কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন (এক্সপার্ট অপিনিয়ন )

ইদানীং অগ্রজদের চেয়ে অনুজদের কাছ থেকে বেশী শিখতে হচ্ছে । এই নতুন করে খুঁজে পাওয়া অব্‌জার্ভেশনটি বছরখানেক আগে এক অনুজের কাছে শেখা। সে আমার কিছু ‘নির্বোধ’ কর্মকান্ড দেখে সৎ উপদেশ দিয়েছিল । নিজে এটা রিলিজিয়াসলি মেনে চলে ; আমিও মেনে চলার চেষ্টায় আছি।

আপনি যদি কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে বা কাজে আপনার দক্ষতাকে পরিপার্শ্বিকের চেয়ে ভালো মনে করেন ; মানে সোজাকথায় নিজেকে এক্সপার্ট মনে করেন– তাহলে আপনার এক্সপার্ট অপিনিওন আপনার কোম্পানিকে যখন তখন দিতে যাবেন না। মনে রাখবেন আপনার ঊর্ধ্বতন এবং মালিকপক্ষ অনেকসময় অযথাই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। অযাচিত শুভাকাংখা দেখে আপনাকে উল্টো বোঝানোর চেষ্টা করবে , ‘ তোমার মতো হরিদাস পাল ছাড়াই আমরা ব্যবসা এতোদূর নিয়ে এসেছি হে ! সুতরাং তোমার এই সব কথাবার্তা পকেটে পুরে রাখো !’

এমন হতে পারে, আপনার পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে বলে একটা সমস্যার খুব সহজ সমাধান আছে আপনার কাছে। সমস্যাটা আপনার চোখের সামনে হচ্ছে। উত্তরটাও আপনার ঠোঁটের আগায়। ‘ক্ষেত্রবিশেষে’ কেউ যেচে এসে না চাইলে সমাধানটা বাৎলে দিয়েন না।অপেক্ষা করুন।

পজিটিভলি দুইভাবে পরিস্থিতি উপকৃত হবেঃ-
প্রত্যক্ষ ভাবে–আপনার ঊর্ধ্বতন, সতীর্থ বা অনুজ সহকর্মীদের ব্রেইনস্টর্মিং হবে ; তাঁরা সমাধানের নানারকম বিকল্প চেষ্টা করবে, একটা লার্নিং প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যাবে। এতে একাধারে — তাদের ,নিজেদের , আপনার ও প্রতিষ্ঠানের উপকার হবে।
আর পরোক্ষভাবে—আপনি অযাচিতভাবে এক্সপার্ট অপিনিওন দিলে সেটার মূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় ! সঠিক বিনিময়মূল্য ছাড়া এক্সপার্ট অপিনিওনের যে দাম নেই সেটা আমার ৯০ সালে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়েই বোঝা উচিৎ ছিল! আমার স্বল্পমেয়াদী প্রাইভেট টিউশনির জীবনে যাদেরকে টাকার বিনিময়ে পড়িয়েছিলাম, তাঁরা সবাই আমার চেয়েও সফল হয়েছে। আর বিনামূল্যে আত্মীয়স্বজন ছোট ভাইবেরাদরকে পড়িয়ে কোন লাভ হয় নাই !

প্রকাশকালঃ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন (ক্রেতার আস্থা )

বছর আটেক আগে এক বন্ধুস্থানীয় বিদেশী ক্রেতার কাছে শেখা!

এই বন্ধুটি প্রায়ই এই কথাটি বলতেন , ‘ You are only as good as your last shipment !’ আমাদের সেক্টরে শিপমেন্ট হলে, অন্য শিল্পে সেটা last deal/ last sale/last performance- হতে পারে।

