কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( মাকড়শা ম্যানেজমেন্ট )

আমার পড়াশোনা শুরু থেকেই বিজ্ঞানবিভাগে। ম্যানেজমেন্টের উপর নামকা ওয়াস্তে একটা অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই ‘হালকার উপর ঝাপসা’মানের একটা MBA ডিগ্রী আছে। তাও সেটার সার্টিফিকেট গত একযুগ ধরে পড়ে আছে সেই ইউনিভার্সিটির কোন এক জং ধরা ক্যাবিনেটে ; আমার সুবিখ্যাত আলস্যের কারণে ওটা আর তুলতেও যাই নি

তো ‘Trial and Error’ , সেই বিখ্যাত মৌলিক পদ্ধতিতে আমার ম্যানেজমেন্ট শেখার হাতেখড়ি । প্রতিমুহূর্তেই শেখার আবশ্যকতা আছে এবং জীবন্ত মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে যা হয়–একজনের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, আরেকজনের ক্ষেত্রে সেটা ভীষণভাবে ব্যর্থ ! সবকিছু বিবেচনা করে এখন পর্যন্ত ‘Situational Leadership’ বা ‘Situational Management’ সবগুলোর একটা সম্মিলিত রূপ মনে হয়েছে।

আরেকটা ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি খুব কার্যকর, বহুল প্রচলিত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় আমাদের দেশে । ম্যানেজমেন্টের ভাষায় এটাকে Autocratic Management বলা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমি এটার নাম দিয়েছি Spider Management বা ‘মাকড়শা ম্যানেজমেন্ট’।

ধরুন , একজন মেধাবী লোক একটা কোম্পানির মালিক অথবা একজন সিইও বা ম্যানেজার। তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। এই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই আছেন এবং ছোট্ট প্রতিষ্ঠানে বাকী লোকেরা তার চেয়ে কম মেধাবী। এবং যে কোন পরিপ্রেক্ষিতে অন্যকেউ যেই সিদ্ধান্তই দিক না কেন, ঐ মেধাবী মালিকের বা ম্যানেজারের সিদ্ধান্ত পরীক্ষিতভাবে সবচেয়ে কার্যকর !

তো, হয় কী , ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের সবধরনের সিদ্ধান্তের একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে বসেন তিনি ! এক পর্যায়ে দেখা যায় রিসিপশনের চেয়ার টেবিলের রং , কার্পেট , কাপ-পিরিচ থেকে টয়লেটের কমোড কেনার সিদ্ধান্তও তাকে দিতে হয়। সকলেই ব্যাপারটাকে মেনে নেয়। সবাই তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। কোম্পানির সর্বোচ্চ মঙ্গলের জন্য ব্যক্তিটিকে এককভাবে সাধুবাদ দেওয়া হয়। আর ঐ ব্যক্তি নিজেকে ধীরে ধীরে কোম্পানির অন্যান্য আসবাবপত্রের মতো নিজেকে অপরিহার্য করে ফেলে।

ব্যাপারটা মাকড়শার মতো অনেকটা। একটা মাকড়শা তার জালের ঠিক কেন্দ্রে থেকে মুখ দিয়ে , পেট দিয়ে , হাত দিয়ে পা দিয়ে চারপাশ আঁকড়ে থাকে। অনেক সময় সেই স্কুলপাঠ্যের লোভী স্বার্থপর মাকড়শার মতো হয়, চারদিকের টানে নিজেকে একসময় ছিঁড়েখুঁড়ে ধ্বংস করে ফেলে সে। কর্মজীবনে এই মাকড়শা মালিক বা ম্যানেজারদের মুখোমুখি হতেই হবে আপনাকে। আমাদের চারপাশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ম্যানেজাররাই এই পদ্ধতিতে চলতে চান। কেন চান , সে গল্প আরেকদিন হবে।

