করপোরেট অবজারভেশন ( তৈল সমাচার )

মনে করেন , যে কোন বস, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা ম্যানেজারের অধীনে চারজন প্রায় সমদক্ষ কর্মচারী আছেন। এর মধ্যে তিনজন বসকে তৈলসিক্ত করা শুরু করলেন। দু’টি ব্যাপার একসঙ্গে ঘটবে:

প্রথমত: ধীরে ধীরে ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মনুষ্যচরিত্রের অলঙ্ঘনীয় নিয়মানুসারে, ওই প্রাত্যহিক তেলে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে কে না দেখতে চায় বলুন!

দ্বিতীয়ত: ওই ‘চতুর্থ’ সমদক্ষ কর্মচারী ; যে হয়তো কোন কারণে বুঝে ও না বুঝে তৈলচর্চা থেকে দূরে আছেন ; তিনি সমস্যায় পড়ে যাবেন । তিনি বাকী তিনজন থেকে আলাদা হয়ে গেলেন । এবং বিনা কারণেই তিনি বসের বিরাগভাজন হওয়া শুরু করবেন (হয়তোবা তৈলাক্ত তিনজনের অপ্রয়োজনীয় তৈল চর্চায় !)।

বসের মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও প্রশ্নের উদয় হবে, কী ব্যাপার ‘ চতুর্থ ‘ আমাকে তেল দেয় না কেন ! সমস্যাটা কী !

প্রকাশকালঃ আগস্ট,২০১৫

করপোরেট অবজারভেশন ( প্রতিষ্ঠানভেদে নিয়মের স্বাতন্ত্র্য )

করপোরেট জগতে আমার খুব কাছের অগ্রজ দু’জন মানুষের কাছ থেকে অনেক দেরীতে শেখা একটা ‘ পর্যবেক্ষণ’।
আফসোস ! এই শিক্ষাটা আগে পেলে, আমি নিজেও অনেকগুলো অপ্রীতিকর অবস্থা এড়াতে পারতাম! সঙ্গত কারণে অগ্রজদের নামোল্লেখ থেকে বিরত থাকছি।

আপনি যখন নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন, তখন মূলত: আপনি প্রতিমুহূর্তে আপনার সদ্য ফেলে আসা কোম্পানির নিয়ম-কানুন, সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে তুলনা করতে থাকবেন। এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মানুষ পূর্ব-অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চায়। মূলত: এক কোম্পানির নিয়ম আরেক কোম্পানিতেও থাকবে এই প্রত্যাশা করেই আপনি ভুল করছেন।

মনে রাখবেন, একেকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান মানে একেকটি আলাদা রাষ্ট্র ; প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্বনির্ভর রাজ্যের মত। সেখানে ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিকের বা ক্ষমতাবানদের তৈরি করা নিয়ম চলে। কোথাও বা মহারাজার চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বা সেনাপতির ক্ষমতা বেশী ! আপনাকে বুঝতে হবে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বা তার পাশে কারা আছে ! কোম্পানির নিয়ন্ত্রক কে বা কারা।

একই মাপের এক কোম্পানিতে কোথাও এইচ আর/ অ্যাডমিন ম্যানেজার অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী ; তো আরেক কোম্পানিতে অ্যাডমিন ম্যানেজার বসে বসে মাছি তাড়ায়। কারণ এইচ আর -অ্যাডমিনের সকল দায়িত্ব মালিক নিজেই দেখে।
এক কোম্পানিতে মার্কেটিং এর লোককে সকাল- বিকাল দুধ দিয়ে গণেশ পূজা করা হয় ; তো আরেক কোম্পানিতে মার্কেটিং এর লোক চাকরির টেনশন করতে করতে অফিসে যায় আর আসে।

এক কোম্পানিতে হয়তো সততার দাম দেওয়া হয় ; দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থেকে বিশ্বস্ত লোকের মূল্য দেওয়া হয় ! তো আরেক কোম্পানির মালিক বলে বসেন , ‘ব্যবসা বাড়াও , প্রফিট বাড়াও –টাকাটাই মুখ্য ; সৎলোক, বিশ্বস্ত লোক কিন্তু ব্যবসা কম আনা লোকের দরকার হয় তাবলীগে যাক, আমার এইখানে কি ? অসৎ লোক কিছু টাকা পয়সা খেলেও সে তো দিনশেষে আমার ব্যবসা এনে দিচ্ছে!’

