আশির দশকে এবং পরবর্তীতে আমাদের সময়েও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেই সমাপনী বর্ষে ‘STUDY TOUR’ নামের একটা ট্র্যাডিশন চালু ছিল। মূলতঃ কক্সবাজার, সিলেট সুন্দরবন দিয়ে শুরু হয়ে নেপাল ও ভারতে এই শিক্ষা সফর শেষ হত। ধারণা করি এই ট্র্যাডিশন এখনো আছে।

তো বছর বিশেক আগে আমাদের সমাপনী বর্ষে ভারত সফরের ব্যাপারে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হল। নানা অনিশ্চয়তার পরে দিনতারিখ নির্দিষ্ট হয়ে গেল। তৎকালীন অধ্যক্ষ ডঃ নিতাইচন্দ্র সূত্রধর, যিনি আই আইটি( Indian Institute of Technology) থেকে টেক্সটাইল স্নাতক ছিলেন ; কথা প্রসঙ্গে আমাদের ডেকে যা বললেন , তার যার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, এই ভারত সফর আমাদেরকে বিদেশ যাত্রার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা দেবে। আমরা হাসি লুকালাম ! বাসে করে যশোরের বেনাপোল হয়ে বাংলাভাষী কোলকাতায় যাওয়া বিদেশ সফর কীভাবে হয় ! দ্বিতীয় কথাটা বলেছিলেন, সাধারণ ভারতীয়দের দেশপ্রেম নাকি চোখে পড়ার মত।

স্যারের প্রথম কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক ছিল। পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি ফর্মালিটিস একটা বিদেশ-সফরের ফ্লেভার এনে দিল।
স্যারের দ্বিতীয় কথাটার প্রমাণ পেলাম হাওড়া স্টেশনে এসে। দুঃখিত আমি ও আমরা একদা উচ্চমাত্রার ধূম্রপায়ী ছিলাম।ঐ সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ট্রিপল ফাইভ ( 555) , তার আবার দুইটা ভার্সন ছিল, লন্ডন ফাইভ আর বাংলা ফাইভ। ছাত্রাবস্থায় যা হয়– বেনাপোল পার হতে হতে ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সিগারেটের মজুদ শেষ। আমি যেহেতু অবাঙ্গালী- বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে বেড়ে উঠেছি , আমার হিন্দি ভাষাজ্ঞান অন্যদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী ছিল। তো আমার স্বল্প ভোকাবুলারী নিয়ে, হাওড়া ষ্টেশনে এক হকারকে পাকড়াও করলাম। ভাঙ্গাভাঙ্গা হিন্দিতে তাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম আমাদের ট্রিপল ফাইভ ( 555) সিগারেট দরকার। বাংলা ফাইভ হলে ভাল, লন্ডন ফাইভ হলেও চলবে। ঐ হতদরিদ্র অশিক্ষিত হকার আমাকে অবাক করে হিন্দিতে বলল, ‘ আপ্ বাংলাদেশ সে আয়ে হো ক্যা ?’ ( আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছ ?’ আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিতেই সে ভারতে প্রস্তুতকৃত গোল্ড ফ্লেকের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ ইন্ডিয়া মে আয়ে হো তো ইন্ডিয়াকে সিগারেট পিয়ো, বাহার কা সিগারেট কিউ ঢুণ্ডরাহে হো !’ ( ইন্ডিয়াতে এসেছ তো ইন্ডিয়ান সিগারেট খাও, বিদেশী সিগারেট খুঁজছ কেন ?) আমি মোটামুটি থতমত খেয়ে গোল্ড ফ্লেকের প্যাকেট হাতে ফিরে আসলাম।‘মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ!’

