by Jahid | Nov 27, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন, দর্শন
‘আমি কিছুতেই বুঝব না’- এইরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাউকে কিছু বোঝানো অসম্ভব। প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাধররা নিজের বোঝার বাইরে কিছু বুঝতে চান না- সে যেভাবেই তাঁদেরকে বোঝানো হোক না কেন।
বঙ্কিমের ‘ কমলাকান্তের দপ্তর’-এর কমলাকান্ত চারপাশে অজস্র।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে অনুল্লেখ্য রেখে বরং বছর তিরিশেক আগে আমার এক মামার কাছে শোনা পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
তো , হয়েছে কি গ্রামে এক শহরের শিক্ষিত লোক বেড়াতে গেছেন। মাঠে গিয়ে দেখেন এক চাষি হাল চাষ করছে, লাঙল- জোয়ালে দুইটা বলদ বাঁধা। চাষির সঙ্গে তার বছর আটেকের ছেলে।
কিছুক্ষণ হাল চষা দেখে শহুরে ভদ্রলোক বললেন, তোমার ডানপাশের বলদটি বেশি পরিশ্রম হচ্ছে বাঁ পাশেরটির তুলনায়। কমসময়ে ভাল ফল পেতে হলে , দক্ষতা বাড়াতে হলে, নির্দিষ্ট সময় পরপর বলদগুলোকে ডানে-বামে অদলবদল করে ফেল।
চাষি তর্ক শুরু করল। কারণ সে পুরুষানুক্রমে বহুবছর ধরে সে এই কাজই করে আসছে। এই ধরনের আজগুবি কথা আগে কেউ তাকে বলে নি।
ভদ্রলোক এক পর্যায়ে বললেন, আমি তোমাকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি, কি করে ডানের বলদটি বেশি পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
চাষিও তেরিয়া গলায় বলল, ঠিক আছে! আপনি যদি আমাক বুঝোতে পারেন, তাহলে ডানের বলদটা আপনাক্ আমি দিয়ে দেব।
চাষির ছোট্ট ছেলেটি পুরো ব্যাপারটা ভয়ার্ত চোখে দেখছিল।
ভদ্রলোক কেন্দ্রাতিগ বল বোঝালেন, কেন্দ্রাভিমুখী বল বোঝালেন। ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে বলে ডানের বলদের উপরে চাপ বেশি পড়ছে তাই পরিশ্রম বেশি হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি নানাভাবে বোঝালেন। চাষি কিছুতেই বোঝে না।
ঘণ্টাখানেক বুঝিয়ে ক্লান্ত , ব্যর্থমনোরথ হয়ে অবশেষে হাঁটা দিলেন নিজের পথে।
লোকটি চলে যাওয়ার পরে ছোট ছেলেটি বলল, বাজান উনি যদি সত্যি তুমাক বুঝো ফেলত, তুমি কি ডানের বলদটা তাক দিয়ে দিতা ?
চাষি হেসে বলল, আরে ব্যাটা – আমি যদি না বুঝি , আমাক্ বুঝায় কোন্ শালা !
by Jahid | Nov 27, 2020 | দর্শন, শিল্প ও সংস্কৃতি, সাহিত্য
বছর তিনেক আগে কেন্দ্রে দেখা করতে এল কয়েকজন তরুণ কবি। দলপতি ছেলেটা পুরোদস্তুর বাগ্মী। দু-চারটে কথা থেকেই বোঝা গেল, সাহিত্যের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্যেই তাদের আসা। বাগ্মিতার বিপুল শক্তি নিয়ে সে বলে যেতে লাগলঃ
“ ষাটের দশকে আপনার সম্পাদনায় বেরিয়েছিল ‘ কণ্ঠস্বর’ – ওই দশকের তরুণ লেখকেরা সেদিন সমবেত হয়েছিল পত্রিকাটিকে ঘিরে। কী উত্তেজনার অস্বস্ত দিন সেসব, কল্পনা করতেও ভালো লাগে।”
“কিন্তু দশ বছরও পার হল না, পত্রিকাটি বন্ধ করে আপনি চলে গেলেন টেলিভিশনে। সবার কাছে আপনার অবস্থান ত্যাগের কারণ হিশেবে দেখিয়ে গেলেন নেহাতই এক খোঁড়া যুক্তি। লিখলেনঃ ‘ যৌবনের মৃত্যুই সুন্দর।’ অথচ ভেবে দেখুন, তরুণ লেখকদের মধ্যে কী উদ্দীপনাই না চলেছিল পত্রিকাটিকে ঘিরে। ”
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলতে গিয়ে খানিকটা বোধহয় হাঁপিয়েই উঠেছিল কবি-বাগ্মী। কিছুটা দম নিয়ে ফের বলতে শুরু করলঃ
“ আজ এতগুলো বছর ধরে ‘ কণ্ঠস্বর’ বন্ধ। আপনিই বলুন, আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে এরচেয়ে বড় ধরনের শত্রুতা একালে আর কেউ কি করেছে? কিন্তু যা যাবার তা গেছে। সুখের বিষয় , সম্ভাবনাময় নতুন ভূমিকায় জেগে ওঠার আরেকটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ হঠাৎ করেই এসে গেছে ‘ কণ্ঠস্বর’ এর সামনে। সে সুযোগ যেমন আচমকা তেমনি সম্মানজনক । কেউ লক্ষ করুন আর নাই করুন, গত দুই দশকের ভেতর দিয়ে আমাদের কাল ও ভূগোল নতুন একটা জীবনানুভূতিতে জেগে উঠে নতুন একটা পালাবদল ঘটিয়ে ফেলেছে আমাদের সাহিত্যের অঙ্গনে। আর সেই উত্থানের পেছনে পেছনে আজ এই আশির দশকের শুরুতে একটা সম্পূর্ণ নতুন সাহিত্যদল এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সাহিত্যের দোরগোড়ায়। না, এসে দাঁড়ায়নি শুধু, তারা আজ উদ্যত, একত্রিত, সমবেত। সবই আছে তাদের । ইচ্ছা, চেষ্টা, আত্মদান, শ্রম, প্রতিভা—কোনোকিছুরই ঘাটতি নেই। অভাব শুধু একটা ছোট্ট জিনিশের—তাদের এই উদ্দীপ্ত প্রেরণার একটা মুখপত্র—তাদের জ্বলন্ত চৈতন্যের একটা অগ্নিময় প্রতিনিধি। হ্যাঁ , একটা পত্রিকা— একটা রক্তিম জ্বলজ্বলে প্রাণবন্ত পত্রিকা, যার মধ্যদিয়ে এই নতুন যুগের শক্তিমান প্রবল নিষ্টুর আলোড়ন উৎক্ষিপ্ত হবে নিজস্ব জ্বালামুখ দিয়ে। আমাদের অনুরোধ, আলসেমি ফেলে ‘ কণ্ঠস্বর’ আর একবার বের করুন আপনি। আপনার নেতৃত্বে ‘ কণ্ঠস্বর’ আবার জ্বলে উঠুক দুদশক আগের মতোই—বেগবান তারুণ্যের অনিবার্য মুখপত্র হিশেবে—তবে এবার ফুরিয়ে যাওয়া ষাটের জীবনানুভূতি নিয়ে নয়—আশির দশকের টগবগে তারুণ্যের উদ্যত প্রতিভূ হিশেবে। ”
সিরাজউদ্দৌলা নাটকে নবারের শেষ সংলাপের মতোই তাঁর ভাষণের বিষণ্ন আকুতি যেন উতল হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে যেতে লাগল। সে একইভাবে বলে চললঃ
‘ কণ্ঠস্বর’ বের করার দায়িত্বটা কষ্ট করে আরেকবার শুধু নিন আপনি। ভেবে দেখুন, আপনার সামান্য একটু কষ্টের ওপর কতবড় একটা বিস্ফোরণ অপেক্ষা করে আছে। শুধু এটুকু পেলেই আশির দশকের শক্তিমান তারুণ্য উদ্যত তলোয়ারের মতো আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারবে আর এ সমস্ত কিছুই সম্ভব শুধু আপনার তুচ্ছ একটু দায়িত্ব নেওয়ার ওপর।”
অনেকক্ষণ একটানা শুনে একসময় আস্তে করে তাকে বললাম, যা বুঝলাম তার মানে তো একটাইঃ “ যৌবন তোমার আর বেদনা আমার , তাই না?”
হঠাৎ ঘা খেয়ে যেন চমকে উঠল কবি-বাগ্মী। অনুরোধের অসঙ্গতিটুকু টের পেয়েই যেন , সলজ্জ মুখে, থেমে পড়ল সে।
বললামঃ এভাবে কি হয়? প্রতিটা নতুন কালই তার পাশব দাবি নিয়ে এসে দাঁড়ায় সেই যুগের শক্তিমান তারুণ্যের সামনে। নিজেদের স্বেদ রক্ত আত্মোৎসর্গ দিয়ে সে দাবি তাদের মেটাতে হয়। আমাদের যুগ-চৈতন্য যেসব নতুন অজানিত বক্তব্য উচ্চারণের দাবি নিয়ে আমাদের সামনে এসেছিল, সাধ্যমতো যত্নে আমরা সে ঋণ শোধের চেষ্টা করেছি। তোমাদের কাল ও ভূগোলের ঋণ তোমাদেরই শোধ করতে হবে। আমাদের নির্বীজ বার্ধক্য দিয়ে তোমাদের তারুণ্যের প্রতিকার আমারা কী করে করব?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ; বিস্রস্ত জর্নাল; ২৯.১০.৮৯
by Jahid | Nov 25, 2020 | ছিন্নপত্র, দর্শন
ছোট্ট দুইটা গল্প বছর ত্রিশেক আগে শোনা। স্মৃতি থেকে লিখছি। অনেকেরই মূল গল্পদু’টো হয়তো আরেকটু ভাল করে জানা আছে ।
গল্প ১ :
বহুদিন আগের কথা , সমাজে টোল ছিল , পাঠশালা ছিল, পণ্ডিতও ছিল। এবং নদী পার হওয়ার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। এখন অনেক নদী ও খালই হেঁটে পার হওয়া যায় ।
তো একদিন এক পন্ডিত নৌকায় নদী পার হচ্ছিলেন । নিজের পান্ডিত্য জাহির করতে অক্ষরজ্ঞানহীন মাঝিকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলেন,
: মাঝি তুমি কি ত্রিকোণমিতি জানো?
