আশির দশকে আধুনিক কবিতার একটা লাইন পড়েছিলাম। দুঃখিত কবির নাম মনে করতে পারছিনা। তিনি লিখেছিলেন, “ তখন আমার বয়স ছিল কম , রাতে ঘুম হতো ,আর প্রস্রাবের রং ছিল সাদা।” স্মৃতি থেকে লেখা, একটু এদিক সেদিক হতে পারে। তো, আমার শৈশবেও আমি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাতাম আর সাদারঙের হিসু করতাম।

যখন শৈশব ছাড়ি ছাড়ি করছে, তখন কীভাবে যেন পড়ালেখার চাপ গেল বেড়ে। স্কুলে প্রথম সারিতে নাম লেখানোর ইঁদুর দৌড়ে পড়ে গেলাম।
আমার যাবতীয় শিশুসুলভ দুঃস্বপ্নের ভিতরে বেশি যেই দুঃস্বপ্ন হানা দিয়েছে বারবার, সেটা হচ্ছে পরীক্ষার হলে গেছি, খাতা পেয়ে প্রশ্ন পেয়ে কিছুই মনে করতে পারছি না। এই স্বপ্নের সিকুয়েল ছিল, কোনবার দেখতাম পরীক্ষা হল খুঁজে ফিরছি, কিন্তু নিজের রুম বা আসন খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০টা ছুঁইছুঁই। কোনবার দেখতাম, মাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, অথচ স্যার বলছেন তিনঘণ্টা নাকি শেষ, খাতা জমা দিতে হবে। তখন প্রবল বেগে লেখার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। ঘুমের মধ্যেই আমি টের পেতাম কী অসহনীয় শারীরিক ও তীব্র মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত।

সে সময়ে আমার ছিল একটা তরতাজা , শক্তিশালী হৃদপিণ্ড । এখনকার মতো ধোঁয়া, ধুলোবালি ভেজাল খাওয়া হৃদপিণ্ড এরকম দুঃস্বপ্নের চাপ নিতে পারবে না। ঘুমের মধ্যেই মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমার ধারণা সবযুগের শৈশবে এই পরীক্ষাভীতি ছিল , আছে সবার ঘুম ভাঙ্গে পরীক্ষার দুঃস্বপ্ন নিয়ে।

দুঃস্বপ্নের কাছাকাছি কিছু কি বাস্তব জীবনে সত্যি ঘটে? আমার হালকার উপর ঝাপসা ঘটেছিল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষায় একবার সাধারণ বিজ্ঞান পড়ে গিয়ে সাময়িক দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। সে আরেক কাহিনী।

আর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে, অর্ধেক প্রশ্নের উত্তর না দিতেই দেখি সময় শেষ। খুব দ্রুত সব প্রশ্ন টাচ করে যাওয়ার বিশেষায়িত ট্রেনিং ও টেম্পারমেন্ট দরকার বুয়েটের পরীক্ষায়। মনে হয়, একটা দুইটা প্রশ্ন নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করে ধরা খেয়েছিলাম।

পরীক্ষার হলে দেরী করে পৌঁছেছি সারাজীবনে একবারই, বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি দিতে চেয়েছিলাম নিতান্তই শখে পড়ে। বিসিএস-এ টিকে হাতিঘোড়া হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা, সম্ভাবনা ও প্রিপ্রারেশন কিছুই ছিলনা। আমি তখন বেশ কয়েকবছর টেক্সটাইল কারখানায় চাকরি করে ওপেক্স গ্রুপের মার্চেন্ডাইজিং এ। আত্মীয়স্বজনদের আফসোস থেকে যাবে পরিবারের মেধাবী ছেলে একবার বিসিএস পরীক্ষা দিল না ! তো, সেসময় গার্মেন্টস ও শিপমেন্টের এমনই হ্যাপা, যে একঘণ্টার জন্য বাইরেও যেতে পারি না ; বড়ো স্যারেরা কেউ না থাকলে কাজের চাপে টেবিলে বসেই সিগারেট খেতাম। কে আবার কষ্ট করে রান্নাঘরের কোনায় যায়। আমার অবস্থা সেভেন ইলেভেনের দোকানগুলোর মতো ; সারাক্ষণ একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। পরীক্ষার দিন তাই, মহাখালী ডিওএইচএস ওপেক্সের অফিসে হাজিরা দিয়ে একটা স্কুটার নিয়ে সোজা ইডেন কলেজে, যেখানে পরীক্ষার সিট পড়েছে। যথারীতি পরীক্ষা শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে গেটে। পুলিশ ঢুকতে দেয় না। বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করার পর, হলে গিয়ে বসলাম। দৌড়াদৌড়িতে ঘেমে নেয়ে একশেষ। প্রিপারেশন ছাড়া পরীক্ষার আর কীই বা হতে পারে। টিকলাম না।

আরেকটা দুঃস্বপ্ন বহুদিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমাকে। সবসময় দেখতাম একটা বড়ো বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান চলছে, বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করে দেখতাম, কনের পাশের বর-বেশে বিমর্ষ বদনে যে বসে আছে সে আমি ! সেটাও সমস্যা না। বিয়ের স্বপ্ন তো দেখতেই পারে ভেতো বাঙালি। সমস্যা হচ্ছে, কনের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি। কোন একটা টিভি সিনেমার বয়স্কা নারীকে বধুবেশে বসে থাকতে দেখতাম। কিন্তু আমি না পারছি উঠে দৌড় দিতে ; না পারছি কবুল বলতে। কীয়েক্টাবস্থা !

আরেকটা খুব কমন স্বপ্ন ছিল, গভীর কোন অতল খাদে পড়ে যাচ্ছি। চিৎকার করছি, কিন্তু পতন থামছে না। আমার ধারণা জীবনে অনেকের কাছেই এটা সবচেয়ে কমন দুঃস্বপ্ন।

প্রায়শঃ দুঃস্বপ্ন দেখতাম অচেনা রাস্তায় পথ হারিয়ে ফেলেছি। একবার কিছু চেনা চেনা মনে হয় , হেঁটে সামনে এগিয়ে গেলেই দেখে একেবারে অচেনা কোন বনজঙ্গল রাস্তা ইত্যাদি। অথচ আমার কোথাও যেন যাওয়ার তাড়া আছে, সেটা মনে করে টেনশনে আছি আবার কাউকে জিজ্ঞেস করার মতোও পাচ্ছি না। কী যে একটা পেরেশানি।

‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ!’

শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে আর যৌবনে ঘুরে ফিরে একই ধরণের দুঃস্বপ্নই ছিল।
আর কর্মজীবন শুরু হওয়ার পরে তো সবরকমের স্বপ্ন দেখাই ছেড়ে দিয়েছি। ইদানীং কিছুই দেখিনা বা দেখলেও ঘুম থেকে উঠে কিছুই মনে থাকে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে, স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গল সেটা ভাবার চেয়ে ব্লাডারের প্রেসার কমিয়ে এসে , পানি খেয়ে শুয়ে পড়ার প্রবণতাই বেশি।

প্রকাশকালঃ ১০ই অক্টোবর,২০২০