by Jahid | Nov 23, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন
একজন কর্মচারী যতো শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত,দূরদর্শী হন না কেন বুদ্ধিমত্তায় তিনি কখনোই তাঁর মালিককে অতিক্রম করতে পারেন না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে মালিকের কথাই শেষ কথা।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই ।
ঢাকার অতি সন্নিকটে একনামে চিনতে পারবেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান কয়েকটি বিশাল ওয়্যারহাউজ ( warehouse ) করেছে ; আমি নিজেও গিয়েছিও সেখানে। এই ইনভেস্টমেন্টের পক্ষে মালিকের দূরদর্শী(!) চিন্তা হচ্ছে– কিছু কিছু ব্র্যান্ড ক্রেতা আছে , যারা হয়তো ভবিষ্যতে কারখানায় বা পোর্টে ইন্সপেকশন করতে চাইবে না ; নিরপেক্ষ তৃতীয় কোন একজায়গায় ইন্সপেকশন করতে চাইবে । স্টোর ডিস্ট্রিবিউশনের স্বার্থে নিজেদের মতো করে রি-প্যাকিং করে নিতে চাইবে। সোজা কথা, মজুরী কম বলে, পশ্চিমের দেশে নিজেদের ওয়্যারহাউজে যে কাজটি তাদের করতে হবে, একটু আগেভাগেই সেটা বাংলাদেশ থেকে করে নিতে চাইবে। দূরদর্শী চিন্তা; ক্লিক করলে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী ব্যবসা।
সেই উদ্দেশ্যেই বিশাল গগনচুম্বী কয়েকটি ওয়্যারহাউজ, সারাক্ষণ শীতল বাতাস, বিশাল ক্রেন,ট্রলি , অসংখ্য স্যাম্পল র্যাক, অত্যাধুনিক ইন্সপেকশন রুম, মেশিনপত্র। যে কোন পোর্ট ওয়্যারহাউজের সমতূল্য কার্গো লোডিং-আনলোডিং এর জায়গা , ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বন্ডিং করে সরাসরি জাহাজে তুলে দেওয়ার জন্য , সমস্ত সুবিধাসহ সরকারী কাস্টম অফিসও আছে ওয়্যারহাউজ-এর ভিতরে !
তো, এই দক্ষযজ্ঞ ইনভেস্টমেন্ট বেশ কয়েকবছর ধরে পড়ে আছে ক্রেতার আশায়। গুচ্ছের অর্থনাশ!
এই দূরদর্শী বুদ্ধিমত্তা একজন কর্মচারীর হলে এবং ইনভেস্টমেন্টটা মাস খানেক বসে থাকলে তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানগুলোর চামড়া তুলে নেওয়া হত। যেহেতু মালিক করেছেন, তার বুদ্ধিমত্তা প্রমাণিত !
আমার ব্যক্তিগত ব্যাখ্যামূলক সংযুক্তিঃ প্রথমত- যতোই কর্পোরেট কালচারের কথা বলি না কেন , তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা একমাত্র মালিকেরই আছে, কর্মচারীর নেই । দ্বিতীয়ত- একজন মালিক তার সাফল্যের কথাগুলোই আলোচনা করে,তার প্রতিষ্ঠানে সেটা নিয়েই আলোচনা হয়। তার ব্যর্থতার জায়গাটা নির্মোহ দৃষ্টিতে কেউ আলোচনা করে শিক্ষা নিতে চায় না ; সেটা হয়তো পশ্চিমা রীতি। জুয়ারীরা যেমন শুধু জিতে আসার গল্প করে, পরাজয়ের গল্প আমাদের আবিষ্কার করতে হয়! আমাদের মালিকদের ক্ষেত্রেও তাই।
[প্রথম প্রকাশঃ ১২ই অক্টোবর,২০১৫]
by Jahid | Nov 23, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন
যোগ্যতা ও ক্ষমতা থাকলেই যেমন সেটার যথেচ্ছ ব্যবহার অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। আবার একেবারেই যদি সেটা প্রয়োগ না করা হয়, তবে সমূহ সম্ভাবনা আছে, পাপোশের মতো সবাই আপনাকে মাড়িয়ে যাবে !