দীর্ঘমেয়াদি মুশকিল হয় অন্যখানে। একজন মানুষ যতো দক্ষ বা সিদ্ধান্তগ্রহণে পারঙ্গম হন না কেন; সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার গুণগত মান কমতে থাকে। একজন দক্ষ ডাক্তার দিনে একটা অপারেশন করলে যে গুণগত মান পাওয়া যাবে ; ১০টা করলে সেক্ষেত্রে ছোটখাটো বা বড় ধরণের ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ! যে মালিক বা ম্যানেজার সপ্তাহে ১০টি বড় ধরণের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, ধরে নিচ্ছি তার এফিসিয়েন্সির মান শতকরা ৯৫ ভাগ। কিন্তু সেই একই ব্যক্তি যখন ১০০ টা সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তার এফিসিয়েন্সি কমে যাচ্ছে । ধরুন, তা নেমে হয়ে গেল ৯০ ভাগে। এখন ২০০টি সিদ্ধান্ত হলে, ২০টি দুর্বল সিদ্ধান্ত বা ভুল সিদ্ধান্ত অনেকাংশে প্রতিষ্ঠানের জন্য বা কর্মচারীদের জন্য নিদারুণ ক্ষতিকর হতে পারে।

কিন্তু এই দুষ্টচক্র থেকে ঐ ব্যক্তি বের হয়ে আসতে পারেন না কোনভাবেই। নিজের জালে নিজে এমনভাবে আটকে যান যে– না পারেন ছিঁড়তে, না পারেন বের হতে, না পারেন কাউকে বলতে। নিজের পরিবারপরিজন থেকে ধীরে ধীরে সরে যান ; পরিবারও তাকে ছাড়া দিব্যি চলতে শিখে যায়।

আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, ‘মাকড়শা ম্যানেজমেন্ট’ ছোট প্রতিষ্ঠানের উত্থানের জন্য দারুণ কার্যকর একটা পদ্ধতি। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠান যখন ২০ জন থেকে ২০০ বা ২০০০ জনের হয়ে যায় ; তখন তা থেকে বের হয়ে না আসতে পারলে, সেটা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, দুইজনের জন্য চরম অমঙ্গলকর !

[ প্রকাশকালঃ ২৩শে সেপ্টেম্বর , ২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন (ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি )

ম্যানেজমেন্ট চালানোর অসংখ্য পদ্ধতি আছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হচ্ছে। প্রচলিত জনপ্রিয়তম পদ্ধতি হচ্ছে অধীনস্থ সাথে একটু দূরত্ব রেখে হুকুম করে বা ডিরেক্ট করে সবকিছু ম্যানেজ করা । অধুনা ইন্টারনেটের বহুল মোটিভেশনাল স্পিকারদের কল্যাণে কোচিং ম্যানেজমেন্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । ম্যানেজার এখানে সফল কোচের মতো হাতেকলমে সবকিছু দেখিয়ে দেন, মোটিভেট করেন, কর্মচারীদের কাছ থেকে তাদের সর্বোচ্চটি আদায় করে নেন। খুব বিরলভাবে আছে ডেলিগেশন ম্যানেজমেন্ট। অসামান্য কিছু ম্যানেজার আছেন যারা দায়িত্ব এমনভাবে পরবর্তীদেরকে ডেলিগেট করেন যে, কিছুদিন পরে উনি নিজেকে সবার কাছে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেন। এতে করে প্রতিষ্ঠানের লাভ হয়, সেকেন্ড জেনারেশন তৈরি হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানে । পাঠ্যপুস্তকের বিস্তীর্ণ পড়াশোনায় নানাধরনের পদ্ধতি বাস্তবে কিছুটা-তো অবশ্যই কাজে আসে; নইলে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন !

কিন্তু মাঝেমাঝে এমন কিছু জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে প্রচলিত কোন নিয়মই আর কাজ করে না। আপনি ম্যানেজার মালিক যাই হন না কেন, দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন – ঘটনাতে এমন প্যাঁচ লেগেছে ! একেবারে ল্যাজেগোবরে অবস্থা — ম্যাজিক ছাড়া কোনভাবেই ঐ বিপদ থেকে উত্তরণের কোন উপায় নেই। দুর্ভাগ্যবশত: আপনি জাদুকর জুয়েল আইচ বা পিসি সরকার নন , যে ছুঃ মন্তর দিয়ে সমস্যার সমাধানের কোন উপায় বাৎলে দেবেন। এটাকে অনেকসময় আমরা বলি বটলনেক (Bottleneck ) সিচুয়েশন। হুট করে গিটঠু খোলার কোন চান্স থাকে না ।

অথচ সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, আপনি কোন একটা পথ দেখাবেন । আমি আমার জীবনে ব্যক্তিগত ভাবে সাংঘাতিক মেধাবী ও ক্যারিসমাটিক কয়েকজন মালিক ও ম্যানেজারকে দেখেছি, যারা সমস্যারে কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেই কীভাবে যেন সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো !

এখন আরেকটা স্বল্প-মেধাবী কিন্তু কার্যকর পদ্ধতির কথা বলি ; সেটা দিয়েও অনেক বুদ্ধিমান মালিক-ম্যানেজারকে জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরিত হতে দেখেছি বহুবার। যেহেতু আমি ও আপনি উভয়েই জানি যে , আমাদের চারপাশে ক্যারিসমাটিক ম্যানেজার বা মালিকের অভাব আছে । সুতরাং ক্ষেত্র-বিশেষে দ্বিতীয় পদ্ধতিটা মন্দ নয়।

এসব ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সোজা একটা কথা বলে দিলেই কাজ হয়।
‘আমি জানিনা কীভাবে করবেন, কিন্তু অমুক সময়ের ভিতরে এটা করতেই হবে। কয়জন মিলে, কী কী রিসোর্স লাগবে, কীভাবে করবেন সেটা আমার দেখার বিষয় না।’
এই পদ্ধতিতে কী কাজ হয়? আলবৎ হয় ! আসলে , গভীর সমস্যায় পড়লে অধীনস্থরা অনেক সময় হাল ছেড়ে দেয়। ‘বসেরা-তো জানেই কতখানি সমস্যা, আমি নতুন করে কী করতে পারি।’ সে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে কমফোর্ট জোনে থাকতে চায় ।

খেয়াল করে দেখবেন , পশ্চিমাদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, বিশেষ করে তরুণ খেলোয়াড়দের মোটিভেট করার জন্য একটা কথা ঘুরে ফিরে বলা হয় “ When someone pushes his/her limits, he/she can reach their maximum potential !” ঠিক একইভাবে কাউকে বিপদসীমার উপরে এক্সট্রিম লেভেলে ঠেলে পাঠিয়ে দিলে, ভয়ংকর প্রেশার বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন সে ম্যাজিক দেখাতে পারে।

তবে লক্ষণীয় এই যে, এই ‘পদ্ধতি’ সারাবছরে একবার বা দুইবারের বেশী প্রয়োগ করা উচিৎ নয়। ঘন ঘন এক্সট্রিম প্রেশার মালিক বা ম্যানেজারকে অধীনস্থদের কাছে ক্লিশে করে ফেলে !

[ প্রকাশকালঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন (শ্রেণিক্রম ও সুবিধাদি)

শ্রেণিবিন্যাসে ক্ষমতার অধঃক্রম অনুসারে নীচের নিয়মটি খাপছাড়া রকমের কার্যকরী।
বুঝিয়ে বলছি। ধরুন একটা বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূল মালিকের পরেই আছেন কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর, তাদের নীচে আছেন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ; ক্রমান্বয়ে জেনারেল ম্যানেজার, ডিজিএম, অপারেশন ম্যানেজার, প্রোডাকশন ম্যানেজার, এপিএম , ফ্লোর সুপারভাইজার, লাইন ইনচার্জ, অপারেটর, লেবার ইত্যাদি ইত্যাদি। অথবা আপনি একটা ছোট সংসারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ‘গিন্নী’ । আপনার নিম্নবর্তী শ্রেণীতে আছে দারোয়ান, ড্রাইভার, কাজের বুয়া ইত্যাদি।

শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে ঊর্ধ্বতর শ্রেণীর কাছে নিম্নতর শ্রেণী/শ্রেণীসমূহের কিছু ন্যায্য ও অন্যায্য দাবী-দাওয়া সবসময় থাকে। পুঁজিবাদী পৃথিবীতে কেউ সহজে সন্তুষ্ট হতে পারে না। চাহিদার শেষ নাই । হয়তো পুঁজিবাদই তা হতে দেয় না। ক্ষেত্র বিশেষে ঊর্ধ্বতর শ্রেণিকে নিম্নতর শ্রেণীর ন্যায্য দাবী মেনে নিতে হয়, নেগোশিয়েশন হয়। উভয়পক্ষের ছাড় দিয়ে একটা সমঝোতায় আসে। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে চলে। কিছুদিন পরে আবার নতুন করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিম্নতর শ্রেণীকে ঠেলে দেয় নতুন দাবী-দাওয়া উত্থাপনে !

