কর্পোরেট অবজার্ভেশন (ও হেনরি-র গল্প ও কর্পোরেট ট্রাজেডি)

পাঠক, আমার এই অবজার্ভেশনটা সহজবোধ্য করতে হলে আপনাকে আমেরিকান লেখক ‘ও হেনরি’-এর একটি গল্পে ফিরে যেতে হবে। ‘ও হেনরি’-কে সবাই উচ্চমাধ্যমিকের ‘ The Gift of Magi’ ছোটগল্পের জন্য একনামে চিনে ফেলবেন। নিম্নবিত্ত এক নবদম্পতির( জিম ও ডেলা) খুব সামান্য অর্থ দিয়ে দু’জন দু’জনের জন্য গোপনে ক্রিসমাস গিফট্ কেনে ; অসাধারণ গল্প ছিল সেটা।

যাই হোক, তাঁর আরেকটি গল্প ‘The Cop and the Anthem’ ( ১৯০৪)-এর অনুবাদ পড়েছিলাম সেই ৯০ সালে। কয়েকদিন ধরে কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না—কার লেখা । এক বন্ধু মনে করিয়ে দিল ও হেনরির কথা। বাংলায় অনূদিত হয়েছে ‘সুর ও বেসুর’ নামে।
নিউইয়র্ক শহরের হত-দরিদ্র কর্ম-বিমুখ সোপি প্রতিবছর শীত আসার আগেভাগেই কোন একটা ছোটখাটো অপরাধ করে একটু দূরে একটা দ্বীপের জেলখানায় যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলে। তিনমাসের জন্য খাওয়া দাওয়া আড্ডার নিশ্চয়তা। তীব্র শীতের হাত থেকে বাঁচার এর চেয়ে সম্মানজনক ব্যবস্থা সোপির জানা নেই। মাথা নিচু করে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে তাঁর গায়ে বাঁধে।

গল্পের শুরুতে সে অপরাধ করার জন্য প্রথমে একটা হোটেলে বিনা পয়সায় খেয়ে বিল না দেওয়ার চেষ্টা করে। হোটেল লোক তাঁর জীর্ণ কাপড় দেখে আগেভাগে দূর করে দেয়। পরে সে চেষ্টা করে বড় একটা শো রুম বা দোকানের কাঁচ ভেঙ্গে পুলিশের কাছে ধরা পড়তে। পুলিশ সোপিকে ফেলে অন্য একজন দৌড়ে যাওয়া লোককে সন্দেহ করে তাঁর পিছে ছোটে। মরিয়া হয়ে সোপি তৃতীয় চেষ্টায় একটা সস্তা হোটেলে খাওয়া দাওয়া সারে, খাওয়া শেষে বলে তাঁর কাছে একটা ফুটো পয়সাও নেই। অনুরোধ করে তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে। পুলিশে ধরিয়ে না দিয়ে , হোটেলের লোক তাঁকে কিছু উত্তমমধ্যম দিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। সোপি হতাশায় ভোগে, আশ্চর্য ! অ্যারেস্ট হওয়া এতো কঠিন !

ঠিক পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলাকে সে টার্গেট করে। কাছে যেয়ে কু-প্রস্তাব দেয়। ধরে নেয় এবার নিশ্চিত গ্রেফতার ! কপাল খারাপ সোপির। মেয়েটা আসলে ছিল পতিতা। মেয়েটা উল্টো তার বাহু-লগ্না হয়ে হাঁটা শুরু করে। সোপি একসঙ্গে কিছু দূর গিয়ে দৌড়ে পালায়।

এরপর থিয়েটারের সামনে পুলিশ দেখে সে মাতালের অভিনয় করে, আশেপাশে একটা গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। লোকেরা অভিযোগ করলে পুলিশ এসে বলে, হার্টফোর্ড কলেজের ডিমের ব্যবসায়ীদের কেউ হবে হয়ত, ওদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য উপরওয়ালাদের নির্দেশ আছে। নিরাশ হয়ে সোপি মাতলামি বন্ধ করে। পুলিশ কি তাঁকে কোনভাবেই গ্রেফতার করতে পারে না !

সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের দামি সিল্কের ছাতা নিয়ে হাঁটা ধরে সে। এইবার তো একটা কিছু হবে।কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা করার পর ভদ্রলোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, সেও নাকি অন্য কোথাও থেকে ছাতাটি খুঁজে পেয়েছিল। হতে পারে, ছাতাটি আসলে সোপির-ই। কিছুদূর গিয়ে ছাতাটি ছুঁড়ে ফেলে সোপি। ‘ধরা পড়তে ইচ্ছে করেছি, আর ব্যাটারা অমনি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমি যেন দোষই করতে পারি না।’

হঠাৎ এক নিস্তব্ধ মোড়ে পুরনো গির্জার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। সমবেত কণ্ঠে রবিবারে প্রার্থনা উচ্চারণ করছে সবাই। সেই সঙ্গীত, সেই মূর্ছনা তাঁর হৃদয়কে অভিভূত করে ফেলে। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। তাঁর মনে পড়ে যায় শৈশবের মায়ের কথা, বন্ধুদের কথা, ভালোবাসার কথা, রঙিন ভবিষ্যতের কথা। ওই বেদনার স্মৃতি আর অর্গানের করুণ ধ্বনি তাঁর হৃদয়কে ধুয়ে দিয়ে যায় ! তার চোখ খুলে যায় !