প্রত্যেক কোম্পানির নিজস্ব নিয়ম কানুন থাকে, সেটা বোঝার জন্য সময় নিন। কোন কারণে আপনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু চিনতে ভুল করলে, ফালতু উপগ্রহের মতো অভিকর্ষের বিপরীতে হুদাই চারপাশ দিয়ে চক্কর কাটতে কাটতে আয়ুক্ষয় করবেন।

প্রকাশকালঃ আগস্ট,২০১৬

করোনায় ঘোরাঘুরি

জুনের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সকলেই করোনা আতঙ্ক থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। সচ্ছল জনগণের বাসায় কোয়ারিন্টিন থেকে হাতি-ঘোড়া মারার নানা উপায় থাকলেও দেশের বৃহত্তম অংশ জীবিকার তাগিদেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া। সরকারের নানারকম প্রজ্ঞাপন ও সাবধানবানী কেউ আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। একমাত্র আন্তর্জাতিক সীমানাগুলো ও বিমান চলাচল সীমিত পরিসরে আছে। অফিস, রেস্তোরাঁ, গণপরিবহন, ট্র্যাফিক জ্যাম সেই আগের মতো। সংক্রমণ বেড়েই চলছে , আইসিইউ-গুলো সব পূর্ণ ; মৃত্যু থেমে নাই।

বাংলাদেশের গড় রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদেশগুলোর চেয়ে বেশি সেটা প্রমাণিত হয়েছে। গরমে ভাইরাস বাঁচে না অথবা দুর্বল প্রজাতির ভাইরাস এসেছে এই ধরণের বালখিল্য কথা যুক্তিতে টেকেনি।
আবার সব দুর্যোগে সরকারী তথ্যের উপর অনিবার্য অবিশ্বাসের মতো করোনায় মৃত্যুহার নিয়েও অনেকে আশাহত। ভেবেছিলেন এই ঘনবসতির দেশে গলিতে-গলিতে, রাস্তায়-রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকবে ; দাফন সৎকার করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেটি যে হয়নি, সে আমাদের পরম সৌভাগ্য। আমাদের জনমানুষের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই এযাত্রা বাঁচিয়ে দিল আমাদের।

গত মে মাসে, প্রবাসী এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল । সে বলছিল, পশ্চিমে একজন কোভিড আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা ও মৃত্যু যথেষ্ট মানবিক ও গবেষণার ব্যাপার। তাই, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সৎকার করার প্রশ্নই আসে না। মৃত্যুসংখ্যা বেশি হলে সৎকারের আগে মর্গে মৃতদেহ দিনকয়েক পড়ে থাকাটা স্বাভাবিক। আর আমাদের বাংলাদেশে সকালবেলায় কারো মৃত্যু হলে, যোহরের নামাজে তার জানাজা হয় আর দুপুরে মারা গেলে আসর অথবা বড়জোর এশার ওয়াক্তে তার দাফন হয়ে যায়। । মুর্দাকে কতো তাড়াতাড়ি দাফন করা যাবে সেটা নিয়ে আত্মীয়স্বজনেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই সামাজিকতায় মৃতদেহ কীভাবে রাস্তায় বা মহল্লায় পড়ে থাকবে? সেই সুযোগ নেই আমাদের দেশে।

