উপলব্ধি: ৪

ডু নট লেট আদার ডিফাইন ইয়োরসেলফ। নিজেকে অন্যের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হতে না দেওয়াই শ্রেয়। সংবেদনশীল মানুষ হিসাবে আত্মোপলব্ধির, নিজেকে জানার প্রতিনিয়ত চেষ্টা ছিল। এটা থাকা উচিৎ। অন্য কেউ এসে অকস্মাৎ আপনার দুর্বলতা চিহ্নিত করে, আপনার সব আত্মবিশ্বাসের মূলে বিষ ঢেলে দেবে সেটা হতে দেবেন না। কেউ আপনার অযাচিত সমালোচনা করলে আপনি দেখার ও বোঝার চেষ্টা করেন, সে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কীনা, তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতা ও অবস্থান আদৌ আপনাকে সমালোচনা করার অবস্থায় আছে কীনা অথবা তাঁর মন্তব্য আপনার আদৌ নেওয়ার দরকার আছে কীনা !

উপলব্ধি: ৩

নিজের সঙ্গে নিজে ও নিজের পরিবারের সঙ্গে সবসময় সৎ থাকতে হয়। পরিবারের প্রতি আপনি যেমন সহানুভূতিশীল,অসীম মমত্ববোধ করেন; নিজের প্রতিও একই রকম মমতা, সমঝোতা ও থাকা দরকার। এই অন্যায্য পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষকে সারাক্ষণ পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। বাইরের প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে, আপনার যে শক্তি দরকার তার শক্তিমত্তা নির্ভর করবে আপনার নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক কেমন তা এবং আপনার নিজের পরিবার,বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের সম্পর্ক কেমন তার উপর। নিজের পরিবারে সঙ্গে দূরত্ব ও অসমঝোতায় যে পরিমাণ শক্তিক্ষয় হবে, বাইরের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য শক্তি অবশিষ্ট থাকবে না।

আমি যে কোন পরিস্থিতি—সে হোক চাকরি বা ব্যবসায়িক জীবনের ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা সবকিছু একসময় আমার জন্মদাত্রীর সঙ্গে আর পরে অবলীলায় সহধর্মিণীর সঙ্গে শেয়ার করি। বহুবার এমন অনেককে পেয়েছি, চাকরি হারিয়ে নিজের পরিবারে সঙ্গে দিনের পর দিন অভিনয় করে চলেছেন। অন্য সব দিনের মতো সকালে অফিসের পোশাক পরে বের হয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরেছেন। আমি তাঁদেরকে বলেছি, যুদ্ধটা আপনি একা করছেন কেন? আপনার পরিবারে জন্য আপনি জীবন সর্বস্ব করছেন, তাদের সঙ্গে কেন অভিনয় করছেন ? আপনার জীবনের প্রতিকূল অবস্থাতো চিরস্থায়ী নয়। এই যুদ্ধে আপনি তাদেরকেও সামিল করুন। ঘরে ও বাইরে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে করে নিজে নিঃশেষ করার কোন মানে হয় না। বিশ্বাস করেন, অনেকে ফিরে এসে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন আমার ওই সৎ পরামর্শটুকুর জন্য।

উপলব্ধি: ২

নৈরাশ্যবাদী ও নেগেটিভ লোক এড়িয়ে চলুন। এই ব্যাপারটা, আমার সহজাত ছিল ছোটবেলা থেকেই। করপোরেট জীবনে এড়িয়ে চলা যায় না। সফল মালিক, নিজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ক্ষমতাশালী অনেকেই ভয়ঙ্কর নৈরাশ্যবাদী ছিলেন। জীবনের নানাবিধ সাফল্য অর্জনের পরেও তাঁরা কেন জানিনা চারিদিকে হতাশা ছড়িয়ে চলতেন। সফল, কিন্তু নেগেটিভ, কুটিল মনের মানুষের সঙ্গে চলার সমস্যা হচ্ছে , তাদের প্রতিটি ভণ্ডামো, চাটুকারিতার কাহিনী-কীর্তি নিজের মনের উপর কালো দাগ ফেলে। এদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে গেলে, একসময় দেখা যায়, নিজেরও এদের মতো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি সচেতনভাবে এদের সারাজীবন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। নিতান্ত এড়িয়ে চলতে না পারলে, ইগনোর করেছি, তাদের কর্মকাণ্ডের কিছু নিজের ভিতরে নিইনি।

একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে আমি আশাবাদী হতে শিখেছি। ঘরোয়া আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বলা একটা কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নৈরাশ্যের ইট দিয়ে দিয়ে বর্তমান সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। সভ্যতার ইমারত গড়ে উঠেছে আশাবাদে। কোটি কোটি নৈরাশ্যবাদী লোকের মাঝে গুটি কয়েক আশাবাদী মানুষ সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

বিশ্বাস করা শিখেছি ‘ মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’আমাদের সভ্যতার প্রতিটি গাঁথুনি শক্তিমান আশাবাদী মানুষের তৈরি। নৈরাশ্য এবং হতাশা দিয়ে কাব্য সৃষ্টি করা যায় হয়তো, আর কিছু না। আমি তো আর কবি নই; দণ্ডমুণ্ডের অধিকারীও কেউ নই। তাই, আমার উপলব্ধি , আশাবাদ আপনার চারপাশের পৃথিবী বদলে দিতে পারে । আর হতাশা ঠিক তাই করবে উল্টোভাবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ You will get, what you are afraid of !’ আপনি প্রতিমুহূর্তে কোনকিছু খারাপ হবে ভেবে থাকলে, আপনার সাথে তাই হবে।

আবার এটাও ঠিক, মাঝে মাঝে আমি হিসাব মেলাতে পারিনি। কেউই পারে না। কেননা পৃথিবী আমার আপনার আকাঙ্ক্ষিত নিয়মে চলে না । পৃথিবী চলে তাঁর নিজের নিয়মে। আধুনিক পৃথিবীতে আমাদের সাফল্য-ব্যর্থতার মাপকাঠি আর্থিক অবস্থান দিয়ে। একসময়ে মনে হয়েছিল, আশাবাদের সাথে সাফল্যের নিশ্চয়ই একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে ; তাই বলে আশাবাদী মনুষ্যমাত্রই সামাজিক ও আর্থিকভাবে সফল হবে সেটা বোধহয় অনেকাংশে সুনিশ্চিত নয়। এরপরেও আমি আশাবাদী। এবং আশাবাদী মানুষ বলতে হাল ছেড়ে না দেওয়া, উন্নত , উদার, সৌরভময়, উচ্চকিত সম্পন্ন মানুষকেই বুঝি।

প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর ২০২০

উপলব্ধি: ১

ব্যক্তি ও পরিস্থিতি সম্পর্কে তাড়াহুড়ো করে জাজমেন্টাল না হওয়া। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা।

আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মকে সেটা জানিয়ে যেতে চাই। যদিও একজন মানুষের ব্যাপারে হুট করে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। সচরাচর আমাদের ধৈর্য হয় না, একটু অপেক্ষা করে ,সামগ্রিক ছবিটি যাচাই-বাছাই করার । হুট করেই অমুক ভালো, তমুক খারাপ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে চাই। সম্ভবত: এটি আমাদের মনে একটা স্বস্তি এনে দেয়। যে ব্যক্তির ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাই, তাঁর সকল ক্রিয়াকর্ম আমাদের জাজমেন্টের চশমা দিয়ে দেখা শুরু করি।

নানা অভিজ্ঞতায় আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, একজন মানুষ পুরোপুরি ভালো বা পুরোপুরি খারাপ হতে পারে না। জীবনের যে কোন পরিস্থিতিও তাই। সাদা কালোর মাঝে একটা রঙিন পৃথিবী আছে, সেটা আমার পরবর্তী প্রজন্মকে শিখতে হবে। নইলে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।

ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক ঘরোয়া আড্ডায় বললেন, অন্যদের কাছে আগে থেকে শুনে শুনে তিনি আমাদের ইশকুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষকের একটা খারাপ ইমেজ দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। এবং ফলশ্রুতিতে আমাদের সবচেয়ে দক্ষ দুইজন শিক্ষকের মাঝে একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলতে দেখতাম। বিজ্ঞান শিক্ষক আমাদেরকে বলেছিলেন, এই পূর্বশ্রুত ধারণা ভেঙ্গে, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে তাঁর অনেক বছর সময় নষ্ট হয়েছিল। ঘুরে ফিরে সেই কথাটাই আসে। আগেই একজন ব্যক্তির সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলে, সেটা সহজে মেরামত করা যায় না।

প্রথম প্রকাশঃ নভেম্বর ২০২০

 

করপোরেট অবজারভেশন ( সম্ভাব্য সিকুয়েল )

আমি যখন করপোরেট দুনিয়ায় ম্যানেজার বা সোজা-বাংলায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলাম ; যখন আমার দৈনন্দিন দায়িত্বের বাইরে অফিস ম্যানেজমেন্ট ও পিপল ম্যানেজমেন্টের স্পর্শকাতর হিসাবনিকাশ শুরু হলো– তখনকার কিছু কথা। এই লেখার কয়েকটি পর্ব হতেও পারে, নাও পারে। পুরোটাই নির্ভর করছে আমার সুবিখ্যাত আলস্যের মেজাজ মর্জির উপর।

বাংলাদেশের সব করপোরেট অফিসে মালিকের একটা অলিখিত নিজস্ব সিস্টেম থাকেই, তবুও মোটা দাগে ম্যানেজারদের কাজ হয়, গুচ্ছের লোকজনদেরকে ক্রমাগত বিক্রয় ও উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ দেওয়া। বেশিরভাগ অফিসের চলনসই হিউম্যান রিসোর্স ( এইচআর) বিভাগও থাকে না। এমনকি বিদেশি যে সব এমএনসি ( মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি) আমাদের এখানে ব্যবসা করতে এসেছে, তাঁরাও এই দেশে এসে, কীভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হবে, কীভাবে কর্মচারীদের কম তেলে মুচমুচে ভাজতে হবে শিখে ফেলে। এবং এই শিক্ষণ পদ্ধতিতে সাহায্য আমাদের দক্ষ ম্যানেজাররাই করে। সার্বিকভাবে সকল কর্মচারীদের সুবিধা না দেখে, নিজের ব্যক্তিগত সুবিধাটি বুঝে নেওয়ার মতো বুদ্ধি বাঙালের সবসময়ই ছিল। তাই, নিজের গাড়ির মডেল বছর বছর বদলালেও ঐ বুদ্ধিমান ম্যানেজারদের অধীনস্থ কর্মচারীদের সুযোগসুবিধার কোন হিল্লে হয় না। নেগোশিয়েশনের মূল অংশটি বুদ্ধিমান ম্যানেজার করে ফেলেন।

বিদেশী মালিকদের দেখান, যে তিনি এই কোম্পানির কতো কতো টাকা বাঁচিয়ে দিলেন। এবং এই খরচ সাশ্রয়ের ভিতর দিয়ে তিনি মূলত নিজেকে কোম্পানির কাছে অপরিহার্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিদেশী কোম্পানিগুলোও দেখে, বাঙালকে দিয়েই যখন বাঙাল ম্যানেজ করা যাচ্ছে, তখন শুধু মিছে নিজেদের কাপড়ে নোংরা লাগানোর দরকার কী !
ম্যানেজমেন্টের যেহেতু কোন ট্রেনিং নেই আমাদের সিংহভাগ অফিসে। নবীন ম্যানেজারকে মালিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সে কী চায় বোঝার জন্য। আর বিখ্যাত ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতি তো আছেই। কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজারদেরকে চায়ের কাপের মডেল সিলেকশন থেকে শুরু করে, কোন কর্মচারী দ্বিতীয় বিয়ে করে পুলিশী মামলা খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে–সবই ম্যানেজ করতে হয়।