এ কী অধঃপতন তার ! এ-ভাবে কুকুরের মতো বেঁচে থাকা , আশা নেই, রঙ নেই। কোন ভরসা নেই, শুধু এক কুটিল অভিলাষ নিয়ে সে বেঁচে আছে কোনমতে।
সে সিদ্ধান্ত নেয় , সে ঘুরে দাঁড়াবে, সে আবার মানুষ হবে। ওই অর্গানের সুর তাকে বদলে দিয়েছে, কালই সে শহরে চলে যাবে। পশমের যে ব্যবসায়ী তাকে ড্রাইভারের চাকরি দিতে চেয়েছিল , তাঁর কাছে গিয়ে কাজটা চাইবে।

[ গল্পের একেবারে শেষে চমক আসে ! ]
হঠাৎ কে যেন সোপির হাত ধরে ফেলল। চকিতে মুখ ফিরিয়েই সে দেখতে পেল: পুলিশ।
‘কী করছ এখানে, বাছাধন?’
‘কিচ্ছু না।’
‘তাহলে হাজতে চল চাঁদ।’
পরের দিন সকালে কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন: ‘তিন মাসের জন্য দ্বীপে কারাদণ্ড দেওয়া হইল।’

এবার আসি কেন এই গল্পটি চিরন্তনত্ব কর্পোরেট জীবনে সঙ্গে যায় ! আমি অসংখ্যবার দেখেছি এই চমক। যেই মুহূর্তে কোন একটি কর্মচারী অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠেন ; কেন জানি না ; সেই তাঁকে চলে যেতে হয় অন্যত্র, অন্য কোথাও। মালিক-কর্মচারী দু’পক্ষ থেকেই ব্যাপারটা দুইভাবে হতে দেখেছি আমি বহুবার। অনেক যোগ্য কর্মচারীকে কে দেখেছি বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠানে অবমূল্যায়িত হতে । প্রতিষ্ঠান অন্য অনেক অযোগ্য লোকের মূল্যায়ন করছে, বাকী থেকে যাচ্ছে শুধু আমাদের সেই ‘ট্র্যাজিক’ নায়কটি ! শেষ পর্যন্ত সোপির মত, অনেক ভাঙচুরের পর যখন কর্মচারীটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে জ্বলজ্বলে—তখন হয়তো সামান্য কোন পদোন্নতি বা তার চেয়েও যৎসামান্য কিছু বেতনবৃদ্ধির হৃদয়হীন অনুপস্থিতিতে সে চলে যায় আরেক প্রতিষ্ঠানে !

আমার নিজের কর্মজীবনেও ঘটে গেছে এই ট্র্যাজেডি ! আমার সবচেয়ে দেদীপ্যমান অবস্থায় আমি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সে আরেক কাহিনী । ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে , ট্র্যাজেডিই কারো কারো জীবনের নিয়তি। আমি নিজেও হয়তো আরেকটা ট্র্যাজেডির জন্য অপেক্ষা করছি !

প্রকাশকালঃ ১৯শে নভেম্বর,২০১৬

নবীন প্রজন্মের জন্য কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন।দ্বিতীয় পর্ব।।

৬। প্রযুক্তি ও দক্ষতা, এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় :
বাংলাদেশের যে দক্ষ জনশক্তি আছে ও ক্যাপাসিটি আছে, সেটা দিয়ে আমরা ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে পৌঁছে যেতে পারি। আমরা পিছিয়ে পড়ছি, আমাদের দক্ষতার কমতিতে। অনেক আগে, ক্লাসে আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মাসউদ স্যার বলেছিলেন, চীনে একটি উইভিং লুমে ১০ বছর ধরে একটানা ৪০/৪০ পপলিন কাপড় হচ্ছে। ওই লুমের কর্মী চোখ বুঁজেও সেটা চালাতে পারে। আর বাংলাদেশের একটা লুমে আজ পপলিন তো কাল টুইল, তো পরশু ক্যানভাস কাপড় চলে। বীম চেঞ্জ কর রে, মেশিন স্পেসিফিকেশন চেঞ্জ কর রে, গুচ্ছের হাঙ্গামা ! এফিসিয়েন্সি আসবে কোথা থেকে ? সত্যিকার এফিসিয়েন্সি চায়নার থাকবে না তো কি আমাদের থাকবে?
আবার ২০০৮ সালে আমি একটা বৃটিশ সোর্সিং অফিসে( Mothercare Sourcing UK) বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড ছিলাম। একই সঙ্গে আমাকে ডুয়েল রোল প্লেয়ার হিসাবে গ্লোবাল সোর্সিং ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতে হত। আমাকে নিরপেক্ষভাবে সব দেশের ( মূলত: ভারত, চীন ও বাংলাদেশ) মূল্য-তালিকা তুলনা করে অর্ডার প্লেস করতে হত।