: নাহ্।
:তবেতো তোমার জীবনের চার আনাই মিছে।
: তুমি মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু বলতে পারো?
: না তো।
: তবেতো তোমার জীবনের আট আনাই মিছে।
: তুমি কি পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন সম্পর্কে ধারণা আছে ?
: এগুলো কি খায় নাকি গায়ে মাখে বাবু সাব?
: তোমারতো দেখি জীবনের বারো আনাই বৃথা !
এমন সময় নদীতে ঝড় উঠলো । বড় বড় ঢেউ এসে নৌকায় আঘাত করা শুরু করলো। পন্ডিতও ডুবে মরার শঙ্কায় থরথর করে কাঁপতে লাগল।
দূরাবস্থা দেখে মাঝি বললো, বাবু সাব আপনি কি সাঁতার জানেন?
: না। সাঁতারতো জানিনা।
মাঝি হাসি দিয়ে বললেন, জনাব! আপনার দেখি জীবনের ষোল আনাই মিছে !
গল্প ২ :
খেয়া নৌকারও আগের কথা। নদী পার হওয়া নিশ্চয়ই আরো ঝক্কির ছিল। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া জনমনিষ্যিহীন শূন্য ঘাট পড়ে থাকতো । নদীর পাশে কোন এক জনপদে একদল সন্ন্যাসী বাস করত। একজন সদগুরুও ছিলেন। অনেক শিষ্যের মাঝে একনিষ্ঠ এক শিষ্য সাধনায় গুরুকেও প্রায় হার মানিয়ে দিল।
দীর্ঘ একযুগের সাধনার পরে শিষ্য এসে গুরুকে বললো, গুরু আমি এখন সাধনার বলে পানির উপরে হাঁটতে পারি, হেঁটে নদী পার হতে পারি।
শিষ্য পরিবেষ্টিত গুরু উল্টো প্রশ্ন করলেন , নদী পার হতে কয় আনা লাগে রে ?
: চার আনা।
: বারো বৎসরের সাধনায় তুই মাত্র চার আনার শিক্ষা অর্জন করলি !
ফুটনোট : গুরু সৈয়দ মুজতবা আলী বলে গেছেন, হাতির দু’ই রকম দাঁত থাকে, একটা দেখানোর আরেকটা খাওয়ার ! অনেক গল্পের দ্বৈত অর্থ থাকে। উপরের গুলোরও হয়তো আছে, হয়তো নেই !
by Jahid | Nov 25, 2020 | দর্শন, শিল্প ও সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি
অনেক আগে পড়া একটা সায়েন্স ফিকশন মাথায় ঘুরছে। A Sound of Thunder ( Ray Brudbury; 1952) উল্লেখ্য , একসময় আমি তিনবেলা খাওয়ার মতো প্রায় নিয়মিত বই পড়তাম। এখন তিনবেলার জায়গায় ছয় বেলা খাই, তবে বই পড়ি না। গুগোলকে জিজ্ঞাসা করতেই লিংক দিয়ে দিল। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
http://teacherweb.com/ON/SacredHeartHighSchool/MrStriukas/A_Sound_of_Thunder.pdf
গল্পের দৃশ্যপট আমেরিকা । ১৯৫২ সালের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের কয়েকদিন পর। মিঃ কিথ জিতেছেন। সবাই খুশী। বিরোধী দলের প্রার্থী মিঃ ডয়েসার মানবতাবিরোধী, প্রগতিবিরোধী। বলা হচ্ছিল, মিঃ ডয়েসার জিতলে আমেরিকাকে প্রাগৈতিহাসিক ১৪৯২ সালের দিকে নিয়ে যেতেন। ভাগ্যিস মিঃ ডয়েসার জেতেন নাই।
ঘটনার নায়ক এক্লিস একটা টাইম মেশিনের অফিসে বসে দেয়ালে ঝুলে থাকা নোটিশ দেখছেনঃ
TIME SAFARI, INC.
SAFARIS TO ANY YEAR IN THE PAST.
YOU NAME THE ANIMAL.
WE TAKE YOU THERE.
YOU SHOOT IT.
৬০ মিলিয়ন বছর আগে যেতে পারবেন, ডাইনোসর শিকার করতে পারবেন। ফিরেও আসতে পারবেন, কিন্ত কঠিন কয়েকটা শর্ত মেনে চলতে হবে। ভবিষ্যতের কোন কিছু আপনি দূর অতীতে ফেলে আসতে পারবেন না, কিছু নিয়েও আসতে পারবেন না। যে প্রানীটি কোন প্রাকৃতিক কারণে মিনিট দু’য়েকের মধ্যে মারা যাবে ( গাছের ডাল ভেঙ্গে বা অন্য কারণে) তাকেই গুলি করতে পারবেন, শিকার করতে পারবেন। বুলেটটাও ফেরত নিয়ে আসতে হবে। ছবি তুলতে পারবেন। নির্দিষ্ট ধাতব পথের বাইরে পা ফেলতে পারবেন না। সোজা কথা ট্যুর গাইডের কথার বাইরে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কিছুই করা যাবে না।
নানা অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে এক্লিস সবকিছুই ঠিকমতো করে, শুধু অসাবধানে একটা প্রজাপতি তার পায়ের তলায় পড়ে মারা যায়। খুবই সামান্য,কিন্তু ৬০ মিলিয়ন বছরের ব্যবধানে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যায়। অভিযানকারীরা ফিরে আসেন। কিন্তু কোথায় যেন একটু পরিবর্তন সূক্ষ্ণ একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে টের পান । বাতাসের গন্ধে , রিসেপশনে সেই একই লোক, ঘরের রং আসবাব সবই আগের মতোই, তবু কীরকম একটা অস্বস্তি।
প্রবেশমুখের সাইনবোর্ডের দিকে এক্লিসের নজর যায়।
TYME SEFARI INC.
SEFARIS TU ANY YEER EN THE PAST.
YU NAIM THE ANIMALL.
WEE TAEK YU THAIR.
YU SHOOT ITT.
ইংরেজী লেখাগুলোর ধরণ অন্যরকম।
জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে ভালো মানুষটিকে প্রেসিডেন্ট পদে আমেরিকায় নির্বাচিত হতে দেখে গিয়েছিলেন তাঁরা , তার যায়গায় সেই প্রগতিবিরোধী অপজিশন প্রার্থী এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।
এক্লিস বুঝতে পারে, ৬০ মিলিয়ন বছর আগের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা প্রজাপতির অবহেলার অসাবধান মৃত্যু তাকে অন্য এক পরিবর্তিত পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।
এক্লিস হাঁটু গেড়ে বসে পায়ের তলার মৃত সোনালী প্রজাপতিটিকে আঁকড়ে ধরে গুঙিয়ে উঠে প্রার্থনা করে, আমরা কী আবার ফিরে যেতে পারিনা? আমরা কী এই প্রজাপতিটিকে জীবিত করতে পারিনা? আমরা কী আবার শুরু করতে পারিনা ?
