by Jahid | Dec 1, 2020 | লাইফ স্টাইল
নারীপুরুষ নির্বিশেষে একজীবনে বেশ কয়েকবার প্রেমে পড়ে। কেউ সেটা প্রকাশ করে , কেউ করে না ; কেউ করতে পারে না। যতো বড় ভালোবাসার বিয়েই হোক না কেন ; একযুগ পরে সেই ভালোবাসার তীব্রতা ফিকে হয়ে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা মাস ছয়েকেই হয়ে যায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিবাহবিচ্ছেদের দামামা বাজে। সন্তানাদিসহ অথবা ব্যতীত সব ডিভোর্সের নানাবিধ সামাজিক, পারিবারিক , আর্থিক কারণগুলো সবাই খালি চোখে দেখেন , আলোচনা করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা আলোচনার বাইরে, অবহেলিত থেকে যায় , সেটা হচ্ছে দম্পতির যৌনজীবন। বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ শারীরিক সমঝোতা না হওয়া। শারীরিক দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। দাম্পত্যের শুরুতে বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাসের সেই উত্তুঙ্গ, শীর্ষানুভূতি থাকে তা একসময় থিতু হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন:
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বাঁধে।।
যুগ পেরিয়ে দাম্পত্যে তখন একজনের অঙ্গ কাঁদলেও আরেকজনের আর কাঁদে না।
যাই হোক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের হিসাবে, চল্লিশের পরপর অনেক পুরুষের টেস্টাস্টেরন হরমোন কমে না গিয়ে বরং বেড়ে যায় আর নারীর এস্ট্রোজেন হরমোন কমে গিয়ে ঋতুবিরতি বা মেনোপজ হয় ! এই প্রাকৃতিক অবিচার কীভাবে হয়েছে , কেন হয়েছে , কে জানে ! তাই, মাঝবয়সে সংসারের অনেক পুরুষ ঠিকই ‘ছোঁকছোঁক করে সম্ভোগের জন্য এবং চিহ্নিত হয় তথাকথিত যৌনকাতর হিসাবে। পুরুষ পরিতৃপ্তি খুঁজে ফেরে যেনতেন করে হলেও স্খলনের মাঝে। পুরুষ পৃথিবীর সকল সব চাপ ঝেড়ে ফেলতে চায় রাতের শয্যায়।
ওদিকে বিবাহিতা নারীটির শরীরে ভাটা এসেছে, মোটেও তা নয়। মেনোপজ বা প্রি-মেনোপজের মুখোমুখি হলে, শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েও যৌনজীবন ধরে রাখা যায় ; সেটা না ভেবে , যৌনজীবন শেষ হয়ে গেছে বলে ভুল ধারণা করে বসে থাকে নারী। দৈহিকতা তখন আর নারীটির প্রায়োরিটি থাকে না। এটাও সত্য , বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারী শুধুমাত্র স্ত্রী ও শয্যাসঙ্গিনী থেকে পরিবর্তিত হয়ে সার্বক্ষণিক ‘মা’ -এর দায়িত্বে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই আমার মনে হয় দৈহিকতা নিয়ে একটা বোঝাপড়া মধ্যবয়সী দম্পতিদের থাকা উচিৎ। বোঝাপড়া স্বচ্ছ হলে, চাহিদা ও যোগানের ; আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির একটা ভারসাম্য থাকে। চাহিদার তুলনায় জোগানের পার্থক্যের কারণে দৈহিকতা বরং আরো বেশি আনন্দময় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
সকল বিবাহিত পুরুষের সমস্যা বোধকরি এরকম: গতরাতে দৈহিকতা হয়েছে, আজ রাতেও হতে পারে। হলে ভালো হয়। অথবা গতকাল বা গত পরশু হয়নি , আজ হতে পারে, হওয়া উচিৎ। সে প্রায় প্রতি রাতেই একটা সুপ্ত কিন্তু উদগ্র যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। হতেও পারে, নাও হতে পারে ; হতেও পারে, নাও হতে পারে।
মাঝবয়সে এসে , সংসারে বিবাহিতা নারীর উপর সারাদিনে শারীরিক-মানসিক ধকল তো আর কম যায় না। তাদের সারাদিনের চিন্তা তো শুধু পুরুষের মতো রাতের শয্যার দৈহিকতা নিয়ে না। যুক্তিসঙ্গত কারণে হয়তো সেই রাতে যৌনতা হয় না। পরের রাতেও অনেক দেরি করে বিছানায় আসে নারী ; শ্বশুরের সেবা, সন্তানদের কোচিং , পরীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত পুরুষকুলের অফিস আর রাস্তার ট্র্যাফিক জ্যামের কিছু হ্যাপা ছাড়া তেমন কোন শারীরিক কসরত থাকে না। তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গম। তাই একটা অনিশ্চিত বিরতির চক্রে পড়ে যায় তার তীব্র শারীরিক কামনা। এই যে, আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির একটা ফারাক তৈরি হয় ; সেখান থেকেই শুরু হয়, বিবাহিত পুরুষ ও নারীর দূরে সরে যাওয়ার চিরন্তন সমস্যা। খুব ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছ থেকে শারীরিকভাবে তারা দূরে সরে যেতে থাকে। একজন আরেকজনের কাছে আরাধ্য না হয়ে অভ্যস্ত কিন্তু অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েন এবং এটাকেই স্বাভাবিক ভাবা শুরু করেন। তৈরি হয় অনতিক্রম্য মানসিক দূরত্ব। নানা সুতোয় বাঁধা পড়ে সংসার চলে সংসারের নিয়মে, টুকটুক করে। কিন্তু সুর কেটে যায়। কারো কারো এভাবেই আরো কয়েকবছর কেটে গেলে যৌনতাহীন জীবনকেই স্বাভাবিক মনে হয়। সামাজিকভাবেও সেটা ভালো চোখে দেখা হয়, তাদেরকে বলা হয়, আর কত ! হয়েছে তো অনেকদিন।
ফিরে আসি আগের আলোচনায়। মূলতঃ ঋতুচক্র শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরপর কয়েকদিন নারী তার যৌন স্পর্শকাতরতার চূড়ায় থাকে। এ সময়ে নারী যৌনতা তো উপভোগ করেই ; পুরুষের জন্যও সেটা উপভোগ্য হয়। ঋতুচক্র শুরু আর শেষ এবং অব্যবহিত পরে মোট ১০ দিন নিরাপদ সময়ে ন্যূনতম ২ বা ততোধিক দিন যৌনতা থাকলে ভাল। এরপরের বাকী থাকে অনিরাপদ ১৭/১৮ দিন । এই দিনগুলোতে সর্বোচ্চ কতোদিন দিন আকাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিৎ ? প্রতি তিনদিনে একদিন হলে ছয় বার । সেটা পারস্পরিক আকাঙ্ক্ষিত হলে তো কোন সমস্যা না। কিন্তু আমাদের সংসারের নারীরা হয়তো এই বয়েসে এসে এই ফ্রিকোয়েন্সির জন্য সামাজিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। অথচ বেশিরভাগ পুরুষ ভেবে থাকে, একদিন পরপর তিন সপ্তাহে ন্যূনতম ৮ বা ১০ বার যৌনতা তো হওয়া উচিৎ। যৌনতার এই ফ্রিকোয়েন্সি, বিবাহিত জীবনের শুরুতে খুব স্বাভাবিক, কিন্তু মাঝবয়সে এসে প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি বলে নারী ধরে নেয়।
পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, হোমোস্যাপিয়েন্স পুরুষ জেগে থাকার সারাক্ষণ তো যৌনকাতর হয়ে থাকেই ; ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও সে যৌনতার স্বপ্নই দ্যাখে। অথচ অন্য সকল প্রাণী বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে যৌনকাতর হয়। তাদের যৌনতা বিবর্তনের ধারায় বংশবৈচিত্রের ও বংশরক্ষার। গরু, ছাগল, হাতি ঘোড়া, বাঘ, সিংহ থেকে থেকে শুরু করে সকল পশুপাখি ঘরের কুকুর বিড়ালও শুধুমাত্র নির্দিষ্ট মাসে কামার্ত হয়। বছরের বাকী মাসে এদের খাদ্য-সংগ্রহ, সন্তানের লালনপালন ছাড়া অন্য কোন কর্মবৈচিত্র থাকে না। নারী প্রাণীদেরও ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু এই হোমোস্যাপিয়েন্সদের যৌনতা শুধু বছরের নির্দিষ্ট সময়ের বংশ-প্রকৃতি রক্ষার জন্য না। যৌনতার সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক প্রেক্ষাপট, সবল-দুর্বলের হিসাব, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকতা রক্ষার চেষ্টা বা পরিশেষে নিখাদ আনন্দ লাভই মুখ্য হয়ে থাকে। আমরা যৌনতার ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় বেশ একটা ব্যতিক্রমী আচরণ করে থাকি। সে আরেক আলোচনা।
হোমোস্যপিয়েন্স নারীর যৌনতার জাদুর কাঠি বিবর্তনের ধাক্কায় আরো গভীরে চলে গেছে। ভেবে দেখেন যে, পুরুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্নায়ুগুলো দেহের বাইরে যৌনাঙ্গের মাথায় পাতলা একটা চামড়ার নীচে প্রায় উন্মুক্ত হয়ে আছে । আর অন্যদিকে নারীর স্পর্শকাতর জি-স্পট , অর্গাজম অথবা চরম-পুলক নিয়ে চলছে যুগের পর যুগ তর্কবিতর্ক। যেটা সচরাচর দেখা যায়, নারীদের জি-স্পট চামড়ার প্রায় দুই-তিন ইঞ্চি গভীরে। সেটিও অনেক নারী চিহ্নিত করতে পারে ; বেশিরভাগই পারে না। পুরুষের চরম-পুলক স্খলনের মাধ্যমে জাজ্বল্যমান। নারীর ক্ষেত্রে সেটা চিররহস্যময়। সুতরাং স্পর্শকাতরতায় হোমোস্যাপিয়েন্স পুরুষ প্রজাতি খামোখাই এগিয়ে আছে। পোশাক থেকে শুরু করে কোন কিছুর হালকা ঘর্ষণেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর নারীর যৌনতাকে ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়; তাকে সিক্ত করতে হয় তারপরে না সেই আরাধ্য যৌনমিলনের প্রশ্ন আসে।
পুরুষদের যৌনকাতরতার কথা বলে শেষ করলে আলোচনা বড্ডো একপেশে হয়ে যায়। দিনশেষে আমি লেখক, নিজেও একজন পুরুষ। নিরপেক্ষতার জায়গাটা থাকছে না। যৌনতায় অনুৎসাহী নির্জীব পুরুষও নারীদের কাছে একইরকম যন্ত্রণার। উপমহাদেশের নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। মাসের পর মাস, পুরুষের নির্জীবতার কথা কাউকে বললে ছিনাল বা খাইখাই নারী হিসাবে কুখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পুরুষকে যৌনতায় আগ্রহী করে তোলা ও যৌনজীবনে বৈচিত্র্য আনার কথা নারী কখনই বলে উঠতে পারে না। অথচ পাঠক, ‘কামসূত্র’ আমাদের এই উপমহাদেশেরই আর তা নিয়ে পশ্চিমের গবেষণা অদ্যাবধি চলমান। পুরুষ সামাজিকতা থেকে জেনে বসে আছে যে, যৌনতার পরিমিতিবোধ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক। আর নারী সেই বাল্যকাল থেকে মা-খালাদের কাছে শিখে এসেছে যৌনস্পৃহাকে অবদমিত করে রাখতে হয়। এ রকম একটা প্রাগৈতিহাসিক মনোভাব , যৌনতাকে অস্পৃশ্য ভাবা যে অসুস্থতা, সেটা নারীকে কে বোঝাবে !
দাম্পত্যের বাইরে যৌন স্বাধীনতা পুরুষের যৎসামান্য থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে তা শূন্যের কাছাকাছি। পুরুষ হিসাবে আপনি মিক্সড ফ্রুট সালাদ বা রুচির পরিবর্তনের কথা ঠাট্টা করে হলেও বলতে পারেন, বড়ো কোন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে না তা। কিন্তু নারী রুচির পরিবর্তনের কথা বললেই, সারা সমাজ তাকে বেশ্যামাগী থেকে শুরু করে যতোরকম পুরুষতান্ত্রিক অশ্লীল গালিতে জর্জরিত করে ফেলবে।
সারাদিন পরে ঘরে ফিরে পুরুষ স্নানাহার সেরে পত্রিকা হাতে টিভির সামনে বসে পড়ে। আর ভাবে, সে সারা দুনিয়া উদ্ধার করে এসেছে। অন্যদিকে, নারী সারাদিনের কাজের চাপে নিজেকে সিনিয়র গৃহপরিচারিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে পরস্পরের কাছে উপস্থাপনের তাগিদ বিয়ের প্রথম কয়েকবছর থাকে। তারপরে পুরুষ তার নোয়াপাতি ভুঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে, গোঁফের কোনে ডালের দাগ মেখেই টিভি দেখতে বসেন। আর নারী সেই সকালের পরিহিত সালোয়ার বা শাড়ী যেটা ঘামে ভিজে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে সেটা নিয়েই আশেপাশে গৃহকর্ম করে যেতে থাকেন। গুটি কয়েক সচেতন নারী ও পুরুষ হয়তো শয্যায় আসার আগে স্নান সেরে সুগন্ধি মাখেন। নিজেকে একটু হলেও ছিমছাম ও আকর্ষণীয় করে তোলেন, সে যৌনতার কারণেই হোক বা এমনিতেই।
উল্টোদিকে কর্মজীবী নারীরা নিজেকে তার অফিসের জন্য যেভাবে প্রতিদিন প্রস্তুত করে, তার ছিটেফোঁটাও কি গৃহের পুরুষটির জন্য করে ? ‘ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর’ তাই বলে সবকিছুকেই সহজলভ্য ও চিরস্থায়ী ভাবার বোকামি করা কি ঠিক ? অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আর যৌন স্বাধীনতাকে এক করে ফেলেন তারা। দিনশেষে তাদের আচরণও একজন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের মতো হয়ে যায়, সেটা তারা টেরও পান না। যখন টের পান ; তখন সম্পর্কের তারে মরিচা ধরে যায়।
ঘরের নারীকে শরীর সচেতন হতে বললেই সেটা পুরুষতান্ত্রিক চাহিদা হয়ে যায় না। নারীকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে থাকতে বললেই সেটা বাজারের বা মিডিয়ার নারীর ছলাকলায় অভ্যস্ত নারীদের সমতুল্য করা হয় না। একটা স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন প্রবৃত্তিকে অবহেলা করে আমাদের দাম্পত্য ও সংসারে আমরা কোন স্থায়ী সম্পর্কের প্রমাণ দিয়ে চলি , সেটা কে জানে !