প্রায়শ: আমাদের কিছু লোকের খামখেয়ালী , অবহেলা বা অদক্ষতার কারণে কিছু শিপমেন্টের এমন লেজেগোবরে অবস্থা হয় যে ক্রেতার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে চলে যায় ! একটা বিশ্বস্ত ভালো ক্রেতা এই যুগে পাওয়া ও তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক ধরে রাখা যে কতোখানি দুঃসাধ্য কাজ , সেটা যারা মার্কেটিং ও সেলস-এ আছেন তাঁরা বোঝেন।
স্বভাবতই দায়ী ব্যক্তি ঊর্ধ্বতন বা মালিককে মনে করিয়ে দেন তার গত বছরগুলোর অতীত সাফল্যের কথা। ইদানীং বাংলাদেশের কর্পোরেট কালচার অনেকখানি নির্দয় আর সংখ্যাভিত্তিক হয়ে গেছে। সুতরাং অতীতকীর্তির কথা বলে দায় এড়ানো যাচ্ছে না।

 

যদিও আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি ‘Hire & Fire’ নীতির বিরোধী। সে তুলনায় পশ্চিমারা নিতান্তই আবেগহীন। এঁদের সঙ্গে সাথে চলতে গিয়ে বোঝা যায় , উপরের কথাটা তাঁরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা মালিককে তখন দায়ী কর্মচারীকে ‘অবস্থান বদলের’ উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হয়, ‘আপনি যদি সোর্সিং অফিস হন– আপনি কারখানার মূল্যায়ন করবেন সদ্যশেষ হওয়া সিজনের শেষ শিপমেন্ট গুলো সেই কারখানা ঠিকমতো দিয়েছে কীনা তা দিয়ে। আবার আপনি যখন কারখানা , তখন আপনার সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানা বা কাপড়, অ্যাকসেসরিজ সরবরাহকারী শেষ সরবরাহ ঠিকমতো করেছে কীনা।

ঠিক একইভাবে পশ্চিমা ক্রেতাকে সারাবছর আপনি ঠিকঠাক সময় মতো সরবরাহ করে আসলেন ; আর বছর শেষে ক্রিসমাসের সময় করলেন গুবলেট ; অতঃপর লেট-শিপমেন্ট, , ডিসকাউন্ট, এয়ার-শিপমেন্ট করে সম্পর্কের অবনতি।

নতুন বছরে তার কাছে আবার অর্ডার চাইলে , সে আপনাকে আপনার শেষ শিপমেন্টের ব্যর্থতার সূত্র ধরেই আলোচনা শুরু করবেন। আপনি উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন, ‘এইটা একটা থ্যাংকসলেস জব , ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আপনি দ্বিমত পোষণ করতে পারেন।কিন্তু দিনশেষে আপনার মূল ক্রেতা যে ধরণের মানসিকতা নিয়ে ব্যবসা করছে , তার প্রভাব চেইন রিঅ্যাকশনের মতো আপনার উপরে পড়বেই !

আমি যেহেতু আশাবাদী, এইবার এই নির্দয় নীতির আশাবাদের জায়গাটা বলি। পুরো ব্যাপারটিকে পজিটিভলি নিলে কী হয় ! যেহেতু, শেষ শিপমেন্ট দিয়ে ক্রেতা আপনাকে বিবেচনা করছেন। যতো খারাপ পারফর্মেন্সই করেন না কেন,পরের বছর ধারাবাহিকতার অজুহাতে হলেও হাতে-পায়ে ধরে আবার কিছু অর্ডার নেন। ঠিকমতো পারফর্ম করলে সে আপনার গতবছরের বাজে শিপমেন্টের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাবে আশা করা যায় !

[ প্রকাশকালঃ সেপ্টেম্বর,২০১৬ ]

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( When everything is coming your way, you’re probably in the wrong lane!)

” When everything is coming your way, you’re probably in the wrong lane! ”

আমি আশাবাদী মানুষ। বেশী আশাবাদী বলেই হয়তো জীবনের বড় দুর্ঘটনাগুলোকে আমি আগে থেকে আঁচ করতে পারিনা। ‘ঘটনা’ একটা ঘটে যাওয়ার পর, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা মর্মাহত হয়ে বলেন, ‘আশ্চর্য ! আপনি এতো বোকা, এই সামান্য আভাষেই তো বোঝা উচিৎ ছিল, সামনে আপনার কতোবড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে!’ তারপর আর কী ! ‘কর্পোরেট মারা’ খাওয়া হয়ে গেলে সেই ব্যথা কাটিয়ে উঠতে পারিনা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ! অবশ্য এইরকম নির্বুদ্ধিতার একটা ভাল-দিকও আছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে সেটা আঁকড়ে ধরে পড়ে না থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বার বার আমি উঠে দাঁড়িয়েছি।

