স্মাইল প্লিজ।। তারাপদ রায়

স্মাইল প্লিজ, আপনারা প্রত্যেকেই একটু হাসুন,
দয়া করে তাড়াতাড়ি, তা না হলে রোদ পড়ে গেলে
আপনারা যে রকম চাইছেন তেমন হবে না,
তেমন উঠবে না ছবি। আপনার ঘড়িটা ডানদিকে
আর একটু, একটু সোজা করে প্লিজ, আপনি কি বলছেন
ঘাড়-টাড় সোজা করে দাঁড়ানো হ্যাবিট নেই, তবে,
কি বলছেন অনেকদিন, অনেকদিন হাসার অভ্যাস,
হাসার-ও অভ্যাস নেই? এদিকে যে রোদ পড়ে এলো
এ রকম ঘাড়গোঁজা বিমর্ষ মুখের একদল
মানুষের গ্রুপফটো, ফটো অনেকদিন থেকে যায়,
ব্রমাইড জ্বলে যেতে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর।
বিশ-পঁচিশ বছর পরে যদি কোনো পুরোনো দেয়ালে
কিংবা কোনো অ্যালবামে এরকম ফটো কেউ দেখে,
কি বলবেন, বলবেন, ক্যামেরাম্যানের ত্রুটি ছিলো,
ঘাড় ঠিকই সোজা ছিলো, সব শালা ক্যামেরাম্যানের
সেই এক বোকার শাটারে এই রকম ঘটেছে।

সরস্বতী।। বুদ্ধদেব বসু

লক্ষ্মী দেবী ভালোমানুষ
অসংখ্য তাঁর ভক্ত,
সরস্বতীর খামখেয়ালে
নাগাল পাওয়া শক্ত ।
পুজো তাঁকে করতে হবে
সপ্তাহে সাতদিনই,
তাই বলে যে তুষ্ট হবেন
তেমন তো নন ইনি ।
সন্ধে , সকাল, রাত-দুপুরেও
সাধতে হবে তোমায়,
কোনোমতেই সইবে না তাঁর
একটি বেলা কামাই ।
কিন্তু যদি চিন্তা করো –
মিটল মনোবাঞ্ছা ?
দেখবে তখন আরো অনেক
দুরে তোমার প্রাণ চায় ।
হঠাৎ যদি একটি কোনো
বর দিয়ে দেন দৈবে ,
ভেব না সেই ভাগ্য তোমার
চিরটা কাল রইবে ।
দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিতে
দিব্যি তিনি পারেন ,
ডান হাতে যা আজকে দিলেন
বাঁ হাতে কাল কাড়েন।
এইজন্যে সরস্বতীর
নেই পপুলারিটি,
পদ্মবনে একলা তাঁকে
দুরে রাখাই রীতি ।
লক্ষ্মী আছেন ঘরে-ঘরে
মা-কাকিমার যত্নে,
সরস্বতীর বেস্পতিবার
কারোই তাতে মত নেই।
মায়ের পাশে লক্ষ্মীদেবী
মন্দিরে জীবন্ত,
কোথাও আছে একটিও কি
সরস্বতীর জন্য ?
বেশি কী আর – বাংলা ভাষার
কাণ্ড দ্যাখো লক্ষ্যি ,
ভালো হলেই ছেলে-বুড়ো
সক্কলে হয় ‘লক্ষ্মী’ ।
পাপ্‌পা যখন পড়তে বসে
বেলুন-বাঁশি ফেলে,
তখন তারে কেউ কি বলে
‘সরস্বতী ছেলে’ ?

বর্ষ ২১ সংখ্যা ১৪ । ১ ফাল্গুন ১৩৬০। ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪

দুটি কবিতা।। শিবরাম চক্রবর্তী

।। ১ ।।
ও … ওই বাড়ীর ছাদে একটি মেয়ে।
আর আমি একলা এখানে
আমার ব্যলকনির ডেক চেয়ারে।
মেয়েটি আমার দিকে ভুলেও কখনো তাকায় না।
কিন্তু আমি তাকালেই সে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কী করে যে টের পায় কে জানে !

