কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( ব্যর্থতার আতঙ্ক )

একজন হতাশ, ব্যর্থ লোকের সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো আজকে। দুঃখিত পাঠক ও পাঠিকা, তিনি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীন বলে উনাকে ব্যর্থ একজন বললাম। কারণ , আমি বা আপনি , আমাদের চারপাশের সবাই মানুষকে অর্থনৈতিক মাপকাঠি দিয়েই মাপেন।

ভদ্রলোক বছরকয়েক আগে বড়ো কর্পোরেট চাকরি করতেন, বাইপাস সার্জারিতে সহায়-সম্বল শেষ। শারীরিক অসুস্থতার দীর্ঘবিরতিতে উনি উনার চাকরিজীবনের আগের পজিশন হারিয়েছেন। এইটা খুব স্বাভাবিক । তাঁর অধস্তনরা উনাকে ফেলে চলে গেছে সামনের দিকে , বয়স ও শারীরিক কারণে নতুন চাকরি পাওয়া অনেকটা দুঃসাধ্য হয়ে গেছে। সবাই, তাঁকে এড়িয়ে চলেন ; হুম হাম করে পাশ কাটিয়ে যান।

ভেবেছিলেন ব্যবসা করবেন। ব্যবসা করার যোগ্যতা বা মূলধন কিছুই নাই। কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নাই। ত্রিশঙ্কু অবস্থা । আমি নিজেও , ব্যবসার ‘ব’ ও বুঝি না। উনাকে বললাম, ‘চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে হলেও পুরনো মালিকের ওখানে জয়েন করেন , যে পজিশনেই হোক না কেন, আপনাকে দিয়া ব্যবসা হবে না। কিছুদিন চাকরি করার পরে হয়তো কোন না কোন পথ পেয়ে যাবেন।’
আমাদের কর্পোরেট জগতের সবাই, খুব ভিতরে একজন আতংকিত ব্যর্থ মানুষকে বয়ে নিয়ে চলছি। আমরা কেউ জানি না, কখন কোন পরিস্থিতিতে ওই ব্যর্থ লোকটা বের হয়ে আসবে সামনে !

প্রকাশকালঃ ৭ই জুন,২০১৩

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( তোতা কাহিনী )

এক লোক তোতা পাখি কিনতে দোকানে গিয়েছে। অনেক ঘুরে এক দোকানে থিতু হলেন।
দোকানদার সারিবদ্ধ তিনটা তোতা পাখিকে দেখিয়ে বলল , একদম বাম দিকের তোতা পাখির দাম ৫ হাজার টাকা!
: এতো দাম ?
: শোনেন, এই তোতা পাখি বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি ৩টা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে!!

পরের তোতা পাখিটার দাম জিজ্ঞেস করল ভদ্রলোক।
সেটার দাম আরো বেশি ১০ হাজার টাকা !!!
: এর গুণাবলী কি ?
: এর দাম বেশি কারণ এই তোতা পাখিটি আগেরটি যা পারে তা তো পারেই ; সেই সংগে ঐ তিনটা ভাষায় লেখালেখিও করতে পারে !!

স্বভাবতই উৎসাহের চরমে পৌঁছে, বাকী থাকা শেষের তোতা পাখিটির দাম জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
: ২০ হাজার টাকা !!!
ভদ্রলোক উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এর বিশেষ গুণাবলী কি কি ?

দোকানদার বলল, ‘ সত্যি কথা বলতে কি , আমি এই তোতা পাখিকে কখনই কিছু করতে দেখি নি ! সারাদিন বসে বসেই থাকে ; কিন্তু অন্য সব তোতা পাখিরা একে BOSS বলে ডাকে !!!