মানুষের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে আমি বিস্মিত হই; মানুষের হাজির-জবাব দেখে আমি আরো বিস্মিত হই। কেউ কোন প্রসঙ্গে হয়তো আমার অক্ষমতা, নির্বুদ্ধিতা, অপ্রাপ্তিকে তাচ্ছিল্য বা ব্যঙ্গ করে গেল ; আমি সেই হঠাৎ আক্রমণে হতবিহব্বল হয়ে পড়ি আমার মুখে রা থাকে না। বোকাটাইপ হাসি দিয়ে সেটা হজম করার চেষ্টা করি। দুই সপ্তাহ বা দুই মাস পরে মনে হয়, আরে শ্লা ! ঐ সময়ে ঐ লোককে তো এই ভাবে জবাব দেওয়া যেত ! তো দ্বিতীয়বার যখন একই ব্যক্তির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় । দেখা গেল সে আমাকে নতুন কোন বাক্যবাণে আহত করছে। এবং আমি আগের মতই অপ্রস্তুত হাসি হাসছি।

আমার ছোট্ট কর্পোরেট জীবনে নানা জাতির লোকের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতে হয়েছে। কর্মজীবনের দুই সময়ে– প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শ্রীলংকান, পরবর্তীতে আরেকজন বৃটিশ– দুই ঊর্ধ্বতন সহকর্মী একই কথা আমাকে শিখিয়েছিলেন। একজন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ওয়ার্কিং প্রসেসে যদি কোন সমস্যা না থাকে, সেটা মুশকিল। আবার চেক করা উচিৎ কোথাও কোন ভুল হচ্ছে কীনা ! আর ব্রিটিশ সহকর্মী বলেছিলেন জীবনের ব্যাপারে। দু’জনের বিদ্যাদান ব্যর্থ হয়েছে আমার ক্ষেত্রে, লাভ হয় নি তেমন কিছু। কারণ আমি রয়ে গেছি সেই আগের মতই ! আত্মরক্ষার ঢাল-তলোয়ার বের করতে আমার দেরী হয়ে যায় ! আর যখন বের করি , দেখি তাতে ইতোমধ্যেই জং ধরে গেছে ! আমার চেয়ে আমার পরিপার্শ্ব সবসময় কয়েকগুণ এগিয়ে থাকে।

জীবনে এরকম সময় আসে, যখন মনে হয় সবকিছু ঠিকমতো চলছে। যেখানে যা থাকার কথা সেখানে আছে, যা পাওয়ার কথা তাই পাওয়া যাচ্ছে , কোন অভিযোগ নাই। আমার জীবনের কয়েকবার হয়েছে, মনে হয়েছে সব প্রাপ্তি আমার দিকেই। কিন্তু কোথায় কোন অলক্ষ্যে যে একটা ঘূর্ণিঝড় পাকিয়ে উঠেছে বা ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’ ট্রাক ধেয়ে আসছে উলটপালট করে দেওয়ার জন্য , আমি বুঝিই নি !

When everything is coming your way, you’re probably in the wrong lane !– বাক্যটির একটা তির্যক অর্থ আছে। ট্রাফিক নিয়মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। সঠিক লেনে থাকলে আপনার সামনে-পিছনে, পাশে যানবাহন থাকবে। কিন্তু মনে করুন , হঠাৎ দেখলেন সব যানবাহন বিপরীত দিকে থেকে আপনার দিকেই এসে পড়ছে, এভরিথিং ইজ কামিং ইয়োর ওয়ে ! অবাক বা আনন্দিত না হয়ে সাবধান হন; কারণ সম্ভবত আপনি ভুল লেনে আছেন !

