। শিফটিং ডিউটির প্যাড়া আচ্ছন্ন করে রাখে আমাকে। রাতে সবাই যখন হুমায়ূন আহমদের নাটক দেখতে বসে , আমি তখন গোছগাছ করে সরাবো,গাজীপুরের বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে যাই ‘সি’ শিফটের ডিউটি দিতে। আবার ‘এ’ শিফটের ডিউটি সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা । ঐ শিফটের ডিউটি ধরতে মাঝরাতে চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠি কি উঠি না । আম্মা আবার না খেয়ে বাসা থেকে বের হতে দিতেন না ! অতো ভোরে কাঁচাপেটে কিছু খেতে ভালো লাগে ? তবে বেক্সিমকো তে অফিসার ক্যান্টিনের খাওয়া দাওয়া ছিল দুর্দান্ত ! সেটা উপভোগ করতাম প্রায়শ:

শিফটিং ডিউটি আমার কাছে মোটেও ভাল লাগতো না। সারারাত জেগে দিনের আলোতে ঘুম আসতো না। আবার ঝিমঝিম ঘুম আসার সময় হলেই দেখা যেত শিফটিং ডিউটির বেক্সিমকোর মাইক্রো-বাস ধরতে হুড়োহুড়ি করে বাসা থেকে বের হচ্ছি। অনেক সময় সিনিয়র ভাইদের জেনারেল শিফট গাড়ীতে বিকালের দিকে চলে আসতাম। এক বড়ভাইয়ের বাসা ছিল মোহাম্মদপুরের দিকে। গাড়ী তাঁকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নামিয়ে দিয়ে মিরপুরের দিকে আসত। আমি অনেকদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে নেমে যেতাম। লেকের পাশে বসে জীবনের হিসাব মেলাতে পারতাম না। এ আমি কি করছি ? গভীর রাতে কতগুলো বিশাল যন্ত্রের সামনে বসে বসে সময় পার করছি। রেসিপি দিচ্ছি, ঘনত্ব মাপছি। কাপড়ের সমস্যা হলে অপারেটরকে খুঁজে হয়রান হচ্ছি। একটা বদ অপারেটর ছিল, নাম ভুলে গেছি। ঠিক ঠিক কাজের সময়ে একে খুঁজে পাওয়া যেত না। আমরা নতুন প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়াররা এই সব বদ ও পুরনো অপারেটরের উপরে চোটপাটও করতে পারতাম না। কারণ ওই নির্দিষ্ট মেশিন সে হয়তো গত ৪/৫ বছর ধরে চালাচ্ছে ; সে জানে কোন রোলারে বা কোন চেম্বারে সমস্যা আছে। আমি তো ঘোড়ার ডিমও জানি না। তো সেই বদ অপারেটরকে বহুদিন লোক পাঠিয়ে ধরে আনতে হয়েছে পাশের ডেনিম প্ল্যান্ট থেকে। ওখানে কোন আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে নাকি তাঁর ভাব-ভালোবাসা।

এইভাবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমি হতোদ্যম হয়ে পড়লাম। চন্দ্রিমা উদ্যানে বসে বাদাম খাই, চা সিগারেট খাই আর ভাবি। বন্ধুরা সব কে কোথায়। মোবাইলের যুগ না , যে সুখ দুঃখের কথা বলতে পারব ! কেউ আছে, ভালুকা ময়মনসিংহ, কেউ নরসিংদী, কেউ চট্টগ্রামে, কেউ গাজীপুরে কেউ নারায়ণগঞ্জে !
এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম দরকার নাই আমার ডায়িং ফিনিসিং এর মোটা বেতনের। আমি যে কোন একটা জেনারেল শিফট ডিউটি হলেই বর্তে যাই। রাতে ঘুমিয়ে সকালে অফিস করতে পারাটাই আমার জীবনের প্রধানতম মোক্ষ হয়ে দাঁড়ালো। আমার যেহেতু ইয়ার লস ছিল, আমার ঢাকা কলেজের সতীর্থ ১৯ ব্যাচের সজল ছিল বন্ধু। ওর সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ার জালালও ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। জানতাম জালাল, স্বরূপদা, ও আমাদের ২০তম ব্যাচের গার্মেন্টস টেকনোলজির কয়েকজন ওপেক্স গ্রুপে মার্চেন্ডাইজিং করছে। আমি আবার মার্চেন্ডাইজিং সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানি না। এঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আমাকে জেনারেল শিফট ডিউটির একটা কিছু ম্যানেজ করে দিতে বললাম। জেনারেল শিফট ডিউটি ছিল হয় ডাইজ-কেমিক্যালস (রং ইত্যাদি) এর মার্কেটিং অথবা গার্মেন্ট মার্চেন্ডাইজিং।