।। ২ ।।
একটা বয়েস এলেই নাকি ব্যর্থতাবোধ এসে যায়।
কিন্তু কেউ-কেউ আবার ব্যর্থতাবোধ নিয়ে জন্মায় ;
সে খুব ভাগ্যবান ।
সে কিছুই আশা করে না, কেননা তার পাবার কিছু নেইকো,
পাওনা নেই তার কোনোখানেই ।
(তবুও এই দুনিয়ার একেবারেরি কিছু না পেয়ে
শুধু হাতে যাবার কারো জো আছে নাকি ? )
তাই যখন সে যা পায় তাই তার কাছে অভাবিত ;
তাই তার কাছে পরমাশ্চর্য—পরমার্থ-উপায় !
কেননা কোনো কিছুর পরেই নেই তার কোনো দাবি তো ;
তাই একটুখানি বর্ষণেই তার ধূসর মরু প্লাবিত।
তাই সর্বদাই তার মনে হয় সে বুঝি ব্যর্থ হয়,
পড়ে-পাওয়া চৌদ্দ আনাই ত লাভ তার !
যদিও সেই চৌদ্দ আনার ষোলো আনাই ফাঁকি ।।

বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ৭ । ২৯ অগ্রাহয়ণ ১৩৭৪। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৬৭

বড়ে গোলাম।। পূর্নেন্দুশেখর পত্রী

ফুলের গন্ধে ফোটার জন্যে
নারীর স্পর্শ পাবার জন্যে
ঘুমের মধ্যে কাঁদতে-কাঁদতে
আমরা যেদিন যুবক হলাম
বাইরে তখন বৃক্ষে বৃক্ষে
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
আমাদের সেই কান্না নিয়ে
গান ধরেছে বড়ে গোলাম।
ফুলের কাছে নারীর কাছে
বুকের বিপুল ব্যাথার কাছে
বেদনাবহ যে-সব কথা
বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম
তাঁরাই যখন ফিরে আসে
কেউ ললিতে কেউ বিভাসে
স্পন্দনে তাঁর বুঝতে পারি
বুকের মধ্যে বড়ে গোলাম।

বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২৯ । ২১ বৈশাখ ১৩৭৫। ৪ মে ১৯৬৮

টুল।। সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আপিসবাড়ির দেয়ালে
সিঁড়ির কোণগুলোতে
ঝাঁঝরির আগে পিছে,
কার্নিসের ঢালে
লাল ফিতের নকলে
চাপা-পড়া ফাইলের কথা
মক্কেলদের মনে করিয়ে দেয়
পানের পিক ।
এ-নেতা সে-নেতার শ্রাদ্ধ করতে থাকে
উঠোন জুড়ে
বি-এ পাস
থুথু ।
টিফিনের সময়কার
অক্ষরযুক্ত ঠোঙার কাগজের মত
আর নিরক্ষর শালপাতার মত
অসংখ্য বেকার
এ-দাদা সে-দাদার পায়ে আঠার মত লেগে
পানের পিক আর থুথু দিয়ে
আরও একটা প্রজন্ম বরবাদ করতে
করজোড়ে প্রার্থনা করছে
ঘরের ভেতর একটা মাছি-মারা চেয়ার
কিংবা নিদেনপক্ষে
বারান্দায় বসে ঢুলবার জন্যে
একটা টুল ।।

বর্ষ ৪২ সংখ্যা ২৩ । ২২ চৈত্র ১৩৮১। ৫ এপ্রিল ১৯৭৫

উত্তরাধিকার।।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ

তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর

ফুসফুস-ভরা হাসি

দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হ’য়ে শুয়ে থাকা

এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভ’রে নাও আমার অবেলা

আমার দুঃখবিহীন দুঃখ ক্রোধ শিহরণ

নবীন কিশোর, তোমাকে দিলাম আমার যা-কিছু ছুল আভরণ

জ্বলন্ত বুকে কফির চুমুক, সিগারেট চুরি, জানালার পাশে

বালিকার প্রতি বারবার ভুল

পরুষ বাক্য, কবিতার কাছে হাঁটু মুড়ে বসা, ছুরির ঝলক

অভিমানে মানুষ কিংবা মানুষের মত আর যা-কিছুর

বুক চিরে দেখা

আত্মহনন, শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত

একখানা নদী, দু’তিনটে দেশ, কয়েকটি নারী —

এ-সবই আমার পুরোনো পোষাক, বড় প্রিয় ছিল, এখন শরীরে

আঁট হয়ে বসে, মানায় না আর

তোমাকে দিলাম, নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও

অথবা ঘৃণায় দূরে ফেলে দাও, যা খুশি তোমার

তোমাকে আমার তোমার বয়সী সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়।