অবশ্য আপনি যদি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহণে থাকেন বা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরিহার্য অনুষঙ্গ কেউ হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে কিছু বলার নেই। আপনি যেদিক দিয়ে গাড়ী ছোটাবেন , সেটাই তো রাস্তা !

[প্রকাশকালঃ ৯ই সেপ্টেম্বর,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( মালিকানা ও অংশীদারিত্ব )

মুক্তবাজার অর্থনীতি , পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র নিয়ে আমার তেমন কোন পড়াশোনা নাই। পুঁজিবাদে মালিকানার অংশীদারিত্ব কীভাবে সম্ভব বা পৃথিবীর শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোথাও সেটা হচ্ছে কীনা আমি জানি না।তবে চাকরির সুবাদে নানা মানসিকতার শিল্পপতি , মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এই দেড়যুগে এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যারা মহল্লার টেইলারিং দোকানের কর্মচারী থেকে শতকোটি টাকার গার্মেন্টস শিল্পের মালিক হয়েছেন। অনেক মালিকের সঙ্গে বয়সের সামঞ্জস্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক ‘ফর্মাল সম্পর্ক’ ছাড়িয়ে ‘বন্ধুত্বের’ কাছাকাছি চলে গেছে।

আবার একই সঙ্গে কাজের স্বার্থে বিভিন্ন শিল্প কারখানার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হয়। তাদের সুখ দুঃখের সমব্যাথী হতে হয়। মূলতঃ প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সব সিদ্ধান্ত ও ভালো-মন্দ তাদেরকেই দেখতে হয়। মালিকদের কার্পণ্য ,উন্নাসিকতা, বঞ্চনা ও ক্ষোভের কথা শুনতে হয়। মালিক-কর্মচারীর এই পারষ্পরিক আস্থাহীনতা , বিশ্বাসহীনতার ব্যাপারে আমার বেশকিছু মন্তব্য আছে। এই টানাপড়েন একটি চিরকালীন সত্য, এটা থাকবেই।

তবে, একটা ব্যাপারে আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি আমার অবস্থান থেকে বহু মালিককে অনুরোধ করেছি বা পরামর্শ দিয়েছি।
মূলতঃ নির্দিষ্ট একটা সময়ের পরে যারা প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে মালিকের সঙ্গে থেকেছেন ; শূন্য থেকে প্রাসাদ করে দেওয়ার বিবর্তনে নিজেরাও ক্ষয়িত হয়েছেন– তাঁদের মধ্যে বিশাল এক অনিশ্চয়তা কাজ করা শুরু করে। কারণ, নতুন প্রজন্ম এসে পদাধিকারবলে ক্ষমতায় আরোহণ করেন । সেই আস্থাভাজন কর্মচারীরা তখন নিতান্তই ব্রাত্য হয়ে পড়েন।

‘অতি বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ’ কর্মচারী হয় দুর্নীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে , সময় থাকতে আখের গুছিয়ে ফেলে। আর সৎ কর্মচারীরার একটা সময়ের পরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। সবার আগোচরে নিজের আরেকটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান তৈরীতে মন দেন। পরে একসময় বিশ্বাসঘাতকতার তিলক কপালে নিয়ে সরে পড়েন।

যেই শিল্পপতি ২ লাইনের কারখানা থেকে ১৫ বছরে ১৫০ লাইনের কারখানা তৈরি করেছেন। তার রাজপ্রাসাদের ইটে ঐ শ্রমিক-কর্মচারীর ঘাম-রক্ত আছে। কিন্তু আস্থা ও বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে অনেক মালিক তার নির্বোধ শ্যালক , দুঃসম্পর্কের টাউট কাজিন বা ভাই-বেরাদর কে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন, মালিকানার অংশীদার করেন। এবং সেটা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়। অনোপার্জিত অর্থ ও ক্ষমতা মানুষকে কুটিল ও হীণ করে ফেলে।

