কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( বন্ধুত্ব ও ব্যবসা )

বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি মুখী শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস সেক্টর। ঘুরে ফিরে সব পেশার ও বিষয়ের লোক এসে জড়ো হয়েছেন এখানে। বছর বিশেক আগেও বলতাম ডাক্তার – ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সবাই আছে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে ! বছর দশেক পরে সেই কথা প্রত্যাহার করতে হল। কমপ্লাইয়েন্সের ধাক্কায় মোটামুটি সব কারখানায় সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও নার্স আছে। কিছু গার্মেন্টসের তো নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ ছোটখাটো ক্লিনিক কাম হাসপাতালও আছে।স্কুল-বন্ধুদের ভিতরে, ভেবেছিলাম মেরিন ইঞ্জিনিয়াররাই বোধহয় এই সেক্টরে আসবে না। মাস-ছয়েক আগে দেখি এক মেরিনার বন্ধু বিভিন্ন গার্মেন্টসে Fire Fighting বা অগ্নি প্রতিরোধ ট্রেনিং দিয়ে বেড়াচ্ছেন !

ব্যাংক থেকে শুরু করে ইনস্যুরেন্স, ট্রান্সপোর্ট, কৃষি, খাদ্য, মোবাইল কোম্পানি এমনকি প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসাও এই সেক্টরের জড়িতদের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

গত দশ পনের বছরে সরকারি ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল , ফ্যাশন ও গার্মেন্টসের উপরে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, চাকুরীর বাজার আগের মতো শক্তিশালী ও সহজলভ্য নেই। প্রায়শ: মুরব্বীদের বা ট্রেডের ভাইবেরাদরদের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার বা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবী আসে। উঁচু-পদে চাকরি করছি, একটা ছোটখাটো চাকরি কী আমি দিতে পারি না ! আবার আমি যে প্রতিষ্ঠানে আছি, সেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হচ্ছে! আমার পক্ষে সামান্য কিছু কাপড় বা অ্যাকসেসরিজ এর ব্যবসা দেওয়া কি এতোই কঠিন ?

প্রথমত: আসি চাকরির বাজারের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। হ্যাঁ, আমার স্বল্প-পরিসরের কর্মজীবনে ডিমান্ড-সাপ্লাই চেইনের প্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য লোকের চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। সে জন্য বাহাদুরির কিছু নেই। এখন পারছি না। কারণ, এখন যোগ্য লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডিমান্ডের তুলনায় বাজারে সাপ্লাই বেশী। আগে ফোন তুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদের কাউকে বললেও এন্ট্রি লেভেলের একটা চাকরি দিয়ে দিত। এখন, মালিক পর্যায়ের কাউকে বললেও , ভদ্রতার খাতিরে হয় সে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায় অথবা তাঁর অন্যকোন ম্যানেজারকে ধরিয়ে দেন। অনুরোধ রক্ষার দায়বদ্ধতা কমে গেছে নানা কারণে। কাউকে এখন অনুরোধ করতেও বিব্রত বোধ করি। সুতরাং চাকরির ব্যাপারে নবীন গ্রাজুয়েটদেরকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী যোগ্য হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, যোগ্য-লোকের চাকরির অভাব হয় না।
আমাদের প্রজন্মের অনেককে একটা আপাত: সচ্ছল জীবনযাপন করতে দেখে, অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদেরকে টেক্সটাইল বা এই রিলেটেড অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন বা পড়াচ্ছেন। কিছুদিন আগেও একজন খুব স্মার্ট নবীন গ্রাজুয়েটের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে বেশ হতাশ মনে হচ্ছিল । তাঁকে পজিটিভলি বুঝিয়ে বললাম, এই সেক্টর যতোই সংকুচিত হোক এখনো সুযোগ আছে যথেষ্ট।

লক্ষণীয় যে, আমাদের আগের প্রজন্মের অগ্রজেরা চাকরি শুরুর পাঁচ-সাত বছরের মাথায় জেনারেল ম্যানেজার , ইন-চার্জ বা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হয়ে গেছেন ; ক্রমান্বয়ে উদ্যোগী মেধাবী কেউকেউ বড় শিল্পপতিও। আমাদের কি অবস্থা ? আমদের প্রজন্মে অগ্রজদের অবস্থানে– মানে জিএম বা ইডি পজিশনে যেতে লেগে যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর। এখন যারা ঢুকছেন, কিছু ব্যতিক্রমী মেধাবী সৌভাগ্যবান ছাড়া মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় আমাদের অবস্থায় তাঁদের আসতে ১৫ থেকে ২০ বছর লাগবে। দ্রুত উন্নতি হবেনা বলে, আমরা যেমন এই সেক্টর ছেড়ে দিইনি ; নবীনদেরকেও লেগে থাকতে হবে। হ্যাঁ , সময় বেশী লাগবে কিন্তু সম্ভব।