বন্ধুর আরেকটি মত ছিল, আমাদের গ্রাম মফঃস্বলে সকলেই কায়িক পরিশ্রমী। এঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ; চারদেয়ালে বন্দী সচ্ছল জনগণের চেয়ে অনেক বেশি। আমরা যারা বাসায় পানি ফুটিয়ে খাই, তরিতরকারি ধুয়ে খাই, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকি, গাড়িতে চড়ি , তাদের ইমিউনিটি প্রান্তিক জনগণের চেয়ে কম। উদাহরণ দিয়ে বলল যে , আমাদের বয়সী বন্ধুদের কয়েকজন যদি পথচলতি রাস্তার ড্রেনের পাশের ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে চটপটি খায়, তবে কী হতে পারে। দুয়েকজন যে অতিঅবশ্যই পেটের পীড়ায় ভুগবে সে দিব্যি করে বলা যায়। কিন্তু এই ঢাকারই বস্তিবাসী যারা বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন, গাদাগাদি জীবনযাপনে অভ্যস্ত একই খাদ্যাভ্যাসে তাদের কি কিছু হবে ? মনে হয়, হবে না। তো সেই বন্ধু রসিকতা করে বলল, তাৎক্ষণিক পরীক্ষায় এদের অধিকাংশের দেহে দুই রকমের ডায়রিয়া আর তিন রকমের কলেরার ব্যাকটেরিয়া এমনিতেই পাওয়া যাবে। এন্তার সিজনাল ভাইরাস তো থাকবেই। কোভিড-১৯ ভাইরাস এদের কাবু করতে পারবে না। ওঁর মতের সঙ্গে এই আগস্টে এসে একমত পোষণ করতেই হচ্ছে। অবশ্যই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেকে মারা গেছেন, সেটা প্রত্যন্ত জেলা শহর থেকে ঢাকার মিডিয়াতে এসে পৌঁছায়নি ; তবে সংখ্যায় সেটা আশাতীত রকমের কম।

ছোটমামার সঙ্গে দেখা হয় না বহুদিন। ফোনে সেদিন বলছিলেন , করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলেও মনে হচ্ছে আতঙ্কটা আর নেই রে ! অবাধ চলাফেরা, মেলামেশা করা পাবলিকের ভাবখানা হচ্ছে, ও আচ্ছা, মৃত্যুই তো !
আমার মনে হয়, করোনার ব্যাপারটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো হয়ে গেছে। যুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে তীব্র আতঙ্ক থাকে। কিছুদিন পরে সবাই বোমা, মৃত্যু, হাসপাতালে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যুদ্ধের ভিতরেই একসময় সোমত্ত ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদি হয়, সন্তানাদি হয়। যুদ্ধকালীন মানবিক সঙ্কটকে স্বাভাবিক মনে করা শুরু করে। দিনশেষে বাসায় রেডিও টিভিতে হতাহতের কথা শুনে একটু আতঙ্কিত হয়, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, আবার বেমালুম ভুলে যায়।

করোনায় পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছে, তবে বিমান ও পর্যটন খাতের অবস্থা একেবারে কেরোসিন মনে হচ্ছিল। ইদানীং গত রোজার ঈদেও অনেকে এদিক সেদিক সামাজিক দূরত্ব রেখে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি।

বন্দিজীবনে তিক্ত হয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোকে একটু খোলা বাতাসে নিয়ে গেলাম গত পরশু। ঢাকার পাশেই একটা রিসোর্টে। ঢাকার সীমানা অতিক্রম করার পরে, মনে হোল না যে দেশে করোনা আতঙ্ক আছে। অর্ধেক লোকের মুখেই মাস্ক নেই। গতমাসে অনেককে সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঘুরতে যেতে দেখেছি আর বাড়ি এসে কোভিড আক্রান্ত হয়ে কোঁকাতেও দেখেছি। যাদের নির্বোধ ব্যাকুলতা নিয়ে হাসি তামাশা করেছি, নিজেরাই সেই কাজ করে এলাম। তাই, সেটা লুকানোর কিছু দেখি না।