অথচ মালিক যদি তার ঐ বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজনকে মালিকানার অংশীদারিত্ব দিতেন , তাহলে কর্মচারীদের নিজেদের মালিক হওয়ার প্রবণতা কমে যেত। যে মালিকের ২০০০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি আছে তার জন্য ১০ কোটি টাকার আরেকটা ছোট্ট ইন্ডাস্ট্রি করে বিশ্বস্ত কর্মচারীকে ৫-১০% করে মালিকানা দেওয়া তেমন কিছু না । সেটা হলে, ঐ কর্মচারীরা তো তার আজীবনের কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। আপনার সম্পদ-সৌভাগ্যের মাত্র ০.০০১% পেয়েই সে বাকী জীবন আপনার কর্মচারী-সহকর্মী হয়ে তার সর্বোচ্চ দিতে থাকবে । কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পরীক্ষিত সহকর্মীর চেয়ে আপনার কাছে বখে যাওয়া বিদেশফেরত ভাতিজা বা আপনার ড্রাগ অ্যাডিক্ট শ্যালক বা আপনার নির্বোধ বড়ভাই অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ !

কর্পোরেট জীবনের দীর্ঘ দেড় যুগে আমি কয়েকজন মালিককে কনভিন্স করতে পেরেছি , তারা সুফল পেয়েছেন। কয়েকজন মালিককে নিজে থেকেই যৌথ অংশীদারিত্বের এই প্র্যাকটিস করতে দেখেছি। এতে করে তাদের নিজেদের সম্পদ কমেনি, বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হতে হয় নি। বরং কিছু স্থায়ী সহকর্মী পেয়েছেন যারা জীবন দিয়ে হলেও মালিকের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ও যাচ্ছেন।

প্রকাশকালঃ ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কর্পোরেট অবজার্ভেশন (He who wants everything every time may lose everything anytime!)

All the chickens of the street are not destined to be the roast on your plate! রাস্তার সকল মুরগী আপনার প্লেটে রোস্ট হয়ে আসবে না।

সে অনেকদিন আগের কথা। পুরনো ঢাকার র‍্যাঙ্কিন স্ট্রীট থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আব্বা মিরপুরে বসতি গড়েছেন। ৭৮/৭৯ সাল। আম্মার গহনা বিক্রির টাকাতে যে বাড়ী কেনা হয়েছে, আমাদের পুরনো বাড়ীর তুলনায় সেটাকে একটা বস্তি-ই বলা চলে। জহুরুল হকের প্ল্যানের সারিবদ্ধ ছোটছোট বাড়ীর সামনে বৃহদাকার উর্দুভাষী বিহারী ক্যাম্প। সেই সময় সারা গলিতে কয়েকটি বাঙালির বাড়ী। এক বাঙালি ভদ্রলোক আবার নোয়াখালীর ; তার বাড়ির সামনে নেমপ্লেট লেখা আছে , ‘এটা বাঙ্গালীর বাড়ী’ ! কেন লিখে রেখেছেন? অনেক পরে এসে বুঝেছি। মূলত: সদ্য স্বাধীন দেশে শত্রু-সম্পত্তির হালুয়া-রুটির ভাগে বিহারীদের সাথে স্থানীয় বাঙালি নেতা ও প্রভাবশালীদের হুজ্জত লেগেই থাকত। নেতারা নানাভাবে বিহারীদের অসামাজিক কাজে ব্যবহার করত ; আবার প্রয়োজন শেষে তাদের ক্যাম্পে আগুন দিতেও দ্বিধা করত না । আমরা থাকাকালীন ৩ বার আগুন লেগেছিল ক্যাম্পে। একটি দুর্ঘটনা, বাকী দুটি বাঙালি-বিহারী কলহের জের ! সুতরাং আগুন লাগুক আর লুট-পাট হোক , বাঙালি নেতাদের কেউ যেন ভুল করে তার বাড়ীকে বিহারীদের বাড়ী ভেবে না বসে—সেজন্যই ‘জাতীয়তার সাইনবোর্ড’।