কীভাবে, কেমন করে সামান্য একটা হত দরিদ্র হকারের মধ্যেও এতোটা দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ এসেছে তা আমি জানি না । তবে অনেকবার ভারতভ্রমণে আমার মনে হয়েছে, দেশপ্রেমের ব্যাপারটা সিনেমা টিভি থেকে শুরু করে টনিকের মতো সবার মাঝে ছড়ানো হয়। যার ফলে গুণগতমান যাই হোক না কেন নিজেদের পণ্য ব্যবহারে এরা অভ্যস্ত। একইভাবে জয়েন্ট ভেংচার গাড়ী, ইলেক্ট্রনিকস ও কম্পিউটারের বহুজাতিক সব সংস্থার নতুন কেন্দ্রবিন্দু চীনের পরেই ভারত।

ছাত্রাবস্থায় হোটেলে ভারতীয় টয়লেট পেপারের সমস্যাটা ভোগালো আমাদের। আমরা অভ্যস্ত ছিলাম খুবই উন্নতমানের ‘বসুন্ধরা’ টয়লেট পেপারে। সেই তুলনায় এদেরগুলো শাব্দিক অর্থেই ‘পেপার’ ! শক্ত, অস্বস্তিকর এবং প্রায় শোষণক্ষমতাহীণ। জনৈক পাশ্চাত্যের পর্যটকের কথা মনে করিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। অধিকাংশ ভারতীয় টয়লেট পেপার ব্যবহার করেনা কেন তা নাকি উনি নিজদেশে ফেরত যাওয়ার আগে টের পেয়েছিলেন ! তাঁর মতে, ভারতীয়রা খাবারে যে পরিমাণ তেলচর্বি ব্যবহার করে, তা অর্ধ-পাচ্য হয়ে পরেরদিন টয়লেট করার সময়ে নির্গত হওয়ার কথা। এখন এদের টয়লেট পেপারের যে অবস্থা তেলে আরে কাগজে ঘষাঘষি হলে তো আগুন লেগে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ! এই ভয়েই সম্ভবতঃ ভারতীয়রা টয়লেট পেপার কম ব্যবহার করে !

বহুবছর পরে এসে মনে হল, বছর বিশেক আগের সেই পর্যবেক্ষণের কোনটাই পরিবর্তিত হয়নি। এঁদের দেশপ্রেম হয়তো আরও বেড়েছে । পাক-ভারত- চীন ত্রয়ী যুদ্ধের দামামায়, সারাক্ষণ হিসাব-নিকাশ চলছে শক্তিমত্তার ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির।
আর টয়লেট পেপারের গুণগত মান সেই আগের মতোই, শক্ত, অস্বস্তিকর এবং প্রায় শোষণ-ক্ষমতাহীন !

বছর বিশেক আগের সেই ‘STUDY TOUR’-এ নানারকম অম্লমধুর বিচ্ছিন্ন ঘটনার আরেকটি মনে আছে । কোলকাতার প্রথম সকালে পার্কস্ট্রীটের কোন এক হোটেলে আমাদের ঘুম ভাঙল আগেভাগে। সতীর্থ পিন্টু ( Habibur Rahman ) বলল, ‘চলো মামা, বাইরে হেঁটে আসি।’

সেই আদ্যিকালের কোলকাতা জেগে উঠছে ধীরে ধীরে । রাস্তার পাশে মাটির খুড়া বা চায়ের পাত্রের সঙ্গে বাসি ফেলে দেওয়া খাবারের উপরে মাছি ভনভন করছে। কিছুদূর হাঁটলেই বটগাছের নীচে দেবী কালীর ছোট মূর্তিতে কিছু গাঁদাফুলের উচ্ছিষ্ট। সাইকেল রিকশার টুংটাং ; পূজার ফুলের ভ্যান যাচ্ছে বড় কোন মার্কেটে। এর মাঝে বেশ খানিক হেঁটে চলে আসার পর পিন্টু বলল , ‘চলো মামা, এখান থেকেই নাস্তা করে যাই।’
তো এক হোটেলে ঢুকে পড়লাম। বসেই জিজ্ঞেস করলাম নাস্তায় কি কি আছে। অতো ভোরে মাত্রই বোধহয় চুলো জ্বেলেছে। মেসিয়ার এসে বলল, ‘লুচি আছে ভাজি আছে।’ এই সামান্য মেনু দেখে আমরা একটু ইতস্তত করছিলাম। মেসিয়ার সেটা টের পেয়েই কিনা বলল , ‘দাদা , মোহনভোগ আছে, দেব ?’ মিষ্টির প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ –আমার আশেপাশের সবাই জানে। লুচি-ভাজির সঙ্গে মোহনভোগ ও চাইলাম। যেমন গালভরা নাম, শুনেই মনে মনে আশা করছিলাম নিশ্চয় বেশ বড়সড় টাইপের কোন একটা মিষ্টি এসে হাজির হবে।
আমাদেরকে হতাশ করে দিয়ে ,লুচি-ভাজির সঙ্গে যে বস্তু আসলো, সেটাকে বাসায় আমরা সুজির হালুয়া বলি। আম্মা যেদিন দায়সারা গোছের নাস্তা বানাতেন, তাড়াহুড়ো করে রুটির সঙ্গে আমাদের সুজির হালুয়া করে দিতেন। সুজির হালুয়ার মতো সামান্য একটা জিনিসকে যে পশ্চিমবঙ্গে ‘মোহনভোগ’ বলে তা কে জানত !