প্রাসঙ্গিক একটা শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প। আম্মার কাছ থেকে শুনেছিলাম বহুবছর আগে, স্মৃতি থেকে লিখছি।
অনেক অনেক আগে , এক মাঠে গ্রামের রাখালরা গরু চরাত, মাঠের পাশেই বিশাল বন। তো, সেই বনে একটা বিশাল বড় ও ভয়ংকর বিষাক্ত সাপ ছিল। সকলেই সেই সাপের ভয়ে সাবধানে থাকত। সাপ আজ এক রাখালকে কামড়ায় তো কাল আরেকজনকে। প্রায়শই গবাদি পশুরা সাপের কামড়ে মারা যায় । সাপের ভয়ে সারা এলাকার রাখালরা ত্রস্ত থাকতো।
একদিন একটি ব্রহ্মচারী সেই মাঠের ধার দিয়ে যাচ্ছিলেন । রাখালেরা দৌড়ে এসে বললে, ‘ঠাকুর ! ওদিক দিয়ে যাবেন না। ওদিকে একটা ভয়ানক বিষাক্ত সাপ আছে।’
ব্রহ্মচারী বললেন, ‘তা হোক; আমার তাতে ভয় নাই, আমি মন্ত্র জানি!’
এই কথা বলে ব্রহ্মচারী সেইদিকে চলে গেল। এদিকে সাপটা ফণা তুলে দৌড়ে আসছে, কিন্তু কাছে না আসতে আসতে ব্রহ্মচারী যেই একটি মন্ত্র পড়ল , ওমনি সাপটা তার পায়ের কাছে পড়ে রইল।
ব্রহ্মচারী বলল, ‘ওরে, তুই কেন পরের ক্ষতি করে বেড়াস ? আয় তোকে মন্ত্র দিই!’
সাপ জিজ্ঞেস করলো, ‘মন্ত্রপূত হয়ে কী লাভ?’
ব্রহ্মচারী বোঝালেন, ‘এতে তোর স্বত্বগুণ লাভ হবে ; মন্ত্র জপলে ঈশ্বর ভক্তি হবে, আর হিংসা প্রবৃত্তি থাকবে না।’ এই বলে তিনি সাপকে মন্ত্র দিলেন।
সাপটা মন্ত্র পেয়ে গুরুকে প্রণাম করল, আর জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠাকুর! কি করে সাধনা করব, বলুন?’
গুরু বললেন, ‘এই মন্ত্র জপ কর, আর কারও হিংসা করিস না, কারো অনিষ্ট করিস না !’
তো এইরকম কিছুদিন যায়। রাখালেরা দেখে যে, সাপটা আর কামড়াতে আসে না! ঢিল মারে, তবুও রাগ হয় না। আজ একজন খোঁচা মারে তো আরেক দিন আরেকজন।
চৈত্রের খরদুপুরের একদিন এক রাখাল কাছে গিয়ে ল্যাজ ধরে খুব ঘুরপাক দিয়ে তাকে আছড়ে ফেলে দিলে মাঝ রাস্তায়। ছোটছোট ছেলে মেয়েরা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে , পিটিয়ে সাপের কোমর দিল ভেঙ্গে। সাপটার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে লাগল, আর সে অচেতন হয়ে পড়ে রইল । নড়ে না, চড়ে না। রাখালেরা মনে করলে যে, সাপটা মরে গেছে। এই ভেবে তারা সব চলে গেল।
ঠিক সেই সময়েই , ওই রাস্তা দিয়ে ব্রহ্মচারী ফিরছিলেন ।
সাপের এই দুরবস্থা দেখে ব্রহ্মচারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে তোর এই অবস্থা কে করল ? কিভাবে হল ?’
সাপ উষ্মা প্রকাশ করে বলল, ‘আপনি ! আপনি আমাকে এখন এই কথা জিজ্ঞেস করছেন ! আপনার মন্ত্রপূত হওয়ার পর থেকে আমি কাউকে হিংসা করি না, কারো উপরে ক্রোধ নেই, কারো অনিষ্ট করি না, কাউকে কামড়াই না। কিন্তু ঠাকুর, মাঠের রাখালরা তো আর জানেনা যে আমি মন্ত্রপূত হয়েছি; ওদের অনিষ্ট করব না। তবুও তারা আমার এই অবস্থা করেছে !’
ব্রহ্মচারী বলল, ‘ওরে তুই এত বোকা ! নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় জানিস না !