অনেকখানি বিভ্রান্তি নিয়ে ফাঁকি দিয়ে একদিন গেলাম ওপেক্স গ্রুপের হেড অফিসে। কর্নেল (অবঃ) ফরিদ স্যারের সঙ্গে দেখা করব। সকাল সকাল গিয়ে হেড অফিসের রিশিপসনে বসে আছিতো, বসেই আছি। সকাল গড়িয়ে দুপুর , ক্ষুধায় পেট জ্বলছে, বাইরে গিয়ে কিছু খাব তাও যেতে পারছি না; কখন ফরিদ স্যার ডেকে বসেন। তো , বসে থাকার এক পর্যায়ে গ্রে মিল্যাঞ্জ কালারের কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোক রিশিপশনে ঢুকলেন। সবাই বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি যেহেতু তাঁকে চিনিনা ; সুতরাং আমি সোফাসেটে বসেই থাকলাম। পরে রিশিপশনের মেয়েটি তাঁকে ফোনে ধরিয়ে দিলেন সিনহা টেক্সটাইলের তখনকার সর্বেসর্বা মাহি আলম সাহেবের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি মাহি আলম নামটি চিনি ভালোমতোই, কেননা তিনি আমাদের টেক্সটাইলের প্রথমদিকের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার বড়ভাই। ঘটনা হচ্ছে, ওই কাঁচাপাকা চুলের ভদ্রলোক ফোন ধরে মাহি আলম সাহেবকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে ভ্যাট ডাইং এর উপকারিতা ও অপকারিতা বোঝাচ্ছিলেন। যেহেতু ওপেক্স বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান এবং আমি নবীন প্রকৌশলী ; সকল টেক্সটাইল সিনিয়র ভাইদেরকে আমি চিনিও না। আমি ওই ভদ্রলোক ও মাহি আলম সাহেবের কথোপকথন শুনে ধরেই নিলাম উনিও আমার স্বজাতি কোন সিনিয়র টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হবেন। উনি উপরের তলায় চলে যাওয়ার পরে আমি রিশিপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে ? রিশিপশনিস্ট বেশ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, উনিই সিনহা স্যার; আমি ঢোক গিললাম। তাহলে ইনিই সেই কিংবদন্তি ক্যাপ্টেন আনিসুর রহমান সিনহা ?

শেষ বিকেলে খুব হেলাফেলায় ডাক পড়ল কর্নেল ফরিদ স্যারের রুমে। কাগজপত্রে সাইন করতে করতে উনি চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে পরিমাপ করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন কেন আমি প্রোডাকশন ছেড়ে মার্চেন্ডাইজিং এ আসতে চাচ্ছি। আমি আকাশপাতাল চিন্তা করতে করতে ভাবছিলাম কি বলা যায়। আমার উত্তরের আগেই উনি আমাকে অফার দিলেন, আমি যেন আমি সিনহা ওভেন ডাইং এ যোগ দিই, ওখানে লোক লাগবে। আমি ইতস্তত করছি দেখে উনি সাহস দিলেন, সত্যি কথা বলতে। আমি তাঁকে বোঝালাম যে, আমি মূলত: জন্মসূত্রে ঢাকার। আমি দীর্ঘদিন প্রোডাকশনে কাজও করেছি। কিন্তু দূরত্বের চেয়েও বড় যে ব্যাপারটি আমাকে পীড়া দিচ্ছে সেটা হচ্ছে শিফটিং ডিউটি এবং কাজের পরিবেশ। উনি চোখ দিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, মানে আমি যেন আরও বিস্তারিত বলি। আমি নিজের মনে বলে চললাম, আমি চাই জেনারেল শিফট ডিউটি। আমি চাই, কিছু শিক্ষিত লোকের সঙ্গে আমার অফিস-টাইম ব্যয় করতে। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি প্রোডাকশনের চেয়ে পিপল ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিং এ ভাল করতে পারব। আরও কিছু হিজিবিজি ধুনুফুনু বলেছিলাম, সব কথা মনেও নাই।