তাজমহল নিয়ে যতো প্রশংসাবাক্য শুনেছি তার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে লেখক মার্ক টোয়েন এর উক্তি। তাজমহল দেখার পরে উনি বলেছিলেন–“There are two types of people in the world : People who have visited the Taj Mahal and people who have not! ”
গতকাল অপরাহ্ণে ( ১২ই অক্টোবর ২০১৬) আমার দুই রাজকন্যাকে ‘তাজমহল দেখা’ শ্রেণীতে উত্তরিত করলাম।

আমার প্রথম তাজমহল দেখার স্মৃতি সেই বছর বিশেক আগে শিক্ষাসফরের সময়ে ।মধ্যদুপুরে আমরা কয়েকজন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম এই সৌধের দিকে। দু’য়েকজন একটু হতাশ ; তারা অন্যের মুখে এতোবার তাজমহলের নানারকম চর্বিতচর্বন স্মৃতিচারণ শুনেছে, ভেবে বসেছিল যে ওটা বোধহয় একশোতলা সমান কোন একটা কিছু হবে। তাজমহল তো আর সিয়ার্স টাওয়ার না রে ভাই ! আমার কাছে মনে হয়েছে, এর বিশালত্বের ও সৌন্দর্য্যের মূল ব্যাপারটা যতোখানি না দেখার তারচেয়েও বেশী অনুভব করার।
ঐ কৈশোরে ক্রমান্বয়ে আমার বিস্ময় বাড়তে থাকল, কারণ দুপুর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকেলে উজ্জ্বল কনেদেখা আলোয় তাজমহলের রং হয়ে গেল একরকম ! সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে দিয়েছিল ; প্রতি ঘন্টায় তাজমহলের বর্ণবৈচিত্র আমাকে হতবাক করল ! এক ফটোগ্রাফারকে দিয়ে ছবি তোলালাম, হোটেলে ছবি পৌঁছে দিল পরের দিন ; এবং আমি বোকার মতো সেই ছবিগুলো হোটেলের ড্রয়ারে ফেলে চলে আসলাম !

সেই বছর বিশেক আগের দেখা তাজমহল ! এতোদিনে আমি পৌঁছে গেছি মাঝবয়সে। আর তাজমহল দাঁড়িয়ে আছে ; সেই চিরযৌবনা হয়ে আগের মতোই !

মুঘলদের স্মৃতিসৌধ ও রাজপ্রাসাদগুলোর বিশালত্ব আর খরচের বাড়াবাড়ি দেখে আমি বহু আগে থেকেই একাধারে মর্মাহত ও বিস্মিত । আমার বড়কন্যাকে জিজ্ঞেস করায়, সে তার আধুনিকতা বজায় রেখে এক কথায় বলল, ‘Mind blowing!’