ব্যবসাবৃদ্ধির অপরিহার্য দায়িত্বের পাশাপাশি প্রথমদিকে পাবলিক রিলেশন মেইন্টেইন করা ছিল আমার জন্য নতুন কাজ । নতুন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানেই, সাপ্লাই/ভেন্ডর-বেইজের অনেক রথীমহারথীরা পদধূলি দিতেন। অনেকেই বিশুদ্ধ খাজুর আলাপ করতে আসতেন। নিজের কাজের ফাঁকে এই মালিক পক্ষ ও শিল্পকারখানার টপ ম্যানেজমেন্টকে আলাদা করে সময় দিতে হতো। জরুরী কাজ ফেলে রেখে ঘণ্টা ধরে তাঁদের জীবনের সাফল্য , বিত্তশালী হয়ে ওঠার গল্প মন দিয়ে শুনতাম। গল্প শোনার ফাঁকে অনেকেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, আমি এতোগুলো বছর ধরে এই সেক্টরে কাজ করে মূলত তেমন কিছুই ‘ফালাইতে’ পারি নাই । আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে করতে তাঁদের আগামী ভবিষ্যতের বহুবিধ গল্প আরো বেশি করে মন দিয়ে শুনতাম।

তো তখন, অনেকে আলাপের ফাঁকে এই কথা সেই কথা বলার পর, আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, ভাই সন্ধ্যার পর কি করেন? আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলতাম, ঢাকা শহরে অফিস থেকে বের হয়ে, কতক্ষণে আমি বাসায় পৌঁছবো সেই চিন্তায় থাকি রে ভাই। উল্লেখ্য, আমার দুই কন্যা তখন বেড়ে উঠছে। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে থাকত ওদের চিন্তা। কখন বাসায় পৌঁছব, একটা শাওয়ার দিয়ে, সাময়িক ক্লান্তি মুছে ফেলে, খাওয়া দাওয়া সেরে ওদের সঙ্গে খুনসুটি করব সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতাম। সুতরাং অফিস থেকে বাসায় পৌঁছানোই আমার মোক্ষ ছিল। কালেভদ্রে যদি আমার অদ্ভুতুড়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে ( রবিবার) যদি কোন আড্ডা বা অনুষ্ঠান ভাগ্যক্রমে সাংঘর্ষিক হয়ে যেতো, তবে সেটাতে হাজির হতাম। এমনও হয়েছে, মাসের পর মাস আমি কোন আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াতে ( যেটা এখনো জনস্বার্থে মূলত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বা শুক্রবার হয়ে থাকে) উপস্থিত হতে পারিনি। এক পর্যায়ে দেখা গেল, সবাই আমাকে হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিয়েই তাঁদের বিয়ে, জন্মদিন আর অন্যান্য অনুষ্ঠানের শিডিউল নির্ধারণ করছে।

আমি সন্ধ্যারাতে তেমন কিছুই করি না, সেটা শুনে অনেক উৎসাহী শুভাকাঙ্ক্ষী বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করতেন। সন্ধ্যার পর আমি কোন তরল পানীয়ের টানে, কোন বিনোদনের টানে, ক্লান্তি-হরণকারী কোনকিছুতে অংশগ্রহণ না করে বাসায় চলে যাই, সেটি সম্ভবত তাঁরা মেনে নিতে পারতেন না বা অন্য অনেকের সঙ্গে মেলাতে পারতেন না। একদিন একজন বলেই বসলেন, ‘আপনি এরকম বলেই, আপনার কিছুই হবে না ভাই !’ আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার এই সীমাবদ্ধতার কথা আমি বিলক্ষণ জানি। করপোরেট পৃথিবীতে আমার কয়েকটি পদন্নোতি আর মানুষের মুখে ‘ উনি ভাল মানুষ’ এর বাইরে আমার কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না, সেও আমি বহু আগেই বুঝে ফেলেছি।

