আমি যখন করপোরেট দুনিয়ায় ম্যানেজার বা সোজা-বাংলায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলাম ; যখন আমার দৈনন্দিন দায়িত্বের বাইরে অফিস ম্যানেজমেন্ট ও পিপল ম্যানেজমেন্টের স্পর্শকাতর হিসাবনিকাশ শুরু হলো– তখনকার কিছু কথা। এই লেখার কয়েকটি পর্ব হতেও পারে, নাও পারে। পুরোটাই নির্ভর করছে আমার সুবিখ্যাত আলস্যের মেজাজ মর্জির উপর।
বাংলাদেশের সব করপোরেট অফিসে মালিকের একটা অলিখিত নিজস্ব সিস্টেম থাকেই, তবুও মোটা দাগে ম্যানেজারদের কাজ হয়, গুচ্ছের লোকজনদেরকে ক্রমাগত বিক্রয় ও উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ দেওয়া। বেশিরভাগ অফিসের চলনসই হিউম্যান রিসোর্স ( এইচআর) বিভাগও থাকে না। এমনকি বিদেশি যে সব এমএনসি ( মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানি) আমাদের এখানে ব্যবসা করতে এসেছে, তাঁরাও এই দেশে এসে, কীভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দিতে হবে, কীভাবে কর্মচারীদের কম তেলে মুচমুচে ভাজতে হবে শিখে ফেলে। এবং এই শিক্ষণ পদ্ধতিতে সাহায্য আমাদের দক্ষ ম্যানেজাররাই করে। সার্বিকভাবে সকল কর্মচারীদের সুবিধা না দেখে, নিজের ব্যক্তিগত সুবিধাটি বুঝে নেওয়ার মতো বুদ্ধি বাঙালের সবসময়ই ছিল। তাই, নিজের গাড়ির মডেল বছর বছর বদলালেও ঐ বুদ্ধিমান ম্যানেজারদের অধীনস্থ কর্মচারীদের সুযোগসুবিধার কোন হিল্লে হয় না। নেগোশিয়েশনের মূল অংশটি বুদ্ধিমান ম্যানেজার করে ফেলেন।
বিদেশী মালিকদের দেখান, যে তিনি এই কোম্পানির কতো কতো টাকা বাঁচিয়ে দিলেন। এবং এই খরচ সাশ্রয়ের ভিতর দিয়ে তিনি মূলত নিজেকে কোম্পানির কাছে অপরিহার্য প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিদেশী কোম্পানিগুলোও দেখে, বাঙালকে দিয়েই যখন বাঙাল ম্যানেজ করা যাচ্ছে, তখন শুধু মিছে নিজেদের কাপড়ে নোংরা লাগানোর দরকার কী !
ম্যানেজমেন্টের যেহেতু কোন ট্রেনিং নেই আমাদের সিংহভাগ অফিসে। নবীন ম্যানেজারকে মালিকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সে কী চায় বোঝার জন্য। আর বিখ্যাত ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতি তো আছেই। কর্পোরেট অফিসের ম্যানেজারদেরকে চায়ের কাপের মডেল সিলেকশন থেকে শুরু করে, কোন কর্মচারী দ্বিতীয় বিয়ে করে পুলিশী মামলা খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে–সবই ম্যানেজ করতে হয়।
ব্যবসাবৃদ্ধির অপরিহার্য দায়িত্বের পাশাপাশি প্রথমদিকে পাবলিক রিলেশন মেইন্টেইন করা ছিল আমার জন্য নতুন কাজ । নতুন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানেই, সাপ্লাই/ভেন্ডর-বেইজের অনেক রথীমহারথীরা পদধূলি দিতেন। অনেকেই বিশুদ্ধ খাজুর আলাপ করতে আসতেন। নিজের কাজের ফাঁকে এই মালিক পক্ষ ও শিল্পকারখানার টপ ম্যানেজমেন্টকে আলাদা করে সময় দিতে হতো। জরুরী কাজ ফেলে রেখে ঘণ্টা ধরে তাঁদের জীবনের সাফল্য , বিত্তশালী হয়ে ওঠার গল্প মন দিয়ে শুনতাম। গল্প শোনার ফাঁকে অনেকেই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন, আমি এতোগুলো বছর ধরে এই সেক্টরে কাজ করে মূলত তেমন কিছুই ‘ফালাইতে’ পারি নাই । আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে করতে তাঁদের আগামী ভবিষ্যতের বহুবিধ গল্প আরো বেশি করে মন দিয়ে শুনতাম।