আমি তোকে কামড়াতে বারণ করেছি, ফোঁস করতে তো বারণ করি নাই ! দুষ্ট লোকের অনিষ্ট না করিস, কিন্তু দুষ্টলোকের সাথে বেঁচে থাকতে হলে মাঝে মাঝে ফোঁস করতে হয় !’
[ প্রথম প্রকাশঃ ১০ই অক্টোবর ২০১৫ ]
by Jahid | Nov 23, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন
ভালো ছাত্র মানেই ভালো শিক্ষক নয় এবং সকল ভালো শিক্ষক যে ভালো ছাত্র ছিলেন তাও না। আমাদের দেশে দক্ষ কর্মীরা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দক্ষ ম্যানেজার হতে পারছেন না। কারণ কী ? মনে করেন একটা ছেলে দারুণ দক্ষ অপারেটর/কর্মী , যেই না তাঁকে সুপারভাইজার করে দেওয়া হচ্ছে , সে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী দক্ষতা দেখাতে পারছে না।
মুশকিল হচ্ছে , সে তখন না পারছে তার নিজস্ব কাজের দক্ষতা দেখাতে ; না পারছে অন্যকে সুপারভাইজ/ম্যানেজ করতে। এই কমতি তাকে পূরণ করতে হচ্ছে আদিম পদ্ধতির ‘বসিং’ করে , হুমহাম-হৈচৈ করে। অনেকেই তাঁদের স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা , ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে ধাক্কা খেতে খেতে সঠিক ব্যবস্থাপনা শিখছেন; কেউ বা শেখার অনাগ্রহ ও নানা ইজমের ফাঁকে পড়ে এক পজিশনে ঘষাঘষি করছেন।
আসলে , বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মচারীদের নিয়মিত কোন স্কিল বেইজড ট্রেনিং নেই । কোন প্রিপারেশন ছাড়াই একজন কর্মীকে ম্যানেজার বানিয়ে সম্মুখসমরে দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধে পাঠাচ্ছি অথচ প্রয়োজনীয় অস্ত্র-রসদ কিছুই দিচ্ছি না; এবং আশা করছি সে যুদ্ধে জিতে আসবে !
আবার , ডেলিগেশন বলে একটা ইংরেজি শব্দ আছে, যেটা আমাদের বার্ধক্যপীড়িত প্রাচীন ম্যানেজাররা জানেন না। তাদের ধারণা নিজের কাজের দক্ষতা অন্যকে শিখিয়ে দিলে তো তার চাকরি নড়বড়ে হয়ে যাবে। সুতরাং তারা তাদের অভিজ্ঞতা অধীনস্থদের দিতে পারছেন বা দিতে চাচ্ছেন না ।
এই দুষ্টচক্রে পড়ে নতুন প্রজন্মকে সেই ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতি দিয়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কর্মঘণ্টা নষ্ট করে সুপারভাইজ বা ম্যানেজমেন্ট শিখতে হচ্ছে।
by Jahid | Nov 22, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন
মোটামুটি সর্বোচ্চ তিন বছর ; বেশীও না কমও না ! তিন বছর পরপর কোম্পানির সঙ্গে কর্মচারীর অবস্থান কি অবশ্যই পুনঃমূল্যায়ন/ রি-ইভালুয়েট করা উচিত।
বিগত তিনবছরে বেতন, বোনাস, পজিশন ও অন্যান্য সুবিধাসমূহ নির্দিষ্ট গতিতে থেকে থাকে; তাহলে কর্মচারী সঠিক কোম্পানিতে আছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
আর যদি উপরের প্রধান তিনটি ব্যাপারের ( বেতন, বোনাস, পজিশন), যে কোন একটা ব্যাপারে তিনি মার্কেট রেটের নীচে থাকেন। তাহলে কর্মচারীর উচিৎ নতুন করে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা।
উল্লেখ্য, কর্মচারী যদি মার্কেট রেটের নিচে মূল্যায়িত হয়েও একই কোম্পানিতে ঘষাঘষি করতে থাকেন ; তাহলে নিশ্চিত ধরে নিতে হবে, তার আসলে যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই বা অবস্থান পরিবর্তনের সুযোগ নেই !
