by Jahid | Nov 30, 2020 | সাহিত্য
” আরও বললেন, ও-সব কিছুই শেষ পর্যন্ত আলাদা দাগ কাটে না, ও-সব অভিজ্ঞতাই মানুষকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।
আমি জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, এই তো আমার ছেলে বসে আছে ( ওঁর পুত্র এবং ঔপন্যাসিক সনৎ বন্দোপাধ্যায় কাছেই বসেছিলেন), ওঁর সামনেই বলছি, আমি অনেক ভোগের মধ্যে গিয়ে দেখেছি, মদ খেয়েছি, নানান নেশা করেছি—কিন্তু এ-সব কোনো কিছুতেই অভিভূত হয়ে পড়িনি। দুঃখ-কষ্টই বলো আর ভোগই বলো, এর সব কিছুতেই ছড়িয়ে আছে নিজেকে প্রকাশের আনন্দ, এঁরা ‘গণদেবতা’র মতো পুরষ্কার দিয়েছে—মনে পড়ছে, ‘গণদেবতা’ আর ‘পঞ্চগ্রাম’ -এর লেখার দিনগুলোর কথা। ‘গণদেবতা’র এই পাতাগুলো যেদিন লিখি–‘গণদেবতা’ বইটি খুলে তারাশঙ্কর কয়েকটি পাতা পড়ে শোনালেন, তারপর বললেন, তারপরদিন সেই বিখ্যাত সাইক্লোন ওঠে, সেই ১৯৪২ সাল-এর সাইক্লোন—সাইক্লোনের দিকে আমার চোখ ছিল না , সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে আমি নিজের লেখার কথাই ভাবছিলুম—নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি, সেই ব্যাকুলতায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল.”
জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথোপকথন। [[ জীবনের বর্ণচ্ছটা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।। ]]
by Jahid | Nov 30, 2020 | লাইফ স্টাইল
বহুদিন আগে এক বাঘ জঙ্গল থেকে লোকালয়ে চলে এসে ধীরে ধীরে মানুষখেকো হয়ে গেল।
গ্রামবাসীরা ভয়ে অস্থির। সবাই একত্রিত হয়ে আলাপ-আলোচনা করছিল, কী করে এই অবাঞ্ছিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
এক সাহসী শিখ সর্দার গোঁফে তা দিয়ে, হাতের পেশী ফুলিয়ে বলল, ‘আমি একাই এই মানুষখেকো বাঘকে মারব।
আমাকে শুধু একটা গরুর ছাল এনে দাও। আর মনে রেখো ,আজ রাতে কেউ যেন বাইরে বের না হয়। তোমরা সবকিছু আমার উপর ছেড়ে দাও।’
তো , সেই রাতে গরুর ছদ্মবেশে শিখ সরদার বাঘের টোপ হিসাবে অপেক্ষা করতে লাগল।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছিল ।
হঠাৎ গ্রামবাসী শুনল, কেউ গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করছে ।
সবাই শব্দের উৎসস্থলের দিকে ছুটে গিয়ে দেখতে পেল বাঘ মারতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শিখ মাটির উপরে পড়ে আছে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে।
একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার ? তুমি কি বাঘটাকে মারতে পেরেছ ?’
ইতোমধ্যে কিছু উৎসাহী গ্রামবাসী চিৎকার করা শুরু করে দিল, ‘সরদারজি জিন্দাবাদ, সরদারজি জিন্দাবাদ !’
‘চুপ করো ! তোমরা সবাই বিশ্বাসঘাতক ! বেঈমান!’
সে গর্জন করে উঠলো, ‘আগে আমাকে বলো, ওটা কার ষাঁড় ছিল? কার ষাঁড় আজ দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছিল ?’
প্রকাশকালঃ ২৫শে মে, ২০২০
by Jahid | Nov 30, 2020 | সাম্প্রতিক
আমাদের জনপ্রিয় এক কথাসাহিত্যিক বাঙালীকে অ্যাকুরিয়ামের রাখা গোল্ডফিশের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। গোল্ডফিশ নাকি অ্যাকুরিয়ামের একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে যেতে ভুলে যায় খেয়েছিল কীনা। খায়, হজম হয়ে , যায় , ত্যাগ করে আবার খায় ! এদের স্মৃতিশক্তি ৩ সেকেন্ডের কাছাকাছি। তথ্যের আদৌ কতখানি বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যতা আছে সেটা খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে !
সপ্তাহ দুয়েক ধরে দাবদাহ চলছে পুরো দেশের উপর দিয়ে । আমি আশাবাদী হওয়ার চেষ্টা করছি। গত বছর না হলেও বা তার আগের অনেকগুলো বছরেই ঠিক এইরকমই বা এর চেয়ে বেশি গরম ছিল। বছর দশেক আগে আমাদের রুটিন করে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ আরেক ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিহীন থাকতে হত। সারারাত হাতপাখা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে ভোররাতে ঘুমিয়ে শ্রান্ত হয়ে অফিসের দিকে ছোটার অভিজ্ঞতা মনে আছে অনেকের ! কিন্তু এই কয়েকদিনে সেই দুর্বিষহ সময়ের কথা আমরা দিব্যি ভুলে বসে আছি।
ছোটবেলায় প্রতি ঈদের জামাতে গিয়ে নতুন করে অতিরিক্ত তিন নাকি ছয় তাকবীরের পরে হাত বাঁধতে হবে, রুকুতে যেতে হবে সেটা ভুলে যেতাম আর নতুন করে ইমামের কাছে শিখতাম। অথবা ডানে বামে মুরব্বী কাউকে অনুসরণ করতাম। ইমাম সাহেবরাও ব্যাপারটা বুঝেই নামাজ শুরুর আগে উচ্চস্বরে নামাজের নিয়ম সবাইকে মনে করিয়ে দিতেন।
অনেকগুলো দুর্বিষহ গরমের মাঝে কয়েকটি মনে করার চেষ্টা করলাম। স্কুল জীবনে ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় স্কুল বন্ধের আনন্দ মাটি হয়ে গেল গরমের যন্ত্রণায়। পুরো ঢাকা জলাবদ্ধ ; বিদ্যুৎ নেই ; চারপাশের ভ্যাঁপসা গরমে নাভিশ্বাস। কোন আশার খবর নেই ; কবে আবার আমরা ফিরে যেতে পারব আমাদের স্বাভাবিক জীবনে। গরম, মশা, বিশুদ্ধ পানির অভাব, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সব মিলিয়ে সে এক অকথ্য অভিজ্ঞতা। রাতের পর রাত খোলা ছাদে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়েছি আমরা। ঠিক কিছুদিন পরেই আমার দুর্ভাগ্য হয়েছিল ঢাকার কোর্ট প্রাঙ্গণের হাজতখানা দেখার। একটা ২০ ফুট বাই ১০ ফুট রুমে চার-পাঁচটা থানার ধৃতদের থাকতে হত। মোটামুটি শ’ দেড়েক লোকের জন্য একটা মাত্র টয়লেট। আর ভেন্টিলেশন নেই বললেই চলে। একজনের গায়ের সঙ্গে আরেকজন লেগে আছে। এমন নারকীয় গরম যে মানুষের ঘামগুলো বাষ্পীভূত হয়ে আবার দেয়াল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল !
এর পরে কলেজ পেরিয়ে টেক্সটাইল বিদ্যাঙ্গনে । আমি নিজে প্রতিটা গরমের সময়ে আম্মার সাবধান বানী শুনে ঠিক সময়ে দুপুরে খাবার খেতাম ; পানি খেতাম বেশি করে ! আম্মা আমাদের গরমের সময়টিতে যাতে হুট করে অসুস্থ হয়ে না পড়ি, সে জন্য নানাভাবে সাবধান করতেন। তাছাড়া ওই সময়টাতে ভরদুপুরের বাইরে বাইরে খেলাধুলা করার বয়সটাও পেরিয়ে এসেছিলেম। বড় ভাইয়াও তাই। কিন্তু আমাদের গুণধর ছোট ভ্রাতাটি তখনো দুষ্টুর শিরোমণি বাউণ্ডুলে ; আগারে পাগারে ঘোরা ফেরা করে ,নাওয়া খাওয়ার ঠিকঠিকানা নেই। সে যথারীতি কোথা থেকে যেন চিকেন পক্স বাঁধিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমে তিনদিনের মাথায় সেরে উঠলো সে , ওর পরে বড় ভাইয়া ~ সে ভুগল এক সপ্তাহের মতো। অবশেষে বাড়ীর শেষ অভিযাত্রী হিসাবে আমার জীবনে বসন্ত এলো। মে-জুনের বিভীষিকাময় গরম। আর আমার রুমের ছাদ ছিল টিনের। সকাল না গড়াতেই চিটচিটে গরমে বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমের প্রতিটা আসবাবপত্র উষ্ণ হয়ে উঠত। আমার মাথা, পিঠ , সারা শরীর জুড়ে টসটসে ফোস্কার মতো পক্স। আমি সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতাম আর যাকে ইচ্ছে তাকে অভিশাপ দিতাম। সেই অভিসম্পাতের বেশির ভাগ আমার অনুজের দিকেই ধাবিত হত।