দ্বিতীয়ত: ফেব্রিক, অ্যাকসেসরিজ, স্ক্রিন প্রিন্টিং ইত্যাদির ব্যবসাও আগের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। সব বড় গার্মেন্টস কারখানাগুলোরই ইন-হাউজ নিজস্ব প্রিন্টিং , অ্যাম্ব্রয়ডারী, টুইল-টেপ, লেবেল ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট আছে। ঘুরে ফিরে তাই অনেকের কাছ থেকে অনুযোগ আসে, ‘জাহিদ ভাই, আপনি তো আমার কোন উপকার করতে পারলেন না!’ ভাইরে, এইটা আমার ব্যর্থতা সত্য, কিন্তু সময় যে বদলে গেছে, আমার নিয়ন্ত্রণে নেই কিছুই।

তৃতীয়ত: FOB গার্মেন্টসের ব্যবসাও মুষ্টিমেয় কিছু বড় গ্রুপের কাছে চলে যাচ্ছে। আমরা অর্ডার প্লেসমেন্ট নিয়ে হিমশিম খাই। ক্রেতার নানাবিধ রিকোয়ারমেন্টের মাঝে মূল হচ্ছে – কমপ্লাইয়েন্ট হতে হবে এবং দামও কম হতে হবে (মাগনা না হলেও পানির দর হলে ভাল !) এতকিছুর মাঝে অফিস খরচ, বেতনবৃদ্ধি , ব্যাংক চার্জ, সার্ভিস চার্জ ধরে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা। অনেক খুঁজে আদর্শ পাত্রী পাওয়া গেলেও, সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায় না ! কারণ পাত্রী ( ফ্যাক্টরি) নিজেও আদর্শ পাত্র ছাড়া কাজ করে না !

সেদিন এক বন্ধু তাঁর ব্যবসায় সহযোগিতা চাইল । সঙ্গতঃ কারণেই নামোল্লেখ করছি না।ব্যবসা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একটা চমৎকার উদাহরণ দিল। ধরেন, ওয়ালমার্টের CEO আপনার ছোটবেলার বন্ধু। এখনো তাঁর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে.( উল্লেখ্য ওয়ালমার্টের বাৎসরিক রেভিনিউ কমবেশি ৫০০++ বিলিয়ন ডলার !) কিন্তু আপনি যখন তাঁর কাছে ব্যবসা চাইবেন, তাঁর পক্ষে হয়তো আপনার জন্য তেমন কিছুই করা সম্ভব হবে না। কারণ, ঐ কোম্পানি তাঁর সোর্সিং সিস্টেম এমন করে রেখেছে, যে স্বজনপ্রীতির জায়গা অত্যল্প।

কর্পোরেট চাকরিতে আমাদের অসহায়ত্বের ব্যাপারটা কেউ কেউ বোঝেন , বেশীরভাগই বুঝতে চান না !

প্রকাশকালঃ ৭ই অক্টোবর,২০১৬

কর্পোরেট অবজার্ভেশন (বড়ক্রেতা, ছোটক্রেতা)

আমার শৈশব কেটেছে অবাঙ্গালি-বিহারী অধ্যুষিত মিরপুর ১১ নাম্বারের সোসাইটি ক্যাম্পের ঠিক সামনে। আমাদের গলির মাথায় আনিসের মনোহারি মুদি দোকান ছিল। পুরো মহল্লার বাঙালী সমাজের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল আনিসের দোকান। মেহমান এসেছে হুট করে , যা তো আনিসের দোকানে ! আব্বার মাস শেষে টাকা পয়সার ঘাটতি, আনিসই ভরসা।

কিছুদিন পরে মহল্লায় বড় মাপের কনফেকশনারী দোকান চলে আসল। ফ্রিজ আসল, সেই ফ্রিজে ঠাণ্ডা কোক-ফান্টা পাওয়া যেতে লাগল। আর অধুনা প্রতিটি মহল্লা আর রাস্তায় বড়বড় সুপার স্টোর এসে তো ঢাকাকেই ঢেকে ফেলেছে ! আনিসের দোকানের মতো ছোট পুঁজির, নিম্নমধ্যবিত্তের নগদ-বাকীর ভরসাস্থল ওয়ান-স্টপ সার্ভিস দোকানগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ওর দোকানে কাঁচামরিচ, মাছ-মাংস ছাড়া- হেন জিনিষ নেই পাওয়া যেত না ! শুকনো বাজারের পুরোটাই ( চাল,ডাল,আলু,পিঁয়াজ,তেল-লবণ,ডিম, চিনি,গরমমসলা, ইত্যাদি) থাকত ওর কাছে।

দশ ফিট বাই দশ ফিট দোকানে এতো বিশাল ব্যাপ্তির প্রোডাক্ট রেঞ্জ সে কীভাবে গুছিয়ে রাখত , এবং চাহিবামাত্র সে কোন এক চিপার ভিতর থেকে গ্রাহকের চাহিদামত ইসবগুলের ভুষি বা রান্নার পাঁচফোড়ন বের করে দিত– সেটা আমার কাছে সেই সময়ে বিস্ময় ছিল, এখনো আছে !