উনি বোঝালেন, হ্যাঁ মার্চেন্ডাইজিং এ জেনারেল শিফট ডিউটি , কিন্তু ঢোকার সময় ঠিক থাকলেও বের হওয়ার সময়ের কিন্তু ঠিক নেই ! সব কথা শোনার পর, উনি ফোনে মেজর( অবঃ) সুনীল স্যারকে ডেকে পাঠালেন তাঁর রুমে। বললেন , আমার একটু মৌখিক লিখিত পরীক্ষা নিতে। ফরিদ স্যারের পাশের একটা বড় কনফারেন্স রুমে সুনীল স্যার কয়েকটা সাদা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, রেমেডিস অফ ট্রাফিক ইন ঢাকা( Remedies of Traffic in Dhaka) —এই সম্বন্ধে লিখতে। যাহ্ বাপস্ ! আসছি মার্চেন্ডাইজিং এর পরীক্ষা দিতে , টেক্সটাইল প্রকৌশলী। এর সঙ্গে ঢাকার ট্রাফিকের কি সম্পর্ক সেটা ভেবে তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আর ঢাকার ট্রাফিকের অচলাবস্থা নিয়ে কত রথীমহারথী চিন্তা করে হিমসিম খাচ্ছে আমি কোন হরিদাস পাল ? যাই হোক পরীক্ষা বলে কথা। গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজিতে কী যে লিখেছিলাম দুই পাতা ভরে সে আর মনে নেই ।

লিখে বসে আছি তো, আছিই। সুনীল স্যারের পাত্তা নেই। উনি ঘণ্টা দুয়েক পরে এসে খাতা নিয়ে ফরিদ স্যারের রুমে গেলেন। মিনিট দুয়েক পরে ফিরে এসে বললেন, কবে জয়েন করতে পারব ? আমি সপ্তাহ দুয়েকের সময় চেয়ে নিলাম। আমি আনাড়ি নতুন প্রোডাকশন অফিসার ; আমি ফ্লোরে থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি! আমাকে ছাড়া বেক্সিমকো এতদিন যেহেতু চলেছে, আগামীতেও চলবে। নানা বিভ্রান্তি কাটিয়ে দিলাম ইস্তফা চাকরিতে। তো বেক্সিমকোর সমস্যা ছিল সেই সময়ে এঁরা তিন মাস পরে বেতন দিত। আমার পাওনা তিন মাসের বেতন আমি যথারীতি ছয়মাস পরে ব্যাংকের মাধ্যমে হাতে পেলাম। আমার টেক্সটাইল প্রোডাকশন জীবনের ওইখানেই ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ঘটে গেল। আমার আর প্রকৌশলী হওয়া হল না। বাকী জীবন মার্চেন্ডাইজিং, মার্কেটিং আর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়েই কাটিয়ে দিচ্ছি।

আমাকে এখনও মাঝে সাঁঝে ইন্টারভিউ বোর্ডে বসতে হয়। নবীন প্রজন্মের প্রকৌশলীদের সঙ্গে যখন ক্যাজুয়াল মুডে থাকি, বলি আমি যেহেতু তোমাদের অনেকক্ষণ প্রশ্ন করলাম ; ইন্টারভিউ শেষে তোমাদের মনে আমার বা আমি যে প্রতিষ্ঠানে আছি তাঁদের সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পার। উভয়পক্ষের সমানাধিকার! সাধারণত: এঁরা নিজেদের সুযোগ সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন করে। কি ধরণের প্যাকেজ , কয়দিনের ছুটি, প্রফিট শেয়ার আছে কিনা ইত্যাদি।