তাই, হে পুরুষেরা ! নারীকে বুঝুন, নারীর যৌনতাকে বুঝুন।
আর হে নারীকুল ! পুরুষদের শারীরিক দুর্বলতাকে বুঝুন । পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়ার এই সম্পর্ককে একটা নিয়ন্ত্রিত কিন্তু আনন্দময় অবস্থানে নিয়ে আসুন। মধ্যবয়সে পুরুষ যেন নিজেকে রিক্ত বা যৌনবঞ্চিত না ভাবে।
আবারো মনে করিয়ে দিই, জীবন সংক্ষিপ্ত, যৌনজীবন তারচেয়েও সংক্ষিপ্ত ! তাই সেটা উপভোগ্য করে তুলুন।
পাঠ করার জন্য ধন্যবাদ।।
প্রকাশকালঃ ১২ই অক্টোবর,২০২০
by Jahid | Dec 1, 2020 | শিল্প ও সংস্কৃতি
আশির দশকে এবং পরবর্তীতে আমাদের সময়েও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই সমাপনী বর্ষে ‘STUDY TOUR’ নামের একটা ট্র্যাডিশন চালু ছিল। মূলতঃ কক্সবাজার, সিলেট সুন্দরবন দিয়ে শুরু হয়ে নেপাল ও ভারতে এই শিক্ষা সফর শেষ হত। ধারণা করি এই ট্র্যাডিশন এখনো আছে।
তো বছর বিশেক আগে আমাদের সমাপনী বর্ষে ভারত সফরের ব্যাপারে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হল। নানা অনিশ্চয়তার পরে দিনতারিখ নির্দিষ্ট হয়ে গেল। তৎকালীন অধ্যক্ষ ডঃ নিতাইচন্দ্র সূত্রধর, যিনি আই আইটি( Indian Institute of Technology) থেকে টেক্সটাইল স্নাতক ছিলেন ; কথা প্রসঙ্গে আমাদের ডেকে যা বললেন , তার যার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, এই ভারত সফর আমাদেরকে বিদেশ যাত্রার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা দেবে। আমরা হাসি লুকালাম ! বাসে করে যশোরের বেনাপোল হয়ে বাংলাভাষী কোলকাতায় যাওয়া বিদেশ সফর কীভাবে হয় ! দ্বিতীয় কথাটা বলেছিলেন, সাধারণ ভারতীয়দের দেশপ্রেম নাকি চোখে পড়ার মত।
স্যারের প্রথম কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক ছিল। পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি ফর্মালিটিস একটা বিদেশ-সফরের ফ্লেভার এনে দিল।
স্যারের দ্বিতীয় কথাটার প্রমাণ পেলাম হাওড়া স্টেশনে এসে। দুঃখিত আমি ও আমরা একদা উচ্চমাত্রার ধূম্রপায়ী ছিলাম।ঐ সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ট্রিপল ফাইভ ( 555) , তার আবার দুইটা ভার্সন ছিল, লন্ডন ফাইভ আর বাংলা ফাইভ। ছাত্রাবস্থায় যা হয়– বেনাপোল পার হতে হতে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সিগারেটের মজুদ শেষ। আমি যেহেতু অবাঙ্গালী- বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে বেড়ে উঠেছি , আমার হিন্দি ভাষাজ্ঞান অন্যদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী ছিল। তো আমার স্বল্প ভোকাবুলারী নিয়ে, হাওড়া ষ্টেশনে এক হকারকে পাকড়াও করলাম। ভাঙ্গাভাঙ্গা হিন্দিতে তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমাদের ট্রিপল ফাইভ ( 555) সিগারেট দরকার। বাংলা ফাইভ হলে ভাল, লন্ডন ফাইভ হলেও চলবে। ঐ হতদরিদ্র অশিক্ষিত হকার আমাকে অবাক করে হিন্দিতে বলল, ‘ আপ্ বাংলাদেশ সে আয়ে হো ক্যা ?’ ( আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছ ?’ আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিতেই সে ভারতে প্রস্তুতকৃত গোল্ড ফ্লেকের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ইন্ডিয়া মে আয়ে হো তো ইন্ডিয়াকে সিগারেট পিয়ো, বাহার কা সিগারেট কিউ ঢুণ্ডরাহে হো !’ ( ইন্ডিয়াতে এসেছ তো ইন্ডিয়ান সিগারেট খাও, বিদেশী সিগারেট খুঁজছ কেন ?) আমি মোটামুটি থতমত খেয়ে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট হাতে ফিরে আসলাম।‘মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ!’
কীভাবে, কেমন করে সামান্য একটা হত দরিদ্র হকারের মধ্যেও এতোটা দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ এসেছে তা আমি জানি না । তবে অনেকবার ভারতভ্রমণে আমার মনে হয়েছে, দেশপ্রেমের ব্যাপারটা সিনেমা টিভি থেকে শুরু করে টনিকের মতো সবার মাঝে ছড়ানো হয়। যার ফলে গুণগতমান যাই হোক না কেন নিজেদের পণ্য ব্যবহারে এরা অভ্যস্ত। একইভাবে জয়েন্ট ভেংচার গাড়ী, ইলেক্ট্রনিকস ও কম্পিউটারের বহুজাতিক সব সংস্থার নতুন কেন্দ্রবিন্দু চীনের পরেই ভারত।
ছাত্রাবস্থায় হোটেলে ভারতীয় টয়লেট পেপারের সমস্যাটা ভোগালো আমাদের। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম খুবই উন্নতমানের ‘বসুন্ধরা’ টয়লেট পেপারে। সেই তুলনায় এদেরগুলো শাব্দিক অর্থেই ‘পেপার’ ! শক্ত, অস্বস্তিকর এবং প্রায় শোষণক্ষমতাহীণ। জনৈক পাশ্চাত্যের পর্যটকের কথা মনে করিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। অধিকাংশ ভারতীয় টয়লেট পেপার ব্যবহার করেনা কেন তা নাকি উনি নিজদেশে ফেরত যাওয়ার আগে টের পেয়েছিলেন ! তাঁর মতে, ভারতীয়রা খাবারে যে পরিমাণ তেলচর্বি ব্যবহার করে, তা অর্ধ-পাচ্য হয়ে পরেরদিন টয়লেট করার সময়ে নির্গত হওয়ার কথা। এখন এদের টয়লেট পেপারের যে অবস্থা তেলে আরে কাগজে ঘষাঘষি হলে তো আগুন লেগে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ! এই ভয়েই সম্ভবতঃ ভারতীয়রা টয়লেট পেপার কম ব্যবহার করে !
বহুবছর পরে এসে মনে হল, বছর বিশেক আগের সেই পর্যবেক্ষণের কোনটাই পরিবর্তিত হয়নি। এঁদের দেশপ্রেম হয়তো আরও বেড়েছে । পাক-ভারত- চীন ত্রয়ী যুদ্ধের দামামায়, সারাক্ষণ হিসাব-নিকাশ চলছে শক্তিমত্তার ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির।
আর টয়লেট পেপারের গুণগত মান সেই আগের মতোই, শক্ত, অস্বস্তিকর এবং প্রায় শোষণ-ক্ষমতাহীন !