কটন টি-শার্টে আমাদের চেয়ে সাশ্রয়ী মূল্য আর কেউ দিতে পারবে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমাদের সবচেয়ে বেশী দক্ষতার প্রোডাক্টে , মানে কটন টি-শার্টে—দক্ষিণ ভারতের কিছু কারখানা দারুণ কম্পেটিটিভ দাম দিয়ে বাংলাদেশের অর্ডার নিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয়দের কে না চেনে ! এঁরা যা জানে না , সেটা বলে বেড়ায়, আর যেটা জানে সেটা কদাপি বলতে চায় না ! আমি জিজ্ঞেস করলাম , তোমাদের এতো ওভারহেড কস্ট, কাটিং মেকিং কস্ট , কিভাবে কটন-টি শার্টের দাম মেলাচ্ছ? যথারীতি কোন সদুত্তর পেলাম না।
আমাকে ওই সময়ে প্রায় প্রতি মাসেই ব্যাঙ্গালোরের Hub Office- এ মিটিং এ যেতে হত।এঁদের সঙ্গে খাতির টাতির করে, কারখানা ঘুরে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সেই সময়ে , কোন একটা গার্মেন্ট শিপমেন্টের আগে মূল কাপড়ের কনজাম্পসন-এর সঙ্গে অতিরিক্ত ওয়েস্টেজ ক্যালকুলেটে করতে হত। সেটা ছিল, ধরেন একটা টি-শার্টের ক্যালকুলেটর কনজাম্পসন ২ কেজি ফিনিশড কাপড়। আমাদের দেশে এর সঙ্গে প্রসেস লস ( নিটিং , ডাইং ফিনিসিং ), কাটিং লস, প্রিন্টিং লস, অলটার ইত্যাদি ইত্যাদি ধরে ১৫ থেকে ২৫ ভাগ পর্যন্ত অতিরিক্ত কাপড়ের বুকিং দেওয়া হত। তারপরেও দেখা যেত, প্রোডাকশনের মাঝখানে কাপড়ের শর্ট বুকিং আসছে। আবার নিটিং ডাইং, আবার অতিরিক্ত কাপড়। এতো কিছুর পরেও শিপমেন্টের সময়ে ১০০% শিপমেন্ট দিতে পারত না আমাদের কারখানাগুলো। অথচ, ভারতীয় কারখানাগুলো ভার্টিকাল সেটআপের না। এঁরা কাপড় নেয় এক জনের কাছ থেকে, সেলাই করে আরেক জায়গায়। ১০০ কেজি যদি মূল কনজাম্পসন হয় , তবে এঁরা ১০৩/১০৫ কেজি কাপড় বুকিং দেয়। মজার ব্যাপার সেই ১০৩ কেজি ফেব্রিক দিয়ে এঁরা ২% বেশী শিপমেন্ট দেয় ! এখন, আমাদের দেশের যে কোন একটা গার্মেন্টস-এর ন্যায্য দামের সঙ্গে ১৮ থেকে ২০ ভাগের এই যে অপচয়ের , অদক্ষতার মূল্য যুক্ত হচ্ছে—সেটার দাম ক্রেতারা কেন দেবে ?

প্রাত্যহিক কাজের ক্ষেত্রেও তাই। একজন ইউরোপীয় ৫ দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ৪০ ঘণ্টায় যে কাজ করছেন , আমাদের একজন মার্চেন্ডাইজার ৩ সপ্তাহেও তা করতে পারছেন না। আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে, যখন দেখি কেউ কেউ গভীর রাত পর্যন্ত মার্চেন্ডাইজিং করছেন। হ্যাঁ, ক্ষেত্র বিশেষে আপনাকে তা করতে হতে পারে, কিন্তু সেটা যখন নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়—আপনার এফিসিয়েন্সি নিয়ে ম্যানেজমেন্ট প্রশ্ন তুলতেই পারেন। হয় আপনার দক্ষতা কম অথবা আপনার সাপোর্টিং হ্যান্ড লাগবে।

কেন এই কথা বলছি, কারণ আমাদের বুড়ো প্রজন্ম কিন্তু গ্রাউন্ড লেভেল মার্চেন্ডাইজিং করে এই খানে উঠে এসেছি। আমাদের সময়ের কারখানার অদক্ষতা কি পর্যায়ের ছিল, সে আর কহতব্য নয় ! অনেকগুলো ঈদের দিনের ভোররাতে ট্রাকে শিপমেন্ট উঠিয়ে আমি বাসায় এসেছি। কোনমতে ঈদের জামাত ধরেছি, তারপরে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ওই ছিল আমাদের ঈদ-বিনোদন। সপ্তাহের ছুটির দিন নামকাওয়াস্তে ছিল শুক্রবার। তাও প্রতি শুক্রবারে ১০/১১টার মধ্যে বাকী কাজ শেষ করার জন্য আমাদের অফিসে যেতে হয়েছে। শুক্রবারে একটু দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাই ছিল আমাদের সবচেয়ে আনন্দের ! সেই তুলনায় এখন এতো বেশী স্মার্ট লোকের সমাগমে কারখানা , ট্রেডিং অফিস সবার দক্ষতা অনেক অনেক বেড়ে গেছে।আপনাদের এই প্রজন্মকে গ্লোবাল কম্পিটিশনে টিকে থাকতে হলে, সময়োপযোগী প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হতে হবে। একই সঙ্গে নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে, এতে করে আমাদের পুরো ট্রেড উপকৃত হবে।

৭। নিজেকে গড়ে তুলুন নতুন নতুন তথ্য ও ট্রেনিং দিয়ে :
স্মৃতি থেকে লিখছি, সম্ভবত: আমেরিকার প্রেসিডেন্ট Abraham Lincoln বলেছিলেন “Give me six hours to chop down a tree and I will spend the first four sharpening the axe.” ঠিক এই জায়গাটাই আমি নতুন প্রজন্মকে বলব। নিজের দক্ষতার কুঠারে ধার দিতে থাকেন। অলস সময়ে কোন একটা নতুন ভাষা শিখুন, MBA করা না থাকলে করে ফেলুন। যে কোন ট্রেনিং প্রোগ্রামে সুযোগ পেলে ট্রেনিং নিয়ে ফেলুন।সেদিন এক অনুজ ছোটবোন বলল, নতুন অফিসে যেখানে সে সদ্য যোগ দিয়েছে সেখানে নাকি কাজের প্রেশার আগের তুলনায় অনেক কম। সে তাই ফেসবুক বা অন্যকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি তাঁকে বললাম, এই সুযোগ কিছুদিন পরে নাও পেতে পার। কিছুদিন পরে তুমি হয়তো ভয়ংকর ব্যস্ততার মধ্যে পড়ে যেতে পার। তুমি কি MBA করেছ। সে না সূচক উত্তর দিলে , তাঁকে অনুরোধ করলাম, করে ফেলতে।