এর মধ্যে একদিন এক চাকরীপ্রার্থী আমাকে খুব স্পর্শকাতর একটা প্রশ্ন করে বসল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কেন এই তীব্র শারীরিক ও মানসিক শ্রমের মার্চেন্ডাইজিং পেশায় আছেন। আপনার কি মাঝে মাঝে এই পেশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে না?’ আমি হাসি হাসি মুখ করে মার্ক টোয়াইন বা আর্নেস্ট হেমিং ওয়ের একটা অপ্রচলিত মন্তব্য তাঁকে শোনালাম। সাংবাদিকের প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে তিনি নাকি স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘আমি জীবনের এক পর্যায়ে এসে বুঝতে পারলাম আসলে আমি লেখালেখির কিছুই জানি না!’ সাংবাদিক তাঁকে উল্টো প্রশ্ন করলেন, ‘ তাহলে লেখালেখি ছেড়ে দিলেন না কেন?’ তাঁর উত্তরটা মজার ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে লেখালেখি ছাড়ার কথা ভেবেছিলাম কয়েকবার ; কিন্তু দেখলাম ততদিনে আমি বেশ বিখ্যাত হয়ে গেছি। তাই আর ছাড়া হয়ে ওঠেনি !’ আমার অবস্থাটাও কাছাকাছি । এই হৃৎপিণ্ড কাঁপানো পেশার কথা কয়েকবার ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করিনি যে , তা না। তবে, দেড়যুগ এই পেশায় কাটিয়ে দেখলাম , আমি একটা অবস্থানে এসে পৌঁছেছি! ছেড়ে আর কী হবে !

আরেকদিন আমার এক অনুজ কলিগের সংগে কথা হচ্ছিল। সে তাঁর পেশাগত জীবনের সাফল্যের হিসাবে আমার অন্তত: পঞ্চাশগুণ ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু সমস্যা একটাই, মারাত্মক প্রেশার নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁকে। মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে তাঁকে বেশ কয়েকবার ডাক্তারেরও শরণাপন্ন হতে হয়েছে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম , ‘এতো প্রেশার নিয়ে কাজ করছ কেন? তোমার কি এই পেশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে ইচ্ছে করে নাকি?’ সে স্মিত হেসে দারুণ একটা উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল, ‘জাহিদ ভাই, এই পেশা আমার রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। এই পেশাই আমার জীবন হয়ে গেছে। আমি যেমন জীবন থেকে পালাতে পারব না। আমাকে এটা মাথা উঁচু করে সামনাসামনি দাঁড়াতে হবে, টেক্সটাইল গার্মেন্ট পেশার ক্ষেত্রেও তাই। I can’t quit my life !’

বহুদিন আগে, আমাদের কোম্পানির শ্রদ্ধেয় সিইও  মাইকেল কোহ্‌  একটা রেস্তরাঁয় বসে ক্যাজুয়াল মুডে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাদের কয়েকজন সিনিয়র ম্যানেজারদের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে?’ যথারীতি ওই ম্যানেজার কাজের ও অকাজের প্রেশারের কথা বললেন।তাঁর শারীরিক সমস্যা, ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টরেল ইত্যাদির কথা বলে গেলেন। আসলে টেক্সটাইল বা গার্মেন্টস ট্রেডে যে মানসিক চাপ সেটা প্রায়শ: সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। ব্যবসার কম্পিটিশন, অর্ডারের কমতি, অতিরিক্ত অর্ডার, বায়ারের অযাচিত ডিসকাউন্ট, এয়ার শিপমেন্ট, সাপ্লাই-চেনের নানা লেভেলের অদক্ষতা ও অসহযোগিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। সিইও মন দিয়ে শুনে যা বললেন- তিনিও ৩৫ বছর আগে অন্য ব্যবসা ছেড়ে টেক্সটাইলের ব্যবসায় যখন আসেন, কিছুদিনের মধ্যেই উনি টের পেলেন এই পেশার কাজের চাপের। উনি হতোদ্যম হলেন না। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মাঝখান দিয়ে উনি এখন বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। উনি আরও বললেন, ৩৫ বছর আগেও টেক্সটাইলে যে কাজের চাপ ছিল , তাঁদের যে অভিযোগ ছিল, তা এখনো আছে। আরও ৩৫ বছর পরে যে প্রজন্ম আসবে তাঁদেরও এই একই অভিযোগ থাকবে ! মোদ্দা-কথা , টেক্সটাইল গার্মেন্টস ট্রেডের এটাই অকৃত্রিম চেহারা। যুগ বদলালেও কাজের ধরণের তেমন কোন হেরফের হবে না ! তাই এটাকে মেনে নিয়েই এই পেশায় থাকতে হবে।