অনেকসময় ঊর্ধ্বতর শ্রেণী ভেবে বসে, ট্রায়ালভিত্তিতে বা পরীক্ষামূলক ভাবে সীমিত সময়ের জন্য ( কয়েকমাস বা এক বছরের ) একটা সুবিধা দেওয়া যাক। পরে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী না হলে ‘সুবিধা’-টা তুলে নেওয়া যাবে ! সেটা হতে পারে, সাপ্তাহিক একদিন ছুটির পাশাপাশি অল্টারনেটিভ আরেকদিন দিনে ছুটি কাটানোর সুযোগ ; হতে পারে দুপুরের ফ্রি লাঞ্চ ; কর্মচারীদের ড্রপ অ্যান্ড পিক অথবা প্রফিট বোনাস , মহার্ঘভাতা ইত্যাদি।

ওই যে প্রথমেই বলেছি, ব্যাপারটা খাপছাড়া ও হাস্যকর মনে হলেও , একটা সুবিধা একবার দেওয়ার পরে, নিম্নতর শ্রেণী যখন সেটা উপভোগ করা শুরু করে – পরবর্তীতে সেটা তুলে নিতে গেলে ভয়ংকর অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ! মূলত: মানুষের চরিত্রই এমন যে , একটা ন্যায্য-অন্যায্য বা অযাচিত সুযোগে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে ধরেই নেয় সেটা তাঁর অধিকার, জন্মজন্মান্তরের পাওনা।

রফতানিমুখি গার্মেন্টস শিল্পে জড়িত ট্রেডিং অফিসগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি দেড়দিন হয়ে থাকে। সেটা শুক্র –শনি অথবা শনি-রবি মিলিয়ে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটির পক্ষে। ঢাকার বেশ কয়েকটি বড় সোর্সিং ও ট্রেডিং অফিসের সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন এবং তারা সবকিছু ম্যানেজ করে দিব্যি ব্যবসা করছে। অনেক অফিসে হাফ-ডে নামে যে ছুটিটা আছে, আমি সেটার ঘোরতর বিরোধী। আমি জানি , সাপ্তাহিক ছুটি সারাদেশে রবিবার হলে এই সমস্যা হত না । মাঝখানের একদিন হাফ-ডে অফিস খোলা না থাকলে পশ্চিমা ক্রেতা , ট্রেডিং অফিস, ব্যাংক এবং কারখানাগুলোর মধ্যে প্রায় ৩ দিনের কম্যুনিকেশন গ্যাপ পড়ে যায়। সেটিও কারো কাম্য নয়।
আবার আধাবেলা অফিসে গুচ্ছের মূল্যবান বিদ্যুৎ , সিস্টেম সাপোর্ট , এসির বাতাস দুপুর-বিকাল পর্যন্ত চালিয়ে যে কার্যোদ্ধার হয় তা মূলত: ঘণ্টাখানেকের কাজ। কেউ বোধহয় দ্বিমত করবেন না যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মধ্যে আধাবেলা অফিসের দিনে তাড়াহুড়ো থাকে — তাড়াতাড়ি কাজ শেষে বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করার ! সুতরাং সকাল ৯:০০ টায় ঢুকে দুপুর ১:০০ টায় বের হয়ে যাওয়ার মাঝখানে কাজের কাজ হয় সামান্যই !