বছর বিশেক আগের সেই ‘STUDY TOUR’-এ নানারকম অম্লমধুর বিচ্ছিন্ন ঘটনার আরেকটি মনে আছে । কোলকাতার প্রথম সকালে পার্কস্ট্রীটের কোন এক হোটেলে আমাদের ঘুম ভাঙল আগেভাগে। সতীর্থ পিন্টু ( Habibur Rahman ) বলল, ‘চলো মামা, বাইরে হেঁটে আসি।’
সেই আদ্যিকালের কোলকাতা জেগে উঠছে ধীরে ধীরে । রাস্তার পাশে মাটির খুড়া বা চায়ের পাত্রের সঙ্গে বাসি ফেলে দেওয়া খাবারের উপরে মাছি ভনভন করছে। কিছুদূর হাঁটলেই বটগাছের নীচে দেবী কালীর ছোট মূর্তিতে কিছু গাঁদাফুলের উচ্ছিষ্ট। সাইকেল রিকশার টুংটাং ; পূজার ফুলের ভ্যান যাচ্ছে বড় কোন মার্কেটে। এর মাঝে বেশ খানিক হেঁটে চলে আসার পর পিন্টু বলল , ‘চলো মামা, এখান থেকেই নাস্তা করে যাই।’
তো এক হোটেলে ঢুকে পড়লাম। বসেই জিজ্ঞেস করলাম নাস্তায় কি কি আছে। অতো ভোরে মাত্রই বোধহয় চুলো জ্বেলেছে। মেসিয়ার এসে বলল, ‘লুচি আছে ভাজি আছে।’ এই সামান্য মেনু দেখে আমরা একটু ইতস্তত করছিলাম। মেসিয়ার সেটা টের পেয়েই কিনা বলল , ‘দাদা , মোহনভোগ আছে, দেব ?’ মিষ্টির প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ –আমার আশেপাশের সবাই জানে। লুচি-ভাজির সঙ্গে মোহনভোগ ও চাইলাম। যেমন গালভরা নাম, শুনেই মনে মনে আশা করছিলাম নিশ্চয় বেশ বড়সড় টাইপের কোন একটা মিষ্টি এসে হাজির হবে।
আমাদেরকে হতাশ করে দিয়ে ,লুচি-ভাজির সঙ্গে যে বস্তু আসলো, সেটাকে বাসায় আমরা সুজির হালুয়া বলি। আম্মা যেদিন দায়সারা গোছের নাস্তা বানাতেন, তাড়াহুড়ো করে রুটির সঙ্গে আমাদের সুজির হালুয়া করে দিতেন। সুজির হালুয়ার মতো সামান্য একটা জিনিসকে যে পশ্চিমবঙ্গে ‘মোহনভোগ’ বলে তা কে জানত !
তাজমহল নিয়ে যতো প্রশংসাবাক্য শুনেছি তার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে লেখক মার্ক টোয়েন এর উক্তি। তাজমহল দেখার পরে উনি বলেছিলেন–“There are two types of people in the world : People who have visited the Taj Mahal and people who have not! ”
গতকাল অপরাহ্ণে ( ১২ই অক্টোবর ২০১৬) আমার দুই রাজকন্যাকে ‘তাজমহল দেখা’ শ্রেণীতে উত্তরিত করলাম।
আমার প্রথম তাজমহল দেখার স্মৃতি সেই বছর বিশেক আগে শিক্ষাসফরের সময়ে ।মধ্যদুপুরে আমরা কয়েকজন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম এই সৌধের দিকে। দু’য়েকজন একটু হতাশ ; তারা অন্যের মুখে এতোবার তাজমহলের নানারকম চর্বিতচর্বন স্মৃতিচারণ শুনেছে, ভেবে বসেছিল যে ওটা বোধহয় একশোতলা সমান কোন একটা কিছু হবে। তাজমহল তো আর সিয়ার্স টাওয়ার না রে ভাই ! আমার কাছে মনে হয়েছে, এর বিশালত্বের ও সৌন্দর্য্যের মূল ব্যাপারটা যতোখানি না দেখার তারচেয়েও বেশী অনুভব করার।
ঐ কৈশোরে ক্রমান্বয়ে আমার বিস্ময় বাড়তে থাকল, কারণ দুপুর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকেলে উজ্জ্বল কনেদেখা আলোয় তাজমহলের রং হয়ে গেল একরকম ! সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে দিয়েছিল ; প্রতি ঘন্টায় তাজমহলের বর্ণবৈচিত্র আমাকে হতবাক করল ! এক ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলালাম, হোটেলে ছবি পৌঁছে দিল পরের দিন ; এবং আমি বোকার মতো সেই ছবিগুলো হোটেলের ড্রয়ারে ফেলে চলে আসলাম !
সেই বছর বিশেক আগের দেখা তাজমহল ! এতোদিনে আমি পৌঁছে গেছি মাঝবয়সে। আর তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে ; সেই চিরযৌবনা হয়ে আগের মতোই !
মুঘলদের স্মৃতিসৌধ ও রাজপ্রাসাদগুলোর বিশালত্ব আর খরচের বাড়াবাড়ি দেখে আমি বহু আগে থেকেই একাধারে মর্মাহত ও বিস্মিত । আমার বড়কন্যাকে জিজ্ঞেস করায়, সে তার আধুনিকতা বজায় রেখে এক কথায় বলল, ‘Mind blowing!’
বছর বিশেক আগের সেই দীর্ঘ সপ্তাহ চারেকের Study Tour-এ দিল্লী, আগ্রা রাজস্থানে মুঘল আর রাজপুতদের রাজপ্রাসাদ আর কেল্লা দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সেই একই বিশালত্ব, সেই শ্বেত মর্মর মার্বেল, রেড স্টোন আর দেয়ালের কারুকাজ। কৈশোরের ঐ অস্থির সময়ে ঐ বিশালত্ব হয়তো একটু ক্লান্তি এনে দিয়েছিল । দিওয়ান-এ আম; দিওয়ান-এ খাস, হাওয়া মহল, জল মহল, গান শোনার জায়গা, খাওয়ার যায়গা, আদিগন্ত বাগান, বিশাল গোলাপজলে ডোবানো পাথরের টবে গোসল করার ব্যবস্থা – কী নাই !
মজার ব্যাপার বহু খুঁজেও এরা এঁদের প্রাকৃতিক কাজগুলো কীভাবে এবং কোথায় সারতেন সেটার কোন নমুনা কোন প্রাসাদেই দেখতে পেলাম না । বাদশাহ হন আর সুলতান ; দিনের শুরুতে , মাঝে বা দিনশেষে এই কাজটি না করলে তো চলবে বা । মুঘলদের এতো কিছু আলোচনা বাদ দিয়ে তাঁদের প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে কেন লিখছি সেটা বলি। বছর বিশেক আগে, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি আমাকে নির্বোধ ভাবে সেই ভয়ে অনেককিছু চেপে যেতাম। হয়তো সেই অস্বস্তিতেই কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় নি । গত দুই দশকে আমার নির্বুদ্ধিতা প্রমাণিত সত্য । সুতরাং বোকার আবার ভয় কীসের ! আমি গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক বাত বাতাও , ইয়ে রাজালোগ টাট্টী কাঁহা কারতে থে?’ ( একটা কথা বলতো, এই রাজা-বাদশাহরা পটি করত কোথায়?) বেচারা নিতান্তই বিরক্ত হল। এই রকম ফালতু টাইপের প্রশ্ন আগের কোন ট্যুরিস্ট করে নি বোধ হয়। বিরক্ত হলেও গাইড-তো, তাই হাসিমুখে জবাব দিল, মূল প্রাসাদের বাইরে এঁদের মল-মূত্র ত্যাগের ব্যবস্থা থাকত।
সম্ভবত: প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয় সংস্কৃতিকেই এরা অনুসরণ করেছেন। শিক্ষা সফরের সময়ে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মাঝখানে দিয়ে যাওয়ার সময়ে ভোরে ট্রেনলাইন থেকে বা বাস রোড থেকে বেশ দূরে পুরুষ ও মহিলাদেরকে পটি করতে দেখেছি। সঙ্গের যে লোকাল গাইড ছিল, তাঁকে প্রশ্ন করায় উত্তর দিল যে, ভারতের বহু জায়গায় নারীপুরুষ নির্বিশেষে খোলা জায়গায় পটি করে। সে নিজেই ইয়ার্কি করে বলল, সম্ভবত: তাদের পশ্চাৎ-দেশে ঘাসের সুড়সুড়ি না লাগলে আসল কাজটি হয় না !