ট্যুর গাইড ট্রাভিস এক্লিসের দিকে রাইফেল তাক করে, ঘরের মাঝে বজ্রপাতের মতো একটা গুলির শব্দ শোনা যায়। গল্পের শেষ এইখানেই।
কিন্তু এই থিমের উপরে হলিউডে অসংখ্য ছবি হয়েছে, এখনো হয়ে যাচ্ছে।
Back to The Future; It’s a Wonderful Life ; Frequency ; The Butterfly Effect; হাল আমলের Terminator ; Man In Black এই ধাঁচের ছবি।
পরবর্তীতে Butterfly Effectদারুণ জনপ্রিয় একটা শব্দে পরিণত হয়।
Chaos Theory তে Butterfly Effectকে বলা হয়েছে, প্রাথমিক অবস্থানের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে বৃহৎ কোন পরিবর্তন। আমাজানের জঙ্গলে প্রজাপতির ডানার ঝাপটানির দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া প্রভাব ফেলতে পারে প্রশান্ত মহাসাগরের টর্নেডোতে।
কয়েকসপ্তাহ আগে আগে হিন্দি একটা ছবি দেখছিলাম, মাদ্রাজ ক্যাফে( Madras Cafe )
পটভূমি ৮০ দশকে ভারতের শ্রীলংকার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আগ্রাসী হস্তক্ষেপ এবং LTTE (Tamil Tigers) এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। একটা জনগোষ্ঠীর জাতিগত লড়াই। রক্তক্ষয়ী ২৭ বছরের যুদ্ধে ( ১৯৮২—২০০৯) প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু। উইকি অনুযায়ী, প্রায় ২৭,৬৩৯ জন তামিল টাইগার্স, ২৩,৭৯০ শ্রীলংকান সৈন্য ও পুলিশ, ১১৫৫ জন ভারতীয় সৈন্য, ১০ হাজারেরও বেশী সাধারণ জনগণ। জিঘাংসার রাজনীতির বলি ইন্দিরা পুত্র রাজীব গান্ধীর আত্মঘাতী বোমায় হত্যা। রাজীব গান্ধীর মৃত্যু তামিল টাইগার্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত করে ফেলে। ভারত হারায় তার প্রধানমন্ত্রীকে, তামিল টাইগার্স হারায় তার ভবিষ্যৎ । এঁরা যে সময়ের সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেটা সবাই বুঝে যায়। সন্ত্রাস দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে কেউ সহানুভূতি পায়নি আজ পর্যন্ত।
নায়কের কথাটা ভালো লাগে , “জো হাম দেখ্তে হ্যাঁয় শুন্তে হ্যাঁয়, সাচ স্রিফ উত্না নেহি হোতা।” আমরা যা দেখি , যা শুনি সত্য শুধু ওইটুকুই নয় ।
আমার মনে হয়, প্রত্যেক রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা থাকে। ভারতের আছে। আমেরিকার আছে, চীনের আছে, সোভিয়েত রাশিয়ার আছে, জার্মানের আছে। পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে ৩৬৫ দিনে সূর্য পরিক্রমা করে । প্রতিটি দেশের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনাও বাস্তবতা। সেটা সে তার সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্যই করে থাকে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতায় রাষ্ট্র হওয়াতে ভারতের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক লাভ কি কি, সেইটা ব্যাখ্যা করতে আমার মতো নির্বোধকেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয় না । বিশাল সেনা খরচ বাঁচিয়ে সামান্য কিছু বিএসএফ দিয়ে সীমান্ত রক্ষায় গত তেতাল্লিশ বছরে ভারতের কত হাজার বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে, আমার নয় ।
শোনা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধূলিসাৎ করতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল। গর্বাচেভদের একটা জেনারেশনকে পুঁজিবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করে সময়মতো কাজে লাগানোর জন্য, আমেরিকাকে অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে।
আমাদের দেশের এতোবড় সেনাবাহিনীর দরকার কি ? খুব কমন প্রশ্ন।
আমার পরিচিত এক সেনাবিশেষজ্ঞের মতে, এই সেনাবাহিনী আছে বলে আমাদের সার্বভৌমত্ব টিকে আছে। মায়ানমার আমাদের আক্রমন করার আগে ম্যান অ্যাগেইন্সট ম্যান, বুলেট অ্যাগেইন্সট বুলেট হিসাব করবে। মানে আমাদের সীমান্ত দখল করতে হলে, আমাদের সমস্ত সেনাবাহিনীকে নিঃশেষ করতে হবে, সেটা হবে উভমুখী। সমপরিমাণ সৈন্য তাদেরও ক্ষয় করতে হবে। সুতরাং মায়ানমার চৌদ্দবার ভাববে আমাদের সীমান্ত আক্রমন করার আগে।
এই যে আমাদের আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষানীতি পাশের আরেকটি দেশের স্বৈরশাসক সামরিকজান্তাকে তার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করছে। এইটা আমাদের আমজনতার বোঝার কথা না। আপনি হয়তো টকশোর পেইড বক্তার কথা রেফারেন্স হিসাবে নিয়ে এসে তর্ক করা শুরু করবেন। তীব্র ভারতবিদ্বেষী হয়ে যাবেন। ঘটনাপ্রবাহ ঘেঁটে দেখার সময় আমাদের নাই। আমরা দুই মিনিটের ম্যাগী নুডলসে তৃপ্ত।
আরেকটা কল্পকাহিনী মনে পড়ছে। কল্পকাহিনীর লেখকের নাম মনে নাই। ধরেন পিঁপড়াদের অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে একটা প্রজাতি জ্ঞানবিজ্ঞানে হঠাৎ অসম্ভব উন্নতি করে ফেললো। ধরেন তাদের বসবাস এক বিরাট মাঠের মধ্যে, তাঁরা তাদের চারপাশের এই বিশ্বের রহস্য, সৃষ্টিরহস্য উদঘাটন করতে চাইল। তাঁরা পারবে কি? রানী পিঁপড়া বছর ত্রিশেক বাঁচলেও কর্মী বাঁচে বছর তিনেক। সুতরাং তিন বছর ধরে পায়ে হেঁটে ওই সভ্য জ্ঞানী পিঁপড়ার দল এই মাঠের কতটুকু অতিক্রম করবে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কী কী বুঝতে পারবে, সৃষ্টি রহস্যের কী উদ্ধার করতে পারবে ?
আমাদের অবস্থা প্রায়শঃ ওই জ্ঞানী পিঁপড়ার মতোই । এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক রহস্যকে আমীমাংসিত রেখেই আমাদের চলে যেতে হবে।
প্রকাশকালঃ ১২ই জুন, ২০১৫
by Jahid | Nov 25, 2020 | দর্শন, শিল্প ও সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি
অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটা কর্তব্য ব’লে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্ত রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। বাঙালি প্রতিবেশীর ঘরবাড়ির ওপর বিনিদ্র চোখ রাখে, ওই বাড়িতে কে বা কারা আসে, কখন আসে ও যায়, সব সংবাদ রাখে, এবং সংবাদ বানায়। বাঙালির ঘরবাড়িতে যে দরোজাজানালা লাগানোর ব্যবস্থা আছে, এটা আপত্তিকর ব্যাপার প্রতিবেশীর চোখে। বাঙালি কারো সাথে দেখা করতে এলে দরোজায় কড়া নাড়ে, ডাকে; সাড়া না পেলে পাড়া মাতিয়ে তোলে, এমনকি দরোজা ভেঙে ঘরে ঢোকার উপক্রম করে। বাঙালির চোখে ব্যক্তিগত জীবন পাপ; বাঙালি মনে করে দরোজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়; তাই তার দায়িত্ব অন্যের দরোজা ভেঙে ঢুকে তাকে পাপ থেকে উদ্ধার করা। তবে বাঙালি উদ্ধার করে না, অন্যকে বিপদে ফেলাই তার সমস্ত উদ্বেগের উদ্দেশ্য। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর আরেকটি দিক হচ্ছে কুৎসা রটনা। বাঙালি কুৎসা রটিয়ে সুখ পায়; আর এ-কুৎসা যদি যৌন হয়, তাহলে তা সর্বশ্রেষ্ঠ। বাঙালি একটি নিন্দাকেই বড়ো নিন্দা মনে করে, তা হচ্ছে লাম্পট্য নিন্দা। কোনো পুরুষকে লম্পট অথবা কোনো নারীকে ভ্রষ্টা হিশেবে চিহ্নিত করে দিতে পারলে বাঙালি জীবন সার্থক হয়েছে ব’লে মনে করে।