ব্যক্তিগত ভাবে , ক্যারিয়ারের ব্যাপারে আমি সবাইকে আশাবাদী হতে বলি। একটা সময় ছিল, টেক্সটাইল থেকে পাশ করে এই শিল্প ছাড়া অন্য কোথাও কিছু করার চিন্তাও করত না কেউ। অধুনা নবীন প্রজন্মের অনেকে সরকারী চাকরিতে ঢুকছেন। বিসিএস দিয়ে পুলিশ, প্রশাসনে ঢুকছেন। কেউ কেউ সফটওয়ার ব্যবসায় সফল হচ্ছেন। একটা বিষয়ে যখন মেধাবী গ্রাজুয়েটের সংখ্যা বেড়ে যায় কর্মসংস্থানের তুলনায়, তখন তাঁদেরকে ছড়িয়ে পড়তে হয় আরও নানা বহুমুখী সেক্টরে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে সবাই কিন্তু কৃষি অফিসার হচ্ছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে সবাই কিন্তু পদার্থবিদ, রসায়নবিদ হচ্ছেন না। যেহেতু , বিষয়ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সংকুলানে চাপ আছে ; নবীন প্রজন্মের গ্রাজুয়েটদেরকে আই ই ( ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং) ; কোয়ালিটি কন্ট্রোল সহ নানা বহুমুখী সেক্টরে ঢুকতে হবে। শুধুমাত্র ডাইং ফিনিসিং বা মার্চেন্ডাইজিং এর কথা চিন্তা না করে অন্য সেক্টরে নিজেদের যোগ্যতা দেখাতে হবে।
ধৈর্য ধরে আমার ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার বিভ্রান্তি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

প্রকাশকালঃ ১লা ডিসেম্বর,২০১৬

কর্পোরেট অবজার্ভেশন (মিডলেভেল ম্যানেজমেন্ট)

জীবনকে সহজভাবে নেওয়ার,সহজ করে তোলার অনেক চমৎকার উপায় আছে।

প্রতিনিয়ত ধাক্কা খেতে খেতে আমাকে শিখতে হয়েছে সেটা ! ক্যারিয়ারের একটা পর্যায় ছিল, সারাক্ষণ ত্রস্ত থাকতাম কখন জানি কী হয় ভেবে ভেবে । যতো দিন যাচ্ছে শিখেই চলেছি। নানাভাবে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে। হ্যাঁ , আমি বিশ্বাস করি … লার্নিং ইজ এ নেভার এন্ডিং প্রসেস ! এই যেমন , সমস্যাকে শুধুই ‘সমস্যা’ হিসাবে দেখা শিখতে অনেক সময় লেগেছ ।

মিড লেভেল ম্যানেজমেন্ট সারাক্ষণ সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের কাছে সব সমস্যা উগড়ে দিতে চায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট পছন্দও করে। সব সমস্যায় তাঁরা আপডেট থাকতে পারলে ভাবে তাঁরা প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য ! যদিও প্রাত্যহিক সমস্যার সেই তীব্র প্রেশার কিন্তু মিড লেভেল ম্যানাজারদেরকেই নিতে হয় !