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( শিল্পীজীবন )

অনেকদিন আগে ট্রেডের এক বড়ভাই কথাচ্ছলে আমাদের কর্পোরেট জীবন নিয়ে বলেছিলেন–‘ আমাদের জীবন অনেকটা সঙ্গীতশিল্পীদের মতো।

যতক্ষণ কণ্ঠে গান আছে,ধবধবে চাঁদোয়া, পরিষ্কার স্টেজ, যন্ত্রের টুং টাং , গুণমুগ্ধ শ্রোতা, হাততালি, কতকিছু! ‘কণ্ঠে গান নাই, কে শুনবে ওই মাধুর্যহীন, বেসুরো , রিক্ত শূন্য ঘর্ঘরে গলার আওয়াজ! যতক্ষণ কোম্পানির জন্য কাজ করতে পারছেন; সবই আছে !বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাজ বা যোগ্যতার কমতি হলে আপনার অবস্থা সেই রিক্ত কণ্ঠের সঙ্গীত শিল্পীর মতোই । সেইসব রাজসিক মুহূর্তগুলো তখন শুধুই স্মৃতি !

প্রকাশকালঃ ৪ঠা এপ্রিল,২০১৭

কর্পোরেট অব‌জার্ভেশন ( চাকরি ভালোবাসার সহজ পদ্ধতি )

আজ সকালে আমার প্রাক্তন বসের কাছ থেকে মেসেজ পেলাম।
উল্লেখ্য, তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুর্দান্ত বন্ধুসুলভ। কিন্তু এতো কঠিন সত্য, নিদারুণ বাস্তবতা –কেউ এইভাবে বলতে পারে? এই অব্‌জার্ভেশনে আমি মুগ্ধ !

1. If you don’t love your job, take a home loan; you’ll start loving it.
2. Take another loan; you will start loving your boss as well.
3. Get Married… You will start loving your office too.

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ও বাঙালি চরিত্র

আমার বর্তমান কর্মস্থলের মালিক-পক্ষ ও প্রধান কার্যালয় সিংগাপুরে ।
বাংলাদেশীদের চরিত্রের একটা ব্যাপার নিয়ে প্রায়শ: আমার সাথে তাঁদের কথা হয়।

আমাদের সামাজিকতায় অধীনস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সরাসরি ঊর্ধ্বতনকে কোন কথা বলতে পারে না। রুমে ঢুকে নানা রকম খাজুরালাপ করেন ; ত্যানা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শেষে এসে আসল কথা বলেন।

আমাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের সমস্যাটা কি, সরাসরি কেন আসল কথা বলতে পার না ? কেন অযথা সময় নষ্ট কর?’

আমি তাঁদেরকে বললাম, কেন –এটা আমিও বুঝি না। তবে এই অভ্যাস আমাদের মজ্জাগত। খাজুর করা ও ত্যানা প্যাঁচানো আমাদের জাতিগত বদভ্যাস !

প্রাসঙ্গিক ,অনেক আগে শোনা আমাদের পূর্ববঙ্গের একটা গ্রাম্য কাহিনী মনে পড়ে গেল।
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে উঠানের দাওয়ায় বসে একলোক তামাক খাচ্ছে আর দা দিয়ে চেঁছে চেঁছে বেড়া তৈরির কাজ করছে।
ওই সময় এক পথচারী এসে পাশে বসলেন।
লোকটার পাশের ছেলেটা বলল , ‘আব্বা তুমার জন্যি আবার তামাক সাজা নিয়ে আসি।’
লোকটা বলল ‘যা সাজায়ে নিয়ে আয়।’
তো পথচারী ও ঘর্মাক্ত লোকের কথোপকথন অনেকটা এই রকম ছিল। স্মৃতি থেকে লিখছি।
পথচারী, ‘ভাই কি করতেছেন?;
তিরিক্ষি মেজাজে লোকটা খেঁকে উঠলেন, ‘দেখতেইতো পারতেছেন কি করতিছি।’
‘ভাই ওই যে ছাওয়ালটা তামাক সাজাতি গেল, সিডা কি আপনার ছাওয়াল ?’
‘আরে মরণ ! আমাক বাপ ডাইকলো কেবল, ওই ছাওয়াল আমার না তো কি আপনার?’
‘ভাই, এই বাড়ীডাও কি আপনের ?’
‘না , এই বাড়ী আমার না আপনার ! কি কতি চাচ্ছেন সুজা করে কনতো।’
‘না, মানে হাঁইটে যাচ্ছিলাম তো, ভাবলাম আপনার কাছ থেকে দুইটান তামাক খায়া যাই, একটু খাজুর করতিছিলাম আর কি।’
‘তামাক খাবেন সিডা সরাসরি কলিই তো হয়।’