পরের কিছু বছরে দিল্লী~রাজস্থানের মরুময় গরমে কাবু হয়েছি, সেই উষ্ণতার কথা ভোলার নয়। লূ হাওয়ার ঝাপটা শরীরের অনাবৃত অংশের চামড়া জ্বলিয়ে দেয় ; ঠোঁট ফেটে যায়, যেখানে যেখানে রোদ পড়েছে গায়ের চামড়ার এক স্তর উঠে যেতে থাকে ।গতবছর চেন্নাই-এর গরমেও কাহিল হলাম। চার~পাঁচ দিনের সফরে দিনের বেলায় বাইরে খুব কম যেতাম। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে মোটর বাইকের মেয়েদের পুরো মুখ ওড়না দিয়ে ঢাকা দেখে আমার সহধর্মিণীর ধারণা হয়েছিল এখানে বোধহয় মুসলমানদের প্রাধান্য। কিছুক্ষণের ভিতরেই বাতাসের ভয়াবহ উষ্ণ ছোবলে বোঝা গেল কেন সকলেই হাত মুখের সমগ্র অংশ ঢেকে রেখেছে।
যাই হোক পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। দিন কয়েক পরে এক পশলা বৃষ্টি আমাদের এই দুর্বিষহ গরমের কথা ভুলিয়ে দেবে। আবারো ২০১৮ বা ১৯ সালের দাবদাহে ভাজা ভাজা হতে হতে আমরা ভুলেই যাব ১৭ সালের মে-জুনে কী ভয়াবহ সময়ই না আমরা কাটিয়েছি।
এই যে জাতি হিসেবে আমাদের ভুলে যাওয়ার সক্ষমতা সেটি আমাদের ‘দুর্বলতা’ নাকি ‘শক্তিমত্তা’ সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে বৈকি !
প্রকাশকালঃ মে, ২০১৭
by Jahid | Nov 30, 2020 | সাম্প্রতিক
জাপানে সামুরাই যোদ্ধা ও তাদের ক্ষুরধার তরবারি নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে।
এই গল্পটি অনেক আগে শোনা, ডিটেইল মনে করতে পারছিলাম না। নেটে বেশ কয়েকটা ভার্সন পেলাম।
মূলত: চাইনিজ অথবা ইহুদিদের কূটবুদ্ধিকে ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যে যে যার মতো গল্পটির রূপান্তর করেছে। পাঠক ইচ্ছে করলে ইহুদি পাদ্রীর জায়গায় করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধকের সূত্রের আবিষ্কারক মুফতি কাজী ইব্রাহিমের নাম বসিয়ে দিতে পারেন।
তো হয়েছে কি, একবার জাপান সম্রাটের প্রধান সামুরাই যোদ্ধার প্রয়োজন।
বহুদিন ধরে যোগ্য কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তিন দেশের তিন সামুরাই পাওয়া গেল– জাপানিজ, চাইনিজ ও ইহুদি।
সম্রাট বললেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দাও।’
জাপানি সামুরাই এগিয়ে এলো। ছোট্ট ক্ষুদ্রাকৃতির একটা বাক্স খুলে একটা মাছি ছাড়ল। তারপর সাঁই সাঁই করে বাতাসে তরবারি চালালো । মাছিটি একেবারে মাঝখান থেকে নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে মেঝেতে পড়ল !
রাজদরবারে একটা বিস্ময় ধ্বনি ! বিস্মিত সম্রাট পরের সামুরাইকে ইশারা করলেন তার নৈপুণ্য দেখাতে।
চাইনিজ সামুরাই এগিয়ে এসে ক্ষুদ্রাকৃতির বাক্স খুলে একটা মাছি ছাড়ল, তারপর বাতাসে তরবারি চালালো সাঁই সাঁই সাঁই সাঁই ! মাছিটি নিখুঁত চারখণ্ডে খণ্ডিত হয়ে মেঝেতে পড়ল।
অসাধারণ ! সম্রাট এইবার ঈশারা করলেন শেষের ইহুদী সামুরাইকে।
ভাবলেন, এই নৈপুণ্যকে টপকানো মুশকিল !