এ তো গেল গত ১৪/১৫ বছর আগের কথা। তারপরে কতদিন, মাস, বছর চলে গেল। ঢাকা মেগা-সিটি হলো, রাস্তায় যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতি বা ৪ কি:মি: / ঘণ্টা হলো। মেট্রো-রেলের হুলুস্থুল শুরু হলো, ফ্লাইওভারে ঢাকা শহর ছেয়ে গেল। এখন গত কয়েকবছর ধরে আরেক ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। সফল উদ্যোক্তারা, শিল্পপতিরা নিজের সাফল্যের কথা বলতে বলতে আমাকে অনেকখানি করুণা করেই বলেন, ভাই আপনি আর কতদিন এই চাকরি-বাকরি, অন্যের দাস হয়ে থাকবেন? আপনার এতো অভিজ্ঞতা, একটা শিল্প-কারখানা নিদেন একটা অফিস দিয়ে বসেন। আমরা তো আছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আমার পরিচিত, স্বল্পপরিচিত , গণ্ডীর ভিতরের বাইরের কে বা কাহারা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে বনানী, গুলশানে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে এবং সমস্ত পরিবারকে কানাডা, আমেরিকায় স্থানান্তর করে নিজে এখন বিজনেস ক্লাসে আসা যাওয়ার ভিতরে আছে, সেই বিশাল লিস্ট শুনিয়ে দেন। আমি একে ভয়ঙ্কর অলস , যার ফলশ্রুতিতে প্রতিভার অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সামাজিক দৃষ্টিতে ব্যর্থ মানুষ। নিজের ব্যর্থতা আর সম্পত্তির সীমাবদ্ধতা নিয়ে এমনিতেই নিজের কাছেই নিজে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকি। এখন সেই কথা যদি সকাল বিকাল অন্য লোকেও বলা শুরু করে তাহলে আর যাই কোথায় ?

এখন, কেন সবাই উদ্যোক্তা হতে পারেন না, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হতে পারেন না। কেন সেনাবাহিনীতে অনেককেই মেজর পদমর্যাদা থেকেই অবসরে চলে যেতে হয়, অথবা কেন সারাজীবন একটা অকিঞ্চিৎকর জীবন যাপন করে যেতে হয়—সেসব তো আর একটা নির্দিষ্ট কারণে হয় না। অনেককিছু মিলিয়েই সেটা হয়ে থাকে। পৃথিবী এভাবেই চলে আসছে। তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা , পারিবারিক চাপ, সামাজিক বলয়, কর্মস্পৃহা, জীবনে কিছু একটা হয়ে ওঠার সেই তীব্রতম উত্তেজনা তো সবাই বহন করতে পারেন না। যার হয় তার ৯ বছরেই হয় ; যার হয় না , তার ৯০ বছরেও হয় না। এখন এই না হওয়াটাকে মেনে নেওয়া যায়। অথবা মেনে না নিয়ে জীবনপাত করে সমাজের উচ্চতম জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা যায়।