৮। নির্দিষ্ট সময় পরে নিজেকে এই কর্পোরেট জগতে কোথায় দেখতে চান:
এই প্রশ্নটা ক্লিশে (Cliché ) হয়ে গেছে। প্রতিটা ইন্টারভিউ বোর্ডে সবাই এই প্রশ্নটা করেন। আমার জন্য খুব অস্বস্তিকর ছিল, ২০০৭ সালে আমার বৃটিশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যখন আমাকে এই প্রশ্ন করে বসলেন । আমি কেন জানি না সাবলীলভাবেই উত্তর দিয়েছিলাম যে আমি যেহেতু লোক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি, আমার দায়িত্ব নতুন প্রজন্মকে ডেলিগেট করতে ভালোবাসি ; ৫ বছর পর এখনকার ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বৃহদাকার কোন প্রতিষ্ঠান চালাতে চাই। ওয়েল , আমি সেটাই করছি এখন।
আরেকটি কথা আমি আমার অনুজদেরকে বলি। দয়া করে আপনি স্বার্থপরের মতো শুধুমাত্র নিজের জন্য কাজ করুন। কোম্পানির কথা , দেশের কথা আপনাকে চিন্তা না করলেও হবে। আপনার দক্ষতা এমন পর্যায়ে নিয়ে যান, যাতে করে আপনার বস আপনার ব্যাপারে খুশী থাকে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ এবং সারা মার্কেট-প্লেস যেন জেনে যায়, হ্যাঁ ওই যে একজন লোক – যাকে বিশ্বাস করা যায় যে কোন কাজ দিয়ে!

আমার CEO—একদিন খুব আন্তরিক ঘরোয়া পরিবেশে বলেছিলেন, ‘জাহিদ নিজেকে ব্র্যান্ড হিসাবে তৈরি কর। আমার প্রতিষ্ঠানের বাইরেও লোকে যেন এক নামে তোমাকে চেনে সেই ভাবে কাজ কর। আমি জানি, সবাইকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে সারাজীবন ধরে রাখতে পারব না। কিন্তু আমি ভীষণ গর্ব অনুভব করব, লোকের মুখে শুনতে যে তুমি TEX LINE -এর প্রোডাক্ট !’

৯। সব সমস্যা বসের কাছে ছুঁড়ে দিয়ে সমাধানের আশা করবেন না ; উনি ঈশ্বর নন:
নতুন প্রজন্মের কম্যুনিকেশন জ্ঞান খুব ভাল। কোন একটা সমস্যা হওয়ার সাথে সাথে তারে ই-মেইল রে, ফোন রে, মিটিং রে করে সারা দুনিয়ার ক্রেতা ও ঊর্ধ্বতনদের সেটা জানিয়ে দেয়। ঠিক আছে। কিন্তু , ওই যে বললাম সবাই সবসময় সমস্যার কথা শুনতে পছন্দ করে না। সমস্যা ছুঁড়ে না দিয়ে, সমস্যা কেন হয়েছে, সম্ভাব্য সমাধান কি কি হতে পারে , সেটা লিখে নিয়ে বসের কাছে হাজির হন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সবচেয়ে সাশ্রয়ী অপশনটা আপনার জন্য বেছে দেবেন, আপনাকে গাইডলাইন দেবেন। এবং একই সঙ্গে আপনার এই কাজে তিনি খুশী হবেন; কেননা আপনি আর সবার মতো সমস্যা তাঁর দিকে ছুঁড়ে দেন নি। বরং সিদ্ধান্তগ্রহণে তাঁকে সাহায্য করেছেন।

১০। দায়িত্বগ্রহণে কখনই পিছপা হবেন নাঃ
আপনি নতুন, আপনার অভিজ্ঞতা নেই, পারবেন নাকি পারবেন না – এইসব ভেবে নতুন দায়িত্ব গ্রহণে পিছপা হবেন না। ম্যানেজমেন্ট প্রো-অ্যাক্টিভ লোক পছন্দ করেন। যোগ্য কিন্তু দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া লোক সামনের দিকে এগোতে পারেন না। সুতরাং অ্যাগ্রেসিভ হয়ে দায়িত্ব নিতে শিখুন। ভুল হবে, ঝামেলা হবে—আপনি নতুন কিছু শিখবেন।

১১। আপনার শক্তিমত্তাকে কাজে লাগান:
আপনার বস হয়তো কারখানার সঙ্গে বা সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে হৈচৈ করে কাজ উদ্ধার করেন। অথচ আপনি একটু ভদ্র গোছের, মুখ খিস্তি করতে পারেন না। ওয়েল, সমস্যা নেই। আপনি যদি ঠাণ্ডা মাথায় ভদ্র-ভাষায় কথা বলে কাজ উদ্ধার করতে পারেন , করেন। বিড়াল কালো না সাদা , তাঁর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিড়ালটি ইঁদুর ধরতে পারে কিনা।

১২। নিজেকে অর্গানাইজ করুন,প্রতিদিনের, সপ্তাহের, মাসের প্রায়োরিটি ঠিক করুন:
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, যেটি আমাদের কর্পোরেট জীবনে খুব কাজে লাগে। “If you are not scheduling your day by yourself, some others will do that !” আপনি সারাদিনে কি কি করবেন , সেটা আপনার একটা মাস্টার লিস্ট থাকতে হবে। সেটা দিনশেষে একটা ডাইরিতে লিখে রাখতে পারেন, অথবা অফিসে আসার সময়ে লিখে ফেলতে পারেন। ইদানীং স্মার্ট-ফোনে নানা অ্যাপ্‌স আছে, আপনি সেটার সাহায্য নিতে পারেন। আপনি যদি নিজের দিনকে প্রায়োরিটি অনুযায়ী শিডিউল করতে না পারেন। আপনার সারাদিনের কাজের দায়িত্ব নিয়ে নেবে আপনার বস, অথবা আপনার ক্রেতা বা সাপ্লাইয়াররা। সারাদিন এঁদের নানাবিধ একটার পর একটা কাজে, ফোনে আপনাকে ব্যস্ত রাখবেন, যে সন্ধ্যার সময় গিয়ে আপনার নিজের কাজে মন দিতে হবে। সুতরাং সাধু সাবধান! নিজের দিনের শিডিউলের দায়িত্ব অন্যদেরকে দেবেন না। টেক কন্ট্রোল ।