প্রকাশকালঃ ৯ই আগস্ট,২০২০

ভেজিটারিয়ান, ননভেজ

বড়কন্যার ছোটবেলা থেকেই মাছমাংসে অনীহা। সদ্য কৈশোরে পড়েছে। নিজের মতামত আছে । আবার, আমাকেও ওর মত মন দিয়ে শুনতে হয়। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হয়। এই প্রজন্মের নতুন ট্রেন্ড প্রাণীজ আমিষ বর্জন করে নিরামিষাশী হওয়া। কেউ ভেজিটেরিয়ান কেউ কট্টর ভেগান। এরা প্রাণীহত্যাকে নিরুৎসাহিত করে। প্রাণীজ আমিষ না খাওয়ার পিছনে হাজারটি কারণ দেখায়। স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে গ্লোবাল ওয়ার্মিং পর্যন্ত এর প্রভাব। বড়টির দেখাদেখি ছোটকন্যাও একই পথের। সেও দুপুর ও রাতের দৈনিক খাবারে মাছমাংস খেতে চায় না। তবে, ফাস্টফুডের দোকানে ফ্রাইড চিকেনে এদের আপত্তি নেই ! চিকেন বারবিকিউ পিজা, বিফ পিজায়ও নেই কোন আপত্তি।

গত দুই দশকে বেশিরভাগ শিশুকিশোরদের মাছ মাংসের ব্যাপারে অনীহা দেখছি। তবে একটু বয়স হলে বন্ধুদের সঙ্গে চলে চলে অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। কেন এদের এই অনীহা ? আমার ধারণা এই অনীহা এসেছে সহজলভ্যতা ও প্রাচুর্য থেকে। আশির দশকে , আমাদের ছোট্ট সংসারে অন্যতম বিনোদন ছিল ছুটির দিনে একটু ভালমন্দ খাবার। গরুর মাংস, সঙ্গে সিজনাল মাছ। আর শাকসবজি তো প্রাত্যহিক ছিল। সকালের নাস্তায় হঠাৎ দুয়েকদিন পর সবজি ভাজির সঙ্গে ডিম। আস্ত ডিমের চেয়ে ভাগাভাগিটা ছিল স্বাভাবিক। কারো বাড়ি বেড়াতে গেলে অথবা বাসায় দাওয়াত থাকলে , তবেই ছোটবড় সবার পাতে আস্ত ডিম পাতে পড়ত।

কবে থেকে শুরু হয়েছিল মনে নেই, তবে সপ্তাহের একদিন ছিল মিটলেস ডে। ঐদিন কসাইখানায় গরুছাগল কাটা হোতো না। নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য তরকারি বাড়ন্ত থাকত। সবকিছুই মেপে রান্না করা হতো। মায়েরা ভাত বেড়ে বাতাস করতে করতে তরকারি বেড়ে দিত। খাবার সময়ে কেউ না কেউ পাশে বসে থাকত। আবার কৈশোরে কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে আলাদা বাটিতে তরকারি বেড়ে রাখা হোতো।রঙ্গিন টিভি আর ফ্রিজ মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে ঢুকেছে ৯০ এর দশকে। আর ফ্রিজ ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাজা সবজি আর তরতাজা মাছমাংসের স্বাদ ভুলতে বসেছি আমরা।

আমার এক স্কুলবন্ধু ফ্রিজের খাবারের ব্যাপারে ভীষণ বিরক্ত ছিল। বাঘ সিংহ যেমন শিকার করে একটু খেয়ে ফেলে রাখে দেয় , মড়ি বানায় ; তারপরে দুইদিন পরে এসে আবার খায়। ফ্রিজ আসার পরে আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই। তাজা খাওয়া বাদ। বাজার থেকে যা আসে, সব ঢুকে পড়ে ফ্রিজ ও ডিপ ফ্রিজের গভীর পাকস্থলীতে। দিনের পর দিন , মাসের পর মাস অথবা বছর জুড়ে ঠাণ্ডায় জমে জমে প্রতিটা কোষের সাইটোপ্লাজম আর মাইটোকন্ড্রিয়ার রস বের হয়ে শুকনো ছিবড়ে হওয়ার পরে রান্নার চুলায় পৌঁছায় তা। সেই ছিবড়ে হওয়া মাছমাংসে কতোখানি পুষ্টিগুণ থাকে জানিনা ; তবে ন্যাচারাল স্বাদ যে পুরোটাই চলে যায়, সে দিব্যি করে বলা যায়।