[ প্রথম প্রকাশঃ ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ]
by Jahid | Nov 22, 2020 | কর্পোরেট অবজার্ভেশন
আমি নিজে খুব বেশী একটা সততার কথা বলি না ।‘সততা’ শব্দটি অধিক ব্যবহারে ক্লিশে (Cliché ) হয়ে গেছে; বিব্রত বোধ করি। আমার স্বল্প-জীবনে কেন জানি মনে হয়েছে, ধর্ম, নৈতিকতা, সততা আবার এর বিপরীতে অতিপ্রয়োজনীয় আকাঙ্ক্ষিত আর্থিক সাফল্য– একটার সঙ্গে আরেকটি ভীষণ বৈপিরিত্যময় ! একজীবনে এতো আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের কাছে আমরা বড্ডো অসহায় হয়ে পড়ি ! হয়তো সেইজন্য ‘সততা’ শব্দটি ব্যবহারে ভরসা পাই না।
আশির দশকে আমার বেড়ে ওঠা অবাঙ্গালী অধ্যুষিত মিরপুরে বিশাল একটা বাজারের পাশে । বাসার পাশেই বাজার ও জনবসতি সংলগ্ন বিশাল মসজিদ ছিল। বাজারের বড়বড় ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, দোকানদার, কর্মচারী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণীর মানুষ এক মহল্লায় বাস করতাম। অসংখ্য ধার্মিক সৎ লোকের মাঝেও শক্তিশালী পদচারণ ছিল অসৎদের। সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ লোকটিকে দেখতাম মসজিদে সবচেয়ে বড় অংকের চাঁদা দিতে।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, একদিন বলছিলেন, ষাটের দশকের নৈতিকতা আর সততার কথা। ধরেন কোন একটা অফিসের কর্মচারী ২০০জন । তো, সেই অফিসে গিয়ে নির্দিষ্ট একজন লোককে দেখিয়ে কেউ কেউ ফিসফিস করে বলত, ‘ওই যে দেখছেন , ‘অমুক’ সাহেব, উনার একটু ঝামেলা আছে, মানে হাতের ইয়ে আছে, উপরি ইনকাম আছে। বুঝেনই তো !’আজ কয়েক দশকের নিরবচ্ছিন্ন লুণ্ঠন আর নৈতিক অবক্ষয়ে অবস্থা ঠিক বিপরীত। আজকে ২০০জন লোকের একটা অফিসে এসে কেউ হয়তো ফিসফিস করে বলবেন, ‘ওই যে দেখছেন, ‘অমুক সাহেব’, উনারে দিয়ে আসলে কিছু হবে না, একটু বেকুব কিসিমের আছে, উপরি ইনকাম-টিনকাম কিছুই নাই। ঢাকার শহরে কোনমতে দিনগুজরান করছেন। বেচারা !’ সুন্দরবনের বাঘের মতই সৎ লোকের সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বিলুপ্তপ্রায়।
মূল প্রসঙ্গে আসি।
আমার এক মুরব্বী বড়ভাইয়ের ক্যারিয়ারের উন্নতি কাছে থেকে দেখেছি। একেবারে কর্পোরেট আইকন বলতে যা বোঝায়, উনি তাই। দুর্দান্ত স্মার্ট, সারাক্ষণ ফিটফাট, যেমন কথাবার্তা তেমন কাজের দক্ষতা। যে কোন সমস্যা সমাধানে তাঁর উপরে কোম্পানির অগাধ আস্থা। উপরি ইনকামের ব্যাপারে উনি দ্বিধাহীন-চিত্ত ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই গাড়ী বাড়ী নারী সব চেখে দেখেছেন। সেই বড়ভাই কিছুদিন আগে অফিসে এসে আমাকে নসিহত করা শুরু করলেন। সততা নিয়ে অনেক জ্ঞান দিলেন। ধর্মের পথে আসতে বললেন।
ওয়েল, তাঁর অনোপার্জিত অর্থ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা বা মন্তব্য নেই। আমি যেহেতু ভয়ংকর আশাবাদী মানুষ, তাঁর এই আকস্মিক পরিবর্তনে আমি সেই চিরন্তন আশাবাদী মানুষের মত ভাবা শুরু করলাম– উনি হয়তো ঠিকই করেছেন।অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করেছেন। এটা তো ঠিক, অতিরিক্ত বিত্ত তো আর সৎ পথে অর্জন করা সবসময় সম্ভব হয় না। যেনতেন প্রকারে বিত্ত অর্জনের পরে উনার যে বোধোদয় হয়েছে, উনি যে ধর্মের পথে এসেছেন, অর্জিত অর্থ নানাভাবে দেশেই রেখেছেন ও লোকজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন—সেই বা মন্দ কি ! তাঁর মতো লোকেদের কর্মদক্ষতা নিয়ে আমি সর্বদাই বিস্মিত ও শ্রদ্ধাশীল। আমার মতো হাড় আলসে লোকের পক্ষে তাঁদের ওই সৌভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও কিছু নাই। কিন্তু তাঁদের মুখোমুখি হলেই হিন্দি একটা ওয়ান লাইনার সবসময় মনে পড়ে যায় সেটা হচ্ছে, ‘ শ চুঁহে মারকে, বিল্লি হাজ্ব কো চালি!’ ( এক শ ইঁদুর মেরে অবশেষে বিড়াল হজ্ব করতে চলল ! )