কিছুদিন আগে একটা কথা বা দৃষ্টিভঙ্গি চোখে পড়ল , কোন একটা ওয়েবে। ভালো লেগে গেল । এটা সমস্যাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটু বদলে দিয়েছে আমার। সমস্যার সংজ্ঞা একজন ম্যানেজারের কাছে কি হওয়া উচিৎ ?
“If you can’t tell me what you’d like to be happening, he said, you don’t have a problem yet. You’re just complaining. A problem only exists if there is a difference between what is actually happening and what you desire to be happening.”
সতীর্থ কলিগদের অন্য উদাহরণ দিয়া বোঝাই। ধরেন আপনার শিপমেন্ট দেরী হয়েছে । সেটা এসে সিনিয়র ম্যানেজারকে বললেন। তাহলে , ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে ? আপনি কি চান ? সে এই দুরবস্থা থেকে ম্যাজিক দিয়ে তিনি সব ঠিক করে ফেলবেন ! আপনি নিজে কি জানেন এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কি কি উপায় আছে? আপনি কি জানেন কি কি হওয়া উচিৎ ? যদি জানেন কি করতে হবে, তাহলে তো এটা কোন সমস্যাই না ; যেহেতু সমাধানের উপায়টা আপনার জানা আছে।

আরেকদিকে ধরেন, চৈত্র মাসের গরম, ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম, ধুলাবালি, হরতাল, দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে আপনি কথা বলতেই পারেন। কিন্তু , এগুলো কি আপনার একার সমস্যা? না এগুলো সমস্যা না, এগুলো একধরনের অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি এবং আপনি যখন এই প্রসঙ্গগুলি নিয়ে কথা বলছেন , সেটা হচ্ছে অভিযোগের ভঙ্গীতে ! এগুলো সিম্পলি কমপ্লেইন। কেন এগুলো সমস্যা না ? কারণ , আপনি আসলে জানেন না কী হওয়া উচিৎ।এটা আপনার কন্ট্রোলে নাই । আপনার জানা বা চাওয়া দিয়ে এগুলোর কোন সমাধানও নাই ! বরং আপনি এই পরিস্থিতিগুলোর সাথে অ্যাডজাস্ট করতে পারেন,মেনে নিতে পারেন।

আমি আরেকটা উদাহরণ সচরাচর আমার সহকর্মীদের দিই। বলি, আমার নিজের জীবনের বড়ো একটা শিক্ষা হচ্ছে– “ Changing yourself is much more easier than changing the whole world.”
আসলে আমাকে কাজ করতে হয় কিছু উচ্চশিক্ষিত উচ্চাভিলাষী তরুণদেরকে নিয়ে। যারা প্রত্যেকে আমাদের জেনারেশনের চেয়ে মেধাবী ও সংবেদনশীল। কিন্তু আমাদের জীবন তো তাঁদের মতো এতোখানি ডিজিটালাইজড ছিল না। আমাদের সর্বোচ্চ মনোযোগ বিঘ্নকারী ছিল টিভি ! এছাড়া বই ও আড্ডাকে আমরা পজিটিভলিই নিয়েছিলাম।

এখন নবীন প্রজন্মের জীবন ও জীবনযাত্রা এতো বেশী জটিল হয়ে গেছে; চাইলেও তাঁদের মনোযোগের শতভাগ কাজের ক্ষেত্রে দিতে পারেন না তাঁরা। দারুণ একটা বৈপিরিত্যময় সময়ের তরুণদের সঙ্গে আমাকে চলতে হয়। আমার অভিজ্ঞতার কিছুটা পুরনো এবং অনেকখানিই তাঁদের ডিজিটাল যুগে অকার্যকর হয়ে গেছে জেনেও অনবরত বাচালের মতো কথা বলে চলি।