তো তখন, অনেকে আলাপের ফাঁকে এই কথা সেই কথা বলার পর, আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, ভাই সন্ধ্যার পর কি করেন? আমি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলতাম, ঢাকা শহরে অফিস থেকে বের হয়ে, কতক্ষণে আমি বাসায় পৌঁছবো সেই চিন্তায় থাকি রে ভাই। উল্লেখ্য, আমার দুই কন্যা তখন বেড়ে উঠছে। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে থাকত ওদের চিন্তা। কখন বাসায় পৌঁছব, একটা শাওয়ার দিয়ে, সাময়িক ক্লান্তি মুছে ফেলে, খাওয়া দাওয়া সেরে ওদের সঙ্গে খুনসুটি করব সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতাম। সুতরাং অফিস থেকে বাসায় পৌঁছানোই আমার মোক্ষ ছিল। কালেভদ্রে যদি আমার অদ্ভুতুড়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে ( রবিবার) যদি কোন আড্ডা বা অনুষ্ঠান ভাগ্যক্রমে সাংঘর্ষিক হয়ে যেতো, তবে সেটাতে হাজির হতাম। এমনও হয়েছে, মাসের পর মাস আমি কোন আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াতে ( যেটা এখনো জনস্বার্থে মূলত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বা শুক্রবার হয়ে থাকে) উপস্থিত হতে পারিনি। এক পর্যায়ে দেখা গেল, সবাই আমাকে হিসাবের খাতা থেকে বাদ দিয়েই তাঁদের বিয়ে, জন্মদিন আর অন্যান্য অনুষ্ঠানের শিডিউল নির্ধারণ করছে।
আমি সন্ধ্যারাতে তেমন কিছুই করি না, সেটা শুনে অনেক উৎসাহী শুভাকাঙ্ক্ষী বিস্ময় ও উষ্মা প্রকাশ করতেন। সন্ধ্যার পর আমি কোন তরল পানীয়ের টানে, কোন বিনোদনের টানে, ক্লান্তি-হরণকারী কোনকিছুতে অংশগ্রহণ না করে বাসায় চলে যাই, সেটি সম্ভবত তাঁরা মেনে নিতে পারতেন না বা অন্য অনেকের সঙ্গে মেলাতে পারতেন না। একদিন একজন বলেই বসলেন, ‘আপনি এরকম বলেই, আপনার কিছুই হবে না ভাই !’ আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার এই সীমাবদ্ধতার কথা আমি বিলক্ষণ জানি। করপোরেট পৃথিবীতে আমার কয়েকটি পদন্নোতি আর মানুষের মুখে ‘ উনি ভাল মানুষ’ এর বাইরে আমার কিছুই অর্জন করা সম্ভব হবে না, সেও আমি বহু আগেই বুঝে ফেলেছি।
এ তো গেল গত ১৪/১৫ বছর আগের কথা। তারপরে কতদিন, মাস, বছর চলে গেল। ঢাকা মেগা-সিটি হলো, রাস্তায় যানবাহনের গতি মানুষের হাঁটার গতি বা ৪ কি:মি: / ঘণ্টা হলো। মেট্রো-রেলের হুলুস্থুল শুরু হলো, ফ্লাইওভারে ঢাকা শহর ছেয়ে গেল। এখন গত কয়েকবছর ধরে আরেক ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। সফল উদ্যোক্তারা, শিল্পপতিরা নিজের সাফল্যের কথা বলতে বলতে আমাকে অনেকখানি করুণা করেই বলেন, ভাই আপনি আর কতদিন এই চাকরি-বাকরি, অন্যের দাস হয়ে থাকবেন? আপনার এতো অভিজ্ঞতা, একটা শিল্প-কারখানা নিদেন একটা অফিস দিয়ে বসেন। আমরা তো আছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আমার পরিচিত, স্বল্পপরিচিত , গণ্ডীর ভিতরের বাইরের কে বা কাহারা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে বনানী, গুলশানে ফ্ল্যাট করে ফেলেছে এবং সমস্ত পরিবারকে কানাডা, আমেরিকায় স্থানান্তর করে নিজে এখন বিজনেস ক্লাসে আসা যাওয়ার ভিতরে আছে, সেই বিশাল লিস্ট শুনিয়ে দেন। আমি একে ভয়ঙ্কর অলস , যার ফলশ্রুতিতে প্রতিভার অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান সামাজিক দৃষ্টিতে ব্যর্থ মানুষ। নিজের ব্যর্থতা আর সম্পত্তির সীমাবদ্ধতা নিয়ে এমনিতেই নিজের কাছেই নিজে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকি। এখন সেই কথা যদি সকাল বিকাল অন্য লোকেও বলা শুরু করে তাহলে আর যাই কোথায় ?