আর কী নেই সেই ফ্রিজে ! এই বছরের কোরবানির মাংস, পরের বছরের শবে বরাতে খাওয়া। এপ্রিল-মে মাসের তাজা ইলিশ মড়ি হয়ে পড়ে থাকে ফ্রিজের এক কোনায়। পহেলা বৈশাখে সেই বিস্বাদ ইলিশ পাতে ওঠে। কিছুদিন আগে বাসার ডিপ ফ্রিজ গেল বিগড়ে । আমার গিন্নী ধীরে ধীরে সবকিছু বের করা শুরু করলেন। করোনাকালীন বাসায় থাকি বলেই, সেই দুর্লভ দৃশ্য চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হল । একেকটা আইটেম বের করেন আমি বিস্মিত হই। অপেক্ষা করি আর কী বের হয় দেখার জন্য ! কবে কোন প্রস্তর যুগে কক্সবাজারের কেনা শুটকি মাছ থেকে শুরু করে গাজর, ছোলা, মটরশুঁটি কী নেই ! মাছ মাংসের পোঁটলাগুলোর এমনতর অবস্থা যে, গিন্নী নিজেই ভুলে গেছেন ভিতরে কোন পদের মাছ ! পুরো ফ্রিজের মালপত্র বের করা দেখে বিস্মিত হচ্ছি দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন , আমি কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি কীনা । আমি বললাম, যেভাবে অতিপুরাতন জিনিসপত্র বের হচ্ছে, এক পোঁটলা ডাইনোসরের মাংস কখন বের হবে সেই অপেক্ষা করছি। ফ্রিজ নষ্ট হওয়ায় তার মেজাজ এমনিতেই তিরিক্ষে , তারপরেও একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনেই বিরতি দিলেন। কিছু পোঁটলা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিকটাত্মীয়দের বাসায় ফ্রিজ না সারা অবধি রেখে আসতে বললেন।

সেকালে , আমরা মাছ মাংস ডিম , আমিষের কাঙাল ছিলাম। সপ্তাহের পরপর দুইদিন শুধু নিরামিষ হলে মুখ অন্ধকার হতো। আম্মা গজগজ করতে করতে দুইভাইকে ডিম ভেজে ভাগ করে দিতেন। অথচ, অধুনা মধ্যবিত্তের ঘরে ডিম, মাছ, মাংস মজুদ থাকে সারামাসের জন্য, প্রায়শ: সারা বছরের জন্য। কিন্তু প্রাচুর্যের চাপে শিশুকিশোরেরা দৈনিক বাসায় তৈরি প্রাত্যহিক খাবারের চেয়ে ফাস্টফুডে আসক্ত। মাছেভাতে বাঙালি নাম ঘুচে যাওয়ার উপক্রম।স্বাস্থ্যচিন্তা, পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ফ্রিজে রাখা বিস্বাদ আমিষের প্রভাব পড়েছে বড়দের উপরেও। নানা কারণে অনেকেই মাংস এড়িয়ে চলেন।

বড়কন্যার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ওর প্রিয় আলু ভর্তা , ডিম ও যে কোন ধরণের সবজি। ঢেঁড়স সবচেয়ে প্রিয়। মুরগির মাংস কদাচিৎ মুখে তুললেও গোমাংস দেখলেই নাক কুঁচকায়। যেহেতু কৈশোরে পা দিয়েছে, ওর মতামতের দাম দিই , জোরাজুরি না করে, জানার চেষ্টা করি। কেন খাচ্ছে না বোঝার চেষ্টা করি। একদিন বললাম মাছমাংস না খেলে বাড়ন্ত শরীরে নানা প্রোটিন, ভিটামিনের কমতি থেকে যেতে পারে। পড়াশোনা করে বলে, উল্টো আমাকে নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে বোঝাল যে ভেগানরা পৃথিবীর জন্য অনেক উপকারী। সে বড় হলে ভেগান হবে।