তো আমাদের সিংহভাগ জনতাই ওই পথচারীর মতো। তামাক খাওয়ার কথা সরাসরি না বলে খাজুর করি, ত্যানা প্যাঁচাই।
এর মধ্যে স্বাভাবিক সৌজন্যের বিষয় আছে নিশ্চয়ই । কিন্তু এই গ্রাম্য-কাহিনী দিয়ে আমাদের বাঙালী চরিত্র যতো সহজে আপনারা বুঝবেন, আমার বিদেশী সহকর্মীদের সেটা বোঝানো সম্ভব না !

কর্পোরেট অবজার্ভেশন ( মালিক-কর্মকর্তাদের উটপাখির আচরণ )

‘আমি কিছুতেই বুঝব না’- এইরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাউকে কিছু বোঝানো অসম্ভব। প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাধররা নিজের বোঝার বাইরে কিছু বুঝতে চান না- সে যেভাবেই তাঁদেরকে বোঝানো হোক না কেন।
বঙ্কিমের ‘ কমলাকান্তের দপ্তর’-এর কমলাকান্ত চারপাশে অজস্র।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে অনুল্লেখ্য রেখে বরং বছর তিরিশেক আগে আমার এক মামার কাছে শোনা পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

তো , হয়েছে কি গ্রামে এক শহরের শিক্ষিত লোক বেড়াতে গেছেন। মাঠে গিয়ে দেখেন এক চাষি হাল চাষ করছে, লাঙল- জোয়ালে দুইটা বলদ বাঁধা। চাষির সঙ্গে তার বছর আটেকের ছেলে।
কিছুক্ষণ হাল চষা দেখে শহুরে ভদ্রলোক বললেন, তোমার ডানপাশের বলদটি বেশি পরিশ্রম হচ্ছে বাঁ পাশেরটির তুলনায়। কমসময়ে ভাল ফল পেতে হলে , দক্ষতা বাড়াতে হলে, নির্দিষ্ট সময় পরপর বলদগুলোকে ডানে-বামে অদলবদল করে ফেল।

চাষি তর্ক শুরু করল। কারণ সে পুরুষানুক্রমে বহুবছর ধরে সে এই কাজই করে আসছে। এই ধরনের আজগুবি কথা আগে কেউ তাকে বলে নি।

ভদ্রলোক এক পর্যায়ে বললেন, আমি তোমাকে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি, কি করে ডানের বলদটি বেশি পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।

চাষিও তেরিয়া গলায় বলল, ঠিক আছে! আপনি যদি আমাক বুঝোতে পারেন, তাহলে ডানের বলদটা আপনাক্ আমি দিয়ে দেব।

চাষির ছোট্ট ছেলেটি পুরো ব্যাপারটা ভয়ার্ত চোখে দেখছিল।
ভদ্রলোক কেন্দ্রাতিগ বল বোঝালেন, কেন্দ্রাভিমুখী বল বোঝালেন। ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে বলে ডানের বলদের উপরে চাপ বেশি পড়ছে তাই পরিশ্রম বেশি হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি নানাভাবে বোঝালেন। চাষি কিছুতেই বোঝে না।

ঘণ্টাখানেক বুঝিয়ে ক্লান্ত , ব্যর্থমনোরথ হয়ে অবশেষে হাঁটা দিলেন নিজের পথে।

লোকটি চলে যাওয়ার পরে ছোট ছেলেটি বলল, বাজান উনি যদি সত্যি তুমাক বুঝো ফেলত, তুমি কি ডানের বলদটা তাক দিয়ে দিতা ?
চাষি হেসে বলল, আরে ব্যাটা – আমি যদি না বুঝি , আমাক্‌ বুঝায় কোন্ শালা !