আমি যে প্রতিষ্ঠানে কামলা খাটি , সেখানে ট্রায়াল বেসিস অল্টারনেটিভ শনিবার ছুটির প্রস্তাব এসেছিল। নানাকারণে আমি দ্বিমত পোষণ করি এই ট্রায়াল বেসিস সুবিধার । আমার কথা খুব স্পষ্ট ছিল — দিতে হলে ঘোষণা দিয়ে একেবারে দিতে হবে। কয়েকমাস দিয়ে এই সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার কোন মানে হয়না।

প্রতিটা ঊর্ধ্বতর শ্রেণীর কাছে নিম্নতর শ্রেণীর যেকোনো ন্যায্য বা অন্যায্য দাবী থাকুক না কেন—একবার সেটা দিয়ে, পরবর্তীতে তুলে নেওয়া মূলত: অপ্রয়োজনীয় অসন্তোষের সৃষ্টি করে । সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আগে দীর্ঘমেয়াদে সেটার প্রভাব কী কী হতে পারে ভেবে দেখা উচিৎ।

[ প্রকাশকালঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]

কর্পোরেট অ‌ব‌জার্ভেশন (সেধে ডাল খাবেন না )

কর্পোরেট অ‌ব‌জার্ভেশন (সেধে ডাল খাবেন না )

আমার অগ্রজ মাঝে মাঝে একটা কথা বলেন, ‘সাইধা ডাইল খাইয়েন না !’ ( সেধে ডাল খাবেন না !)

মানুষ নানারকম লোকাল প্রবাদ-প্রবচন,বাগধারা ব্যবহার করে ; ভাবতাম এটা সেরকম কিছু একটা। এই যেমন দুইদশক আগে আমি টেক্সটাইলের সদ্য পাশ করা প্রকৌশলী ; প্রাইমারী, সেকেন্ডারি , টারশিয়ারী সব কালার- মুখস্থ। দেশের বাড়িতে গেছি ! আমার খুব বন্ধু-সুলভ মামাটি আমার কাছে কী কারণে যেন কিছু টি-শার্ট চাইলেন । একইসঙ্গে আমাকে আবার মনে করিয়ে দিলেন, ‘ ভাগিনা, ভালো কালারের কিছু দিও, ‘খায়রুল কালার’ – দিও না। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ,‘খায়রুল কালার’- আবার কী!’ কথা শুনে বুঝলাম ,বন্ধু-মহলে উনাদের খায়রুল নামের একজন আছে, যার কালার-সেন্স অতিমাত্রায় কম। রাজ্যের ফালতু আবঝাপ রঙয়ের পোশাক পড়েন। তাই , অদ্ভুতুড়ে যে কোন রঙের নাম তাদের বন্ধু-মহলে ‘খায়রুল কালার’ নামে পরিচিত।

ইনাম ভাই নামে একজন সদাহাস্যময় বড়ভাই ছিলেন মহল্লায়। ছিলেন বলছি, কারণ তিনি অকালেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ছোটবেলায় উনাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করার সময় নানা ধরণের কথার ভিতরে উনার ফেভারিট ছিল-

‘আল্লাহ্ তুই রহমতের মালিক !
কাউরে দিলি ঘুঘুর বাচ্চা, আমারে দিলি শালিক!!!’

কোন বেদনা থেকে এই দুলাইন উনি বলতেন জানি না। ঘুঘুর বাচ্চা যে শালিকের চেয়ে ভাল শুধু এইটুকু বুঝতাম। লাইনগুলো উনার নিজস্ব রচিত কীনা সেটা জানার এখন আর উপায় নেই !

তো আমি আমার অগ্রজের ‘One liner’ কে ধরে নিয়েছিলাম ঐরকম লোকাল কিছু একটা ! মাস খানেক আগে জিজ্ঞাস করলাম অন্তর্নিহিত অর্থ কি ? হয় কি , ধরেন আপনার সঙ্গে কেউ একটা নেগোশিয়েশনে যাবে, হতে পারে সেটা মালিক-পক্ষ , ক্রেতা বা আপনার কর্মচারী ! আপনাকে আগে তার/তাদের কথা শুনতে হবে মন দিয়ে। সে অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট প্ল্যান করে আপনার সাথে আলাপে বসেছে । আপনার উচিৎ হবে তাকে আগে বলতে দেওয়া। আপনি যদি আগ বাড়িয়ে ধরে নেন তার বরাদ্দ অফার কী হতে পারে , তাহলে আপনার নেগোশিয়েশন স্কিলকে আরো একটু ঝালাই করার সময় হয়ে গেছে !