গতকাল খেতে বসে বললাম, প্রাণীহত্যা বা যে কোন প্রাণহত্যা যদি খারাপ হয়। তাহলে তো সবজি খাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ। সকল উদ্ভিদের প্রাণ আছে, প্রমাণিত সত্য। সে হু হা করল। আমি বললাম, তোমার সবচেয়ে যে প্রিয় খাবার ডিম ; সেটাও খাওয়া বাদ দেওয়া উচিৎ। কারণ প্রতিটি ডিম একেকটা সম্ভাব্য মুরগি অথবা মোরগ।

আমরা একটা দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্যদিয়ে কৃষিতে থিতু হয়েছি। ছিলাম তো একসময় মাংসাশী শিকারির দল। আর প্রাণিজগতে ফুডচেইন বা খাদ্যশৃংখলে একজন আরেকজনের উপর নির্ভরশীল। এখানে এক প্রজাতি আরেক প্রজাতির খাবার বলেই না শৃঙ্খলা আছে। আর শুধুমাত্র খাবারের জন্য চাষাবাদ করে যে মাছ মাংস উৎপাদন করা হচ্ছে সে গুলো খেলে সমস্যা কোথায়, সেটাই দুর্বোধ্য !

অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস যার যার। কিন্তু একজন আমিষাশী মানুষ খারাপ আর আপনি নিরামিষাশী বলে ভাল মানুষ হয়ে গেলেন , সেটা কিরকম কথা ! প্রতি মুহূর্তে আমাদের নিঃশ্বাসে কোটি ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস ও অণুজীব ঢুকছে, কেউ বেঁচে থাকছে, কেউ মরে যাচ্ছে। তো, এদের জীবনরক্ষার্থে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে ?
প্রতিবছর কোরবানির ঈদ এলেই প্রাণীহত্যা নিয়ে আহা উঁহু করাটা আমার কাছে বড্ডো আদিখ্যেতা মনে হয়। সারাবছর তো ডিম,দুধ, মাছমাংস খেলেন ; এখন কোরবানির বিরোধিতা করে সারাদেশের এতোবড় একটা অর্থনৈতিক চক্রকে তুচ্ছ জ্ঞান করার কী আছে !

আমার বয়স অর্ধশতকের কাছাকাছি। গোমাংস ও সকল লোহিতমাংস ( রেডমিট) খাওয়া চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমি কম খাই বা বেশি খাই সেটা আলোচ্য নয়। আমার বিশ্বাস পশু কোরবানির এই ট্রেন্ড ধর্মীয়দৃষ্টিতে যতোটা যৌক্তিক , অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে সেটা আরো বেশি যৌক্তিক। পুরো কোরবানিকে ঘিরে লক্ষলক্ষ পরিবারের পশুপালন ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভাগ্য জড়িত।
কোরবানি দিন এবং দিন কয়েক কবজি ডুবিয়ে খান।
সবাইকে ঈদ মোবারক। ঈদের শুভেচ্ছা ।

প্রকাশকালঃ ৩১শে জুলাই,২০২০

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( সততার রকমফের )

সততার নানা রকমফের আছে– আর্থিক, ধার্মিক, আত্মিক, শারীরিক ইত্যাদি। শুধু অর্থনৈতিক সততার ব্যাপারে নিজস্ব কিছু স্বগতোক্তি! মোটা দাগে, আমার দেখা তিনটি শ্রেণী আছে। আমি জাজমেন্টাল হতে চাচ্ছি না, কারণ আমি নিজেও একটা গ্রুপে পড়ি !

প্রথম শ্রেণীঃ আপনি নিখাদ অসৎ। আপনি জানেন, আপনি কিভাবে অর্থ উপার্জন করছেন। পরিবারের ও সমাজের আশেপাশের সবার কমবেশি ধারণা আছে আপনার বেতন ও সম্পদের বৈষম্যের ব্যাপারটা। পৃথিবীর সকল প্রাপ্য ও অপ্রাপ্য সুবিধা আপনার চাইই চাই । যোগ্যতার চেয়েও বেশীকিছু আপনার পায়ের কাছে গড়াগড়ি দেবে ; কঠিন পৃথিবীতে ধাক্কা খেতে খেতে , সেটা কীভাবে করতে হয় আপনি শিখে গেছেন। সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে দোটানায় থাকার মতো বিলাসী সময় আপনার নাই। আরো চাই, আরো চাই করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছেন। তবে সোসাইটির কাছে আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ! আপনার মতো এই বিশেষ শ্রেণি না থাকলে , শিল্পায়ন অসম্ভব ও পুঁজিবাদের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটত ! আপনার ধার্মিকতা নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন নেই। পরিপার্শ্বের কাছে, আপনার এলাকায়, বন্ধুমহলে আপনার অর্জিত সম্পদের গল্প ঈর্ষার সাথে বলা হতে থাকে।