কর্পোরেট অবজার্ভেশন। সেলসম্যান ও খাতির

সেদিন ট্রেডের এক বড়ভাই আফসোস করে বলছিলেন , ‘বুঝলা জাহিদ, একসময় ম্যানেজার বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে অধীনস্থরা বুঝে শুনে চলত। রুমে ঢোকার আগে খোঁজ খবর নিত- বসের মুড কেমন আছে, ইত্যাদি।এখন আমাগো ম্যানেজাররাই উল্টা অধীনস্থদের সমঝে চলি ! যারা ব্যবসা এনে দিচ্ছে, এঁদেরকে নানারকম ‘স্নেহ’ দিয়ে প্রতিষ্ঠানে খুশী রাখতে হচ্ছে ! সেই স্নেহ তাঁদের অযাচিত দাবিদাওয়া থেকে শুরু করে, টেবিলের তলা দিয়ে নগদ অর্থ পর্যন্ত হয়ে থাকে!’

ওয়েল, আপনি যদি সেই ব্যবসা এনে দেওয়া কর্মচারী হয়ে থাকেন। বসের মেজাজ কেমন আছে , সেসব নিয়ে থোড়াই কেয়ার করবেন। কেননা, আপনি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বাকি সবাই ধইঞ্চা ! আপনার এনে দেওয়া ব্যবসায় সবাই দুইবেলার সাদা-ভাত খাচ্ছে, সেটা কেন আপনি ভুলে যাবেন বা অন্যকে ভুলতে দেবেন ?

আর যদি আপনার প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় শ্রেণীর কেউ হন, যাকে মাস শেষের বেতন দিয়েই প্রতিষ্ঠান ভেবে থাকে, একে চাকরিতে রাখা হয়েছে এই দুর্মূল্যের বাজারে, এই তো কত ! তাহলে, আপনার জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক ম্যানেজমেন্টের নিয়ম ফলো করতে হবে। বেতন বৃদ্ধি, ছুটির দরখাস্ত যে কোন যৌক্তিক চাহিদাই হোক না কেন, বসের কাছে বা মালিকের কাছে সেটা উত্থাপনের আগে বুঝে নিন তাঁর মুড কেমন । ভুলে যাবেন না , আপনি ধইঞ্চা শ্রেণী থেকে উত্তরিত না হতে পারলে, খামোখা বসের ঝাড়ি খাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। একটু আগেই হয়তো আপনার মালিক সেই ব্যবসা এনে দেওয়া কর্মচারীর সঙ্গে হো হো হা হা করছিলেন। যেই না আপনি রুমে ঢুকে কোন কথা বললেন! ঊর্ধ্বতনের চেহারা বাংলা পাঁচের মতো হয়ে যাবে। ব্যবসা মন্দা,লোক ছাঁটাই ইত্যাদি নানা বাউল-সঙ্গীত শুরু করে দেবেন তিনি। একসময় দেখবেন আপনি যে কিছু যৌক্তিক দাবী নিয়ে এসেছিলেন সেটা ভুলে গিয়ে কতক্ষণে ওই ঝাড়ির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবেন সেই চিন্তা করছেন। এটাই নিদারুণ বাস্তবতা !

আর যদি আপনি দুগ্ধ-প্রদানকারী প্রাণী হয়ে থাকেন। বসের বা মালিকের মেজাজ যাই থাক না কেন ; আপনাকে দেখা মাত্রই তাঁদের মেজাজ তবিয়ত শীতল হয়ে যাবে। কোনদিন যদি সামনে বসে ইয়েও করে ফেলেন আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, দুর্গন্ধের কথা ভুলে তাঁরা আপনার মল-মূত্রের হলদেটে সোনালী রঙ নিয়ে উৎফুল্ল হবেন।

স্বগতোক্তি। ডায়েরি ও দিনলিপি

ক্লাস সিক্সে থাকতে পড়েছিলাম, ‘Live your life in a way ; so you don’t have to hide your diary!’ ‘জীবনকে এমনভাবে যাপন করুন, যাতে আপনার ডায়েরী লুকোতে না হয়!’