বছর বিশেক আগের সেই দীর্ঘ সপ্তাহ চারেকের Study Tour-এ দিল্লী, আগ্রা রাজস্থানে মুঘল আর রাজপুতদের রাজপ্রাসাদ আর কেল্লা দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেলাম। সেই একই বিশালত্ব, সেই শ্বেত মর্মর মার্বেল, রেড স্টোন আর দেয়ালের কারুকাজ। কৈশোরের ঐ অস্থির সময়ে ঐ বিশালত্ব হয়তো একটু ক্লান্তি এনে দিয়েছিল । দিওয়ান-এ আম; দিওয়ান-এ খাস, হাওয়া মহল, জল মহল, গান শোনার জায়গা, খাওয়ার যায়গা, আদিগন্ত বাগান, বিশাল গোলাপজলে ডোবানো পাথরের টবে গোসল করার ব্যবস্থা – কী নাই !
মজার ব্যাপার বহু খুঁজেও এরা এঁদের প্রাকৃতিক কাজগুলো কীভাবে এবং কোথায় সারতেন সেটার কোন নমুনা কোন প্রাসাদেই দেখতে পেলাম না । বাদশাহ হন আর সুলতান ; দিনের শুরুতে , মাঝে বা দিনশেষে এই কাজটি না করলে তো চলবে বা । মুঘলদের এতো কিছু আলোচনা বাদ দিয়ে তাঁদের প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে কেন লিখছি সেটা বলি। বছর বিশেক আগে, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি আমাকে নির্বোধ ভাবে সেই ভয়ে অনেককিছু চেপে যেতাম। হয়তো সেই অস্বস্তিতেই কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় নি । গত দুই দশকে আমার নির্বুদ্ধিতা প্রমাণিত সত্য । সুতরাং বোকার আবার ভয় কীসের ! আমি গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এক বাত বাতাও , ইয়ে রাজালোগ টাট্টী কাঁহা কারতে থে?’ ( একটা কথা বলতো, এই রাজা-বাদশাহরা পটি করত কোথায়?) বেচারা নিতান্তই বিরক্ত হল। এই রকম ফালতু টাইপের প্রশ্ন আগের কোন ট্যুরিস্ট করে নি বোধ হয়। বিরক্ত হলেও গাইড-তো, তাই হাসিমুখে জবাব দিল, মূল প্রাসাদের বাইরে এঁদের মল-মূত্র ত্যাগের ব্যবস্থা থাকত।

সম্ভবত: প্রাগৈতিহাসিক ভারতীয় সংস্কৃতিকেই এরা অনুসরণ করেছেন। শিক্ষা সফরের সময়ে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মাঝখানে দিয়ে যাওয়ার সময়ে ভোরে ট্রেনলাইন থেকে বা বাস রোড থেকে বেশ দূরে পুরুষ ও মহিলাদেরকে পটি করতে দেখেছি। সঙ্গের যে লোকাল গাইড ছিল, তাঁকে প্রশ্ন করায় উত্তর দিল যে, ভারতের বহু জায়গায় নারীপুরুষ নির্বিশেষে খোলা জায়গায় পটি করে। সে নিজেই ইয়ার্কি করে বলল, সম্ভবত: তাদের পশ্চাৎ-দেশে ঘাসের সুড়সুড়ি না লাগলে আসল কাজটি হয় না !

এটাও মনে আছে ২০০৯ এর দিকে অগ্রজের কিডনি ট্রান্স-প্ল্যান্টের সময় আমরা আদি কোলকাতায় অ্যাটাচড বাথসহ ছোট অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছিলাম। বাজেটের মধ্যে কিছুতেই মনোমতো পাচ্ছিলাম না। হয়তো , সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসতবাড়ি থেকে তাঁদের টয়লেট বেশ দূরে থাকাটাই রীতি ; এবং সেটা তারা ফ্ল্যাট কালচারেও বজায় রেখেছে। অবশেষে টালিগঞ্জের দিকে অ্যাটাচড্ টয়লেট সহ ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছিল।

অবশ্য রাজস্থানের জয়পুরের জয় সিংহ, মানসিংহদের রাজ প্রাসাদে কয়েদখানার আশে পাশে কয়েকটি জায়গা দেখিয়ে গাইড বলল, সেগুলো নাকি তাঁদের টয়লেট ছিল। আর রাজপুতদের উত্তরসূরিদের জীবন যাপন ছিল বেশ আধুনিক। এরা ১৮০০ সালের দিকেই ব্রিটিশদের সঙ্গে মিত্রতা করেছিল এবং বাকী জীবন সুখে-শান্তিতেই কাটিয়েছিল। এখনকার যিনি মহারাজা তার বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। জয়পুরের সিটি প্যালেসের একপাশে রাজপরিবার এখনো বাস করছে। একাংশ ছেড়ে দেওয়া মিউজিয়াম থেকে যে পরিমাণ আয় হচ্ছে , বাকী-জীবন সুখেই কাটবে আশা করা যায় ।