এটাও মনে আছে ২০০৯ এর দিকে অগ্রজের কিডনি ট্রান্স-প্ল্যান্টের সময় আমরা আদি কোলকাতায় অ্যাটাচড বাথসহ ছোট অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছিলাম। বাজেটের মধ্যে কিছুতেই মনোমতো পাচ্ছিলাম না। হয়তো , সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়ি থেকে তাঁদের টয়লেট বেশ দূরে থাকাটাই রীতি ; এবং সেটা তারা ফ্ল্যাট কালচারেও বজায় রেখেছে। অবশেষে টালিগঞ্জের দিকে অ্যাটাচড্ টয়লেট সহ ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছিল।
অবশ্য রাজস্থানের জয়পুরের জয় সিংহ, মানসিংহদের রাজ প্রাসাদে কয়েদখানার আশে পাশে কয়েকটি জায়গা দেখিয়ে গাইড বলল, সেগুলো নাকি তাঁদের টয়লেট ছিল। আর রাজপুতদের উত্তরসূরিদের জীবন যাপন ছিল বেশ আধুনিক। এরা ১৮০০ সালের দিকেই ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা করেছিল এবং বাকী জীবন সুখে-শান্তিতেই কাটিয়েছিল। এখনকার যিনি মহারাজা তার বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। জয়পুরের সিটি প্যালেসের একপাশে রাজপরিবার এখনো বাস করছে। একাংশ ছেড়ে দেওয়া মিউজিয়াম থেকে যে পরিমাণ আয় হচ্ছে , বাকী-জীবন সুখেই কাটবে আশা করা যায় ।
পাড়ার সেলুনের নাপিতরা সাধারণত খুব উন্নতমানের জ্ঞানী হয়ে থাকে ! আরেকধরনের জ্ঞানী হচ্ছে নতুন কোন শহরে পৌঁছে যে ড্রাইভারের সঙ্গে আপনার দেখা হবে তিনি। CNN- BBC যে সব গোপন সংবাদ এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি, সেটাও তারা জানে! এঁদের মতো দার্শনিক ও জ্ঞানী-লোক কেন যে এইসব তুচ্ছ কাজ করে জীবন কাটাচ্ছে সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। অধুনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ভাবে পিএইচডি ডিগ্রী বিলচ্ছে, তাঁদের তো এতদিনে বিষয়-এর অভাব পড়ে যাওয়ার কথা। নবীন গবেষকরা ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারেন।
তো , আমাদের সাড়ে চারফুটি ড্রাইভারের নামের সঙ্গে তার দেহসৌষ্ঠব এক্কেবারে যায় না। এক্সেলেটর আর ব্রেকে ঠিকমত পা যাতে পড়ে সেজন্য সে প্রায় একফুট উঁচু বুট পড়ে চলাফেরা করে। ক্ষুদ্রাকৃতির ড্রাইভার সাহেবের বাড়ী হিমাচল প্রদেশের এবং দেহের তুলনায় নাম খুবই ওজনদার – শের সিং ! পাক-ভারত ভূ-রাজনীতি থেকে শুরু করে ওবামা পরবর্তী আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে সে অত্যন্ত চিন্তিত।
তার অনেক কথার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি নির্বোধের মত আচরণ করাই শ্রেয় মনে করেছি। বিদেশ বিভূঁইয়ে খামোখা ক্যাচাল না করে তার হিসাবমতো চলাই উত্তম মনে হয়েছে। শের সিংয়ের অনেক জ্ঞানের কথার মধ্যে বাস্তব-ধর্মী হচ্ছে তিনটি ।
প্রথমটি হচ্ছে, আগ্রার হোটেলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে গেল। রাতে গরম পানি ছিল না। এক্কেবারে নতুন হোটেল পুরো গোছগাছ হয় নি। তো তারা বলল, সকালে উপরের বয়লার চালু করে দেবে। যথারীতি সকালে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পর গরম পানি তো পাওয়া গেলই না, দেখা গেল পানিই বন্ধ হয়ে গেছে। ওভাবেই তাড়াহুড়ো করে জয়পুরের উদ্দেশ্যে বের হলাম আমরা। ঘটনা শুনে শের সিং বলল, ‘ আজকাল তো , অনলাইন পে সাব কুছ্ মিলতা হ্যায় !’ কথায় তাচ্ছিল্যের সুর শুনে জিজ্ঞেস করার পর সে যেটা জানালো, অনলাইনে হোটেল বুকিং দিলে কম টাকায় ঝকঝকে তকতকে সুযোগ সুবিধে দিয়ে দেয়। বাস্তবে আসলে টের পাওয়া যায় হোটেলে অবস্থা ! অনলাইনে দিল্লী থেকে তিনঘণ্টায় আগ্রা পৌঁছে দেওয়া যায় , বাস্তবে কতখানি লাগে সেটা ড্রাইভাররা ভালো জানে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে মোটর সাইকেল আরোহীদের নিয়ে তার মন্তব্য। ঢাকার মোটর বাইকারদের ড্রাইভিং নিয়ে আমি নিজেও ত্যক্ত। শহরের ভিতরে কিংবা হাইওয়েতে এঁদের হুট হাট রাস্তা-ক্রসিং আর ডান-বাম জ্ঞানের অভাব যেমনটি বাংলাদেশে তারচেয়েও বেশী দেখলাম ভারতে। শের সিং এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ এক বাইক খরিদ্ লিয়া লাগ্তা হ্যায় সারে ইন্ডিয়া খরিদ্ লিয়া ! ( একটা মোটর সাইকেল কিনে এমনভাবে চলাফেরা করে , মনে হয় যেন সারা ইন্ডিয়া কিনে ফেলেছে!) ঘটনা সত্য, বাংলাদেশের মোটরবাইকাররা রাস্তা, ফুটপাত সবকিছুকেই নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে !
বছর বিশেকে আরও প্রশস্ত হয়েছে দিল্লী-আগ্রা-জয়পুরের হাইওয়েগুলো। মাইল দশেক পরপর দীর্ঘাকৃতির ফ্লাইওভার ট্রাফিক জ্যাম প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে এসেছে।
শের সিংয়ের আরেকটি মন্তব্য ছিল হাইওয়ের পাশগুলোতে নানারকম ল্যান্ড ডেভেলপারদের গালভরা সাইনবোর্ড নিয়ে। সিং হাম সিটি , সান সিটি, মুন সিটি, কুবের সিটি, নিমরানা কাউন্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। শের সিং যা বলল, গত বছর পনের ধরেই কিছু সাইনবোর্ড সর্বস্ব কোম্পানি লোকজনের টাকাপয়সা লুটে নিচ্ছে । রাস্তাঘাটের, ইউটিলিটির নাম নেই , জমি বুঝিয়ে দেওয়ার নাম নেই শুধু বড়বড় সাইনবোর্ড আর বাগাড়ম্বর। ‘রুপিয়া বাড়নেকে সাথ্ সাথ্ আদমি লোগ্কা বেওকুফি ভি বাড় যাতি হ্যায়।’ ( টাকা পয়সা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের বেকুবি বেড়ে যায় !) আমার গায়েও এই অপমান লাগল, আমি চুপচাপ হজম করলাম। ঘটনা সত্য ; আমি নিজেও পাকেচক্রে পূর্বাচলের ধুনুফুনু নানা কোম্পানির অন্যতম GREAT WALLS LAND PROPERTY LTD. নামের এক ফোর টুয়েন্টি কোম্পানিকে মাসেমাসে কষ্টের টাকা দিয়েছি ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১১ পর্যন্ত, এখন না পাচ্ছি কোন জমির হিসাব না পাচ্ছি টাকা পয়সা। এরা বিঘা খানেক জমি কিনে, হাজার দশেক লোকের কাছে বিক্রি করে টাকা পয়সা সরিয়ে ফেলেছে। বুঝলাম আমার মতো বেকুব সব দেশেই আছে !
এইবার প্রায় প্রত্যেক দর্শনীয় জায়গাগুলোতেই শের সিংয়ের কথামতো গাইড নিয়েছিলাম। ইতিহাস জানার চেয়েও বড় সুবিধা যেটা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে এরা আমাদেরকে দ্রুত টিকেট কিনে দিয়েছে ; লম্বা লাইন এড়িয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সার্ক দেশের জন্য সাদাচামড়ার বিদেশীদের চেয়ে কম টাকায় টিকেট আছে। এই সুযোগে আমার ক্যামেরাটা ধরিয়ে দিয়েছি গাইডদেরকে; তারা আমাদের চারজনের গ্রুপ ছবি তুলে দিয়েছে! নয়তো চারজনের একসঙ্গে ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব ছিল।
স্থানভেদে গাইডের চার্জ ২৫০ রুপি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০০ রুপি। সমস্যা একটাই, প্রতিটা গাইডই তাদের পরিচিত দোকানে নিয়ে হাজির হয়েছে, এবং কিনব না কিনব না করেও গুচ্ছের পাথরের ঘটিবাটি কেনা হয়েছে। দেখা যাক, এয়ারপোর্টে কতখানি ওভার-ওয়েট চার্জ দিতে হয় !
প্রকাশকালঃ অক্টোবর,২০১৬
by Jahid | Dec 1, 2020 | ছিন্নপত্র
আশির দশকে আধুনিক কবিতার একটা লাইন পড়েছিলাম। দুঃখিত কবির নাম মনে করতে পারছিনা। তিনি লিখেছিলেন, “ তখন আমার বয়স ছিল কম , রাতে ঘুম হতো ,আর প্রস্রাবের রং ছিল সাদা।” স্মৃতি থেকে লেখা, একটু এদিক সেদিক হতে পারে। তো, আমার শৈশবেও আমি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাতাম আর সাদারঙের হিসু করতাম।
যখন শৈশব ছাড়ি ছাড়ি করছে, তখন কীভাবে যেন পড়ালেখার চাপ গেল বেড়ে। স্কুলে প্রথম সারিতে নাম লেখানোর ইঁদুর দৌড়ে পড়ে গেলাম।
আমার যাবতীয় শিশুসুলভ দুঃস্বপ্নের ভিতরে বেশি যেই দুঃস্বপ্ন হানা দিয়েছে বারবার, সেটা হচ্ছে পরীক্ষার হলে গেছি, খাতা পেয়ে প্রশ্ন পেয়ে কিছুই মনে করতে পারছি না। এই স্বপ্নের সিকুয়েল ছিল, কোনবার দেখতাম পরীক্ষা হল খুঁজে ফিরছি, কিন্তু নিজের রুম বা আসন খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০টা ছুঁইছুঁই। কোনবার দেখতাম, মাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, অথচ স্যার বলছেন তিনঘণ্টা নাকি শেষ, খাতা জমা দিতে হবে। তখন প্রবল বেগে লেখার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। ঘুমের মধ্যেই আমি টের পেতাম কী অসহনীয় শারীরিক ও তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত।
সে সময়ে আমার ছিল একটা তরতাজা , শক্তিশালী হৃদপিণ্ড । এখনকার মতো ধোঁয়া, ধুলোবালি ভেজাল খাওয়া হৃদপিণ্ড এরকম দুঃস্বপ্নের চাপ নিতে পারবে না। ঘুমের মধ্যেই মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমার ধারণা সবযুগের শৈশবে এই পরীক্ষাভীতি ছিল , আছে সবার ঘুম ভাঙ্গে পরীক্ষার দুঃস্বপ্ন নিয়ে।
দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি কিছু কি বাস্তব জীবনে সত্যি ঘটে? আমার হালকার উপর ঝাপসা ঘটেছিল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষায় একবার সাধারণ বিজ্ঞান পড়ে গিয়ে সাময়িক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। সে আরেক কাহিনী।
আর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে, অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর না দিতেই দেখি সময় শেষ। খুব দ্রুত সব প্রশ্ন টাচ করে যাওয়ার বিশেষায়িত ট্রেনিং ও টেম্পারমেন্ট দরকার বুয়েটের পরীক্ষায়। মনে হয়, একটা দুইটা প্রশ্ন নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করে ধরা খেয়েছিলাম।
পরীক্ষার হলে দেরী করে পৌঁছেছি সারাজীবনে একবারই, বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি দিতে চেয়েছিলাম নিতান্তই শখে পড়ে। বিসিএস-এ টিকে হাতিঘোড়া হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা, সম্ভাবনা ও প্রিপ্রারেশন কিছুই ছিলনা। আমি তখন বেশ কয়েকবছর টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করে ওপেক্স গ্রুপের মার্চেন্ডাইজিং এ। আত্মীয়স্বজনদের আফসোস থেকে যাবে পরিবারের মেধাবী ছেলে একবার বিসিএস পরীক্ষা দিল না ! তো, সেসময় গার্মেন্টস ও শিপমেন্টের এমনই হ্যাপা, যে একঘণ্টার জন্য বাইরেও যেতে পারি না ; বড়ো স্যারেরা কেউ না থাকলে কাজের চাপে টেবিলে বসেই সিগারেট খেতাম। কে আবার কষ্ট করে রান্নাঘরের কোনায় যায়। আমার অবস্থা সেভেন ইলেভেনের দোকানগুলোর মতো ; সারাক্ষণ একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। পরীক্ষার দিন তাই, মহাখালী ডিওএইচএস ওপেক্সের অফিসে হাজিরা দিয়ে একটা স্কুটার নিয়ে সোজা ইডেন কলেজে, যেখানে পরীক্ষার সিট পড়েছে। যথারীতি পরীক্ষা শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে গেটে। পুলিশ ঢুকতে দেয় না। বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করার পর, হলে গিয়ে বসলাম। দৌড়াদৌড়িতে ঘেমে নেয়ে একশেষ। প্রিপারেশন ছাড়া পরীক্ষার আর কীই বা হতে পারে। টিকলাম না।
আরেকটা দুঃস্বপ্ন বহুদিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমাকে। সবসময় দেখতাম একটা বড়ো বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান চলছে, বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করে দেখতাম, কনের পাশের বর-বেশে বিমর্ষ বদনে যে বসে আছে সে আমি ! সেটাও সমস্যা না। বিয়ের স্বপ্ন তো দেখতেই পারে ভেতো বাঙালি। সমস্যা হচ্ছে, কনের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি। কোন একটা টিভি সিনেমার বয়স্কা নারীকে বধুবেশে বসে থাকতে দেখতাম। কিন্তু আমি না পারছি উঠে দৌড় দিতে ; না পারছি কবুল বলতে। কীয়েক্টাবস্থা !