১৩। আপনার বস, আপনার ক্রেতা বা সরবরাহকারী দিনশেষে কিন্তু একজন রক্তমাংসের মানুষ:
আপনার সারাদিনের কাজ কিন্তু যন্ত্রের সঙ্গে নয়। যাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন তাঁরা আমার আপনার মতোই মানুষ। তাঁরাও নিজের নিজের প্রতিষ্ঠানে, নিজের অবস্থানে নিজের মুখ উজ্জ্বল দেখাতে চান; মাস শেষে বেতন আর বছর শেষে ভাল প্রফিট শেয়ার চান। সুতরাং তাঁদেরকে আপনি সাফল্য অর্জনে সাহায্য করলে, তাঁরা আপনাকে সাহায্য করবেন। যে আচরণ আপনি আপনার নিম্নপদস্থদের কাছ থেকে আশা করেন না , সেটা আপনি আপনার আপার হ্যান্ড ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে করবেন না।
ধৈর্য ধরে আমার দুই পর্বের নবীন প্রজন্মের জন্য লেখা কর্পোরেট অব্‌জার্ভেশন পড়ার জন্য আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ।

[প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০১৬]

নবীন প্রজন্মের জন্য কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন। প্রথম পর্ব

আমার স্বল্প পরিসরের কর্মজীবনে আমি খুব বেশী প্রতিষ্ঠানে কাজ করিনি। টেক্সটাইলে প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজ করেছি এদিক সেদিক। অবশেষে কাজ ছেড়েছি বেক্সিমকো(BEXIMCO)- থেকে। পরে যখন গার্মেন্টস-এ আসলাম, মার্চেন্ডাইজিং অভিজ্ঞতার শুরু ওপেক্স(OPEX) গ্রুপে। তারপরে আমার বর্তমান কর্মস্থলে ছিলাম ২০০১ সাল থেকে ২০০৭-এর শেষ পর্যন্ত একটানা সাত বছর। পরের দেড় বছর ছিলাম মাদারকেয়ার সোর্সিং ( Mothercare Sourcing UK) নামের এক বৃটিশ রিটেইলে। পরে ২০০৯ সালের মাঝে আবার পুরনো কর্মস্থলে ফিরে আসা। মূলত: মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্মঅভিজ্ঞতা থেকে এই ধরণের লেখা খানিকটা ধৃষ্টতা হয়ে যায়। অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি!

আমি প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এখনো যাচ্ছি; প্রতিবছর নতুন নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। নবীন প্রজন্মের সবাই দুর্দান্ত মেধাবী, আমাদের বুড়ো প্রজন্মের তুলনায় তাঁরা শতগুণ যোগ্য। আমরা যেখানে কম্পিউটার মানে ‘ ক-অক্ষর গোমাংস’ অবস্থা ছিল। নবীনরা সেই তুলনায় এতো সহজেই সবকিছু বুঝে ফেলে তা দেখে বিস্মিত হতে হয়।

নীচের লেখায় আমি কিছু আমি টেকনিক্যাল জার্গন ( Jargon: special words or expressions used by a profession or group that are difficult for others to understand) ব্যবহার করেছি। ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ আমার ঠিক পছন্দের নয়, কিন্তু কিছু করার নেই। সব কিছুর বঙ্গানুবাদ করা মুশকিল। অধুনা গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং শেখার অনেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে, বুটেক্স(Bangladesh University of Textiles) থেকে প্রতিবছর বের হচ্ছেন টেক্সটাইল প্রকৌশলীরা। অন্যান্য বেসরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হচ্ছে আরও অনেকে। এছাড়া প্রতিবছর BGMEA বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রফেশনাল ডিগ্রী নিয়ে এই সেক্টরকে সমৃদ্ধ করছে।
আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, আরেকটু আন্তরিকতা আর প্রচেষ্টা থাকলে আমাদের নবীন প্রজন্ম আমাদের এই গার্মেন্টস শিল্পকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারবেন। কথা কিন্তু সেটাই, এটা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সেটা সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই , অবস্থা, প্রতিষ্ঠান ও প্রেক্ষিত বুঝে আপনাকে নিজের মতো করে তা ব্যবহার করতে হবে।

১। নিজের প্রতিষ্ঠানকে জানুন:
কোথায় কাজ করছেন? কে বা কারা এই কোম্পানি কবে শুরু করেছেন, জেনে রাখুন। আপনি একটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অথচ তার আদ্যোপান্ত কিছুই জানেন না, সেটা সমীচীন নয়। কয়টা ডিপার্টমেন্ট আছে, কারা ম্যানেজমেন্ট লেভেলে আছে, বাৎসরিক ব্যবসার পরিমাণ কত। সিনিয়র কাউকে জিজ্ঞেস করুন, মালিক বা মালিক-পক্ষ কিভাবে কিভাবে আজ এতো বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন।নিজের প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস জানলে আপনারই সুবিধা। কারণ আপনি সেল্‌সে থাকেন বা অন্যকোন বিভাগে, নিজের প্রতিষ্ঠানকে ভালোমতো জানলে বাইরের কারো কাছে আপনার অ্যাপ্রোচ অনেক ভালো হবে।