এবার ধীর পায়ে ইহুদি পাদ্রী এগিয়ে আসল, বাক্স খুলে মাছি ছাড়ল।
অসম্ভব শক্তির সঙ্গে বাতাসে তার সামুরাই তারবারি চালাল।
কিন্তু মাছিটির কিছু হলো না ; উড়ে বেড়াতে লাগল।
বিরক্ত সম্রাট জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি ধরণের দক্ষতা ? মাছিটাও তো মারতে পারলে না হে ! দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে !’
‘অবশ্যই উড়ছে , মহামান্য সম্রাট ! কিন্তু এখন থেকে মাছিটা আর বাবা হতে পারবে না !’
দ্বিতীয় ভার্সনে ইহুদি পাদ্রীর এগিয়ে এসে মাছি ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে।
মাছি বনবন করে উড়ছে, সম্রাট বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এটা কি ধরণের দক্ষতা ? মাছিটাও তো মারতে পারলে না হে ! দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে !’
ইহুদি মৃদু হেসে উত্তর দিল, ‘মাছিকে টুকরো করে মারা তো সহজ কাজ ! কিন্তু উড়ন্ত মাছির পুরুষাঙ্গের খৎনা করা ! সেটি কয়জন সামুরাই করতে পারবে মহামান্য !’
প্রকাশকালঃ ১৫ই মে ২০২০
by Jahid | Nov 30, 2020 | সমাজ ও রাজনীতি, সাম্প্রতিক
[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: আমার পক্ষে অনেক গবেষণা করে কিছু লেখা মুশকিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি আমার প্রজন্মের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যা উপলব্ধি করেছি, দেখেছি তাই বলার চেষ্টা করি। অনেক রেফারেন্স বই ঘেঁটে ভারী ভারী লেখকের নাম দিয়ে প্রবন্ধ লেখা আমার সাধ্যাতীত। লেখা বড় হয়ে গেছে, তবে আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। ]
ছোটবেলা থেকে চারপাশে মোটা দাগে তিন রকমের শিক্ষা ব্যবস্থা দেখে আসছি। বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম এবং মাদ্রাসা। এছাড়া কারিগরি শিক্ষা নামের কিছু একটা শুনতাম ভাসাভাসা। যে শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে ভারী হওয়ার দরকার ছিল, সেটাই ছিল নিভুনিভু !
বাংলা মিডিয়ামে বর্ণবৈষম্য ছিল।
এলাকা ও স্কুলের আভিজাত্য ভেদে সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ছিল। ক্যাডেট কলেজগুলো , গভঃ ল্যাব, ধানমণ্ডি বয়েজ, হলিক্রস, ভিকারুন্নেসাসহ ঢাকার কিছু উঁচু সারির স্কুলকে ব্রাহ্মণ ধরলে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলো ছিল শূদ্র। অধুনা জাতীয় শিক্ষাবোর্ডের পুচ্ছে আরেক পালক সংযুক্ত হয়েছে ইংরেজি ভার্সন। অভিজ্ঞ শিক্ষক ও অবকাঠামোর অভাবে কয়েকটি ব্রাহ্মণ স্কুল ব্যতীত বেশির ভাগ স্কুলের ভার্সনের শিক্ষাদান তথৈবচ।
ইংরেজি মাধ্যমেও এই শ্রেণিবৈষম্য আছে।
ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের প্রথম থেকেই যে অভিযোগ ছিল আমাদের সময়ে , সেটা হচ্ছে এরা নিজভূমে পরবাসী। এরা গুচ্ছের অর্থনাশ করে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো তৈরি হওয়া স্কুলগুলোতে যা শেখে আর যা শেখে না, সে আরেক বিশাল আলোচনা। তবে মূলত: এদের সিলেবাস পশ্চিমের তাই দেশের ব্যাপারে অনেকখানি উদাসীন, নিজের সমাজ ও পরিপার্শ্ব নিয়ে উদাসীন। নিজেদেরকে কুলীন ভাবে । সমাজের সবচেয়ে সম্পদশালী বাবা-মায়ের সন্তান হিসাবে এদের পরিপার্শ্ব থেকে এদের উদ্দেশ্যই থাকে কবে ভালোভাবে পড়া শেষ করে বিদেশে পাড়ি জমাবে।
মাদ্রাসায় আছে প্রধান দুইভাগ, কওমি, ফোরকানিয়া আর আলিয়া। আলিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান আছে। কওমি, ইবতেদায়ি, হাফিজিয়া মাদ্রাসাগুলোতে কিছুই নাই। আমার নানা লেখায় কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের ব্যাপারে তিক্ততা আছে। আমি যে সমাজে বড় হয়েছি, সেখানে বড় একটা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ছিল। ছোটবেলা থেকেই এদের ভিক্ষাবৃত্তি আমার মনে সহানুভূতির পাশাপাশি ক্ষোভের কারণ হয়েছে। প্রথম থেকেই মনে হয়েছে, দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠীকে অনুৎপাদনশীল করে রাখার এই শিক্ষাব্যবস্থার কোন মানে হয় না।