আরেকটা খুব কমন স্বপ্ন ছিল, গভীর কোন অতল খাদে পড়ে যাচ্ছি। চিৎকার করছি, কিন্তু পতন থামছে না। আমার ধারণা জীবনে অনেকের কাছেই এটা সবচেয়ে কমন দুঃস্বপ্ন।
প্রায়শঃ দুঃস্বপ্ন দেখতাম অচেনা রাস্তায় পথ হারিয়ে ফেলেছি। একবার কিছু চেনা চেনা মনে হয় , হেঁটে সামনে এগিয়ে গেলেই দেখে একেবারে অচেনা কোন বনজঙ্গল রাস্তা ইত্যাদি। অথচ আমার কোথাও যেন যাওয়ার তাড়া আছে, সেটা মনে করে টেনশনে আছি আবার কাউকে জিজ্ঞেস করার মতোও পাচ্ছি না। কী যে একটা পেরেশানি।
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ!’
শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে আর যৌবনে ঘুরে ফিরে একই ধরণের দুঃস্বপ্নই ছিল।
আর কর্মজীবন শুরু হওয়ার পরে তো সবরকমের স্বপ্ন দেখাই ছেড়ে দিয়েছি। ইদানীং কিছুই দেখিনা বা দেখলেও ঘুম থেকে উঠে কিছুই মনে থাকে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল সেটা ভাবার চেয়ে ব্লাডারের প্রেসার কমিয়ে এসে , পানি খেয়ে শুয়ে পড়ার প্রবণতাই বেশি।
প্রকাশকালঃ ১০ই অক্টোবর,২০২০
by Jahid | Dec 1, 2020 | ছিন্নপত্র
আমাদের আশির দশকের শৈশবে কতো রকমের ফ্যান্টাসি ছিল !
এই প্রজন্মেও আছে নিশ্চয়, কিন্তু সেটা কখনো জানার চেষ্টা করা হয়নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপড়েনে মাসের ২০ তারিখ গেলেই পাশের বাসার খালাম্মাদের কাছে ধারদেনা চাইতে হতো। আমরা একটা কিছু শখ করলাম, আর সেটা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবো, সেটা এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবতাম না।
সচ্ছল বন্ধুরা যারা ছিল, দেখতাম অমুকের চাচা আমেরিকা থেকে নতুন গান শোনার ওয়াকম্যান পাঠিয়েছে। অথবা কোন পিকনিকে দেখলাম, তার হাতে নতুন ইয়াশিকা ক্যামেরা। তার মামা পাঠিয়েছে। আমরা শাব্দিক অর্থেই জুলজুল করে সেটা চেয়ে দেখতাম।
চাওয়া আর পাওয়ার এই বিস্তর ফারাক আমাকে মাঝে মাঝে ফ্যান্টাসিতে ভোগাতো। কেন সামান্য একটা বাইসাইকেল কিনে দেওয়া যায় না? অথবা কেন একটা ক্যামেরা আমাদের কেনা হয় না? এসব অপ্রাপ্তি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বেদনা কাজ করত। আর আমাদের বিনোদন যেহেতু ছিল সিনেমা অথবা বিটিভির নাটক, সেগুলো দেখে দেখে কোন কাহিনীর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতাম।
আম্মার কাছে কিছু চেয়ে না পেলে মনে হতো , ধ্যাত্ ! কী একটা গরিবগুরবোর ঘরে এসে পড়েছি রে বাবা ! সিনেমার কাহিনীর বিশাল ধনী কেউ একদিন এসে নিশ্চয়ই বলবে, ‘আরে এই ছেলে তো আমাদের! ভুল করে এই পরিবারে চলে এসেছে ! যাই হোক একে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।’ তারপরে সেই সাম্রাজ্যের একক অধিপতি আমি! যা চাই, তাই পাই। চেয়ে না পাওয়ার ফালতু জীবন একদিনে বদলে যাবে।
আবার ভাবতাম, এই যে আমি মহল্লার ভালো ছাত্রদের একজন; অথচ কেউ আমাকে একটু প্রশংসাও করে না ! সিনেমায় দেখায় না, পরিচয় লুকিয়ে মানুষের বাড়ি গৃহপরিচারকের কাজ করছে নায়ক। সে রকমটি করে যদি পরিচয় লুকিয়ে কোন বিশাল বড়লোকের বাড়ির কাজের ছেলে হই ; তাহলে আমার এইযে পাটিগণিত, বীজগণিতের দক্ষতা সেই বাড়ির সুন্দরী কন্যাকে হুট করে একদিন দেখিয়ে দিতে পারতাম। তারপর ধন্য ধন্য পড়ে যেতো। সবাই টের পেত, আহা , ছেলেটি তো হীরের টুকরো ! তারপর আর কী ! সেই ফ্যান্টাসি বড়লোকের একমাত্র উর্বশী কন্যার সঙ্গে প্রেম পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতাম।
কর্পোরেট চাকরির প্রথমদিকে একটা ফ্যান্টাসি ছিল কিছুদিন। এই যে, আমরা সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্টের একধাপ উপরে আছি বলে কারখানার ছোটখাটো খুঁত ভুলত্রুটি বের করে খুব বাহাদুরি দেখাই। ভাবখানা, আমাদের না জানি কতো জ্ঞান গম্মি ! পরিচয় লুকিয়ে কোন ছোট্ট প্রতিষ্ঠানে, খুব ছোট একটা পদে যোগদান করতে পারি, তাহলে কী হতে পারে ! তাহলে, আমার অভিজ্ঞতা থেকে কার্যকরী জ্ঞান প্রয়োগ করে, ঠিক ঠিক উল্টোভাবে কর্পোরেট অফিসের নাদানদের নাকি দড়ি দিয়ে ঘোরাতাম !
অথবা এই যে ,সেলস আর মার্কেটিং এর জন্য বিদেশে বিদেশে ঘুরি। এমন কী হতে পারে, পরিচয় লুকিয়ে কোন ছোট্ট শাড়ির দোকান অথবা মনোহারী দোকানে সেলসম্যান হলাম। বা কোন একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁ বা ছোট্ট হোটেলে বেয়ারার চাকরি করা শুরু করলাম। এটাতো সম্ভব, কে আর মানা করবে ! আমি যদি ঢাকার দূরপ্রান্তে অথবা ঢাকার বাইরের গিয়ে করি, কেউ তো আর চিনবে না যে, আমি টেক্স-ইবোর জাহিদ ! আর যদি পরিচিত কেউ যদি চিনেও ফেলে, এমনও তো হতে পারে সে আমাকে না চেনার ভাণ করে একটু বেশি বখশিশ দিয়ে চলে গেল। সেই লোক বাসায় ফিরে নিজের স্ত্রীকে আর ফোন করে বন্ধুদের বলল, ‘জানিস, জাহিদ সাহেব ছিল না, সেতো এখন এই করে চলছে, আহা !’