একটা ব্যাপার নিয়ে আমি প্রায়শ: বিরক্ত হতাম। বাকীতে নিই বা নগদে, আমি ছিলাম আনিসের বড় খরিদ্দারদের একজন। কোন বারই ৫০ বা ১০০ টাকার নীচে সদাই-পাতি করতাম না। অথচ দেখা যেত, আমাকে রেখে অবাঙ্গালী বিহারী খরিদ্দারকে সে আগে সার্ভিস দিচ্ছে। দেখা গেল কোন ছোট বিহারী বাচ্চা এসে আট আনা বা এক টাকার কিছু কিনছে, তাকে সে আগে বিদায় করত। একদিন আনিসকে জিজ্ঞাস করলাম। ‘মামা, কাহিনী কি এইটা তো ঠিক না। আমি আগে আসছি। আমার সদাই-পাতি বেশী , আমাকে আগে বিদায় কর!’ কেন সে ওঁদেরকে আগে সার্ভিস দেয় সেটা একদিন সে আমাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দিল।

হয়েছে কী , একদিন আমি আনিসকে বাজারে ফর্দ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটা একটা করে ওজন করছে আনিস। ঠিক সেই সময় এক পিচ্চি বিহারী এসে, এক টাকার নোট খুব মুডের সাথে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ অ্যা মোদী, এক রুপাইয়াকে মুরালি দে !’ আনিস আমার মাল-পত্র গোছাচ্ছিল। এর ফাঁকেই কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বেশ উত্তপ্ত গলায় ,’ এ মোদী ! কাব তাক খাড়া রাহুঙ্গা,এক রুপাইয়া কি মুরালি কে লিয়ে? ’ আনিস আমার জিনিসপত্র রেখে তাড়াহুড়ো করে ঐ পিচ্চিকে এক টাকার মুরালি কাগজে মুড়িয়ে বিদায় দিল।

আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, ‘ মামা, আপনি আমার বড় গাহাক, আপনার সদাই-পাতি অনেক। আপনি জানেন, আপনার সময় লাগবে ; আপনি সেইটা বুইঝাই অপেক্ষা করবেন, তাড়াহুড়া করবেন না ! কিন্তু এই হালার খুচরা গাহাকগুলা–কিনব আটআনার জিনিষ, কিন্ত গরম দ্যাখলে মনে হইব লাখ টাকার সদাই করতে আইছে!’

ইদানীং নানা বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে বড়বড় ক্রেতাদের যথেষ্ট আস্থা আছে বাংলাদেশের উপরে। যেহেতু তারা তাঁদের সোর্সিং-এর বড় একটা অংশ চীন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে বছর বিশেক হল; বাংলাদেশের যে কোন পরিস্থিতিতে এঁদের মাথা ঠাণ্ডা থাকে। অপেক্ষা করে অবস্থার উন্নতির জন্য । চিৎকার চেঁচামেচি মাথা গরম করে, খুচরা ক্রেতারা। দেড় টাকার টি-শার্ট কিনবে , তাও ১৫০০ পিসের MOQ( Minimum Order Quantity) – কিন্তু কমপ্লাইন্সের গরম আর নানাবিধ চাহিদার বহর দেখলে আমার সেই বিহারী পিচ্চির কথাই মনে পড়ে !
অনুসিদ্ধান্ত: ক্রেতার চাহিদা ও মেজাজ তাঁর ক্রয় ক্ষমতার ব্যস্তানুপাতিক। যতো ছোট
ক্রেতা-ততো বেশী মেজাজ !

[ প্রকাশকালঃ ৭ই অক্টোবর,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( টপ ম্যানেজারস )

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের দেশী-বিদেশী টপ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে আমাকে। এঁদের কেউ কেউ এতো ভয়ঙ্কর মেধাবী ছিলেন যে, এখনও আমার সামনে কেউ তাঁদের নামোচ্চারণ করলে ফোনের এপাশের পুলিশের ছোট কর্মকর্তাদের মতো, স্যার স্যার বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে।

আবার এঁদের মধ্যে কেউকেউ ছিলেন বেশ মজার ও দুর্দান্ত কৌতূহল উদ্দীপক। মজার এইজন্য যে, তাঁদের কাজের দক্ষতা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত; কিন্তু অনেকসময় ‘উদ্ভূত জটিল সমস্যা’ সম্পর্কে তাঁদের তাৎক্ষণিক মনোভাব আমার কাছে যৎসামান্য এড়িয়ে যাওয়া ও ফাঁকিবাজ টাইপ মনে হয়েছে !