মাদ্রাসা শিক্ষার সবচেয়ে বড় সমস্যা আমার কাছে মনে হয়েছে অর্থনৈতিক পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকার পাশাপাশি এরা , জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবকিছুর ব্যাপারে এরা একটা অমূলক বিদ্বেষ নিয়ে বেড়ে ওঠে। এর মূল কারণ স্বল্প শিক্ষিত ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে বেড়ে ওঠা এদের শিক্ষকরা। সমাজের সবধরনের প্রগতিশীলতা আর আধুনিকতাকে এরা তীব্র ঘৃণার সঙ্গে দেখে। এভাবেই সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা একজনের সঙ্গে এদের মৌলিক মানসিক পার্থক্য গড়ে ওঠে। যথারীতি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষার্থীদেরও মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের ব্যাপারে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য থাকে।
বেশ কয়েকবছর আগে আমার কাছের এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে প্রায় সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। প্র্যাকটিসিং মুসলমান হিসাবে তিনি তাঁর এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালান। তর্কে তো আর কেউ জেতে না। তাই , নানা তর্কের পরে ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতার বাইরে গিয়ে যে কথা উনি আমাকে বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি কষ্ট করে হলেও গরীব ঘরের বাচ্চাগুলোকে দুইবেলা খাওয়ার ও নৈতিকতার ছায়াতলে আনতে পেরেছেন। মাদ্রাসার বাইরে থাকলে ঐ বাচ্চাগুলো সমাজের অধিকতর ক্ষতির কারণ হতো। ধর্মান্ধতা তো থাকতই, বরং ক্ষুধা ও অভাবে ছিনতাইকারী বা রাজনৈতিক দুষ্কৃতিকারী হয়ে উঠতো। যেমনটা হচ্ছে গ্রামের প্রান্তিক সমাজে ও ঢাকার বস্তির শিশুদের। আমাকে তর্কে ক্ষান্তি দিতে হয়েছিল সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে। হয়তো আমার ঐ বড়ভাই গভীর মমত্ব থেকেই মাদ্রাসার শিশুদের ব্যাপারে কথাগুলো বলেছিলেন এবং তিনি সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মাদ্রাসাটি চালাতেন।
পরবর্তীতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি সাধারণ শিক্ষার ছাত্ররা , হোক সে উপজেলা-জেলা শহরের অথবা ঢাকার ব্রাহ্মণ সমাজের, তারা খুব সহজেই নিজেরা কাছাকাছি হয়েছে, বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ইংরেজি মিডিয়ামরাও কোন না কোনভাবে মূলধারায় মিশে গেছে । সামাজিক সমতা অথবা প্রায় কাছাকাছি শিক্ষাব্যবস্থা এই কয়েকটা শ্রেণির মিলেমিশে কাজ করাতে তেমন বড় বাঁধার সৃষ্টি করে নাই।
সমস্যা হচ্ছে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদ্রাসার। মূলত: কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের। আমার বেড়ে ওঠা ঢাকার শহরতলী মিরপুরে। গ্রামের ব্যাপকতা আমার চোখে ধরা পড়েনি। তবুও একটা ব্যাপারে গ্রাম ও শহরতলীর মিল আছে। বাবা-মা , তাদের কয়েকটা সন্তানের ভিতর থেকে যে কোন একজনকে মাদ্রাসা বা ধর্মশিক্ষায় পাঠানোর দ্বিবিধ কারণ থাকত। প্রথমত: আখিরাতের সুরাহা করা, হাফেজের পিতামাতা কোনভাবেই দোজখে যাবে না, ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: ও প্রধানত: অর্থনৈতিক কারণ। অসহনীয় দারিদ্র্যের কারণেই মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীর ঢল কমেনি কখনোই।
আশির দশকে সাধারণ শিক্ষার প্রভাব বেশি ছিল। জাতীয় শিক্ষা বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যম একটা ছিল ; সেটা টের পেতাম এসএসসি ও এইচএসসির প্রশ্নপত্র ঘাঁটতে গিয়ে। শুনতাম কাতারে, কুয়েতে বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে ইংরেজিতে পরীক্ষা দিচ্ছে এসএসসি বা এইচএসসি। মিরপুরের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মহল্লায় কাউকেই দেখিনি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে। কোন কোন বন্ধুর বড়লোক আত্মীয় যারা গুলশান, বনানী বা ধানমণ্ডি থাকে তাদের কেউ কেউ পড়তো। অবাক ব্যাপার আমাদের বাংলা মিডিয়ামের ছেলেমেয়েদের ওদের ব্যাপারে একটা ঈর্ষামিশ্রিত তাচ্ছিল্য বা উন্নাসিকতা থাকত। কাউকে সামনে পেলে ‘ কী হে আলালের ঘরের দুলাল’ টাইপের একটা চাহনি দিতাম। মেডিক্যালে , বুয়েটে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন বন্ধু জুটে গেল ইংলিশ মিডিয়ামের। আশ্চর্য ! ওদের ব্যাপারে যে উন্নাসিক ধারণা ছিল, চলে গেল। এদের অনেকে বাসায় রবীন্দ্রসংগীত শেখে, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা চেনে।