বাঙালির যৌনজীবন একটি ভয়ংকর ট্যাবো। ওই জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না; কিছু লেখা হয় না। ওটাকে নিষিদ্ধ জীবনও বলা যায়। এক আশ্চর্য সন্দেহজনক গোপনীয়তায় ঢাকা ওই জীবন, যেনো তার আলোচনা পাপ। এ থেকেই বোঝা যায় তার ওই জীবনটি পঙ্কিল, দূষিত, অপরাধপূর্ণ, অস্বাভাবিক ও সুখশূণ্য। বাঙালি যৌন ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী; প্রতিটি পুরুষ একেকটি ক্যাসানোভা, কিন্তু তাদের কামনা সাধারণত অচরিতার্থই থাকে, তাই ভরা থাকে নানা বিকৃতিতে। কিশোরেরা বাঙলায় জড়িত যৌনবিকৃতিতে, যুবকেরা সময় কাটায় যৌনক্ষুধায়, বয়স্ক ও বৃদ্ধরাও তাই। অধিকাংশ বাঙালিই যৌনআলোচনায় সুখ পায়, অন্যের যৌনজীবন নিয়ে কুৎসা রটায়; বড়োদের আলোচনার বড়ো অংশ যৌনতাবিষয়ক। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ভন্ড তারা; তাদের কাছে এ-সম্পর্কিত কিছু জানতে গেলে তারা এমন ভাব করে যেনো তারা যৌনতার কথা কখনো শোনে নি; কাম কী তারা জানে না। বাঙালির জীবনের এ-অংশটি বিকৃত। বাঙালিসন্তান এ-বিষয়ে কোনো শিক্ষা পায় না; নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জানে না; তাদের আচরণ ও ব্যবহার জানে না। পরোক্ষভাবে তারা কতোগুলো সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধের মুখোমুখি হয়। ওই নিষেধগুলো পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। বাঙালির যৌনজীবনে বিজ্ঞান নেই, কলাও নেই; রয়েছে পাশবিকতা। বাঙালির যৌবন অতিবাহিত হয় অবদমিত যৌন কামনাবাসনায়, যার ফল বিকৃতি। ধর্ষণ বাঙলায় প্রাত্যহিক ঘটনা, বাঙালিকে ধর্ষণকারী জাতিও বলা যায়। এর মূলে রয়েছে সুস্থ যৌনজীবনের অভাব। পশ্চিমে যে-বয়সে তরুণতরুণীরা ঘনিষ্ট হয়, সুখ আহরণ করে, সে-বয়সটা বাঙালির কাটে প্রচন্ড যন্ত্রণায়। বাঙালির যৌবনমাত্রই ব্যর্থ, ও যন্ত্রণাপীড়িত। সুস্থ মানুষ ধর্ষণ করে না; অসুস্থরা ধর্ষণ না করে পারে না। বাঙালির বিবাহবহির্ভূত যৌনজীবন ছোটো নয়, তারা খোঁজে থাকে এ-সুযুগের; কিন্তু বিবাহিত যৌনজীবনই তার শরীর কামনা পরিতৃপ্তির প্রধান স্থল। এ-ক্ষেত্রে বাঙালি কি তৃপ্ত? এ-সম্পর্কে কোনো সমীক্ষা পাওয়া যায় না; আলোচনা পাওয়া যায় না কোনো। বাঙালি এ-ক্ষেত্রে পরিতৃপ্ত নয়; শুধু অপরিতৃপ্তই নয়, প্রচন্ড অসুখী। বাঙালির যৌনক্ষেত্রে পুরুষ সক্রিয় কর্মী; নারী নিষ্ক্রিয় শয্যামাত্র। পুরুষ নিজের সাময়িক সুখ ছাড়া আর কিছু ভাবে না, সঙ্গিনীও যে সুখী হ’তে চায়, তা জানে না; কখনো জানার কথা ভাবে না। বাঙালি নারীপুরুষ পরিতৃপ্তির সাথে পরস্পরকে উপভোগ করে না। উপভোগের ধারণাও তাদের নেই। যে-প্রশান্তি, স্বাস্থ্য ও নিরুদ্বেগ পরিবেশ প্রয়োজন পরিতৃপ্তির জন্যে, তা নেই অধিকাংশ বাঙালির। তাই বাঙালি অনুপ্রাণিত হওয়ার সাথে সাথেই উপসংহারে পৌছে; এটা তার জীবনের সংক্ষিপ্ততম কাজ; যদিও এটা বৃহত্তম কাজ জীবনে। এখানে যে-অপরিতৃপ্তি, তা ঘিরে থাকে বাঙালি সমগ্র জীবন; তাকে রুগ্ন ক’রে রাখে। এ-রুগ্নতার ফল বাঙালির হঠাৎ-জাগা কামনা। বাঙালি নারী দেখলেই তাকে কাম্য বস্তু মনে করে, মনে মনে রমণ করে। এমন যৌনঅসুস্থ জাতি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুস্থ হ’তে পারে না।
একটা রোগ আগে বাঙালির ছিলো না; কিন্তু গত দু-দশকে উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ওই রোগটির, যার নাম ‘স্থানচ্যুতির অস্থিরতা বা বৈকাল্য’। বৃটিশ পর্বে বাঙালি জানতো সমাজে তার স্থান কোথায়, যে চাষী হবে, না হবে দারোগা, না কেরানি, না মেজিস্ট্রেট? পাকিস্থাপর্বেও জানতো কী হ’তে পারে সে; তার স্বপ্নের একটি নির্দিষ্ট সীমা ছিলো। দু-দশকে ওই সীমাটি ভেঙ্গে গেছে; বাঙালি এখন যা কিছু হতে পারে। যার স্বপ্ন সে দেখে নি, তা সে পেতে পারে; যার যোগ্যতা সে অর্জন করে নি, সে তার প্রভু হ’তে পারে। যার হওয়ার কথা ছিল বা যে সুখী বোধ করত নিম্নপদস্থ হয়ে, সে হঠাৎ একদিন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে উচ্চপদে; যে-কেরানিও হতে পারতো না, সে মন্ত্রনালয়ের প্রভু হচ্ছে; যার কথা ছিলো অসরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো অধ্যাপক হচ্ছে। যার বাসে ঝোলার কথা ছিলো, সে হঠাৎ হয়ে উঠছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ফলে চারিদিকে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। পদ আর ব্যক্তিটির মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হচ্ছে না, পদটিকে মনে হচ্ছে ব্যক্তিটির ওপরে, বা ব্যক্তিটির মাথার ওপর চেপে আছে পদটি। চারপাশে এখন দেখা যাচ্ছে স্থানচ্যুতি রোগটি। তাই কোথাও কিছু চলছে না ঠিক মতো। চারিদিকে বিকলন।
পশ্রীকাতরতা, বলা যাক পরোন্নতিকাতরতা- কারণ কারোই শ্রী নেই এখন, বাঙালির একটি স্থায়ী রোগ। পিতামাতার জিনক্রোমোসোমের সাথে, ছেচল্লিশের দ্বিগুণ হয়ে, এটি সংক্রমিত হয় বাঙালির সত্তায়। কারো ভালো দেখতে নেই, এমন একটি জন্মলব্ধ জ্ঞান নিয়ে আসে বাঙালি; আর চারপাশে যা দেখে, তাতে উত্তেজিত থাকে সবসময়। তবে বাঙালি শত্রুর উন্নতিতে যতটা কাতর হয়, তারচেয়ে বেশি কাতর হয় বন্ধুর উন্নতিতে। উন্নতির ক্ষেত্রে বন্ধুই বাঙালির শত্রু। শত্রুর উন্নতি ঘটলে যে-বিষ ঢোকে বাঙালির শরীরে, তা মধুর করা যায় নিন্দা ক’রে; কিন্তু বন্ধুর উন্নতিতে রক্তনালি দিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিষকে কিছুতেই মধুর করা যায় না। একটিই উপায় আছে , সেটি বন্ধুবিচ্ছেদ। উন্নতিকাতরতা রোগটি হয়তো জন্মসূত্রে পাওয়া নয় বাঙালির, পাওয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূত্রে, যে-সূত্র কোনো নিয়ম মানে না। যোগ্যের উন্নতি হয় না বাঙালি সমাজে, উন্নতি ঘটে অযোগ্যের; অযোগ্যরাই তাদের অসাধারণ যোগ্যতা দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যায়, যোগ্যরা নিচে প’ড়ে থাকে। উন্নতির সুযোগ এত সীমিত যে তা’কে ভাগ্য না বলে উপায় নেই, কে যে ভাগ্যবান হবে তা আগে থেকে বলা যায় না। কিছুই সুনিশ্চিত না বাঙালি সমাজে, সুনিশ্চিত শুধু অসংখ্য বাঙালির উন্নতিকাতরতা রোগে আক্রান্ত হওয়া। উন্নতির একটি উপায় এখানে দাসত্ব বা দালালি। বাঙালিসমাজ প্রধানত দালালসমাজ। পরোন্নিতিকাতরতা থেকে মুক্তির একটি উপায়ও বের করেছে বাঙালি, চমৎকার উপায়, তা হচ্ছে পরনিন্দা। বাঙালি পরনিন্দায় সুস্থবোধ করে। পরনিন্দা শুধু ছিদ্রান্বেষণ নয়, যার যে ছিদ্র নেই তার সে-ছিদ্র আবিষ্কারই পরনিন্দা। বাঙালি উপকারীর নিন্দার জন্যে খ্যাত। নিন্দিতরাও এর চমৎকার উত্তর বের করেছে, তারা যে-কোনো সমালোচনাকেই নিন্দা ব’লে গণ্য করে। বাঙালির দোষের শেষ নেই; তাই তার আচরণের বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ বর্ণনাকেও নিন্দা ব’লে মনে হয়। বাঙালি সমালোচনা সহ্য করে না, নিজেকে কখনো সংশোধন করে না; নিজের দোষত্রুটি সংশোধন না ক’রে সেগুলোকে বাড়ানোকেই বাঙালি মনে করে সমালোচনার যথাযথ উত্তর। বাঙালি যখন নিজের সম্পর্কে অন্য কারো মত চায়, তখন সে প্রশংসাই আশা করে; আর প্রশংসা না পেলে ক্ষুব্ধ হয়। বাঙালি নিজের সব কিছুকেই মনে করে প্রশংসনীয়; কিন্তু বাঙালি কখনো অন্যের প্রশংসা করে না। বাঙালি শক্তিমানের মিথ্যা প্রশংসা করে, যা স্তাবকতা মাত্র; কিন্তু প্রকৃতই প্রশংসা যার প্রাপ্য, তার কখনো প্রশংসা করে না। যার প্রশংসা প্রাপ্য, তার প্রশংসা করাকে বাঙালি গণ্য করে নিজের অপূরণীয় ক্ষতি ব’লে।
বাঙালি দায়িত্বহীন, কোনো দায়িত্বই বাঙালি ঠিকমতো পালন করে না। তবে বাঙালি দায়িত্ব পালন সম্পর্কে অন্যকে হিতোপদেশ দিতে ব্যগ্র থাকে। কোনো কাজের সাথে যদি নিজের স্বার্থ জড়িত না থাকে, তাহলে বাঙালি সেটি দিনের পর দিন ফেলে রাখে, এবং চাপ ছাড়া কোনো কাজ করে না। বাঙালির প্রতিটি কর্মস্থল অকর্মস্থল, দায়িত্ব-পালন-না করার কেন্দ্র। বাঙালি কর্মস্থলে ঠিকমতো যায় না, গেলেও কোনো কর্ম করে না; যা করে, তার অধিকাংশই অকর্ম। বাঙালির জীবনের অর্ধেকেরও বেশী ব্যয় হয় অকর্মে। বাঙালি সততার ভান করে, কিন্তু খুবই অসৎ। প্রতিটি কর্মক্ষেত্র অসৎ মানুষের লীলাভূমি। ঘুষ খাওয়া বাঙালির প্রিয়। বাঙালি সবসময়ই সুযোগে থাকে কীভাবে অন্যকে ফেলা যাবে অসুবিধায়, এবং ঘুষ খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থাই ঘুষ খাওয়ার যন্ত্র। ঘুষ খাওয়াকে বাঙালি গৌরব মনে করে। বাঙালি নীতির কথা বলে সব সময়, কিন্তু নীতি রক্ষা করে না। বাঙালি মনে করে নীতি রক্ষা করবে অন্যে, তার নিজের কাজ হচ্ছে নীতির কথা বলা। সামান্য অসুবিধার জন্যে বাঙালি প্রতিমার মতো নীতি বিসর্জন দেয়; কোনো অনুতাপ বোধ করে না।