এঁদের একজনের কথা মনে পড়ছে ; সমস্যা তিনি মন দিয়ে শুনতেন। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলতেন, ‘ Jahid ! This is not my problem !’ এর মানে হচ্ছে, উনি অন্যকোন টপ ম্যানেজারের কাছে বল পাস করে দেওয়ার চিন্তা করছেন অথবা এই বিষয়ে উনার জড়িয়ে পড়াটা অনর্থক মনে করছেন অথবা উনি বলার চেষ্টা করছেন– সমস্যাটা নীচের লেভেলের কেউই তো সমাধান করতে পারে, উনাকে কেন ইনভল্ভ করা হচ্ছে ? কিন্তু , তাঁর সেই কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে , ‘Jahid ! This is not my problem !’ –আমার মনে থাকবে সারাজীবন !

ইদানীং সহকর্মীরা এমন কিছু সমস্যা নিয়ে সামনে হাজির হয়, যেগুলো তারা নিজেরাই সমাধান করে ফেলতে পারে। তখন , মাঝে মাঝে মনে হয়, সেই টপ ম্যানেজারের মতো যদি , কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে বলতে পারতাম “Guys ! This is not my problem !’ – ব্যাপারটা নিতান্ত মন্দ হতো না !

আরেক টপ ম্যানেজার ছিলেন, দুকাঠি সরেস। দৈনন্দিন সমস্যার ব্যাপারে উনি তাৎক্ষণিক সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা করতেন। বারবার তাঁর রুমে ঢুকে তাকে বোঝাতে হতো কী কী হয়েছে। মজার ব্যাপার , যখনই কোন জটিল সমস্যা তাঁর সামনে আসত। উনি দীর্ঘক্ষণ ধরে জটিল উদ্ভূত সমস্যাটি কোন দূর অতীত থেকে কীভাবে শুরু হয়ে আজ এই পর্যন্ত এসেছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতেন। ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা, মেজকর্তা, ছোটকর্তা সবার কাছ থেকে আলাদা আলাদা করে শুনতেন ; কিন্তু কোন সমস্যার সমাধান দিতেন না !
বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর আমি কিছুটা বিরক্ত ও উৎসুক হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ আচ্ছা তোমার সঙ্গে এতো দীর্ঘক্ষণ ধরে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে লাভ কি , যদি না কোন পথ খুঁজে না পাওয়া যায় !’ সেদিন উত্তর দিলেন না । অন্য আরেকদিন হালকা মুডে হঠাৎ করে বলে ফেললেন তাঁর ‘সিক্রেট’ !

তাঁর ভাষায় মাঝে মাঝে এইরকম জটিল সমস্যা হলে, বার বার আলোচনা করতে হয়। আলোচনা করতে করতে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সমাধান বের হয়ে আসে! আর যখন বুঝি যে, এই সমস্যার কোন সমাধানই নাই আমার কাছে, কিন্তু সেটা তোমাদেরকে লজ্জায় বলতেও পারছি না –সেই ক্ষেত্রে আমি চুপচাপ থাকি। আমি জানি, কিছু কিছু সমস্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই মিটে যায়। কেউ না কেউ করে ফেলে অথবা কোন না কোন ভাবে হয়ে যায়। ‘ I better keep myself silent, as sometimes with the duration of time, the problem gets resolved by itself !

কথা হচ্ছে, দুই টপ ম্যানেজারের দুইরকম পদ্ধতিই বেশ কার্যকর ও ইন্টারেস্টিং । কিন্তু আমি নিজে এখন পর্যন্ত কোনটাই হাতে-কলমে প্র্যাকটিস করে দেখিনি। অবশ্য, আমার আর তেমন কী বয়েস ; সামনে দিন তো পড়েই আছে !

[ প্রকাশকালঃ ৬ই অক্টোবর,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( দুর্জন সর্বদা পরিত্যাজ্য )

কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে মিলে যায় বলেই সৈয়দ মুজতবা আলীর এই গল্পটি আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল বছরদশেক আগে। বিশদ লেখার আলস্যে শেয়ার করা হয়নি। মুজতবা ভক্তদের গল্পটি জানা।আমি আমার খুব কাছের কয়েক সহকর্মীকে তাঁদের সিদ্ধান্তহীনতার সময়ে গল্পটি শুনিয়েছিলাম।

তো , মুজতবা আলী শুনেছিলেন এক ইরানী সদাগরের কাছ থেকে খোলা আকাশের নীচে সরাইয়ের চারপাইয়ের উপর শুয়ে শুয়ে। তাঁর ভাষাতেই তুলে দিচ্ছিঃ