দ্বিতীয় শ্রেণীঃ মূলত: আপনি অসৎ ও লোভী। কিন্তু সমাজে সৎ হওয়ার ভান করে সম্মান পেতে আপনি প্রতিনিয়ত উন্মুখ ! সবাইকে সততার কথা বলেন। অথচ আপনি ঠিক ঠিক জানেন কতটুকু আপনার প্রাপ্য, আপনার মাত্রাতিরিক্ত অনোপার্জিত অর্থ নিয়ে আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। আপনি সর্বদাই নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন- আমি ঠিক পথেই আছি ; এই যুগে এভাবেই সম্পদ অর্জন করতে হয়, এভাবেই করা উচিৎ, সবাই এভাবেই করে ! সময় গেলে এই সুবর্ণ সুযোগ আর পাওয়া যাবে না ! আপনি দান-ধ্যান করেন , ধর্মেও মন আছে। কিন্তু মনের গহীনে এই প্রাচুর্যের ব্যাপারে আপনি চিন্তা করতে করতে আবার গা ঝাড়া দিয়ে টাকা কামানোতে মন দেন । যদিও আপনি জানেন , অনেক যোগ্য লোকের চেয়ে বেশীরকমের প্রাচুর্যে আছেন। তবুও প্রথম শ্রেণীর ওই পরাক্রান্ত, চক্ষুলজ্জাহীন দুর্দান্ত সাহসী অসৎ লোকদের সঙ্গে তুলনা করে আপনি নিজেকে সৎ ও ধার্মিক ভেবে সান্ত্বনা পেতে চান !

তৃতীয় শ্রেণীঃ আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ! কারণে বা অকারণে কেমন করে যেন আপনি সু্যোগের অভাবে সৎ থেকে গেছেন ! কিন্তু পূর্বোক্ত দুই শ্রেণীর বৈভব ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে সারাক্ষণ তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মত নিজেকে ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির ভাবতে থাকেন। ধার্মিকতা পুরোটাই আছে । কী কী সম্পদ করেছেন , এইসব প্রশ্ন আসলেই সুযোগমত আপনি যে সৎ সেটা তোতাপাখির মত কপচাতে থাকেন। আপনি সৎ সেই কথা বলে , নিজের পিঠ নিজে চাপড়ান, শ্রোতার কাছ থেকে সান্ত্বনা বা সততার বাহবা পেতে চান !
আগের দুই শ্রেণীর ব্যাপারে একটা ক্ষোভ মেশানো ঈর্ষা আপনাকে ক্লান্ত করে। তাদের অসততা যতোটুকু আছে তার চেয়েও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদের আপনি পশুতুল্য করে নিজের বঞ্চনার ক্ষতে বাতাস দিতে থাকেন। যা আপনি ভুলে থাকতে চান, তাই আপনাকে গ্রাস করে প্রতিমুহূর্তে ! মনের গহীনে যথারীতি প্রাচুর্যে উপচিয়ে পড়া শ্রেণিকে ঘৃণা করেন। সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু কেন আপনার নেই, সেটা নিয়ে হা হুতাশতো আছেই !

এই তিন শ্রেণীর বাইরেও ক্ষীণধারায় আরো কয়েকটি শ্রেণি আছে হয়তো ! তবে কারা যে হাস্যকর রকমের বেদনাদায়ক , ক্ষতিকর বা প্রয়োজনীয় সেটা অবশ্য এখানে আলোচ্য নয়!