ফ্ল্যাশব্যাক ১:
২০০৫ সালে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে একটা দারুণ বর্ধিষ্ণু বিভাগের প্রধান ; সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার। টেক্সটাইলের ডায়িং ফিনিশিং এর শনৈ শনৈ টাকার জায়গা ছেড়ে কেন আমি মার্চেন্ডাইজিং এ চলে এসেছিলাম সে আরেক গল্প। আমার প্রয়াত আব্বা ব্যাপারটাকে ঠিক সেভাবে পছন্দ করতে পারেন নি। টেক্সটাইলে পড়াশোনা করে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রকৌশলী না হয়ে কেন আমি গার্মেন্টস-এর জেনারেল একটা লাইনে গেলাম, সেটা তাঁকে বিরক্ত করেছিল হয়তো।
মার্চেন্ডাইজিং সম্বন্ধে আমি সেই সময় নিজেই তেমন কিছু জানতাম না। ‘গার্মেন্টস এর মার্চেন্ডাইজিং ’—এই তকমাটা আব্বার ঠিক পছন্দ হয়নি। সেই সময়কাল অনুযায়ী বাজারদরে আমি যে বেতন পেতাম তা নিতান্ত মন্দ ছিল না। সংসার খরচের বাইরে কোনরকম সঞ্চয় করতে না পারলেও বছর শেষে আমি আর আমার গিন্নী এদিক সেদিক বেড়াতে যাওয়ার মতো বিলাসিতা করতে পারতাম।
তো সেই সময়, আব্বা এক সন্ধ্যায় আমাকে বেশ উৎসুক হতাশার গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি টেক্সটাইল প্রোডাকশন ছেড়ে , কি জানি বায়িং হাউজের মার্চেন্ডাইজিং না কিসে জানি জয়েন করেছ ! সেদিন তো পজিশনও জানালে, সিনিয়র মার্চেন্ডাইজার। আজকে একটা তোমার বয়সী ছেলে এসেছিল। সে একটা কোরিয়ান বায়িং হাউজে চাকরি করে। পজিশনে মার্চেন্ডাইজার। সে একটা পৌনে দুই কাঠার বাড়ী কিনছে, প্রায় ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে। তুমি কি ধরনের বেতনের চাকরি কর তা তো জানি।’
আব্বার হতাশ কৌতূহল আমাকে একটু বিব্রত করলেও সামলে নিলাম। একটু বেশ কর্কশ ভঙ্গীতেই বললাম, ‘ আমার বেতন কত , আমি সংসারে কত দিই সবই তো আপনি জানেন। আমি যে কোম্পানিতে আছি, তা ঢাকার অন্যতম ভালো কোম্পানির একটা। বেতনও বয়স-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে খারাপ পাই না। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি বুঝতে পেরেছি। একটা কোরিয়ান বায়িং হাউজের সামান্য মার্চেন্ডাইজার কিভাবে ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ী কেনে, আর আমি প্রকৌশল ডিগ্রী নিয়ে কি করছি, সেটাই তো আপনার প্রশ্ন ? আব্বা , আমি যে আজকে ৫৫ লাখ টাকার বাড়ী কিনতে অক্ষম , সেটার দায়িত্ব আমি একা কিভাবে নিই? সেই অক্ষমতার দায়িত্ব আপনাকেও নিতে হবে। আপনি আমাদের যে মূল্যবোধ আর সততা দিয়ে মানুষ করেছেন, সেই মূল্যবোধ আর সততাই ৫৫ লাখ টাকার বাড়ী কেনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা !’ আব্বা আমার কর্কশ বলার ভঙ্গী দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলেন। এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন , উনি আমার আর্থিক উন্নতি-অবনতি নিয়ে আর কোনদিন কথা বলেন নাই।একসময়ে আমার খারাপ লেগেছিল, হয়তো অন্যভাবেও তাঁকে বোঝানো যেত। কেন যে ওই কর্কশ উত্তর দিতে গেলাম !