দিনমজুর আগা আহমেদ ও তার খান্ডারনী বউ মালিকা খানমের সংসার লোকালয়ের শেষপ্রান্তে বনে। বউ আগা আহমেদকে সারাক্ষণ মিনসে , হাড়হাভাতে, ডেকরা বলে অভিসম্পাত দেয়। আর দিনশেষে শুকনো রুটি। একদিন আগা আহমেদ কী যেন খুঁজতে গিয়ে মালিকা খানমের লুকিয়ে রাখা মুচমুচে রুটি, ভেজা কাবাব , তেলতেলে আচার আবিষ্কার করল। সে রাতে আগা মনের দুঃখে খেল না। খেতে বসে যথারীতি বউয়ের মুখ ঝামটা ! সারারাত ভেবে ভেবে, আগা ঠিক করল, খুন করবে বউকে। তালাক দিয়ে লাভ নেই, একশ বার দেওয়া হয়ে গেছে। আশে পাশে প্রতিবেশী কেউ নেই, যে মনে করিয়ে দেবে – তালাক দেওয়া বউয়ের সঙ্গে সহবাস ব্যাভিচার।

আগা আহমেদ সকালবেলা বনে গিয়ে খুঁড়ল গভীর এক গর্ত, তার উপরে কাঠ, কঞ্চি লতাপাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে আসল। বিকেলে বউকে বলল, চল একটু বেড়িয়ে আসি , বউ হাসল দশমিনিট ধরে। ‘ মিনসের পরানে আবার সোহাগ জেগেছে!’ নাছোড়বান্দা আগা, বহু বুঝিয়ে সুঝিয়ে মালিকা খানমকে নিয়ে গেল সেই গর্তের কাছে , তারপর মোক্ষম এক ধাক্কায় নীচে। আরো লতাপাতা দিয়ে ভালো করে গর্তটি ঢেকে দিয়ে বাড়ী ফিরে তিন রকমের মোরব্বা, হালুয়া, আচার , হরিণের মাংস দিয়ে ডিনার। বউ নেই, এই কথা ভাবলেই মনটা খুশীতে ভরে উঠছে তার ! কিন্তু পরদিন সকালে মনের আকাশে একটু হলেও অনুশোচনা জেগে উঠল। হাজার হোক, নবী রাসুলের কসম কেটে বিয়ে করা বউ। ওই অবস্থায় আর পাঁচজন যা করে , আগা তাই করল। ‘ যাক গে ছাই, গিয়ে দেখেই আসিনা, বেটি গর্তের ভিতরে আছে কী রকম।’ গর্তের মুখ সরাতেই পরিত্রাহি চিৎকার , কিন্তু আশ্চর্য ! এতো মালিকা খানমের গলা নয় ! পাতা সরিয়ে দেখে , অ্যাব্বড়ো এক কাল-নাগ , কুলোপনা –চক্কর-গোখরা সাপ । সে তখনো চেচাচ্ছে, ‘ বাঁচাও বাঁচাও , আমি তোমাকে হাজার টাকা দেব, লক্ষ টাকা দেব , আমি গুপ্তধনের সন্ধান জানি, আমি তোমাকে রাজা করে দেব। ’

আগা শুধালো, ‘ তুমি এতো লোকের প্রাণ নাও – নিজের প্রাণ দিতে এতো ভয় কীসের ?’

ঘেন্নার সংগে সাপ বলল , ‘ ধাত্তর তোর প্রাণ ! প্রাণ বাচাঁতে কে কাকে সাধছে। আমাকে বাঁচাও এই দুশমন শয়তানের হাত থেকে। এই রমনীর হাত থেকে। মাগো মা, সমস্ত রাত কি ক্যাট ক্যাটটাই না করেছে, আমি ড্যাকরা, মদ্দা , মিনসে হয়েও অপদার্থ! অবলা নারীকে কেন সাহায্য করছি না গর্ত থেকে বের হতে। ’

আগা আহমেদ বলল, ‘ তা ওকে একটা ছোবল দিয়ে খতম করে দিলে না কেন ?’ চিল-চ্যাচানি ছেড়ে সাপ বলল, ‘ আমি ছোবল মারব ওকে ? ওর গায়ে যা বিষ তা দিয়ে সাত লক্ষ কালনাগিনী তৈরী হতে পারে ! ছোবল মারলে আমি ঢলে পড়তুম না ? ওসব পাগলামি রাখো, আমাকে গর্ত থেকে তোল, অনেক ধনদৌলত দেব, পশুপক্ষীর বাদশা সুলেমানের কসম !’

অবাক ব্যাপার একরাত সাপের সঙ্গে থেকে মালিকা খানমের পরিবর্তন এসেছে, সে মাথা নীচু করে বলল, ‘ ওরা গুপ্তধনের সন্ধান জানে।’

আগা আহমদের টাকার লোভ ছিল মারাত্মক, কিরা কসম কাটিয়ে দুজনকেই গর্ত থেকে তুলল। সাপ বলল, গুপ্তধন আছে, উত্তর মেরুতে—বহু দূরের পথ। তারচেয়ে সহজ পথ বাৎলে দিচ্ছি তোমাকে , শহর কোতয়ালের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরব আমি , কেউ আমাকে ছাড়াতে কাছে আসলেই মেয়েকে ছোবল মারতে যাব। শুধু তুমি আসলেই আমি সুড়সুড় করে সরে পড়ব। তুমি পাবে বিস্তর এনাম, এন্তার ধনদৌলত। কিন্তু খবরদার, ঐ একবার, অতি লোভ করতে যেও না !’