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করা , মেধাতালিকায় জায়গা পাওয়া তুখোড় একজন এসে আমাদের সম্মিলিত মেধাতালিকায় বরাবর দ্বিতীয় স্থান দখল করে বসে রইল। আরো কয়েকজন আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমার। তেমন কোন মানসিক দূরত্ব অনুভব করিনি।
কয়েকমাস আগে বাম রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এক বড়ভাইয়ের বাসায় দাওয়াতে গিয়ে কথা হচ্ছিল। ভাবী আর ভাই দুজনেই তাদের সন্তানদেরকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন।আমি যখন মনে করিয়ে দিলাম, সারাজীবন সাম্যবাদী রাজনীতি করে বাচ্চাগুলোকে তো পশ্চিমের জন্য তৈরি করছেন। তখন তাঁদের কণ্ঠে বিষাদ। নানা বাদানুবাদের পরে আমাকে ইন্টারেস্টিং যে ব্যাপারটা উনি মনে করিয়ে দিলেন বা যেই ব্যাপারটা আলোচিত হল, সেটা হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই দেশে থাকছে না কেন। ও-লেভেল , এ-লেভেল পাশ করে সাধারণ উচ্চশিক্ষায় এদের জায়গা কোথায় ?
দেশ চালাচ্ছে যারা, সেই প্রশাসন , কাস্টমস সবাইতো সেই কৃষকের ছেলেই। গত কয়েক দশক ধরে ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেপেলে গুলো কেন সরকার ও প্রশাসন ও পুলিশ সেনাবাহিনীতে নেই। থাকলেও সেটার পারসেন্টেজ এতো কম কেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এক আলোচনায় বলেছিলেন উনিশ-শতকী প্রজন্মের কথা। প্রথম প্রজন্মের মানুষ শুধু সম্পদ কিনে চলে। পায়ের তলার মাটির জন্য জন্তুসুলভ বর্বর রাক্ষসের মতো গোটা পৃথিবীকে দখল করতে চায়। এদেরকে বলা হয় ‘কেনারাম’। দ্বিতীয় প্রজন্ম বিনাশ্রমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে বসে। নতুন করে রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠন আর দস্যুবৃত্তিতে না জড়িয়ে শুরু হয় তাদের বাবুগিরি। এই প্রজন্মকে বলে ‘বাবুরাম’। এদের চালচলন কিছুটা রাজকীয় হয়। এরা সবাই বাবার জন্তু প্রকৃতি পেলেও দশভাগ পায় দেবতা-প্রকৃতি। শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে কাজ করে বলে এদের আত্মোৎসর্গ হয় প্রথম প্রজন্মের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
তৃতীয় প্রজন্মের নাম ‘বেচারাম’। এরা বৈষয়িক ব্যাপারে আগ্রহহীন কিন্তু উচ্চতর ও সূক্ষ্মতর চেতনার মানুষ।পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া ধনসম্পদ বিক্রি করে , শ্রেয়তর কাজে চায় আত্মার চরিতার্থতা। যদিও সবাই এটা করেনা, মানুষের একদিকের দশভাগ যেমন দুরারোগ্য দেবতা তেমনি অন্যদিকের দশভাগ দুরারোগ্য জন্তু। স্যারের ধারণা ছিল, আমাদের স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক যাবে কেনারামদের। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে বাবুরামদের প্রজন্ম চলে আসবে। যাঁদের ততটা আর্থিক কষ্ট করতে হচ্ছে না, তাদের হাতে থাকছে পৃথিবীকে ভালোবাসার সময় , চারপাশের দুঃখে ব্যথিত হওয়ার অবসর। স্যার তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে রসিকতা করে বলতেন বাবুরামের বাবারা ঘুষ খেয়ে, খুন করে রাষ্ট্রীয় দস্যুবৃত্তি করে করে আরো একবার তাদের উত্তর প্রজন্মকে সেই ঘৃণ্য কাজগুলো করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে গেছেন। স্যারের আশা নদীর প্রথম বর্ষার উন্মত্ত হিংস্রতার পরে জলধারা সুস্থির হয়। সবসময়ই দ্বিতীয় প্রজন্ম প্রথম প্রজন্মের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে আর্থিক কষ্ট সম্পর্কহীন নির্লোভ উদার মূল্যবোধ নিয়ে দেখা দেয়। এছাড়া দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকে বিদেশে থাকে সেখান থেকে পাওয়া উচ্চতর মূল্যবোধগুলোকে জাতিতে যুক্ত করে । হা হতোস্মি !
