অনেক আগে পড়া একটা সায়েন্স ফিকশন মাথায় ঘুরছে। A Sound of Thunder ( Ray Brudbury; 1952) উল্লেখ্য , একসময় আমি তিনবেলা খাওয়ার মতো প্রায় নিয়মিত বই পড়তাম। এখন তিনবেলার জায়গায় ছয় বেলা খাই, তবে বই পড়ি না। গুগোলকে জিজ্ঞাসা করতেই লিংক দিয়ে দিল। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।

http://teacherweb.com/ON/SacredHeartHighSchool/MrStriukas/A_Sound_of_Thunder.pdf

গল্পের দৃশ্যপট আমেরিকা । ১৯৫২ সালের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের কয়েকদিন পর। মিঃ কিথ জিতেছেন। সবাই খুশী। বিরোধী দলের প্রার্থী মিঃ ডয়েসার মানবতাবিরোধী, প্রগতিবিরোধী। বলা হচ্ছিল, মিঃ ডয়েসার জিতলে আমেরিকাকে প্রাগৈতিহাসিক ১৪৯২ সালের দিকে নিয়ে যেতেন। ভাগ্যিস মিঃ ডয়েসার জেতেন নাই।

ঘটনার নায়ক এক্‌লিস একটা টাইম মেশিনের অফিসে বসে দেয়ালে ঝুলে থাকা নোটিশ দেখছেনঃ

TIME SAFARI, INC.

SAFARIS TO ANY YEAR IN THE PAST.

YOU NAME THE ANIMAL.

WE TAKE YOU THERE.

YOU SHOOT IT.

৬০ মিলিয়ন বছর আগে যেতে পারবেন, ডাইনোসর শিকার করতে পারবেন। ফিরেও আসতে পারবেন, কিন্ত কঠিন কয়েকটা শর্ত মেনে চলতে হবে। ভবিষ্যতের কোন কিছু আপনি দূর অতীতে ফেলে আসতে পারবেন না, কিছু নিয়েও আসতে পারবেন না। যে প্রানীটি কোন প্রাকৃতিক কারণে মিনিট দু’য়েকের মধ্যে মারা যাবে ( গাছের ডাল ভেঙ্গে বা অন্য কারণে) তাকেই গুলি করতে পারবেন, শিকার করতে পারবেন। বুলেটটাও ফেরত নিয়ে আসতে হবে। ছবি তুলতে পারবেন। নির্দিষ্ট ধাতব পথের বাইরে পা ফেলতে পারবেন না। সোজা কথা ট্যুর গাইডের কথার বাইরে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কিছুই করা যাবে না।

নানা অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে এক্‌লিস সবকিছুই ঠিকমতো করে, শুধু অসাবধানে একটা প্রজাপতি তার পায়ের তলায় পড়ে মারা যায়। খুবই সামান্য,কিন্তু ৬০ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যায়। অভিযানকারীরা ফিরে আসেন। কিন্তু কোথায় যেন একটু পরিবর্তন সূক্ষ্ণ একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে টের পান । বাতাসের গন্ধে , রিসেপশনে সেই একই লোক, ঘরের রং আসবাব সবই আগের মতোই, তবু কীরকম একটা অস্বস্তি।

প্রবেশমুখের সাইনবোর্ডের দিকে এক্‌লিসের নজর যায়।

TYME SEFARI INC.

SEFARIS TU ANY YEER EN THE PAST.

YU NAIM THE ANIMALL.

WEE TAEK YU THAIR.

YU SHOOT ITT.

ইংরেজী লেখাগুলোর ধরণ অন্যরকম।

জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে ভালো মানুষটিকে প্রেসিডেন্ট পদে আমেরিকায় নির্বাচিত হতে দেখে গিয়েছিলেন তাঁরা , তার যায়গায় সেই প্রগতিবিরোধী অপজিশন প্রার্থী এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

এক্‌লিস বুঝতে পারে, ৬০ মিলিয়ন বছর আগের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা প্রজাপতির অবহেলার অসাবধান মৃত্যু তাকে অন্য এক পরিবর্তিত পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।

এক্‌লিস হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের তলার মৃত সোনালী প্রজাপতিটিকে আঁকড়ে ধরে গুঙিয়ে উঠে প্রার্থনা করে, আমরা কী আবার ফিরে যেতে পারিনা? আমরা কী এই প্রজাপতিটিকে জীবিত করতে পারিনা? আমরা কী আবার শুরু করতে পারিনা ?

ট্যুর গাইড ট্রাভিস এক্‌লিসের দিকে রাইফেল তাক করে, ঘরের মাঝে বজ্রপাতের মতো একটা গুলির শব্দ শোনা যায়। গল্পের শেষ এইখানেই।

কিন্তু এই থিমের উপরে হলিউডে অসংখ্য ছবি হয়েছে, এখনো হয়ে যাচ্ছে।

Back to The Future; It’s a Wonderful Life ; Frequency ; The Butterfly Effect; হাল আমলের Terminator ; Man In Black এই ধাঁচের ছবি।

পরবর্তীতে Butterfly Effectদারুণ জনপ্রিয় একটা শব্দে পরিণত হয়।

Chaos Theory তে Butterfly Effectকে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অবস্থানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে বৃহৎ কোন পরিবর্তন। আমাজানের জঙ্গলে প্রজাপতির ডানার ঝাপটানির দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া প্রভাব ফেলতে পারে প্রশান্ত মহাসাগরের টর্নেডোতে।