আমাদের বাড়ী কেনার পরেও নানা ঝামেলা ছিল। বাড়ীর মূল মালিক পাকিস্তানে চলে গেছেন। রেখে যাওয়া বিহারী কেয়ারটেকারকে দখলমুক্ত করতে আরো গুচ্ছের বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়েছে। বাড়িটিকে বসবাসযোগ্য করার জন্য অস্থায়ীভাবে আমাদের গৃহকর্মীর ছোটভাই মকবুলকে পাঠানো হল। বছর পনেরোর কিশোর , ভয়ংকর দুষ্টু। ভাষার ব্যবধান থাকার পরেও, সে কেমন কেমন করে যেন বিহারীদের সঙ্গে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় কথা চালিয়ে যেত। ছোট্ট পৌনে দু’কাঠার বাড়িতে নিজের হাঁড়িকুঁড়ি, স্টোভের চুলা পেতে নিজের সংসার মকবুলের ; রাজমিস্ত্রিরা ঘর মেরামত করছে। আমরা মাঝে সাঁঝে আম্মার সাথে, ছোটমামার সাথে আমাদের নতুন বাড়ী দেখতে যাই এবং ‘ তুম্ ওয়াকিল ছাহাবকা লাড়কা আছো?’ টাইপের ভাঙা বাংলার প্রশ্ন শুনে হু হা উত্তর দেই।

তো সেই মকবুল সারাদিন দুষ্টুমির পাশাপাশি একটা মাছ ধরার পলো কোথা থেকে জোগাড় করে ফেলল। সেটার উপরের মুখ বন্ধ করে দড়ি বেঁধে বারান্দায় বসে থাকত। খাবার খেতে চড়ুই পাখী পলোর সীমানার ভিতরে ঢুকলেই অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে সে পলোটা ফেলে দিত। চড়ুইগুলোকে সে আদৌ কীভাবে রান্না করে খেত মনে নেই ! কিন্তু বিহারী শিশুগুলো তাকে রাস্তায় দেখলেই চেঁচিয়ে উঠতো, ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ , ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ মকবুল দিনদুয়েক পরে একটা প্রত্যুত্তর বের করে ফেলল। ওরা সমস্বরে ‘চোঁ চোঁ মোরাব্বা!’ বললেই সে উত্তর দিত, ‘আমি তোর আব্বা !’

কিছুদিন পরে মকবুলের সাহস বেড়ে গেল । আঙিনার খোলা মাটিতে ছোট্ট বাগানে কিছু শাক পাতা বা ফুলগাছ লাগানো হয়েছিল। বিহারীদের মোরগ-মুরগী এসে সেগুলোর বারোটা বাজাতো। বাড়ীর বাইরে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে লাভ নাই, কেননা মুরগীর গায়ে-তো আর নাম লেখা নেই! আর সামনের অগুনিত বিহারী শিশু ও মহিলারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মকবুলের চিৎকার বিমলানন্দে উপভোগ করত। মকবুল সাহস করে সম্ভবত: একটা দু’টো মুরগী ধরে খেয়ে ফেলেছিল। পুরো ঘটনা মনে নেই, আমি নিজেও তখন নিতান্ত বছর ছয়েকের বালক। এরপরে আমরা গেলেই প্রতিবেশীদের মুরগী হেঁটে গেলে সে লোভী চকচকে চোখে খুব উৎসাহ নিয়ে বলত,’মামা দ্যাখেন রোস্ট হাইঁটা যাইতেছে, রোস্ট !’ সে তার কল্পনাশক্তি দিয়ে রাস্তার মুরগীটিকে নিজের প্লেটের রোস্টের চিত্রকল্প তৈরি করে ফেলত।

ঘটনা এর পরে দুর্ঘটনা হয়ে যায়, তার এই দুর্বৃত্ততা কোনভাবে ধরা পড়ে গেলে বিহারীদের সাথে বড় একটা ঝামেলা হয়, আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে সামলাতে হয় আমাদের।
বহুদিন পরে মনে পড়ে গেল মকবুলের কথা। অনেক রকমের ব্যবসা, আর হরেকরকমের অংশীদারিত্ব আছে। আপনার যা প্রাপ্য ; আপনার যোগ্যতাবলে যা আসবে তাই আপনার । অর্জন করুন, চৌর্যবৃত্তি বা দুর্বৃত্ততা দিয়ে যে ব্যবসা বা সম্পত্তি আপনি উপভোগ করতে চাচ্ছেন তা আপনাকে বিপদে ফেলবে। মকবুলের মতো রাস্তার সমস্ত মুরগীকেই আপনি আপনার প্লেটের রোস্ট হিসাবে দেখবেন না। He who wants everything every time may lose everything anytime!