হতে পারে, আপনার প্রতিপক্ষ নিজে থেকেই আপনার ‘সম্ভাব্য’ দাবীর চেয়ে একটু বেশী সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই আপনার সঙ্গে বসেছে ! সুতরাং , তাকে বলতে দিন। তারপর, আপনি আপনার দাবী-দাওয়া উত্থাপন করেন। এমনটা তো হতেই পারে, রোস্ট-রেজালার আকাঙ্ক্ষা বা দাবী নিয়ে যাচ্ছেন ; হয়তো গরুর ভুনা-মাংসের ব্যবস্থা আছে। তা না জেনে, খাবার আসার আগেই ডাল-ভাত দাবী করে বসলেন !

ছোটখাটো ইস্যুতে আমার নিজের এমনটি হয়েছে–কোন একটা মিটিং হয়তো পূর্বনির্ধারিত ছিল। হঠাৎ করে আমার ব্যস্ততা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে। আমি অনেকক্ষণ ধরে ইতস্তত করছি কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটিকে না করি, বা মিটিং পিছিয়ে নিতে বলি! দেখা গেল, আমি ফোন করে হালকা কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর অপরপক্ষ নিজে থেকেই বলছে, ‘আমি তো ব্যাংকের কাজে আটকে গেছিরে ভাই, ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি ! আসলে , কোন কথোপকথন বা মিটিং এ বসার আগেই অনেকে মাইন্ডসেট করে ফেলেন কী কী বলবেন প্রথম সুযোগেই ; অপরপক্ষকে না শুনেই হড়বড় করে কী কী চাই সেটা বলেও ফেলেন। এতে অনেকসময়ই হিতে বিপরীত হয় !

নেগোশিয়েশনের যে কোন পরিস্থিতিতে তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য দেখাতে শিখুন, কেন আগ বাড়িয়ে ডাল খাবেন !

[প্রথম প্রকাশঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর ,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( You always meet twice in life )

“You always meet twice in life!” আমার এক অগ্রজের কাছে শেখা।
চাকরির প্রথমদিকে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস কারখানায় ছিলাম বেশ কয়েকবছর ; তারপরে নানা পাকেচক্রে ট্রেডিং হাউজে। আমরা যারা কারখানায় কাজ করে এসেছি , কেন জানিনা মালিকদের ব্যাপারে একটা সহজাত সম্মানবোধ আছে তাদের । সম্বোধনে ও আচার আচরণে আমি মালিকপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হই, যে তাঁদের বহুবিধ সমালোচনা থাকতেই পারে, কিন্তু দিনশেষে তাঁরা মালিক । আমি জানি , একটা প্রতিষ্ঠান চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। আরেক বড়ভাই, কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন,’ আমি একটা ফ্লোরে বসে একসঙ্গে কয়েকশত নানা মাপের , চিড়িয়াটাইপ শিক্ষিত লোক চালাতে পারি ! কারণ এটা আমার এক্সপার্টিজ। কিন্তু এই আমাকেই ২ জন কর্মচারী সহ একটা পান-বিড়ির দোকানের মালিক করে দিলে দেখা যাবে আমি সেটা চালাতে পারছি না।’ তো কর্মজীবনের প্রথমধাপেই বুঝে গেছি ,প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া ও চালানো সহজ না। ‘Entrepreneurship’ ব্যাপারটা সবার হয় না !

অনুজ সহকর্মীদের অনেকে কোন প্রতিষ্ঠানের মালিকের সাময়িক ব্যর্থতায় হুট করে অসম্মান করে বসেন । মূলত: ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা প্রভুসুলভ আচরণতো থাকেই। যারা কারখানাগুলোতে কাজ করে এসেছেন , তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা একটু কম। সরাসরি এসেই ট্রেডিং বা সোর্সিং অফিসের চেয়ারগুলোতে বসে পড়লে সমস্যা হতে পারে। কারণ নবীন কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোনে কারখানার কাউকে উচ্চস্বরে মুখ খিস্তি করতে দেখে ভেবে নিয়েছে—কার্যোদ্ধারের ওইটাই একমাত্র পন্থা।