কয়েকসপ্তাহ আগে আগে হিন্দি একটা ছবি দেখছিলাম, মাদ্রাজ ক্যাফে( Madras Cafe )

পটভূমি ৮০ দশকে ভারতের শ্রীলংকার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আগ্রাসী হস্তক্ষেপ এবং LTTE (Tamil Tigers) এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। একটা জনগোষ্ঠীর জাতিগত লড়াই। রক্তক্ষয়ী ২৭ বছরের যুদ্ধে ( ১৯৮২—২০০৯) প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু। উইকি অনুযায়ী, প্রায় ২৭,৬৩৯ জন তামিল টাইগার্স, ২৩,৭৯০ শ্রীলংকান সৈন্য ও পুলিশ, ১১৫৫ জন ভারতীয় সৈন্য, ১০ হাজারেরও বেশী সাধারণ জনগণ। জিঘাংসার রাজনীতির বলি ইন্দিরা পুত্র রাজীব গান্ধীর আত্মঘাতী বোমায় হত্যা। রাজীব গান্ধীর মৃত্যু তামিল টাইগার্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত করে ফেলে। ভারত হারায় তার প্রধানমন্ত্রীকে, তামিল টাইগার্স হারায় তার ভবিষ্যৎ । এঁরা যে সময়ের সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেটা সবাই বুঝে যায়। সন্ত্রাস দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে কেউ সহানুভূতি পায়নি আজ পর্যন্ত।

নায়কের কথাটা ভালো লাগে , “জো হাম দেখ্‌তে হ্যাঁয় শুন্‌তে হ্যাঁয়, সাচ স্রিফ উত্‌না নেহি হোতা।” আমরা যা দেখি , যা শুনি সত্য শুধু ওইটুকুই নয় ।

আমার মনে হয়, প্রত্যেক রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা থাকে। ভারতের আছে। আমেরিকার আছে, চীনের আছে, সোভিয়েত রাশিয়ার আছে, জার্মানের আছে। পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে ৩৬৫ দিনে সূর্য পরিক্রমা করে । প্রতিটি দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনাও বাস্তবতা। সেটা সে তার সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্যই করে থাকে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতায় রাষ্ট্র হওয়াতে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভ কি কি, সেইটা ব্যাখ্যা করতে আমার মতো নির্বোধকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না । বিশাল সেনা খরচ বাঁচিয়ে সামান্য কিছু বিএসএফ দিয়ে সীমান্ত রক্ষায় গত তেতাল্লিশ বছরে ভারতের কত হাজার বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে, আমার নয় ।

শোনা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধূলিসাৎ করতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল। গর্বাচেভদের একটা জেনারেশনকে পুঁজিবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করে সময়মতো কাজে লাগানোর জন্য, আমেরিকাকে অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে।

আমাদের দেশের এতোবড় সেনাবাহিনীর দরকার কি ? খুব কমন প্রশ্ন।

আমার পরিচিত এক সেনাবিশেষজ্ঞের মতে, এই সেনাবাহিনী আছে বলে আমাদের সার্বভৌমত্ব টিকে আছে। মায়ানমার আমাদের আক্রমন করার আগে ম্যান অ্যাগেইন্সট ম্যান, বুলেট অ্যাগেইন্সট বুলেট হিসাব করবে। মানে আমাদের সীমান্ত দখল করতে হলে, আমাদের সমস্ত সেনাবাহিনীকে নিঃশেষ করতে হবে, সেটা হবে উভমুখী। সমপরিমাণ সৈন্য তাদেরও ক্ষয় করতে হবে। সুতরাং মায়ানমার চৌদ্দবার ভাববে আমাদের সীমান্ত আক্রমন করার আগে।

এই যে আমাদের আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষানীতি পাশের আরেকটি দেশের স্বৈরশাসক সামরিকজান্তাকে তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করছে। এইটা আমাদের আমজনতার বোঝার কথা না। আপনি হয়তো টকশোর পেইড বক্তার কথা রেফারেন্স হিসাবে নিয়ে এসে তর্ক করা শুরু করবেন। তীব্র ভারতবিদ্বেষী হয়ে যাবেন। ঘটনাপ্রবাহ ঘেঁটে দেখার সময় আমাদের নাই। আমরা দুই মিনিটের ম্যাগী নুডলসে তৃপ্ত।

আরেকটা কল্পকাহিনী মনে পড়ছে। কল্পকাহিনীর লেখকের নাম মনে নাই। ধরেন পিঁপড়াদের অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে একটা প্রজাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে হঠাৎ অসম্ভব উন্নতি করে ফেললো। ধরেন তাদের বসবাস এক বিরাট মাঠের মধ্যে, তাঁরা তাদের চারপাশের এই বিশ্বের রহস্য, সৃষ্টিরহস্য উদঘাটন করতে চাইল। তাঁরা পারবে কি? রানী পিঁপড়া বছর ত্রিশেক বাঁচলেও কর্মী বাঁচে বছর তিনেক। সুতরাং তিন বছর ধরে পায়ে হেঁটে ওই সভ্য জ্ঞানী পিঁপড়ার দল এই মাঠের কতটুকু অতিক্রম করবে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কী কী বুঝতে পারবে, সৃষ্টি রহস্যের কী উদ্ধার করতে পারবে ?

আমাদের অবস্থা প্রায়শঃ ওই জ্ঞানী পিঁপড়ার মতোই । এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক রহস্যকে আমীমাংসিত রেখেই আমাদের চলে যেতে হবে।

প্রকাশকালঃ ১২ই জুন, ২০১৫