পাড়ার সেলুনের নাপিতরা সাধারণত খুব উন্নতমানের জ্ঞানী হয়ে থাকে ! আরেকধরনের জ্ঞানী হচ্ছে নতুন কোন শহরে পৌঁছে যে ড্রাইভারের সঙ্গে আপনার দেখা হবে তিনি। CNN- BBC যে সব গোপন সংবাদ এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি, সেটাও তারা জানে! এঁদের মতো দার্শনিক ও জ্ঞানী-লোক কেন যে এইসব তুচ্ছ কাজ করে জীবন কাটাচ্ছে সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। অধুনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ভাবে পিএইচডি ডিগ্রী বিলচ্ছে, তাঁদের তো এতদিনে বিষয়-এর অভাব পড়ে যাওয়ার কথা। নবীন গবেষকরা ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারেন।

তো , আমাদের সাড়ে চারফুটি ড্রাইভারের নামের সঙ্গে তার দেহসৌষ্ঠব এক্কেবারে যায় না। এক্সেলেটর আর ব্রেকে ঠিকমত পা যাতে পড়ে সেজন্য সে প্রায় একফুট উঁচু বুট পড়ে চলাফেরা করে। ক্ষুদ্রাকৃতির ড্রাইভার সাহেবের বাড়ী হিমাচল প্রদেশের এবং দেহের তুলনায় নাম খুবই ওজনদার – শের সিং ! পাক-ভারত ভূ-রাজনীতি থেকে শুরু করে ওবামা পরবর্তী আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে সে অত্যন্ত চিন্তিত।

তার অনেক কথার সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি নির্বোধের মত আচরণ করাই শ্রেয় মনে করেছি। বিদেশ বিভূঁইয়ে খামোখা ক্যাচাল না করে তার হিসাবমতো চলাই উত্তম মনে হয়েছে। শের সিংয়ের অনেক জ্ঞানের কথার মধ্যে বাস্তব-ধর্মী হচ্ছে তিনটি ।

প্রথমটি হচ্ছে, আগ্রার হোটেলে পৌঁছাতে দেরী হয়ে গেল। রাতে গরম পানি ছিল না। এক্কেবারে নতুন হোটেল পুরো গোছগাছ হয় নি। তো তারা বলল, সকালে উপরের বয়লার চালু করে দেবে। যথারীতি সকালে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পর গরম পানি তো পাওয়া গেলই না, দেখা গেল পানিই বন্ধ হয়ে গেছে। ওভাবেই তাড়াহুড়ো করে জয়পুরের উদ্দেশ্যে বের হলাম আমরা। ঘটনা শুনে শের সিং বলল, ‘ আজকাল তো , অনলাইন পে সাব কুছ্ মিলতা হ্যায় !’ কথায় তাচ্ছিল্যের সুর শুনে জিজ্ঞেস করার পর সে যেটা জানালো, অনলাইনে হোটেল বুকিং দিলে কম টাকায় ঝকঝকে তকতকে সুযোগ সুবিধে দিয়ে দেয়। বাস্তবে আসলে টের পাওয়া যায় হোটেলে অবস্থা ! অনলাইনে দিল্লী থেকে তিনঘণ্টায় আগ্রা পৌঁছে দেওয়া যায় , বাস্তবে কতখানি লাগে সেটা ড্রাইভাররা ভালো জানে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে মোটর সাইকেল আরোহীদের নিয়ে তার মন্তব্য। ঢাকার মোটর বাইকারদের ড্রাইভিং নিয়ে আমি নিজেও ত্যক্ত। শহরের ভিতরে কিংবা হাইওয়েতে এঁদের হুট হাট রাস্তা-ক্রসিং আর ডান-বাম জ্ঞানের অভাব যেমনটি বাংলাদেশে তারচেয়েও বেশী দেখলাম ভারতে। শের সিং এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ এক বাইক খরিদ্ লিয়া লাগ্তা হ্যায় সারে ইন্ডিয়া খরিদ্ লিয়া ! ( একটা মোটর সাইকেল কিনে এমনভাবে চলাফেরা করে , মনে হয় যেন সারা ইন্ডিয়া কিনে ফেলেছে!) ঘটনা সত্য, বাংলাদেশের মোটরবাইকাররা রাস্তা, ফুটপাত সবকিছুকেই নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে !

বছর বিশেকে আরও প্রশস্ত হয়েছে দিল্লী-আগ্রা-জয়পুরের হাইওয়েগুলো। মাইল দশেক পরপর দীর্ঘাকৃতির ফ্লাইওভার ট্রাফিক জ্যাম প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে এসেছে।
শের সিংয়ের আরেকটি মন্তব্য ছিল হাইওয়ের পাশগুলোতে নানারকম ল্যান্ড ডেভেলপারদের গালভরা সাইনবোর্ড নিয়ে। সিং হাম সিটি , সান সিটি, মুন সিটি, কুবের সিটি, নিমরানা কাউন্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। শের সিং যা বলল, গত বছর পনের ধরেই কিছু সাইনবোর্ড সর্বস্ব কোম্পানি লোকজনের টাকাপয়সা লুটে নিচ্ছে । রাস্তাঘাটের, ইউটিলিটির নাম নেই , জমি বুঝিয়ে দেওয়ার নাম নেই শুধু বড়বড় সাইনবোর্ড আর বাগাড়ম্বর। ‘রুপিয়া বাড়নেকে সাথ্ সাথ্ আদমি লোগ্‌কা বেওকুফি ভি বাড় যাতি হ্যায়।’ ( টাকা পয়সা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের বেকুবি বেড়ে যায় !) আমার গায়েও এই অপমান লাগল, আমি চুপচাপ হজম করলাম। ঘটনা সত্য ; আমি নিজেও পাকেচক্রে পূর্বাচলের ধুনুফুনু নানা কোম্পানির অন্যতম GREAT WALLS LAND PROPERTY LTD. নামের এক ফোর টুয়েন্টি কোম্পানিকে মাসেমাসে কষ্টের টাকা দিয়েছি ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১১ পর্যন্ত, এখন না পাচ্ছি কোন জমির হিসাব না পাচ্ছি টাকা পয়সা। এরা বিঘা খানেক জমি কিনে, হাজার দশেক লোকের কাছে বিক্রি করে টাকা পয়সা সরিয়ে ফেলেছে। বুঝলাম আমার মতো বেকুব সব দেশেই আছে !

এইবার প্রায় প্রত্যেক দর্শনীয় জায়গাগুলোতেই শের সিংয়ের কথামতো গাইড নিয়েছিলাম। ইতিহাস জানার চেয়েও বড় সুবিধা যেটা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে এরা আমাদেরকে দ্রুত টিকেট কিনে দিয়েছে ; লম্বা লাইন এড়িয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সার্ক দেশের জন্য সাদাচামড়ার বিদেশীদের চেয়ে কম টাকায় টিকেট আছে। এই সুযোগে আমার ক্যামেরাটা ধরিয়ে দিয়েছি গাইডদেরকে; তারা আমাদের চারজনের গ্রুপ ছবি তুলে দিয়েছে! নয়তো চারজনের একসঙ্গে ছবি তোলা প্রায় অসম্ভব ছিল।

স্থানভেদে গাইডের চার্জ ২৫০ রুপি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৬০০ রুপি। সমস্যা একটাই, প্রতিটা গাইডই তাদের পরিচিত দোকানে নিয়ে হাজির হয়েছে, এবং কিনব না কিনব না করেও গুচ্ছের পাথরের ঘটিবাটি কেনা হয়েছে। দেখা যাক, এয়ারপোর্টে কতখানি ওভার-ওয়েট চার্জ দিতে হয় !

প্রকাশকালঃ অক্টোবর,২০১৬