২।আপনার জব রেসপন্সিবিলিটি বা জব ডেসক্রিপশন ( Job Description) কি কি ; ভালোমতো বুঝে নিন:
মূলত: প্রাথমিক অবস্থায় একজন মার্চেন্ডাইজারের এর কাজ থাকে সাপোর্টিং রোলের। আপনার ইমিডিয়েট সুপারভাইজারের কাজগুলো গতিশীল করাই আপনার লক্ষ্য। বসের কাজই আপনার কাজ। বসের সাফল্য আপনার সাফল্য। সবার সামনে আপনার বস-কে সফল দেখানোই আপনার প্রাথমিক লক্ষ্য। তাঁকে সবার সামনে উজ্জ্বল করে দেখানোর জন্য খাটুন। আপনার সুনাম এমনিতেই হবে। আর ইমিডিয়েট বস-এর সুনজরে না থাকলে, আপনার জীবন দুর্বিসহ হয়ে যাবে। উনি প্রতিপদে আপনাকে ত্যক্ত করবেন। আপনাকে ব্যর্থ দেখানোর চেষ্টা করবেন। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন। আমি আমার জীবনে শ্রীলংকান, ভারতীয়, পাকিস্তানী, বৃটিশ, চাইনিজ, আমেরিকান, সিঙ্গাপুরিয়ান, বাংলাদেশী নানা ধরণের বসের সঙ্গে কাজ করেছি। শুধুমাত্র কোরিয়ান কোন বস আমার কপালে জোটেনি। অবশ্য , সেটি নাকি সৌভাগ্যেরই ব্যাপার, তাই সবাই বলে !
প্রায়শ: অভিযোগ শুনতে পাই, ই-মেইল আসার সেকেন্ডের মধ্যে কিছু বস-রা নাকি ফলো আপ শুরু করে দেন। হ্যাঁ, এইরকম খুঁতখুঁতে বসের পাল্লায় আমিও পড়েছিলাম। আমার নিজস্ব একটা টেকনিক দিয়ে পার পেয়ে গেছি সবসময় , সব ধরণের বসের অনর্থক ফলোআপ থেকে। আমি , ইনফরমেশন ওভার-ফিড করতাম।মানে, কোন একটা ইস্যু হয়েছে, আমি প্রতি কয়েকঘন্টা পরে পরে, বস-কে আপডেট দিতাম। সিচুয়েশন কতোখানি উন্নতি বা অবনতির দিকে জানাতাম। তাঁর যতোটুকু তথ্য হলে চলে, তার চেয়ে বেশী দিতাম। ফলে, কিছুদিন পরে তাঁর আমার ব্যাপারে কনফিডেন্স লেভেল বেড়ে যেত। আমাকে অনর্থক ফলোআপ করতেন না।
ও হ্যাঁ, মনে রাখবেন , বস-রা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে ভালোবাসেন। সুতরাং আপডেট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে , তাঁর কাছে সাহায্য চান। অনুরোধ করেন, কাউকে ফোন করে দিতে। এতে করে উনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববেন, ইনভল্ভড ভাববেন। আর ওদিকে আপনার প্রাত্যহিক কাজ ঠিকমতো চলবে।

৩।শেখার ও জানার কোন বিকল্প নেইঃ
নতুন সংস্থায় , নতুন চাকরি হিসাবে আপনার সামনে অবারিত সুযোগ শেখার। প্রশ্ন করতে শিখুন, জানুন এবং প্রশ্ন করুন। নিজের ডিপার্টমেন্টের কয়েকটি প্রোডাক্টে সীমাবদ্ধ না থেকে, কাজের ফাঁকে অন্য বিভাগগুলোতে খোঁজ নিন। আপনাকে কেউ মানা করেনি শিখতে। একটি নির্দিষ্ট গার্মেন্ট তৈরি করতে কয়টি ও কত ধরণের মেশিন দরকার, কি ধরণের প্রোডাক্টিভিটি হওয়া উচিৎ । একজন কোয়ালিটি কন্ট্রোলার সারাদিনে যা যা করছে একদিন তাঁর সাথে কারখানায় যান। তাঁর কাজের প্রতিটি স্টেপ দেখুন, শিখুন। কিভাবে একজন দক্ষ ইন্সপেক্টর ইন্সপেকশন করছেন, দেখুন। নিজেকে একটা ছোট্ট কিউবিক্যালে আবদ্ধ করে রাখলে আখেরে আপনারই ক্ষতি। AQL ; Inspection procedures ; Technical difficulties of Machines ; Needle marks ; Seam Slippage ; Part shading ; Fabric Inspections; Fabric relaxation; Marker; Pattern; Buying seasons of different Customers & Countries ; Report writing; Meeting recap preparation ; WIP ( Work in Progress/Work in Process) ; Critical Path ; Shipping Procedure; Incoterms ; LC ; FOB; C&F; Payment terms ; Testing Machines ; Testing Methods, Testing Parameters & Procedures; Accessories Sourcing ; Accessories Inventories; Garments packing & assortments etc.etc.–জানুন, নিজেকে সমৃদ্ধ করুন।
নির্দিষ্ট ক্রেতার নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট ছাড়াও অসংখ্য প্রোডাক্ট অন্য ডিপার্টমেন্টে চলছে।একেক ক্রেতার জন্য Payment terms আলাদা আলাদা। জিজ্ঞেস করেন, কোথায় হচ্ছে, কত দাম। ফেব্রিক সোর্সিং, অ্যাকসেসরিজ সোর্সিং। কনজাম্পসন কত , কেন এতো দাম , প্রশ্ন করুন , জানুন।

৪। প্রশ্ন করুন, সাময়িক নির্বুদ্ধিতা দীর্ঘকালীন নির্বুদ্ধিতার চেয়ে অনেক ভালো:
পৃথিবীর সকল প্রশ্নের উত্তর সকলের কাছে নেই। কেউ মার্কেটিং সেল্‌সে ভাল, তো কেউ অ্যাডমিন্সট্রেশনে ভাল। কেউ পাবলিক রিলেশনে ভাল। কেউ আবার টেকনিক্যালি ভাল। আপনাদের এখন শেখার সময়। আপনার যদি মেশিন লে আউট জানতে ইচ্ছে করে বা শিখতে ইচ্ছে করে- নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করুন। জ্ঞানী ব্যক্তিটি হয়তো সাময়িক আপনাকে শেখানোর সময় আপনাকে তাচ্ছিল্য করবেন, আপনাকে নির্বোধ ভাববেন। কিন্তু যখনই আপনি তাঁর অর্জিত জ্ঞানটা লাভ করবেন , ব্যাপারটা বুঝে ফেলবেন—আপনি সারাজীবনের জন্য বুদ্ধিমান হয়ে গেলেন। লজ্জা করে, মুখচোরা হয়ে আপনি কি সারাজীবন নির্বোধ থাকতে চান? না চাইলে, প্রশ্ন করুন। জানুন।

