আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে ।। হুমায়ুন আজাদ

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
আমার খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিলো অন্যদের জীবাণু,
আমার নিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম, আমি বেড়ে উঠেছিলাম,
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মত দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম নিজস্ব ভঙ্গিতে,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম আমার আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মোলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ কখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয় নি।
আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আমার আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলাপড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মত ময়লাধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম.
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মত মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলঙ্কার।
আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম।
এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোন অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মত চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বিশাল বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্যে পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্যে নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জড়িয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে-পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচেছিলাম
অন্যদের সময়ে।

 

“আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে ।। হুমায়ুন আজাদ”

এক জন্ম।।তারাপদ রায় ।

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

লোকটা জানলই না।। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।

বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায়! হায় !
লোকটার ইহকাল পরকাল গেল !

অথচ আর একটু নীচে
হাত দিলেই সে পেত
আলাদ্বীনের আশ্চর্য- প্রদীপ,
তার হৃদয় !

লোকটা জানলোই না !

তার কড়ি গাছে কড়ি হল ।
লক্ষ্মী এলেন
রণ-পায়ে

দেয়াল দিল পাহাড়া
ছোটলোক হাওয়া
যেন ঢুকতে না পারে !

তারপর
একদিন
গোগ্রাসে গিলতে গিলতে
দু-আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে

কখন
খসে পড়ল তার জীবন-
লোকটা জানলই না !

ঊনিশশো চৌত্রিশের।। জীবনানন্দ দাশ।

একটা মোটরকারখটকা নিয়ে আসে।

মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস,

যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে

রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর

আলোর সন্তানদের মধ্যে

তার নাম সবচেয়ে প্রথম।

একটা অন্ধকার জিনিস :

পরিষ্কার ভোরের বেলা

দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে হাঁটতে

হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি

লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে

হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে

উনিশশো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার

ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে;

পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে,

ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বধূর মতো

সহসা অগোচর

মাঠ নদী যেন নিশ্চেষ্ট,

সহসা যেন প্রতীজ্ঞা হারিয়ে ফেলে,

এই মোটর অগ্রদূত,

সে ছুটে চলেছে

যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত;

একটা মোটরকারের পথ

সব সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,

অন্ধকারের মতো।

স্ট্যান্ডে

শহরের বিরাট ময়দানের পুবে পশ্চিমে-ফুটপাথের পাশে

মোটারকার;

নিঃশব্দ।

মাথায় হুড

ভিতরের বুরুশ-করা গভীর গদিগুলো

পালিশ স্টিয়ারিং-হুইল হেডলাইট;

কী নিয়ে স্থির?

কলকাতার ময়দানের একটা গাছ অন্য কিছু নিয়ে স্থির,

আমি অন্যকিছু নিয়ে স্থির;

মোটরের স্থিরতা একটা অন্ধকার জিনিস

একটা অন্ধকার জিনিস :

রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে

প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায়

সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে

অসংখ্য তারের মতো,

রাতের উল্কার মতো,

মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো

তারাও চলেছে;

কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।

একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার

সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,

অন্ধকারের মতো।

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;

আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,

পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।

জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা

অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :

আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ

হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

নক্ষত্রের নিচে।

“ঊনিশশো চৌত্রিশের” (জীবনানন্দ দাশ।)

ভাল লাগে। জয় গোস্বামী।।

‘সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।’

এই কথা বলবার সাহস

জীবনে হল না।

জীবনও তো শেষ হল প্রায়।

কত আগে থেকে চিনতাম।

ভাল লাগত আপনাকে-

একবারও বলিনি।

আজও লাগল।

খেয়ালই করিনি কেউ দেড়ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে

কথা বলছি রাসবিহারী মোড়ে।

বাইরের লোকের মুখে কতদিন পরে শুনলেন

বাড়ির পুরনো ডাকনাম।

আপনার অবাক হওয়া, ছেলেমানুষের মতো খুশি হওয়া দেখে

ভাল লাগল। ভাল লাগত। আপনার মত ভাল কাউকে

লাগেনি।

কত কত দিন আগে থেকে—

বলিনি তখন।

আজ বললাম।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ।জীবনানন্দ দাশ।।

আশাবাদী বলেই কিনা জানিনা, অন্য সবার হাপিত্যেশে একমত পোষণ করতে পারছিনা । কেন আপনার মনে হচ্ছে এই অদ্ভুত আঁধার প্রথমবারের মতো এসেছে পৃথিবীতে ! এই আঁধার হাজারবছর আগেও ছিল, কয়েকশো বছর আগে তো ছিলই ; বছর পঞ্চাশেক আগেও জীবনানন্দ দেখেছিলেন।

“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা ;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া ।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় ।”
অদ্ভুত আঁধার এক-জীবনানন্দ দাশ