ফ্ল্যাশব্যাক ২:
সপ্তাহ দুয়েক আগে টেক্সটাইলের এক অনুজ এসেছিল ক্যারিয়ারের ব্যাপারে কিছু আলোচনা ও পরামর্শের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তার পরে তাঁর কণ্ঠে কিছুটা উষ্মার ছোঁয়া পেলাম। আমি পুরনো ধ্যানধারণা আর মূল্যবোধ নিয়ে কেন চলছি? তাঁর পরিচিত আমার সমসাময়িকরা ঢাকা শহরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।কারো কারো সম্পদের স্রোতের ঢেউ আমেরিকা , কানাডার সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে। তাঁদের তুলনায় আমার যোগ্যতা হয়তো সমান, কাছাকাছি বা কিঞ্চিৎ বেশী। আমারও আরও দূরে যাওয়া উচিৎ ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাঁকে বললাম সে ভারতের সরোদ বাদক ওস্তাদ আমজাদ আলী খান সাহেবকে চেনে কিনা। হ্যাঁ সূচক উত্তর আসল। কথা প্রসঙ্গে জানালাম, ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিচারণে কেউ একজন লিখেছিল। পুরোটা মনে নাই, ঘটনা-সংক্ষেপ অনেকটা এরকম। একদিন এক স্মার্ট তরুণী ইন্টারভিউয়ার ওস্তাদজীর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। নানা কথার ফাঁকে তরুণীটি জিজ্ঞেস করলেন,’ ওস্তাদজি আপনি সবদিকে এগিয়ে আছেন, ভারতের শ্রেষ্ঠ সরোদ-বাদকদের একজন। কিন্তু কিছু ব্যাপারে আপনি কেন যে পুরনো ধ্যান ধারণা নিয়ে আছেন! ওই সব মূল্যবোধ ছেড়ে আপনি কি অন্য সবার মতো আরেকটু আধুনিক হতে পারেন না? তাহলে তো অনেক দূরে যেতে পারতেন !’
ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের বুদ্ধিদীপ্ত ও আধ্যাত্মিক উত্তরটা ভালো লেগেছিল বলে আজ এতদিন পরেও কিছুটা মনে আছে, উনি নাকি বলেছিলেন, ‘যে আমজাদ আলী খানের সঙ্গে তুমি কথা বলছ সে তাঁর অর্জিত মূল্যবোধ আর রুচি সংস্কৃতি নিয়েই গড়ে উঠেছে ; সবকিছু মিলিয়েই আমি । ওই মূল্যবোধ ছাড়া আমার অস্তিত্ব কোথায়? এই মূল্যবোধগুলো আছে বলেই আমি ওস্তাদ আমজাদ আলী খান এবং আরও অনেক লোকের কাছে না গিয়ে তুমি আমার সাক্ষাৎকার নিচ্ছ !’
আমার অনুজকে বললাম , আমিতো আর ওস্তাদ-ফোস্তাদ কেউ নই। তবে সামান্য কিছু অনোপার্জিত অর্থের জন্য আমি আমার এতদিনের অর্জন পুরনো মূল্যবোধ ছাড়তে রাজি নই। আর ওই মূল্যবোধের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে জাহিদের কাছে তুমি পরামর্শ নিতে এসেছ আরও অনেক আর্থিক সফল বড়ভাইদের কাছে না গিয়ে, সেই মূল্যবোধগুলো ছেড়ে দিলে তাঁদের সঙ্গে আমার তফাৎ রইল কি !
আমার সেই অনুজ গম্ভীর মুখে হতাশার সঙ্গে মাথা নাড়ল ! কি বুঝল কে জানে ! মনে মনে নিশ্চয় আমাকে একগুঁয়ে , পুরোন ধ্যানধারণার একজন ভেবেই নিজের পথে পা বাড়াল !
সাম্প্রতিক মন্তব্য