সত্যি কথা বলতে কী, সচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া সন্তানেরা ‘বাবুরাম’ শ্রেণির। উচ্চবিত্ত বাবাদের সম্পদের উপরে বসে সমাজের সবচেয়ে ভালো শিক্ষাটা পায় । সম্পদ তৈরি করার সেই পাশবিক পরিশ্রম করতে হয় না তাদের। অমানুষিক দারিদ্র্য থাকে না বলে একটা সুস্থির নৈতিকতা তৈরি হয় তাদের মাঝে। অথচ এই সুবিধাভোগী যত্নআত্তি করে তৈরি করা প্রজন্মটাকে কোনভাবেই সমাজের মেইন স্ট্রিমে রাখা যায় না।
কেন সচ্ছল ‘কেনারাম’ পিতাদের ‘বাবুরাম’ সন্তান শ্রেণীকে কোনভাবেই দেশের মেইনস্ট্রিমে রাখা যাচ্ছে না। রাখার কোন ব্যবস্থা আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্র আদৌ চায় কীনা সে ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত সন্দেহ আছে।
দুই-যুগ আগে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ভর্তি হওয়ার জন্য এদের সিলেবাস যথোপযুক্ত ছিল না। এদের ‘ও’লেভেল, ‘এ’ লেভেল শেষ হওয়ার আগে ইউরোপ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যেত। অধুনা প্রাইভেট হাসপাতালের মতো যথেচ্ছ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় একশ্রেণীর উচ্চবিত্তদের সন্তানেরা দেশে থেকে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। পড়া শেষে এরা বাবার তৈরি ব্যবসায় লেগে পড়ছেন অথবা অগতির গতি বড়ো বড়ো মাল্টিপারপাস কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেরানিগিরি করতে ঢুকে পড়ছেন।
আমাদের সরকারি ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্টগুলো করুণ অবস্থা দেখলে মনে হয়, চীন যেমন চায়না রেভুলশনের সময় উচ্চশিক্ষা বন্ধ করে কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল, আমাদেরও তাই করা উচিৎ । নানা তর্ক-বিতর্ক থাকলেও আমার মনে হয়, শত শত বিশ্ববিদ্যালয় আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২টা প্রশ্ন পড়ে ৮টা কমন পড়ে নানাধরনের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে আমাদের আখেরে লাভ হয়নি কিছুই ; প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ প্রস্তুতি-হীন বেকার তৈরি করা ছাড়া। আর শহর হোক আর গ্রাম হোক, কোনভাবে কেউ গ্রাজুয়েশন করে ফেললে সে আর কোনরকমের কায়িক পরিশ্রমের, কারিগরি, কৃষি, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কোন কিছুতেই আগ্রহ প্রকাশ করে না। সামাজিক ও পারিবারিক চাপে সেই সদ্য গ্রাজুয়েটের একমাত্র মোক্ষ থাকে একটা চাকরির ! একটা ‘বসার চেয়ার’ পেলেই সে বর্তে যায়। ব্রিটিশদের প্রচলিত এই কেরানী তৈরি শিক্ষাব্যবস্থার চক্করে পড়ে না হল আমাদের সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয়; না হলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি।