এখন, কেন সবাই উদ্যোক্তা হতে পারেন না, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হতে পারেন না। কেন সেনাবাহিনীতে অনেককেই মেজর পদমর্যাদা থেকেই অবসরে চলে যেতে হয়, অথবা কেন সারাজীবন একটা অকিঞ্চিৎকর জীবন যাপন করে যেতে হয়—সেসব তো আর একটা নির্দিষ্ট কারণে হয় না। অনেককিছু মিলিয়েই সেটা হয়ে থাকে। পৃথিবী এভাবেই চলে আসছে। তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা , পারিবারিক চাপ, সামাজিক বলয়, কর্মস্পৃহা, জীবনে কিছু একটা হয়ে ওঠার সেই তীব্রতম উত্তেজনা তো সবাই বহন করতে পারেন না। যার হয় তার ৯ বছরেই হয় ; যার হয় না , তার ৯০ বছরেও হয় না। এখন এই না হওয়াটাকে মেনে নেওয়া যায়। অথবা মেনে না নিয়ে জীবনপাত করে সমাজের উচ্চতম জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা যায়।
আমি আজন্ম অলস, আমি আমার নিজের কমফোর্ট জোন থেকে সেই দুগ্ধপোষ্য বয়স থেকেই বের হতে পারি নাই। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধকরি আমার মাতৃদুগ্ধ পানের ইতিহাস। আমি প্রায় ছয় বছর পর্যন্ত স্তন্যপায়ী ছিলাম। আমার অন্য দুই সহোদর ছয়মাস একবছরে স্তন্যপায়ী থেকে সাবালক হয়েছেন। অথচ , আমি কেমন করে যেন বছর ছয়েক পর্যন্ত স্তন্যপায়ী ছিলাম। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, নানাজনের নানা উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে আমাকে মাতৃস্তন থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনভাবেই কেউ সফল হয়নি। আম্মা মুরব্বীদের কথা শুনে বুকে নিমপাতা থেকে শুরু করে আরো অনেককিছুর প্রলেপ দিয়ে দেখেছেন। কিন্তু আমি সেইসব তুচ্ছ করে আমার অধিকার আদায় করে নিতাম। পুরোদমে ইশকুলগামী হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি যতদিন স্তন্যপায়ী ছিলাম, আম্মার সেই অমৃতধারাও বাধাহীন, অবিরত ছিল। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত, কেন রে দুষ্টু, তুই এখনো মাতৃস্তন নিয়ে জোরাজুরি করছিস, কিছুই তো পাওয়ার কথা না। আমি হা করে গালভর্তি দুগ্ধধারা তাঁকে দেখিয়ে দিয়ে বোঝাতাম আমার বরাদ্দ তো থেমে যায়নি !
যাই হোক, কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম !
ওই যে বলছিলাম, সামান্য ও সাধারণ প্রাপ্তিতেই আমি ডুবে থাকি বা থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। কুয়োর ব্যাঙের মতো, বাইরের আলোকিত পৃথিবী, সুবিশাল খাদ্য বৈচিত্র্যে লুব্ধ হওয়ার চেয়ে নিজেকে নিয়ে নিজের মতো থাকার কুঅভ্যাস আছে আমার। এখন এই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে এসে, জীবনানন্দের কাব্য দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি, সেলফ প্রোটেকশন নিই, নিজেকে শোনাই:
‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।’
আমি জানি , আমাকে সবাই মনে করিয়ে দেয় ; একটু ইচ্ছে করলেই আমি ‘জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতা’ পেতে পারতাম, এখনো চাইলেই পারি। কিন্তু কী যে করি, এই আজন্ম আলস্যের জন্যই সেই সাফল্য আমার চার-দেয়ালের বাইরে মাথা কুটে মরে গেল,আর আমি রইলাম আমার কমফোর্ট জোনে। নিজের কমফোর্ট জোনের বাইরে না যাওয়ার এই সাফল্য-বিধ্বংসী চারিত্রিক কুঅভ্যাসের পাশাপাশি নিজেকে অন্যভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আজ এই দুই-যুগের কর্পোরেট জীবনে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান অসংখ্য উদ্যোক্তাদের আমি কুটিরশিল্প থেকে বৃহদায়তন শিল্পকারখানার মালিক হতে দেখেছি। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় , সমবয়সী অথবা আমার অনেক কম বয়েসের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণদের দেখেছি, তাঁরা জানেন কীভাবে দুইহাতে বুনো মোষের শিং ধরে নিজের পায়ের তলায় আনতে হয়। দেখেছি, কী অপরিসীম পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে সমাজের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত শক্তিমত্ত মানুষে পরিণত হতে হয়।
আমি যেখানে ছিলাম, মোটের উপর কিছু বেতন ও পদবী-বৃদ্ধিসহ সেখানেই পড়ে আছি। আমার অবস্থা হয়েছে, গ্রামের প্রাইমারী ইশকুলের সেই শিক্ষকদের মতো। বছরের পর বছর , যুগের পর যুগ অসংখ্য কচিকাঁচা তাঁদের চারপাশ দিয়ে হাইস্কুল, কলেজ, বিসিএস দিয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকৌশলী, কেউ পুলিশ, কেউ আমলা, কেউ মন্ত্রী হয়ে যান। কিন্তু প্রাইমারী ইশকুলের শিক্ষককে সেই সীমাবদ্ধ জীবন ও জগত নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। এখন বোধকরি নতুন করে জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা বহন করবার শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। বাকীজীবন শিক্ষকসুলভ ঔদার্যে অন্যের সাফল্যে আনন্দ লাভ করাই শ্রেয় মনে করছি।
প্রথম প্রকাশ: ২৬শে মার্চ, ২০২২
সাম্প্রতিক মন্তব্য