বাঙালি ইন্দ্রিয়পরায়ণ, সব ধরণের নেশার প্রতি আসক্ত; কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করে না। সুযোগে সব বাঙালিই মদ্যপান করে, কিন্তু স্বীকার করে না। ধুমপান বাঙালির প্রিয় নেশা। অন্যান্য নেশা যেহেতু নিষিদ্ধ বাঙালি সমাজে, তাই ধুমপানকেই তারা নিজেদের সমস্ত উদ্বগ থেকে মুক্তির উপায়রূপে গণ্য করে। বাঙালির ধারণা মদ্যপান করলেই মাতাল হ’তে হয়, বা মাতাল হয়; তাই বাঙালি সামান্য পানের পরেই মাতলামো করে। বাঙালির জীবনে আনন্দ নেই, আনন্দ পাওয়াকে বাঙালি গর্হিত ব্যাপার মনে করে। আনন্দ পাওয়ার জন্যে দরকার উৎসব; কিন্তু বাঙালির উৎসবগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাঙালি সেগুলোতে অংশ নেয় না, থাকে দর্শকরূপে। আনন্দ পাওয়ার জন্যে নিজেকে ভুলে যাওয়াও দরকার, কিন্তু বাঙালি ভোলে না সে কে। বড়োই আত্মসচেতন বাঙালি। বাঙালি আত্মসচেতন, অর্থাৎ শ্রেনীসচেতন, পদসচেতন, অর্থসচেতন। বাঙালি সব সময় নিজের সঙ্গে অপরের তুলনামুলক মূল্যায়নে ব্যস্ত থাকে, নিজেকে ওপরে দেখে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিচ্ছিন্নতা আনন্দ বা সুখের বিরোধী। প্রতিটি বাঙালি কোনো ব্যক্তি নয়, সে একটি শ্রেণী, বা পদ বা টাকার বাক্স। বাঙালি বাহ্যিকভাবে চালাকচতুর, অনেক কিছু বোঝেও তাড়াতাড়ি, কিন্তু বেশি কিছু বোঝে না। একজন জাপানি বা চীনার পাশে বাঙালিকে মনে হবে অনেক বেশি চৌকশ, চীনা-জাপানিকে মনে হবে বোকা; তবে ঈশপের খরগোশের মতো বাঙালি মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়বে; অন্যরা এগিয়ে যাবে কিংবদন্তির কাছিমের মতো। বাঙালি ‘মোটামুটি’তেই সন্তুষ্ট, তারা কখনো চরম উৎকর্ষের অভিলাষী নয়।
বাঙালি না ভেবে লাফ দেয়, এবং লাফ দেয়ার পর বার বার ভাবে, অর্থাৎ অনুশোচনা করে। প্রতিটি বাঙালির জীবন অসংখ্য অনুশোচনার ভান্ডার। বাঙালি যা হ’তে চায়, সাধারণত তা হয় না; এবং যা হয়, তা সাধারণত হ’তে চায় নি। তাই জীবন কাটে অনুশোচনায়। ধারাবাহিক অনুশোচনার শ্লথ স্রোত বাঙালির জীবন। বাঙালি নিজেদের মনে করে অন্য জাতিদের থেকে উৎকৃষ্ট;- অন্য সমস্ত জাতিকেই দেখে পরিহাসের চোখে, এবং নিজেদের সব কিছুকে মনে করে অন্যদের সবকিছুর চেয়ে ভালো। তাই বাঙালি জাতিগর্বী। তার চোখে চীনা-জাপানি হাস্যকর, পাঠানপাঞ্জাবি উপহাস্যকর; পশ্চিমের মানুষেরা প্রায় অমানুষ। তবে এদের মুখোমুখি বাঙালি অসহায় বোধ করে, ভোগে হীনমন্যতায়। বাঙালি ভিক্ষা করতে লজ্জা বোধ করে না। দরিদ্রদেরই শুধু নয়, বাঙালি ধনীস্বভাবের মধ্যেও রয়েছে ভিখিরির স্বভাব। বাঙালির স্বভাবের কোনো দৃঢ়তা নেই; তাই বাঙালির পতনও ট্র্যাজিক মহিমামন্ডিত হয় না, পরিণত হয় প্রহসনে। বাঙালি ভাঙে না, লতিয়ে পড়ে। বাঙালির প্রিয় দর্শন হচ্ছে বেশি বড়ো হোয়ো না ঝড়ে ভেঙে পড়বে, বেশি ছোটো হোয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে;- তাই বাঙালি হ’তে চায় ছাগলের সীমার থেকে একটু উচ্চ,- নিম্নমাঝারি। বাঙালির এ-প্রবচনটিতে তার জীবনদর্শন বিশুদ্ধরূপে ধরা পড়ে। এতে নিষেধ করা হয়েছে অতি-বড়ো হওয়াকে, কেননা তাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা; আর নিষেধ করা হয়েছে খুব ছোটো হওয়াকে, কেননা তাতে সহজেই বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। তাই মাঝারি হ’তে চায় বাঙালি; বাঙালি মাঝারি হওয়ার সাধক। মাঝারি হতে চাইলে হওয়া সম্ভব নিম্নমাঝারি; এবং বাঙালির সব কিছুতেই পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নমাঝারিত্বের।
বাঙালি উদ্ভাবক নয়, তাত্ত্বিকও নয়। সম্ভবত কোন কিছুই উদ্ভাবন করে নি বাঙালি, এবং বিশ্বের আধূনিক উদ্ভাবনগুলোতে বাঙালির কোনো ভূমিকা নেই। কোনো তত্ত্ব ও চিন্তার জনক নয় বাঙালি; বাঙালির সমস্ত তত্ত্বই ঋণ করা। আধূনিক বাঙালির জীবনে যে-সমস্ত তত্ত্ব কাজ করে, তার একশোভাগই ঋণ করা। বাঙালি সাধারণ সূত্র রচনা করতে পারে না, আন্তর শৃঙ্খলা উদ্ঘাটন করতে পারে না; পারে শুধু বর্ণনা করতে। বাঙালি সংঘ গরে তুলতে পারে না, তবে ভাঙতে পারে; এক সংঘকে অল্প সময়ের মধ্যে বহু সংঘে বিশ্লিষ্ট করার প্রতিভা রয়েছে বাঙালির। বাঙালি একদিন যা গ’ড়ে তোলে কিছুদিন পর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তাতেই। বাঙালি যে-সংঘের প্রধান হ’তে পারে না, সে-সংঘ তার নিজের গড়া হ’লেও তাকে সে আর প্রয়োজনীয় মনে করে না। বাঙালি আমরণপ্রাধান্যে বিশ্বাস করে। তাই বাঙালি গণতান্ত্রিক নয়, যদিও গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দেয়। বাঙালি সুবিধাবাদী; সুবিধার জন্যে সব করতে পারে। বাঙালি পুজো করতে পছন্দ করে; প্রতিমা বা লাশ পুজোতেই বাঙালির সুখ। বাঙালি লাশের গলায় মালা দেয়, তবে জীবিতকে লাশে পরিণত করে। বাঙালি মূল্যায়ন করতে পারে না; কারো বা কোনো বস্তুর আন্তর মূল্য কতোটা, তা স্থির করতে পারে না বাঙালি; একবার কারো বা কিছুর ভুল মূল্য স্থির হয়ে গেলে, তার পুনর্মূল্যায়নে বাঙালি রাজি হয় না।
এমন একটি জনগোষ্ঠিকে কি রুগ্ন বলে শনাক্ত করা ছাড়া আর কোনো পথ আছে? এ-রুগ্নতা সাময়িক নয়, কয়েক দশকের নয়, বহু শতকের; সম্ভবত শুরু থেকেই বাঙালি ভুগছে এ-সমস্ত রোগে; এবং দশকে দশকে দেখা দিচ্ছে নানা অভিনব ব্যাধি। তার শরীর রুগ্ন, রুগ্ন তার মন; তার আচরণ রুগ্ন, রুগ্ন তার স্বপ্ন। তার সমাজ রুগ্ন, সামাজিক রীতি রুগ্ন; তার রাজনীতি রুগ্ন, রুগ্ন তার রাষ্ট্র। কোথাও তার স্বাস্থ্য নেই, সুস্থতা নেই। এতো রোগের সমষ্টি যে-জনগোষ্ঠি, তার বর্তমান অবশ্যই শুয়ে আছে রোগশয্যায়; তার ভবিষ্যত শুধু শ্মশান বা কবরস্থান। বাঙালি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা, সন্দেহ করা চলে। মালার্মে অনেক আগেই মুমূর্ষ বা অবলুপ্তির কাছাকাছি পৌছে যাওয়া একটি পাখির সাথে তুলনা করেছিলেন বাঙালিকে; ফরাশি প্রতীকী কবির এ তুলনাটি যদি সত্যে পরিণত হয়, তাহলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। বাঙালি চিকিৎসায় বিশ্বাসী নয়। কোনো দিকেই বাঙালির রোগের চিকিৎসা চলছে না। জাতির চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু রাষ্ট্র চিকিৎসার বদলে রোগ বাড়াতেই বেশি আগ্রহী। রাষ্ট্র এখন রুগ্ন ক’রে চলেছে বাঙালির শরীর ও মন, তার কাঠামো ও মনোজগত; রুগ্ন করে চলেছে তার সমাজ, রাজিনীতি, রাষ্ট্র। রুগ্ন রাজনীতি বিনাশ ঘটায় সব কিছুর; এখন বিনাশ ঘটছে বাঙালির সব কিছু। বাঙালি হয়ে উঠছে আরো প্রতারক, ভন্ড; হয়ে উঠছে আরো অসৎ, নীতিশূণ্য, আদর্শহীন; বাঙালি হয়ে উঠছে আরো খল, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী। নিয়ন্ত্রণের ফলে বিকৃত হচ্ছে বাঙালির শরীর, ও কামনাবাসনা। যতোই ধর্মের কথা বলা হচ্ছে অজস্র মাইক্রোফোনে, ততোই বাড়ছে অনৈতিকতা; যতোই শোনানো হচ্ছে সংযমের কথা, ততোই বাড়ছে অসংযম ও বিকৃত কাম; পান যতোই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, শক্তিমান মাতালের সংখ্যা ততোই বাড়ছে। বাঙালি হয়ে উঠছে একটি বিকৃত জনগোষ্ঠি। মনোবিজ্ঞানীর চোখ দেয়া দরকার এদিকে, যেমন চোখ দেয়া দরকার সমাজবিজ্ঞানীর। বাঙালির রুগ্নতা আর লুকিয়ে রাখা চলে না, ক্ষতস্থলকে ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখলে ক্ষত শুকোয় না, তাতে পচন ধরে। পচন ধরেছে এর মাঝেই। বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না;- একটি জনগোষ্ঠি কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ’তে হ’তে লুপ্ত হয়ে যাবে?