ফিরে আসি ‘বাবুরাম’প্রজন্মের কাছে । উচ্চমাধ্যমিক/এ-লেভেল পাশ করে এদের গুটিকয়েক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলেও এদের লক্ষ্য কিন্তু বিসিএস বা সরকারী চাকরি থাকে না । তাই যুগের পর যুগ সেই মফঃস্বল আর গ্রামের কৃষকের ছেলেরাই এসে শোষক রাষ্ট্রের লোভনীয় চেয়ারগুলোতে বসা শুরু করেন। প্রাথমিক স্বপ্নপূরনের আর স্বপ্নভঙ্গের পরে শুরু করেন নতুন করে পশুসুলভ রাক্ষুসে খাওয়া। রাষ্ট্রীয় প্রতারণার বঞ্চনার মূল ভুক্তভোগী মূলত: নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা। রাজনীতির কূটচাল আর সরকারি নেতাদের ও প্রশাসনের দুর্নীতির মোচ্ছব কাছাকাছি থেকে সবচেয়ে বেশি চাক্ষুষ করে উপজেলা ও জেলা শহরের সেই পরিবারের ছেলেগুলোই। অথচ সেই প্রতারিত সন্তানেরা বড় স্বপ্ন নিয়ে দেশের শাসনযন্ত্রে বসছে এবং দুর্নীতি করছে পুর্নোদ্যমে। দুর্নীতি থামছে না কোনভাবেই। প্রতিনিয়ত কেন সেটা হচ্ছে ,তা গবেষণার দাবী রাখে।
সমবয়সী বন্ধুদের মাঝে প্রশাসনে আছে এমন কয়েকজনের সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিকভাবে কথা হয়েছে। কেউ কেউ পরিবারের উচ্চাভিলাষিতার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা সরকারের দলীয় নেতাদের অবৈধ ক্ষমতাচর্চা ও সিস্টেমের দোষ দিয়ে নিজেরা দায়মুক্ত হতে চেয়েছেন। কেউ কেউ আবার মজা করে সরল স্বীকারোক্তি করেছেন যে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দায়িত্ব যতোখানি না জনগণকে সাহায্য করা তাঁর চেয়েও বেশি হচ্ছে কোন কিছু সহজে করতে না দেওয়া। এক বন্ধুতো বলেই বসল, ‘আমরা না থাকলেই বরং দেশ ভালোভাবে চলবে। আমরা তো কাজের কাজ তেমন কিছু করি না, আমাদের ধান্ধাই থাকে– কে রে, কী হলো রে, কে যায় রে, কেন রে তুই ওইভাবে করলি, আমাকে জানালি না কেন রে! — এইসব করে। মোদ্দাকথা প্রতি পদক্ষেপে কোনকাজ সহজ না করে সেটাতে বাগড়া দেওয়াই মুখ্য। ওদের কথা শুনে কষ্টের হাসি হেসেছি। আসলেই তো যে কাজ পাঁচ মিনিটে হয়ে যায়, সেটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কয়েক বছরে কীভাবে লালফিতায় বেঁধে রাখা হয় সে আমাদের সবার কমবেশি দেখা হয়েছে।
শৈশব থেকেই কয়েকরকম শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের জনগোষ্ঠীর মানসিক বিভেদ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মানসিকতা দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে বাকী সদস্যরা । দেশের যে কোন ইস্যুতে প্রত্যেকে যার যার মতো কেউ মধ্যযুগীয় চিন্তা আর কেউ প্রগতিশীল চিন্তার প্রকাশ করছে। মানসিকতার সংঘর্ষ যেখানে অনিবার্য ; মানবিকতার অপমৃত্যু তো সেখানে খুব স্বাভাবিক,প্রাত্যহিক।
একই আলোবাতাসে বেড়ে উঠছে ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থার মানুষ। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা, ইসলামী শাসনাকাংখা, মদিনা সনদ, পুঁজিবাদ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ , কুসংস্কার , অনিশ্চয়তা, প্রগতিশীল শিক্ষা, অনাধুনিক শিক্ষা, পশ্চিমা শিক্ষা, ধর্মীয় নৈতিকতা, আপোষকামিতা, হিংস্রতা, স্বার্থপরতা—সবকিছুর বাইরে এই তিন শ্রেণির মানুষের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
এতো বিভেদ আর বিদ্বেষ নিয়ে আমাদের দেশের টেকসই উন্নয়ন কবে হবে, কীভাবে হবে ?
প্রকাশকালঃ ৬ই মে,২০২০
সাম্প্রতিক মন্তব্য