আপনার ভাগে চড়ুই থাকলে তাই সই। যে কোন হেঁটে যাওয়া মুরগীকে আপনার খাদ্য ভাবলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা আছে !

[ প্রকাশকালঃ ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন (স্বর্গ ও নরক)

কর্পোরেট জগতে চাকচিক্যময় আরেকজনকে দেখে অযথাই ঈর্ষান্বিত হবেন না। আপনি আসলেই জানেন না যে তিনি কীরকম নরকযন্ত্রণায় আছেন !
দেড়যুগ আগে OPEX GROUP- এ থাকতে আমার বসের কাছে শোনা। স্মৃতি থেকে লিখছি ; পশ্চিমা জোক, সামান্য অশ্লীলতা আছে।

দুইবন্ধুর একজন খুবই পাপী, বেঁচে থাকতে হেন পাপ নেই সে করে নাই। আরেকজন পুণ্যবান।

তো মৃত্যুর পরে স্বর্গে গেলেন যথারীতি সেই পুণ্যবান। স্বর্গের ব্যাপারে যা গল্পটল্প শুনে এসেছিলেন তার সঙ্গে মিলও ছিল । সারাদিন বেশুমার খাওয়া দাওয়া, চারিদিকে মধুর বিশুদ্ধ সঙ্গীত বেজে চলছে , শ্বেতশুভ্র পোষাকের দাস-দাসী তার সেবায় ব্যস্ত , আলোকোজ্জ্বল বাসস্থান ইত্যাদি। সবই ঠিক আছে , তবুও কিছুদিনের ভিতরে ব্যাপারগুলো একঘেঁয়েমি হয়ে গেল।

এক বিকেলে সেই পুণ্যবান তার নিজস্ব স্বর্গের জানালায় দাঁড়িয়ে আছেন ; হঠাৎ দেখেন তাঁর সেই পাপী বন্ধুটিকে! গোধূলিলগ্নের আকাশ দিয়ে উড়ে উড়ে যাওয়া আলাদীনের আশ্চর্য জাজিমের একপ্রান্তে বালিশের উপরে হেলান দিয়ে বসে আছে সে ! আরেকপ্রান্তে বসে আছে উদ্ভিন্নযৌবনের এক অপ্সরী ; ধীরে ধীরে একটা পানপাত্রে সুরা ঢেলে দিচ্ছে তাকে ।

পরের দিন ছিল স্বর্গের সাপ্তাহিক মিটিং ; পাপী সহকর্মীর সৌভাগ্যে বেচারা পুণ্যবান খুবই মর্মাহত হয়ে ছিলেন।

স্বর্গপ্রধান কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, কিছু কথোপকথনের পরে আসল অভিযোগ বেরিয়ে এলো , ‘আমার স্বর্গ এতো বোরিং আর ওই পাপীকে এতো উত্তেজক যৌবনবতী অপ্সরাসহ স্বর্গ দিয়েছেন, এটা কী রকমের বিচার হল ? ’

স্বর্গপ্রধান মৃদু হেসে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ কী কারণে মনে হচ্ছে তোমার সেই সহকর্মী স্বর্গসুখে আছে? তাকে আমি নরকযন্ত্রণাতেই রেখেছি !

কীভাবে ?

শোন, যে পাত্রে সে সুরা পান করছে সেটার তলায় ছিদ্র আছে। সুতরাং সে শুধু সুরা পড়তেই দেখছে, একফোঁটাও চেখে দেখার সাধ্য নেই তার ! বোঝ কীরকম যন্ত্রণায় আছে সে। আর যে যৌবনবতী বসে আছে,তার কোথাও কোন ছিদ্র নাই!’

[ প্রকাশকালঃ ২৪শে আগস্ট,২০১৬ ]