পশ্চিমের দেশে এটা সম্ভব।পৃথিবীর সবদেশ থেকে কতো তাবৎ বড়ো মাপের লোকেরা নিউইয়র্কে, প্যারিসে গিয়ে ট্যাক্সি চালায়, ওয়ালমার্টে বাচ্চাদের ন্যাপি বিক্রি করে।যদিও সেটা আরেক জীবনসংগ্রামের কাহিনী। ওখানে তো আর পেশার জাত্যভিমান নেই। একজন ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের জন্যও পার্টটাইম অড জব খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।
আমাদের দেশে পরিচয় লুকিয়ে কাজ করার সুবিধা একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থার আছে। এরশাদশাহীর আমলে তার স্বৈরাচার সামলানোর জন্য চারিদিকে ছদ্মবেশী গোয়েন্দারা ঘুরতো। হ্যাঁ ,পরিচয় লুকিয়ে কাজ করার সুবিধা আছে আমাদের সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রী আমলাদেরও। কেমন করে যেন, তারা যে আসলে ‘জনগণের সেবক’ ; সেই পরিচয় দিব্যি লুকিয়ে ফেলেছে আর সামন্ত-প্রভুদের মতো কুৎসিত থেকে কুৎসিততম আচরণ করছে আমাদের আমজনতার সাথে !
‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ!’
শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে আর যৌবনে আমাদের প্রজন্ম কী কী ধরণের ফ্যান্টাসিতে ভুগেছে, সেটা বোধকরি কখনই বলা ঠিক হবে না। বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট!
প্রকাশকালঃ ৮ই অক্টোবর,২০২০
by Jahid | Dec 1, 2020 | সাম্প্রতিক
গত সাত সাতটি মূল্যবান মাসে সবধরনের লকডাউন, হোম কোয়ারিন্টিন, আইসোলেশন, আইসিইউ, সিসিইউ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্যাচুরেশন ইত্যাদি পার হয়ে যেখানে আছি, সেটা সেই প্রথম মাসের শিক্ষার খুব কাছাকাছি।
কেননা, কোভিড-১৯ ভাইরাসের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও ব্যবহারযোগ্য তথ্য হচ্ছে আপনাকে মাস্ক পরতেই হবে ও নিয়মিত সাবান স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতেই হবে। সুষমখাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা ও রোগপ্রতিরোধ বাড়ানো সব রোগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কোভিডের জন্য নতুন নিয়ম না।
মূলত: কোভিড ভাইরাস আক্রান্ত রোগী, সে উপসর্গযুক্ত হোক বা উপসর্গহীন হোক; তার সংস্পর্শে আসলে আপনার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কমবেশি। তাই মাস্ক পরে চলতে হবে। নিরাপদ দূরত্ব রেখে কথা বলতে হবে।
কোভিড-১৯ বায়ুবাহিত কীনা, বিতর্ক চলছেই।
এটি পানিবাহিত কীনা, বিতর্ক চলছেই।
অন্য প্রাণীকুল , বাজারের সজীব শাকসবজিতে কতোক্ষণ থাকে, নানা মুনির নানা মত আছে।
সকল নির্জীব বস্তু, চেয়ার টেবিল, সিঁড়ি রেলিং, লিফট, যানবাহন, পোশাক, জুতা মোজায় কতক্ষণ এই ভাইরাস টিকে থাকতে পারে, নানাবিধ মত আছে।
পুরো বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বাভাবিক। সরকারি-বেসরকারি সবাই মোটামুটি কর্মক্ষেত্রে । শুধুমাত্র শিক্ষায়তনগুলো বন্ধ, সেটাও আগামী জানুয়ারিতে খুলে দিতে পারে।
যা বুঝলামঃ নিজের অজ্ঞাতে আমরা প্রতিনিয়ত কোভিড ভাইরাসের সংস্পর্শে আসছি। একই লিফট বা রেলিং স্পর্শ করছি। একই চেয়ারে বসছি। আরেকজনের চিমটি কাঁটা লাউ নিজেও চিমটি কেটে দেখছি। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের হাতের স্পর্শ করা ভাইরাস আমাদের চোখ, মুখ ও নাসারন্ধ্র দিয়ে দিয়ে দেহে প্রবেশ করছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্তি-ভেদে প্রবল বা ক্ষীণ।
আমাদের ছোটবেলায় সিনেমার কৌতুক অভিনেতারা ঘরে ঘরে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন, বিখ্যাত ছিলেন। খান জয়নুল থেকে শুরু করে হাসমত, টেলিসামাদ, আশীষ কুমার লোহ, আনিস, সাইফুদ্দিন আহমেদ আরো অনেকে। বছর পঁয়ত্রিশ আগে , সাইফুদ্দিন আহমেদ সম্ভবত: বিটিভির আনন্দমেলায় একটা ঢাকাইয়া চুটকি বলেছিলেন। তিনি অসাধারণ ঢাকাইয়া উচ্চারণে কৌতুক পরিবেশন করতে পারতেন। খুব দুর্বল স্মৃতি থেকে লিখছি, কারো কাছে মূল কৌতুক থাকলে শেয়ার করবেন।
তো, এক পাগলা গারদে একজন বড়ো ডাক্তার অথবা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি গেছেন পরিদর্শন করতে। উন্মুক্ত পরিবেশে মানসিক রোগীদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। প্রত্যেকের আচরণ স্বাভাবিক নয় যথারীতি । তো একজনকে দেখা গেল ড্রেনে পড়া একটা নোংরা বিড়ালকে উদ্ধার করা নিয়ে ব্যস্ত। পরিদর্শক বেশ খুশি, একটা প্রাণীকে বাঁচিয়ে তুলছে যে, সে তো আর পাগল হতে পারে না ! তাঁকে পাগলাগারদ থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিড়ালকে নিয়ে কী করবেন সেই রোগী। সে বলল, বিড়ালের গায়ে নোংরা লেগেছে সে একে গোসল করাবে।
পুরো হাসপাতাল ঘুরে সেই পরিদর্শক যখন ফিরতি পথে ; দেখলেন সেই রোগী মৃত বিড়ালটি সামনে নিয়ে বসে আছে।
‘বিড়াল কি গোসল করার সময়ে মারা গেছে?’
‘না ডাগদর ছাব ! বিলাই তো গোছলের ছময়ে ঠিকই আছিলো। মাগার যখন চিপা পানি বাইর কইরা দড়িতে শুকাইতে দিছি, তহন মইরা গেছে।’
মোরাল অভ দি স্টোরি:
কোভিড-১৯ ভাইরাস হাতে লাগুক, জামায় লাগুক, জুতায় লাগুক লাগতে দেন। পরিষ্কার করেন ইচ্ছেমত। কিন্তু সেটা যেন হাত থেকে মুখে অথবা নাকে এসে দেহে প্রবেশ না করে। বিড়াল পরিষ্কার করে ছেড়ে দিন,শুকাতে যাবেন না
প্রকাশকালঃ ৪ঠা অক্টোবর,২০২০
সাম্প্রতিক মন্তব্য