by Jahid | Nov 25, 2020 | দর্শন, শিল্প ও সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতি
বাঙালি, পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো;- ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; কুপমন্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধ’রে। বাঙালির এক অংশ প’ড়ে আছে এক বড়ো দেশের একপ্রান্তে, ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক অংশ ঠাসাঠাসি করে বেঁচে আছে আরেক ভূভাগে, যা এক টুকরো। বাঙালির দারিদ্র বিশশতকের এক কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। প্রতিটি বাঙালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড়ো ভাবার অচিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙালি। ইতিহাসে বাঙালির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে পরিচয় পাই বাঙালির তা আরো অগৌরবের। প্রতিটি জনগোষ্ঠির রয়েছে একটি বিশেষ চরিত্র, যা দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যায়; কিন্তু বাঙালির পাওয়া যায় না এমন কোন বৈশিষ্ট্য;- কোনো জাতি সরল, কোনো জাতি পরোপকারী, কোনো জনগোষ্ঠি উদার, বা মহৎ, বা আন্তরিক; বা কোনো জাতি স্বল্পভাষী, বা বিনয়ী, বা পরিশ্রমী, বা উচ্চাভিলাষী; কিন্তু বাঙালির নেই এমন কোনো গুণ, যার সংস্পর্শে এসে মুনষত্বের প্রসার ঘটতে পারে। বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিচার করা হয়েছে কি না, তা জানি না আমি; কিন্তু বোধ করি তা এখন জরুরি। বাঙালিকে এখন বিচার করা দরকার শারীরিক দিক থেকে- তার অবয়বসংস্থান কেমন, ওই সংস্থান মানুষকে কতোটা সুন্দর বা অসুন্দর করে, তা দেখা দরকার। বিচার করা প্রয়োজন বাঙালিকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে;- কেমন তার মানসগঠন, ওই মনে নিয়ত চলছে কিসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; দিনভর কতোটা ইর্ষায় ভুগছে, উত্তেজিত থাকছে কতোখানি, কতোটা গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে দিনরাত, বা কতোটা গৌরবে তার সময় কাটে। মানসিক এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু বাঙালির মানস উদ্ঘাটনের চেষ্টা হয়নি আজো। বাঙালির আচরণও বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও বিচারের বিষয়। বাঙালি সাধারণত কী আচরণ করে, তার সামাজিক আচরণ কেমন; বন্ধুকে কতোটা প্রীতির সাথে গ্রহণ করে, শত্রুকে দেখে কতোটা ঘৃণার চোখে; কতোটা কথা বলে বাঙালি, কথায় কতোটা বক্তব্য থাকে বা থাকে না, এবং আরো অনেক আচরণ সূক্ষভাবে বিচার করা দরকার। তার আর্থ, সামাজিক, রাজনীতিক জীবন ও আচরণ তো গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাই খুব বিস্তৃতভাবে রচনা করা দরকার বর্তমান বাঙালির জীবন ও স্বপ্নের ব্যাকরণ, যাতে আমরা বুঝতে পারি তার সমস্ত সূত্র। ওই সব সূত্র যদি কখনো রচিত হয়, তবে কি ধরা পড়বে যে বাঙালি একটি সুস্থ জনগোষ্ঠি, না কি ধরা পড়বে বাঙালি জাতি হিশেবে রুগ্ন; আর এ রুগ্নতা শুধু সাম্প্রতিক নয়, ঐতিহাসিকও। বাঙালির অহমিকা কি বাঙালিকে বাধা দেবে না নিজের নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে ও বিচারে? তা দেবে; কেননা বাঙালি সত্যের থেকে শূণ্য স্তাবকতা পছন্দ করে। আমি এখানে বাঙালির কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা বা বর্ণনা করতে চাই, বস্তুনিষ্ঠভাবে, যাতে বাঙালির ব্যাকরণ রচনার সূচনা ঘটে।
বাঙালির ভাষিক আচরণ দিয়েই শুরু করি। জাতি হিশেবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকন্ঠে, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয়টি বিতর্কিত হয়, পক্ষ-বিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচন্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে-কোন আলোচনায় বাঙালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙালির যুক্তি কন্ঠের উচ্চতা; যার কন্ঠ যত উঁচু সে নিজেকে ততোটা যুক্তিপরায়ণ ব’লে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত ব’লে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙালি কখনো পরাজিত হয়নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। বাঙালি কথায় সাধারণত ভুল শব্দ ব্যবহার করে, বাক্য সম্পুর্ন করে না; এক কথা বলে অন্য কথা বুঝিয়ে থাকে। বাঙালি উচ্চকন্ঠে আলাপ করে, অযুক্তি পেশ করে, এবং অনেকের মাঝখানে থেকেও ফিশফিশে স্বরে চমৎকার চক্রান্ত করতে পারে। বাঙালি কারো সাথে দেখা হ’লেই কথা বলে, কথার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও। বাঙালি প্রচুর মিথ্যা কথা বলে থাকে, অনেকে মিথ্যা কথা বলাকে মনে করে চাতুর্য, একধরণের উৎকর্ষ। বাঙালির প্রতিটি এলাকায় অন্তত একজন পেশাদার মিথ্যাবাদী পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে একটি উপজাতি রয়েছে, যারা চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর কথা বলাই থামিয়ে দেয়, তাদের বলার মতো আর কিছু থাকে না। বাঙালি এর বিপরীত- বয়স বাড়ার সাথে কথাও বাড়তে থাকে বাঙালির; বাঙালি বুড়োরা কথা বলার জন্য প্রসিদ্ধ। বাঙালির কথার পরিমাণ ও বক্তব্য সমানুপাতিক নয়; প্রচুর কথায় বাঙালি সামান্য বক্তব্য প্রকাশ করে। বাঙালির কথার প্রাচুর্য হয়ত বোঝায় যে জীবন তাকে ক্লান্ত করে নি; এবং সাথে সাথে এও বোঝায় যে জীবনে তার অপ্রাপ্তী অশেষ। বাঙালির অধিকাংশ কথা তার না পাওয়ার কথা, তার সমস্যার কথা, তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যর্থতার কথা। বাঙালি তার কথা দিয়ে জীবনে না-পাওয়ার শূণ্যতাগুলো পূরণ করে। এ-দিক দিয়ে বেশ ট্র্যাজিক জাতি বাঙালি; কিন্তু সে তার ট্র্যাজেডিকে লুকিয়ে রাখতে চায় অন্যের কাছে। বাঙালির কথায় ধরা পড়ে তার অন্তঃসারশূণ্যতাও।
বাঙালি গুছিয়ে কথা বলে না; এক কথা বারবার বলে; কথায় কথায় অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করে। সাধারণ মানুষের বাক্যের ভান্ডার বেশ সীমাবদ্ধ; কিন্তু তারা ওই সীমাবদ্ধ ভান্ডারকে বারবার ব্যবহার করে প্রায় অসীম ক’রে তোলে। বাঙালি মনে করে এক কথা বারবার বললে তা গ্রহণযোগ্য হয়, তাতে ফল ফলে। এটা হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু এতে কথার তাৎপর্য কমে, মূল্য বাড়ে পৌনপুনিকতার। সাধারণ মানুষকে যদি ছেড়ে দিই, ধরি যদি মঞ্চের মানুষদের, বিচিত্র কথা বলা যাদের পেশা, তারাও একই কথা বারবার বলে। বাঙালি নতুনত্ব চায় না, বিশাস করে পুনরাবৃত্তিতে। পুনরাবৃত্তিতে বাঙালির প্রতিভা কি তুলনাহীন? বাঙালির স্বভাবে রয়েছে অতিশয়োক্তি, সে কোনো আবেগ ও সত্য প্রকাশ করতে পারে না অতিশয়োক্তি ছাড়া। অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে, যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। ‘দারুণ পছন্দ করি’, ‘ভীষণ ভালোবাসি’, ‘শ্রেষ্ঠতম কবির’ মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ। অতিশয়োক্তি লঘুতার লক্ষণ, এতে প্রকাশ পায় পরিমাপবোধের অভাব। বাঙালি লঘু, পরিমাপবোধহীন। বাঙালি সাধারণত কারো আন্তর গুরুত্ব নিজে উপলব্ধি করতে পারে না; অন্য কারো কাছ থেকে তার জানতে হয় এটা; এবং একবার অন্যের কাছ থেকে জেনে গেলে, বিচার না ক’রে, সে তাতে বিশ্বাস করে। বাঙালি ভাষাকে এক ধরণের অস্ত্ররূপেও ব্যবহার করে। কলহে বাঙালির প্রধান অস্ত্র ভাষা- আগ্নেয়াস্ত্রের মতো বাঙালি ভাষা প্রয়োগ ক’রে থাকে।
বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয় বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে ‘কী চাই?’ অপেক্ষা করার জন্য বলে ‘দাঁড়ান’। কোন কর্মক্ষত্রে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। যিনি কোনো আসনে ব’সে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চিত। আসীন কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কেনো, তিনি আগন্তুকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলের কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক’রে নিজেকে সম্মানিত করে। পশ্চিমে এটা কখনো হয় না। পশ্চিমে সাক্ষাৎপ্রার্থী সাদরে গৃহীত হয়, সম্মানিত হয়; কিন্তু বাঙলায় প্রতিটি সাক্ষাৎপ্রার্থী হয় অপমানিত। বাঙলায় সম্মানলাভের বড়ো উপায় হচ্ছে ক্ষমতা। কোথাও গিয়ে তাই প্রথমেই নিজের পদের পরিচয় দিতে হয়, ঐ পদটি যদি আসীন ব্যক্তিকে সন্ত্রস্ত করে, তাহলে সাক্ষাৎপ্রার্থী যথেষ্ট সমাদর লাভ করেন। তাই বাঙালি সামাজিকভাবে ভদ্র ও সৌজন্যপরায়ণ নয়; তার সৌজন্য ভীতি বা স্বার্থচেতনাপ্রসূত। বাঙালি যখন পথেঘাটে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখনও ঠিক সৌজন্য বিনিময় ঘটে না। ধর্মীয় সম্বোধন অনেকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে থাকে, তবে তা যতোটা যান্ত্রিক, ততোটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়। পশ্চিমে রাস্তায় বেরিয়েই পরিচিতজনের, সামান্য পরিচিতের, হাসিমুখ দেখা স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এখানে হাসিমুখ দুর্লভ; রেশারেশি বাঙলায় আলোবাতাসের মতো সত্য। প্রতিটি এলাকা পারস্পরিক রেশারেশিতে গোপন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ঙ্কর এখানে। তাই সামাজিক ভদ্রতা দুষ্প্রাপ্য। বাঙালি সমাজ প্রতি মুহূর্তে ক্ষমতানিয়ন্ত্রিত; প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি ক্ষমতারূপে বিরাজ করে, চলাফেরা করে। ক্ষমতা কোনো ভদ্রতা জানে না। ক্ষমতার দুটি দিকে রয়েছে;- একটি দম্ভ, তা শক্তিমানকে দাম্ভিক করে; আরেকটি অসহায়ত্ব, তা অধীন ব্যক্তিকে স্তাবকে পরিণত করে। তাই বাঙালি দাম্ভিক বা স্তাবক, ভদ্র নয়।
বাঙালির চরিত্রের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ভন্ডামো। বাঙালি প্রকাশ্যে একটি মুখোশ পরতে ভালোবাসে, মুখোশটি নানা রঙে রঙিন ক’রে রাখে; কিন্তু তার ভেতরের মুখটি কালো, কুৎসিত। বাইরে বাঙালি সব আদর্শের সমষ্টি, ভেতরে আদর্শহীন। বাঙালি সততার কথা নিরন্তর বলে, কিন্তু জীবনযাপন করে অসততায়। বাঙলায় এমন কোনো পিতা পাওয়া যাবে না, যিনি পুত্রকে সৎ হ’তে বলেন না; আর এমন পিতাও খুব কম পাওয়া যাবে, যিনি পুত্রের অসৎ উপার্জনে গৌরব বোধ করেন না। ‘চরিত্র’ সম্পর্কে বাঙালির ধারণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ‘চরিত্রহীন’ বলতে বাঙালি বোঝে পরনারীতে আসক্ত পুরুষ; তার চোখে আর কেউ চরিত্রহীন নয়, শুধু পরনারীআসক্তই চরিত্রহীন বা দুশ্চরিত্র। ঘুষ খাওয়া চরিত্রহীনতা নয়, গৌরব; কপটতা চরিত্রহীনতা নয়, মিথ্যাচার চরিত্রহীনতা নয়, এমনকি খুন করাও চরিত্রহীনের লক্ষণ নয়, শুধু নারীআসক্তিই চরিত্রহীনতা। তবে বাঙালি মাত্রই পরনারীআসক্ত; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। বাঙালি ধর্মের কথা সোরগোল ক’রে ব’লে ধর্মবিরোধী কাজ করে অবলীলায়, প্রগতির কথা ব’লে প্রগতিবিরোধী কাজ করে প্রতিদিন; বাঙালি প্রকাশ্যে মহত্ত্ব দেখিয়ে বাস্তবে কাজের সময় পরিচয় দেয় ক্ষুদ্রতার। বাঙালি যা বিশ্বাস করে মুখে তা প্রকাশ করে না; বাঙালি যা প্রকাশ করে আচরণে তা পালন করে না; বাঙালি পেছনে যার নিন্দা করে, মুখোমুখি তার তোষামোদ করে- যদি সে শক্তিমান হয়। শক্তি বাঙালির জীবনের বড়ো নিয়ন্ত্রক;- বাঙালি শক্তিমানের পদানত হয় নির্দ্বিধায়, আর দুর্বলকে পীড়ন করে অবলীলায়। বাঙালি শক্তিমানের কোনো ত্রুটি দেখে না, শক্তিমানের সমস্ত অন্যায়কে মেনে নেয়, বাঙালির চোখে শক্তিমান কখনো চরিত্রহীন নয়, শক্তিমানের কোন চরিত্র থাকার দরকার আছে বলেও মনে করে না বাঙালি; কিন্তু চরিত্রবান হওয়া দুর্বলের জন্য বিধিবদ্ধ। বাঙালি খুবই পরনিন্দা করে, পিতার নিন্দা করতেও কুন্ঠিত হয় না; তবে বাঙালির চোখে সামাজিকভাবে কেউ নিন্দিত নয়, যদি সে শক্তিমান হয়। নিন্দিত শক্তিমানের কন্ঠে মালা পরাতে বাঙালি লজ্জিত হয় না, গর্ব বোধ করে; নিন্দিত শক্তিমানকে নিমন্ত্রণ করে ধন্য বোধ করে বাঙালি। বাঙালি, অশেষ ভন্ডামোর সমষ্টি, শক্তিকেই মনে করে বিধাতা।
বাঙালির শরীরটির দিকেই তাকানো যাক একবার। বাঙালি কি সুন্দর, বাঙালি কি নিজেকে মনে করে রূপমন্ডিত? বাঙালির অহমিকা আছে, তাই নিজেকে রূপের আঁধার মনে করে নিশ্চয়ই; কিন্তু বাঙালির চোখে সৌন্দর্যের দেবতা অন্যরা। একটু ফরশা হ’লে বাঙালি তাকে বলে ‘সাহেবের মতো সুন্দর’; একটু বড়োসড়ো হলে বাঙালি তার তুলনা করে, বা কিছুদিন আগেও তুলনা করত, পাঠানের সাথে। বাঙালি সাধারণত খর্বকায়, তবে সবাই খর্ব নয়; বাঙালির রঙ ময়লা, তবে সবাই ময়লা নয়, কেউ কেউ ফরশা। শাদা রঙটিকে পূজো করে বাঙালি, সম্ভবত সমস্ত ভারতবর্ষীয়ই। এদিক দিয়ে বাঙালিকে বর্ণান্ধ বা বর্ণবাদীও বলা যায়। রঙের জন্য এত মোহ আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। যে-মেয়ে শুধুই শাদা, আর কিছু নয়, যার মুখের দিকে তাকানো যায় না, যার শরীর বেঢপ, তাকেও বাঙালি সুন্দর বলে, কারণ সে শাদা। বাঙালি কালো, কিন্তু তার সৌন্দর্যের দেবী শাদা। বাঙালির শরীর সুন্দর নয়। কেউ হয়তো খর্ব, মধ্যভাগে মাংশ প্রচুর; নারীদের সৌন্দর্য কম, যদিও কেউ কেউ রূপসী। বাঙালি নারী বক্র হয়ে যায় পিঠ বাঁকিয়ে চলতে চলতে, আর ঠিক মতো সোজা হ’তে পারে না, সব সময় ঢাকা থাকে জড়তায়। বাঙালি পুরুষের কাঠামোতে পৌরুষের অভাব; নারীদের অভাব আবেদনের। বাঙালি অবশ্য নিজের সম্পর্কে সবকিছু বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে ব’লে সৌন্দর্যের কথাও বাড়িয়ে ব’লে থাকে; কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সাথে তুলনা করলে তার সৌন্দর্য স্থান পাবে তালিকার নিচের দিকেই। তাই বাঙালি তাকেই সুন্দর বলে যে দেখতে বাঙালির মতো নয়। তাহলে কি বাঙালির সৌন্দর্যচেতনা চিরকালই থেকে যায় অপরিতৃপ্ত? বাঙালির জীবন ভ’রে অপরিতৃপ্ত ও অসন্তোষ; অর্থ তাকে সচ্ছলতা দেয় না, সমাজ তাকে শান্তি দেয় না, রাজনীতি তাকে মানুষ হিশেবে গণ্য করে না, আর তার সৌন্দর্যপিপাসাও তাকে করে রাখে অপরিতৃপ্ত?