৫। মার্কেট ইনফরমেশন / মার্কেট ইন্টেলিজেন্স সম্বন্ধে নিজেকে আপডেট রাখুন:
আমরা বস্ত্র রপ্তানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রথমটি ‘জনাব চীন’ ! কিন্তু আপনি জানেন কি আমাদের বাৎসরিক রপ্তানি মূল্য কত? ২৬/২৭ বিলিয়ন ইউ এস ডলার ! চায়নার কত? প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ইউ এস ডলার !আমারা সেই ক্লাসের রোল নাম্বার টু, যেই ক্লাসের ফার্স্ট বয় বিশাল ব্যবধানের নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হয়েছে।
নতুন রপ্তানির দেশগুলো কারা , জানেন কি ? ইউরোপ ও আমেরিকা ছাড়া , যে কোন দেশে ( অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি ) সবগুলো দেশে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ৫% ইনসেনটিভ দিয়েছিল। সেটা ইদানীং কমিয়ে দিয়েছে। এইগুলো জানলে , কারখানার সঙ্গে মূল্য নিয়ে দর কষাকষি করাটা আপনার জন্য সহজ হবে।

[ প্রকাশকালঃ ১৮ই  নভেম্বর ২০১৬]

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( শীতের ওয়াজ শীতে, গরমের ওয়াজ গরমে)

আমি নিজে দীর্ঘদিন ও বহুবছর ধরে ‘তথাকথিত’ কর্পোরেট অফিসে ঘষটাচ্ছি ! নানা রকমের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পরিপ্রেক্ষিত আর অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে। এখনো , প্রতি মুহূর্তে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন করে শেখা। কিন্তু আমি সন্দিহান, আমার নির্দিষ্ট একটা প্রোডাক্টের( পড়ুন গার্মেন্টস), নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের ও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে অভিজ্ঞতা—তা তো আর সার্বজনীন নয়। এক প্রতিষ্ঠানের নিয়ম , আরেক প্রতিষ্ঠানে প্রায়শঃ অচল প্রমাণিত হয়। এক সময়ের অভিজ্ঞতা আরেক সময়ে হয়ে যায় বাতিল।

কারখানা বা ট্রেডিং ও সোর্সিং অফিসের নবীন প্রজন্মের কাছে আমার অর্জিত
যৎসামান্য অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন লেখালেখি। অবশ্য সকল নবীনদের মনে রাখতে হবে, ‘গরম কালের ওয়াজ শীতে করলে, শীতে কেঁপে সমূহ বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা আছে!’

অভিজ্ঞতার সর্বজনীনতা না থাকুক , হাস্যকৌতুকের একটা সর্বজনীনতা আছে। শুধু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রেক্ষিত ও কুশীলবদের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়; কৌতুকের মাঝ দিয়ে সহজ সত্য বুঝে ফেলার প্রবৃত্তিও মানুষের সহজাত। বহুল ব্যবহৃত গল্প, তবু আরেকবার বলি—
শিষ্য পরিবৃত হয়ে এক হুজুর কোন এক অজ-পাড়াগাঁয়ে ওয়াজ করেছিলেন, ‘মেয়ে মানুষের কাপড় একশো বার ধুইলেও বেগানা মরদ তথা পরপুরুষের তা গায়ে লাগানো উচিত না’। তাঁর এক শাগরেদ এই ওয়াজ শুনে আরেক সময়ে আরেক অজ-পাড়াগাঁয়ে গিয়ে দিনের বেলায় একই ওয়াজ করলেন। সেটা ছিল হাড়-কাঁপানো শীতের সময়। রাতের বেলায় শোবার সময় তাঁকে এনে দেয়া হল কাঁথা, যেটা গ্রামদেশে মেয়েদের পুরনো সূতীর শাড়ি দিয়েই তৈরি করা হয়ে থাকে। নবীন সাগরেদ তার সদ্য অর্জিত জ্ঞান ফলিয়ে বললেন, ‘আমি বেগানা মরদ, এই সব মেয়ে মানুষের কাপড়ে তৈরি কাঁথা আমি গায়ে দেব না’। ওরা বললো, ‘জনাব, আমাদের গ্রামাঞ্চলে লেপ-তোষকের প্রচলন নেই; হয় আপনাকে কাঁথা গায়ে দিতে হবে, না হয় শীত কাঁপতে হবে।’

তো এভাবে দু’-তিন রাত শীতে কেঁপে অসুস্থ হয়ে শাগরেদ হুজুরের ডেরায় ফিরে বললেন, ‘হুজুর, আমারে এমন ওয়াজই শিখাইলেন; আমি তো শীতে মরি প্রায় !’ হুজুর সবটা শুনে তাঁকে ধমক লাগালেন, ‘আরে বেওকুফ, এটা তো ছিল গরমের দিনের ওয়াজ; তোরে শীতের দিনে এই ওয়াজ করতে কইছে কে ?”