শহরে তুলকালাম কান্ড , কোতয়ালের মেয়েকে তিন দিন ধরে কাল-নাগ গলা জড়িয়ে ফোঁসফোঁস করছে ! লক্ষটাকা পুরষ্কার ঘোষণা হয়েছে, সব ওঝা ফেল মেরছে, বলছে উনি মা মনসার বাপ ! প্রথমে আগাকে কেউ পাত্তা দেয় নাই। ওঝা-বদ্যি হদ্দ হল, ফার্সী পড়ে আগা ! তারপর যা হবার তাই হল, আগা ঘরে ঢোকামাত্রই কাল-নাগ কোথা দিয়ে বের হয়ে গেল, কেউ টেরই পেল না। লক্ষ টাকার সঙ্গে সঙ্গে আগাকে করে দেওয়া হল, ঐ বনের ফরেস্ট অফিসার। আগা সুখী, মালিকা খানম ও দাসী , চাকর-বাকর নিয়ে তম্বি-তম্বা করে ব্যস্ত।

ওমা ! একমাস যেতে না যেতেই , উজীর সাহেবের মেয়ের গলায় একই সাপ ! আগার বিলক্ষন স্মরণ ছিল, একবারের বেশী না যেতে। আগা যতই নারাজী হয়, পাইক পেয়াদা কী ছাড়ে ! সাপ জুলজুল করে তাকিয়ে বললে, ‘ তোমার খাঁই বড্ডো বেড়েছে- না ? তোমাকে না পই পই করে বারন করেছিলুম , একবারের বেশী আসবে না ! তুমি আমার উপকার করেছ, এইবারে মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এই শেষবার , আর যদি আসো, মারবো এক ছোবল, তিন সত্যি !’

নওয়াব উপাধি সঙ্গে দশলক্ষ টাকা , পাঁচশ ঘোড়ার সৈন্যদল পেয়েও চিন্তায় চিন্তায় আগার ঘুম নেই, গলা দিয়ে পানি নামে না । কাল-নাগ আবার কখন কী করে বসে। আগা সিদ্ধান্ত নেয়, দেশ ছেড়ে পালাবে।

কী কান্ড, পরদিনই কোতোয়াল স্বয়ং হাজির। ঐ হারামজাদা কাল-নাগ জড়িয়ে ধরেছে শাহাজাদীর গলা। আগা আহমেদ যতোই কোতয়ালের পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদে, লাভ হয় না। কোতয়াল হুকুম করে একে বন্দী করে নিয়ে চল বাদশাহের কাছে। সারাপথ আগা আহমেদ, চোখ বন্ধ করে, নিজের মৃত্যুচিন্তা আর আল্লাহর নাম নিতে থাকে।

স্বয়ং বাদশা হাত ধরে নিয়ে গেলেন রাজকুমারীর ঘরের কাছে। আগা আহমেদ, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। কাল-নাগ হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘ আবার এসেছিস হারামজাদা, এবার আমার কথার নড়চড় হবে না ! তোর দুই চোখে দুই ছোবল।‘’ আগা বিনীত কন্ঠে বলল, ‘টাকার লোভে আসিনি। সে তোমার বদৌলতে অনেক পেয়েছি। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, তাই তোমার একটা উপকার করতে এলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম , শুনলাম তুমি এখানে। আজ সকালে আমার বিবি মালিকা খানম আমাকে বলেছে, সে আসছে রাজকুমারীকে সালাম জানাতে ! বোধহয় এক্ষুনি এসে পড়বে। তুমি তো ওঁকে চেনো, তাই ভাবলুম তোমাকে খবরটা দিয়ে উপকারটাই না কেন করি , তুমি আমার –— ’ ‘বাপ রে মা রে ’ চিৎকার শোনা গেল । কোনদিক দিয়ে যে , কালনাগ অদৃশ্য হল আগা আহমেদ পর্যন্ত বুঝতে পারল না !

এর পর আগা আহমেদ শান্তিতেই জীবন যাপন করেছিল।

গল্পটি নানা দেশে নানা ছলে, নানা রূপে প্রচলিত আছে । কাহিনী শেষ করে সদাগর মুজতবাকে জিজ্ঞাস করলেন , ‘ গল্পটার “ মরাল” কি, বলো তো ?’