বাঙালি দরিদ্র কিন্তু অপচয়প্রবণ; আর বাঙালি সময়ের মূল্যবোধহীন। দারিদ্রের একটা বৈশিষ্ট্য সম্ভবত অপচয়, বা অপচয়ে তারা গৌরব বোধ করে। গরিব বাঙালির বাড়িতে গেলেও নানা অপচয় চোখে পড়ে। ভাতের অভাব বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক সত্য ও নিয়তি; কিন্তু প্রতি বাড়িতেই প্রতিদিন কিছু পরিমাণ হ’লেও ভাতের অপচয় ঘটে। কেউ হয়তো খাওয়ার সময় কিছু ভাত ফেলে দেয়, কেউ না-খেয়েই উঠে যায়; কিন্তু ধনী দেশগুলোতে এক টুকরো রুটিও অপচয় হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালির অপচয়ের কোনো শেষ নেই, এটা ব্যাক্তির অপচয়েরই রাষ্ট্রীয় পরিণতি। বাঙালির রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন অপচয় করে চলে, কিন্তু জাপানে একটি ইয়েনেরও অপচয় ঘটে না। অপব্যয় বাঙালির স্বভাব ও সামাজিক দাবি। বৃটেনে কারো আয়ের একটি ছোটো মুদ্রাও অপব্যয়িত হয় না; তারা নিজেরা অপব্যয় করে না, রাষ্ট্র অপব্যয় করতে দেয় না, সমাজ অপব্যয় করতে দেয় না। সিগারেটকেই উদাহরণ হিশেবে নিই। আমি সিগারেট খাই, হিশেব মতো খেতে চাই, কিন্তু হয়ে ওঠে না। পাশের কাউকে-না-কাউকে প্রতিদিনই দু-চারটি দিতে হয়, যদিও তাদের অনেকেই ধূমপায়ী নন, কিন্তু অন্যকে সিগারেট খেতে দেখলে ধূমপানের শখ জেগে ওঠে তাঁদের। প্রতিদিনই কয়েকটি সিগারেট অপচয় হয় আমার, যেমন হয় অধিকাংশ বাঙালির। আয় খুব সামান্য, কিন্তু অপচয় অনেক;- কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে। দর্জির কাছে কখনো একবার গিয়ে জামা তৈরি পাওয়া যায় না, দু-তিনবার যেতে হয়, অপচয় ঘটে সময়ের ও অর্থের; যে কাজে একবারের বেশি যাওয়ার কথা নয়, সেখানে যেতে হয় বারবার। এমন অপচয় পশ্চিমে ঘটে না। তারা অনেক আয় করেন, কিন্তু তাঁদের একটি সিগারেটেরও অপচয় ঘটে না। বাঙালি আয় করে কম, কিন্তু তার একটা বড় অংশ অপচয় হয়ে যায়। অপচয় হয় বাঙালির জীবন। বাঙালির সময় বোধ নেই বললেই চলে; বাঙালি পাঁচটা বললে ছটা-সাতটাও বোঝাতে পারে। সময় মতো যে চলে বাঙালি সমাজে সে-বেমানান, তাকে বার বার পড়তে হয় অসুবিধায়। বাঙালি সভা বা বৈঠক করতে খুবই উৎসাহী; প্রতিটি অফিস বৈঠকপরায়ণ, তারা প্রতিদিন নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে ব্যগ্র; কিন্তু ঠিক সময়ে কোনো সদস্য আসে না বৈঠকে। যারা আগে আসে তাদের মূল্য কম, বাঙালি মনে করে সময়বোধহীন বিলম্বীরাই মূল্যবান। যে-ঠিক সময়ে এসেছে বাঙালি তাকে খেয়াল করে না; কিন্তু যে আসে নি, আসবে কি না সন্দেহ, বাঙালি তার কথা বারবার বলে, তার জন্যে বড়ো আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।
প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা বা কথা না রাখায় বাঙালি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। কারো সাথে আর্থিক সম্পর্কে জড়িত হ’লে প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একশো ভাগ, না হ’লেই বিস্ময় জাগে। বাঙালি প্রচুর দলিলপত্র ক’রে ব্যবসায়ে নামে অন্যের সাথে, তারা সবাই সুযুগ খুঁজতে থাকে পরস্পরকে ঠকানোর, এবং ঠকাতে পারলে গৌরব বোধ করে, ও না ঠকলে অবাক হয়। ঋণ শোধ না করা বাঙালির স্বভাব। কেউ একবার ঋণ নিলে তা যে ফেরত পাওয়া যাবে, এমন আশা করা বাঙালি সমাজে অন্যায়; আর ফেরত পাওয়া গেলেও তা কখনো ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। বাঙালি কারো প্রাপ্য অর্থ শোধ করতেও কয়েকবার ঘোরায়। প্রথমে একটি তারিখ দেয়, প্রাপক গিয়ে দেখে অন্যজন অনুপস্থিত। তখন তার খোঁজ করতে হয়, পাওয়া গেলে প্রাপ্য টাকা পাওয়া যায় না, টাকা শোধের আরেকটি তারিখ পাওয়া যায়। অনেকবার ঘোরানোর পর বাঙালি টাকার কিছুটা শোধ করে, বাকিটার জন্যে আরেকটি তারিখ দেয়। এটাই হচ্ছে বাঙালির ঋণনীতি। ব্যবসাবাণিজ্যে যারা জড়িত, তারা প্রত্যেকেই প্রতারক; কাউকে-না-কাউকে প্রতারণ করে তারা টাকা করে। এখন অবশ্য রাষ্ট্রকে প্রতারণ করার পথই তারা আবিষ্কার করেছে। বাঙালি বন্ধুকে, পরিচিত জনকে, এমনকি অপরিচিতকেও নানা রকম কথা দেয়; কিন্তু কথা রাখে না। কথা না-রাখার অজুহাত বের করতে দক্ষ বাঙালি; এতো দক্ষ যে বাঙালির কথা শুনে যে বিশ্বাস করবে না তাকে চরম অবিশ্বাসী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
বাঙালি খুবই স্বৈরাচারী; দেখতে এতোটুকু, কিন্তু সবাই ছোটোখাটো চেঙ্গিশ খাঁ। প্রতিটি পরিবারকে যদি একটি ছোটো রাষ্ট্র হিশেবে দেখি, তাহলে ঐ রাষ্ট্রের একনায়ক পিতাটি। পল্লীসমাজে পিতার একনায়কত্ব খুবই প্রবল ও প্রচন্ড; শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে কিছুটা কম। পিতার শাসনে স্বৈরাচারে পরিবারটি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ; মা-টি হয় সবচেয়ে পীড়িত ও পর্যুদস্ত, সন্তানেরাও তাই। পিতার স্বৈরাচারের পরিচয় পরিবারের সদস্যদের সম্বোধনরীতিতেও ধরা পড়ে। আগে, সম্ভবত এখনো, সন্তানেরা পিতাকে সম্বোধন করতো ‘আপনি’ বলে, কিন্তু মাকে সম্বোধন করতো বা করে ‘তুমি’ বলে। পিতা যে প্রতাপশালী ও অপ্রতিহত, এটা বোঝে ছোটো শিশুটিও; মা যে শক্তিহীন তাও বোঝে। মা তাদের মতোই পীড়িত। বাঙালির পারিবারিক একনায়কত্বই বিস্তৃত হয় সমাজে, রাষ্ট্রে। বাঙালি সমাজে প্রধানেরা একনায়ক, তারা অন্যের মত গ্রাহ্য করে না, নিজের মত চাপিয়ে দেয় সকলের ওপর। রাষ্ট্রনায়কেরা তো প্রসিদ্ধ একনায়ক, যদিও বিশ্বের প্রধান একনায়কদের কাছে তারা ইঁদুরছানার মতো। বাঙালি একনায়কত্ব করে, ও ওপরের একনায়কের বশ্যতা মেনে নেয়। নিচের সবাই তাদের কাছে ‘ভৃত্য’, ওপরের সবাই ‘প্রভু’। একনায়কত্ব বাঙালিসমাজে বিকাশ ঘটিয়েছে স্তাবকতার। স্তাবকতায় বাঙালি কি অদ্বিতীয়? প্রভুকে তারা হাজার বিশেষণে শোভিত করে, এতো বিশেষণ তাকে উপহার দেয় যে বিধাতাকেও অতো বিশেষণে সাজানো হয় না। স্তাবকতায় যে-কোনো অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করতে পারে বাঙালি, এবং মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন অতিশয়োক্তি খুঁজে ফেরে। তবে বাঙালি কখনো প্রভুভক্ত নয়। বাঙালি জানে প্রভু শাশ্বত, কিন্তু কোনো বিশেষ প্রভু নশ্বর। এক প্রভু নিঃশেষ হয়ে গেলে বাঙালি আরেক প্রভু ধরে, আগের প্রভুর নিন্দায় মুখর হয়, জয়গানে মুখর হয় নতুন প্রভুর।
সাম্প্রতিক মন্তব্য