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( প্রাপ্য চাইতে দ্বিধা করবেন না )

আমার এক কলিগ ছিলেন বা আছেন ( নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না) যিনি নিজের যে কোন যুক্তিসংগত চাহিদার ব্যাপারে নিতান্তই নির্বিকার ও নৈর্ব্যক্তিক। ম্যানেজমেন্ট কি ভাববে, এই সময় চাওয়া উচিৎ, নাকি ওই সময়ে চাওয়া উচিৎ এসবের তেমন কেয়ার কখনই করতে দেখিনি তাঁকে।

একবার আমার পারিবারিক কাজে ঈদের ছুটির সঙ্গে কয়েকদিন বেশী ছুটি লাগবে, কিন্তু নানা কারণে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ওই সময়ে একটু মন কষাকষি চলছিল। কীভাবে বলব, ম্যানেজমেন্ট কীভাবে নেবে ব্যাপারটা — সেটা নিয়ে দুঃচিন্তা করছিলাম। তাঁর সঙ্গে শেয়ার করতেই বলে উঠল ‘ Jahid , What you have to do , you have to do ! What you have to say, you have to say !” বুঝিয়ে বলল, তুমি যেহেতু আর দশজন ফাঁকিবাজ কর্মচারীদের মতো নও। সপ্তাহের প্রথমদিন সোমবার তোমার জ্বর ও মাথা ব্যাথা থাকে না অথবা উইকএন্ড শুক্রবারে ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে না ! তোমাকে সবাই চেনে, যেটা তোমার দরকার, প্রাপ্য ও আবশ্যক সেটা বলতে বা চাইতে দ্বিধা করছ কেন?

আমি জড়তা কাটিয়ে আমার প্রয়োজনীয় ছুটি চাইলাম এবং এরপর থেকে এই ব্যাপারটা আমি মেনে চলি।
“What you have to do , you have to do ! What you have to say, you have to say !”

প্রকাশকালঃ নভেম্বর ২০১৬

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( নতুন কোন দায়িত্বের প্রতি আপনার মনোভাব )

আমার মধ্যে একসময় খুব খুঁতখুঁতে স্বভাব ছিল। বহুকষ্টে সেটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আমি যদিও জানতাম ৩টা রচনা পড়লেই পরীক্ষায় কমন পড়বে, তবুও খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য গুচ্ছের পড়াশোনা করে যেতাম। সকল ক্ষেত্রেই শঙ্কামুক্ত থাকতে চাইতাম। অফিসিয়াল কাজের বাইরে অফিসে নানা ধরনের কর্পোরেট কাজ থাকে , নতুন চ্যালেঞ্জ থাকে এবং মালিক-পক্ষ বা ঊর্ধ্বতনরা সেই সব চ্যালেঞ্জের কথা খোলামেলা উপস্থাপন করে মতামত জানতে চান সিনিয়রদের কাছ থেকে। আমি নেগেটিভ ক্যারেক্টারের না হলেও ওই যে বললাম, নিজেকে পারফেকশনিস্ট হিসাবে দেখতে চাইতাম বলে কোন নতুন দায়িত্ব নিতে দশবার চিন্তা করতাম। এতে হল কি, আমার সম্বন্ধে আমার সেই সময়ের ম্যানেজমেন্টের একটা ঋণাত্মক ধারণা হয়ে গেল।সেটা আমার পক্ষে উতরানো সম্ভব হয় নি নানা কারণে।

মাত্র বছর পাঁচেক আগে ট্রেডের এক বড়ভাইয়ের কাছে একটা বড় শিক্ষা পেলাম। আসলে আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য, কোন নতুন দায়িত্ব নেওয়ার আগে মোটামুটি ১০০ ভাগ নিশ্চিত হতে চাইতাম যে কাজটি আমি ঠিকমতো সম্পন্ন করতে পারব । সুতরাং আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব না নিলেও সবাই জানতেন , আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হত, সেটা শতভাগ সফল হয়। ট্রাজেডি হচ্ছে, আমার সমসাময়িক কয়েকজন সতীর্থ সহকর্মীদের চেয়ে আমার যোগ্যতা বেশী থাকা স্বত্বেও আমার খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য আমি ঠিক সেইভাবে ঊর্ধ্বতনদের কাছাকাছি ছিলাম না।

ট্রেডের সেই শুভাকাঙ্ক্ষী বড়ভাই যিনি দীর্ঘদিন কর্পোরেট চাকরী করছেন, উনি আমার অবস্থান ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আমার ক্রমশ: অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন। একদিন কাছে ডেকে বললেন, ‘জাহিদ কোন একটা কাজ আপনি সফলভাবে সম্পন্ন করবেন নাকি করবেন না , তার চেয়েও মুখ্য ব্যাপার হচ্ছে কাজটি শুরু করার ব্যাপারে আপনার মনোভাব বা অ্যাটিচুড কি। সেটা পজিটিভ হতে পারে, নেগেটিভ হতে পারে, নিউট্রালও হতে পারে। আপনি হয়তো পুরোপুরি নিশ্চিত না- আপনি কাজটি শতভাগ সম্পন্ন করতে পারবেন কিনা। এবং সেই দ্বিধা থেকে আপনি জড়তায় ভুগছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার ঊর্ধ্বতনও ব্যাপারটি জানেন। মূলত: দুজন কর্মচারীর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব বা কাজ সম্পন্ন করার প্রশ্নে — একজন যদি হয় আপনার মতো , যিনি যোগ্য কিন্তু সাবধানী, খুঁতখুঁতে হিসাব করে দায়িত্ব নিতে চান । আর অপরদিকে আরেকজনের যোগ্যতা কম থাকা স্বত্বেও যদি হয় কাজের ব্যাপারে পজিটিভ এবং প্রোঅ্যাক্টিভ, তাঁকে কিন্তু ঊর্ধ্বতনরা অনেক বেশী দাম দেবেন ও কাছে টেনে নেবেন।’

দ্বিতীয় ব্যক্তি, যদি কোন কারণে কাজটি অসম্পন্ন রেখে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বা তার মিশন সাকসেসফুল নাও হয়, সেটা ঊর্ধ্বতনেরা হাজার কাজের ফাঁকে ভুলে যাবেন। তাঁদের মনে থাকবে কর্মচারীর প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক মনোভাবটি। এই শিক্ষাটা আমার জীবনে অনেক দেরী করে হলেও দারুণ দরকারী ও উপকারী হিসাবে প্রমাণিত। আমি এখন বিশ্বাস করি –Sometimes small thing makes a big difference !

প্রকাশকালঃ নভেম্বর ২০১৬