আমি আজন্ম অলস, আমি আমার নিজের কমফোর্ট জোন থেকে সেই দুগ্ধপোষ্য বয়স থেকেই বের হতে পারি নাই। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধকরি আমার মাতৃদুগ্ধ পানের ইতিহাস। আমি প্রায় ছয় বছর পর্যন্ত স্তন্যপায়ী ছিলাম। আমার অন্য দুই সহোদর ছয়মাস একবছরে স্তন্যপায়ী থেকে সাবালক হয়েছেন। অথচ , আমি কেমন করে যেন বছর ছয়েক পর্যন্ত স্তন্যপায়ী ছিলাম। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, নানাজনের নানা উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে আমাকে মাতৃস্তন থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনভাবেই কেউ সফল হয়নি। আম্মা মুরব্বীদের কথা শুনে বুকে নিমপাতা থেকে শুরু করে আরো অনেককিছুর প্রলেপ দিয়ে দেখেছেন। কিন্তু আমি সেইসব তুচ্ছ করে আমার অধিকার আদায় করে নিতাম। পুরোদমে ইশকুলগামী হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি যতদিন স্তন্যপায়ী ছিলাম, আম্মার সেই অমৃতধারাও বাধাহীন, অবিরত ছিল। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত, কেন রে দুষ্টু, তুই এখনো মাতৃস্তন নিয়ে জোরাজুরি করছিস, কিছুই তো পাওয়ার কথা না। আমি হা করে গালভর্তি দুগ্ধধারা তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে বোঝাতাম আমার বরাদ্দ তো থেমে যায়নি !
যাই হোক, কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম !

ওই যে বলছিলাম, সামান্য ও সাধারণ প্রাপ্তিতেই আমি ডুবে থাকি বা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। কুয়োর ব্যাঙের মতো, বাইরের আলোকিত পৃথিবী, সুবিশাল খাদ্য বৈচিত্র্যে লুব্ধ হওয়ার চেয়ে নিজেকে নিয়ে নিজের মতো থাকার কুঅভ্যাস আছে আমার। এখন এই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসে, জীবনানন্দের কাব্য দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি, সেলফ প্রোটেকশন নিই, নিজেকে শোনাই:

‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।’

আমি জানি , আমাকে সবাই মনে করিয়ে দেয় ; একটু ইচ্ছে করলেই আমি ‘জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতা’ পেতে পারতাম, এখনো চাইলেই পারি। কিন্তু কী যে করি, এই আজন্ম আলস্যের জন্যই সেই সাফল্য আমার চার-দেয়ালের বাইরে মাথা কুটে মরে গেল,আর আমি রইলাম আমার কমফোর্ট জোনে। নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে না যাওয়ার এই সাফল্য-বিধ্বংসী চারিত্রিক কুঅভ্যাসের পাশাপাশি নিজেকে অন্যভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আজ এই দুই-যুগের কর্পোরেট জীবনে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান অসংখ্য উদ্যোক্তাদের আমি কুটিরশিল্প থেকে বৃহদায়তন শিল্পকারখানার মালিক হতে দেখেছি। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় , সমবয়সী অথবা আমার অনেক কম বয়েসের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণদের দেখেছি, তাঁরা জানেন কীভাবে দুইহাতে বুনো মোষের শিং ধরে নিজের পায়ের তলায় আনতে হয়। দেখেছি, কী অপরিসীম পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে সমাজের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত শক্তিমত্ত মানুষে পরিণত হতে হয়।

আমি যেখানে ছিলাম, মোটের উপর কিছু বেতন ও পদবী-বৃদ্ধিসহ সেখানেই পড়ে আছি। আমার অবস্থা হয়েছে, গ্রামের প্রাইমারী ইশকুলের সেই শিক্ষকদের মতো। বছরের পর বছর , যুগের পর যুগ অসংখ্য কচিকাঁচা তাঁদের চারপাশ দিয়ে হাইস্কুল, কলেজ, বিসিএস দিয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ পুলিশ, কেউ আমলা, কেউ মন্ত্রী হয়ে যান। কিন্তু প্রাইমারী ইশকুলের শিক্ষককে সেই সীমাবদ্ধ জীবন ও জগত নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। এখন বোধকরি নতুন করে জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা বহন করবার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। বাকীজীবন শিক্ষকসুলভ ঔদার্যে অন্যের সাফল্যে আনন্দ লাভ করাই শ্রেয় মনে করছি।

প্রথম প্রকাশ: ২৬শে মার্চ, ২০২২