টেবিলের এই পাশে থেকে কাউকে তাচ্ছিল্য করে কথা বলাটা খুব সহজ একটা কাজ। ভুলে যাবেন না , আপনাকে টেবিলের ঐ পাশে যেকোনো মুহূর্তে বসতে হতে পারে। আপনি কোন মালিককে তার ঐ মুহূর্তের ব্যর্থতা দিয়ে তাকে বিবেচনা করছেন। আপনি জানেন ও না, ঐ অবস্থানে আসতে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। আপনার উন্নাসিক ক্রোধের এক মুহূর্তে আপনি এমন দুর্ব্যবহার ব্যবহার করে বসলেন যে , দ্বিতীয়বার তাঁর সাথে কথা বলার মতো অবস্থা থাকল না। বরং কেউ আপনার সঙ্গে অসদাচরণ করলে , সেটি তার ব্যর্থতা ; পরের বার সে আপনার চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারবে না। আপনার মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি তাকে অনুশোচনায় জ্বালাবে !

মানুষের আয়ু ক্ষুদ্র ! তাই বলে এতো সংক্ষিপ্ত নয় যে কারো সাথে আপনার আরেকবার দেখা হবে না !

[ প্রকাশকালঃ ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন( ফিটফাট থাকুন, নিজেকে প্রেজেন্টবল রাখুন )

পদাধিকারবলে আমাকে সারাদিন নানা ক্যাটাগরীর লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। বিলিওনার থেকে শুরু করে ড্রাইভার-দারোয়ান, অফিসবয় ইত্যাদি। কর্পোরেট সফল ব্যক্তিদের ব্যাপারে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁরা একেকজন নিজেই সাফল্যের সংজ্ঞা ও প্রতিভূ হয়ে প্রাতঃস্মরনীয় । কিন্তু যারা অসফল, ব্যর্থ তাদের ব্যাপারে আমার একটা অদ্ভুত অব্‌জার্ভেশন আছে।এটা অব্‌জার্ভেশন-এর পর্যায়ে পড়ে কীনা কে জানে।প্রতিনিয়ত একই পুনরাবৃত্তিকে– কী বলা উচিৎ ।

আমি খেয়াল করে দেখেছি , যারা সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের শরীরে দুর্গন্ধ বা বাজে গন্ধ থাকে। মুলতঃ নিজের শরীর,পোশাক,নাওয়া খাওয়ার অপর্যাপ্ততার কারণেই সেটা হয়ে থাকতে পারে। হতে পারে নিজের অজ্ঞাতেই ব্যর্থ লোকটি নিজেকে ব্যর্থতার একটা আচ্ছাদনে মুড়িয়ে ঢেকে চলাফেরা করেন; সহানুভূতির আশায় । কিন্তু এই ব্যাপারটা তার জন্য যে আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারে না । একজন অপরিচ্ছন্ন , এলোমেলো লোকের উপর চাকরিদাতা ভদ্রলোক ভরসা করবেন কেমন করে ? সুতরাং তার ব্যর্থতার সঙ্গে আরেকটি দিন যুক্ত হয়।

ট্রেডের এক বড়োভাইয়ের কাছে শেখা। সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকছি। মুলতঃ কর্মজীবনের হঠাৎ প্রেসার, নিরানন্দ, একঘেঁয়েমি আমাদের অনেকের পোশাক-পরিচ্ছদে, চালচলনের উপরে প্রভাব ফেলে। তো, আমার ও সেটা আছে। কিন্তু বছরখানেক আগে তার উপদেশ শুনে অভ্যাস বদলে ফেলেছি। আমার দিনটা ভালো যাবে নাকি খারাপ যাবে ; আজ আমার ছুটির দিন না অফিসের দিন তাও ধর্তব্য না। প্রতিদিন ভোরে উঠে আমার প্রথম কাজ হয় প্রাতঃকৃত্য সেরে দাঁড়ি কামিয়ে সুগন্ধি মেখে ফিটফাট থাকা। এতে করে আমার প্রাক্তন ও দৈনন্দিন ব্যর্থতা অনেকখানি চাপা পড়ে থাকে !

[ প্রকাশকালঃ ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]