‘ সে তো সোজা, রমণী যে কী রকম খান্ডারনী হতে পারে , তারই উদাহরণ এ দুনিয়ার নানা ঋষি-মুনিতো এই কীর্তনই গেয়ে গেছেন।’ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পরে সদাগর বললেন, ‘ তা তো বটেই । কিন্তু জানো , ইরানী গল্পে অনেকসময় দুটো করে “মরাল” থাকে। এই যেরকম হাতীর দুজোড়া দাঁত থাকে। একটা দেখাবার , একটা চিবোবার। দেখাবার “মরাল” টা তুমি ঠিকই দেখেছ। অন্য “মরাল”-টা গভীরঃ- খল যদি বাধ্য হয়ে , কিংবা যে কোন কারণেই হোক , তোমার উপকার করে তবে সে উপকার কদাচ গ্রহণ করবে না। কারণ খল তারপরই চেষ্টায় লেগে যাবে , তোমাকে ধনে প্রানে বিনাশ করবার জন্য, যাতে করে তুমি সেই উপকারটি উপভোগ না করতে পারো। অবশ্য তোমার বাড়ীতে যদি মালিকা খানমের মতো বিষ থাকে অন্য কথা ! কিন্তু প্রশ্ন, ক’জনের আছে ও-রকম বউ ?’

 

[ প্রকাশকালঃ ২রা আগস্ট,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( অথবা নিছক ঢাকাইয়া চুটকি )

বৃহদাকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বা গ্রুপ অভ কোম্পানি গুলোতে কোন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে চাকরীচ্যুত করতে হলে বা মানে মানে বিদায় করতে হলে একেক কোম্পানি একেকরকম নিয়ম মেনে চলে। টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে চাকরি করার সময় দেখেছি— যখনই প্রোডাকশন ও কারখানা থেকে বড় কোন কর্মকর্তাকে হেড অফিসে ডেকে কোন পোস্টিং দেওয়া হয় ; আমরা বুঝে ফেলতাম ‘অমুক স্যার’ আর বেশীদিন নেই গ্রুপে।

আবার, অনেক কোম্পানিতে বেতন বোনাসের বাইরেও প্রত্যক্ষ অবহেলার পরিমাণ এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে, তিনি যতদূর সম্ভব ইজ্জত নিয়ে কেটে পড়েন। কোন কোম্পানিতে মালিকপক্ষ সম্ভাব্য টার্গেটেড ব্যক্তির ডিপার্টমেন্টের লোকজন নিয়ে আলাদা মিটিং করা শুরু করেন, তাকে না জানিয়েই।
আরও মোক্ষম উপায় মালিকপক্ষের কাছে আছে ; সেটা হচ্ছে সম্ভাব্য ব্যক্তিকে তাঁর কাজের দক্ষতার সঙ্গে মিল নেই, এইরকম ফালতু কিছু কাজের দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রাখা। সরকারি চাকুরীতে OSD ( Officer on Special Duty) করে রাখার মত আর কী !
সবচেয়ে মোক্ষম ও কার্যকর উপায় হচ্ছে, সম্ভাব্য ব্যক্তির চেয়ে অনভিজ্ঞ সহকর্মী বা তাঁর অধস্তন অযোগ্য ব্যক্তিকে পদন্নোতি দিয়ে দেওয়া। এই অপমান মূলত: কোন সুস্থ লোকের পক্ষে হজম করা সম্ভব হয় না।
যাই হোক, এক যুগ আগে আমিও অনেকটা এইরকম একটা সিচুয়েশনের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কোনভাবেই কিছু যখন হচ্ছিল না , তখন রাগে দুঃখে ক্ষোভে তৎকালীন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মালিকপক্ষের আস্থাভাজন বসকে গিয়ে এই চুটকি শোনালাম। পরিশেষে প্রশ্ন করলাম, ‘ আপনি আসলে আমাকে নিয়ে কি করতে চাচ্ছেন ?’
যদিও উত্তর মেলেনি কখনই !

সেই চুটকি আবারও সবার সঙ্গে শেয়ার করছি, যৎসামান্য খিস্তি ক্ষমার্হ হবে আশা রাখি।
ঘটনা ব্রিটিশ আমলের।
মহল্লা প্রধান বা সর্দাররা জাতে ওঠার জন্য ঘরে বন্দুক রাখতেন। নতুন সর্দার যথারীতি দোনলা বন্দুক কিনলেন। কিনে রেখে দিলে তো হবে না ! ‘ ছিকার-ঠিকার না করলে — মহল্লা বুঝব ক্যাম্থে, বন্দুক কিনবার লাগছি !’
তো , সর্দার যাবেন পাখী শিকারে। সন্দেহ থাকতেই পারে, নতুন সর্দারের বন্দুক চালানোটা ঠিকমত জানা আছে কী নেই। ঢাকার আশেপাশে তখন অসংখ্য জলাভূমি এবং অতিথি পাখীর আনাগোনা। শীতের শেষ, অস্বস্তিকর চিটচিটে রৌদ্রের শুরু। অনেক আয়োজন করে কাক-ডাকা ভোরে নৌকা ও মাঝিকে নিয়া সর্দার পাখী-শিকারে বের হলেন। এই জলা, সেই জলা, পাখীর আর দেখা নাই। মাঝি চূড়ান্ত বিরক্ত। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ধীরেধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ। হঠাৎ দূরে ঘাস, লতা-পাতার আড়ালে একটা বক দেখা গেল। মাঝি খুব সাবধানে বৈঠার আওয়াজ না করে আস্তে আস্তে নৌকা এগিয়ে নিয়ে চলছে।
শ’ খানেক হাত দূরে ।