স্কুলজীবনে কিভাবে কিভাবে যে দিনলিপি বা ডায়েরী লেখার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কে জানে ! সুবিধা ছিল ছোট্টমনের ব্যকুল কথাগুলো পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখতে পারতাম। মনের ভার কমে যেত।সেদিন দেখি কাঁচা হাতের লেখায় কয়েকটা ডায়েরী এখনো বুকশেলফের কোনায় পড়ে আছে। উল্টেপাল্টে দেখলাম, পড়াশোনার কথা, পরীক্ষার কথার সঙ্গে কিছু ছড়া-কবিতাতে ভরা। উচ্চমাধ্যমিকে উঠে পড়াশোনার চাপ ও নানাবিধ কারণে দিনলিপিতে আর ফিরে যাওয়া হয়নি।

মিরপুরের আমাদের বাড়ীটি ছিল খানিকটা লঙ্গরখানার মত। আব্বা এবং আম্মা দুজনেই ছিলেন গ্রামের বাড়ীরে সঙ্গে ঢাকার একমাত্র যোগসূত্র। ঐদিকে বড়মামা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। প্রশাসনিক নানা কাজে দলবলসহ ঢাকার ছোটবোনের বাড়ীতে আসতেন। নিকট ও দূরসম্পর্কের আত্মীয়রাও আসতেন বিদেশ-গামী কাউকে বিদায় দিতে। কেউ আসতেন শুধুমাত্র ঢাকা শহর দেখতে। এয়ারপোর্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গে শিশু-পার্ক , বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা ছিল অন্যতম বিনোদন-স্থান। চিড়িয়াখানা আমাদের বাসা থেকে মাইল তিনেক দূরে , সুতরাং আমাকে গাইডের ভূমিকা নিতে হত। অসংখ্যবার চিড়িয়াখানা যেতে যেতে এমনটি হয়েছিল, আমি চোখ বুজে হেঁটে হেঁটে বলে দিতে পারতাম বানরের খাঁচার ডানপাশ দিয়ে কত পা গেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাঁচা।

মেহমানদের অগ্রাধিকারে সপ্তাহের পর সপ্তাহ হয়তো নিজের বিছানা তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে ফ্লোরিং করতে হত। মেহমান থাকলে খুশীই হতাম। সকালের নাস্তায় রুটির জায়গায় পাকোয়ান ডালডা ভাজা পরোটা, হালুয়া,ডিমভাজা, গরুর মাংস ইত্যাদি।নাস্তা শেষে আম্মার হাতের সেই অসাধারণ দুধ চা। মেহমানের বিদায়ের আগের দিন একপ্রস্ত পোলাও মাংসের ফিস্ট অবধারিত! ওই সময়ে যেহেতু ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল, হয়তো মেহমানের উৎপাত নিয়ে কিছু একটা বেফাঁস লিখে রেখেছিলাম নিতান্তই ব্যক্তিগত স্বগতোক্তি হিসাবে। অন্যের ব্যক্তিগত দিনলিপি পড়াটা অভদ্রতা সেটা আমি জানতাম ; আমার বড়মামা জানতেন না বা মানতেন না। উনি সেই ডায়রি অন্য সবাইকে পড়ে শুনিয়ে সে এক কেলেঙ্কারি !

ফেসবুককে কিছুটা সাম্প্রতিক তথ্যের মুচমুচে ম্যাগাজিন, কিছুটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, কিছুটা লিটল ম্যাগাজিনের সুস্বাদু সাহিত্যের এবং সর্বাংশে ব্যক্তিগত দিনলিপির একটা সম্মিলিত রূপ মনে হয়। আমি ব্যক্তিগত দিনলিপির স্বগতোক্তির জায়গাটা ওইভাবেই প্রকাশ করি, যাতে স্বচ্ছতা থাকে বিব্রত না হতে হয়।

মূলত: মনুষ্য চরিত্র তেমন দুর্বোধ্য নয়। সামাজিকতার আত্মপ্রকাশে সে চাইবে সবচেয়ে সুশ্রী পোশাক, চেহারা ও আচরণে নিজেকে প্রকাশিত করতে। সেই রঙিন আলোর হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় আড়ালে ভঙ্গুর, একাকী,রিক্ত,ব্যর্থ-পরাজিত মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল !

প্রকাশকালঃ ২৩শে নভেম্বর,২০১৬