মাঝি: ‘ গুলি করেন ছর্দার সাব।’
সর্দারঃ ‘ আরেকটু আউগাইয়া যা !’
পঞ্চাশ হাত দূরে–
মাঝি: ‘ গুলি করেন ছর্দার সাব।’
সর্দার: ‘আরেকটু আউগাইয়া যা !’
এমন করতে করতে বিশ হাত দূরে গিয়ে অবশেষে সর্দার বন্দুক তাক করলেন ।
মাঝি: ‘এইবার গুলি করবার লাগেন, বক তো উইড়া যাইব গা।’
সর্দার: ‘ আরেকটু আউগাইয়া যা’।
তিতবিরক্ত হয়ে মাঝি সর্দারকে: ‘ ছর্দার সাব, আপনারে এউগা কথা জিগাই?’
বন্দুকে চোখ রেখেই সর্দার বললেন: ‘ জিগা।’
মাঝি: ‘ সত্যি কইরা কন্ তো, আপনে হালায় বক রে গুলি করবেন, নাকি বকের পুঁটকি মারবেন?’

[ প্রকাশকালঃ ২৮শে সেপ্টেম্বর ,২০১৬ ]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলুন )

ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম-এর সেই বিখ্যাত উক্তি বহুশ্রুত ও সবার জানা। “ Love your job, but don’t love your company , because you may not know when your company stops loving you.”

অনেকেই ব্যাপারটাকে নেগেটিভলি ব্যবহার করেন ; এতে করে মালিক-কর্মচারী দূরত্ব বেড়ে যায়। আমি যেহেতু আশাবাদী লোক, তাই আশার কথা বলি। মূলত: এই ব্যাপারটিকে যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায় , সেটা বছর পনের আগে আমার প্রতিষ্ঠানের সিইও এক ঘরোয়া মিটিং-এ আমাদের কয়েকজনকে বলেছিলেন। উনি এখন আর আমাদের দৈনন্দিন ব্যবসায় জড়িত নন। ভাল লেগেছিল, তাই মনে আছে।

আসলে আপনি যেখানে কাজ করছেন সেই কাজকে এনজয় করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আনুগত্য এবং ‘Good-feeling’ থাকতে হবে। পরিবারের সঙ্গে আপনার কথোপকথন সকালে ঘণ্টাখানেক আর রাতে বাড়ী ফিরে সর্বোচ্চ ঘণ্টাদুয়েক। অথচ খেয়াল করে দেখেন, জাগ্রত আপনাকে পরিবারের চেয়ে আপনার কর্মস্থলে তিনগুণ বেশী সময় দিতে হচ্ছে ! আবার, নিজের সম্পূর্ণটা দিতে না পারলে কী করে বুঝবেন আপনার সঠিক সম্ভাবনা কতখানি বা আপনার পক্ষে কতদূর যাওয়া সম্ভব ! নিজের কর্মদক্ষতা বাড়লে আপনার সুনাম যেমন বাড়বে, প্রতিষ্ঠানেও আপনার অবস্থান শক্ত হবে। একই সঙ্গে মার্কেটেও আপনি পরিচিত হয়ে উঠবেন।

একজন মালিক হিসাবে তিনি আমাদেরকে তাঁর কোম্পানির জন্য শতভাগ দিতে বলেছিলেন ; একইসঙ্গে আমাদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন মার্কেটে নিজের একটা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে। নিজের নেটওয়ার্কিং স্কিল, কমিটমেন্ট, পাবলিক রিলেশন, সততা, দক্ষতা দিয়ে নিজের একটা ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করা আবশ্যক ! আমি অনেকসময় দেখেছি , কিছু দক্ষ কর্মকর্তা ও ম্যানেজার পরিশ্রম দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানের চেয়েও নিজের নামকে বড় করে ফেলেছেন। একসময় দেখা যায় , মার্কেটে তাঁর নামেই প্রতিষ্ঠানকে চেনে সবাই। বলেন , অমুক সাহেবের তমুক প্রতিষ্ঠান।

জানি সবাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবে না । কিন্তু এই লেখা তেমন কারো চোখে পড়লে, সে নিশ্চয় চেষ্টা করবে এবং সফলও হবে ! আশা করতে দোষ কী !

[ প্রকাশকালঃ ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]