ওইদিকে আমেরিকা আর এইদিকে ইউরোপের মধ্যে জার্মানি আমাদের অন্যতম বৃহৎ তৈরি পোশাক-ক্রেতা দেশ। এদের বেশ কিছু নাম করা ডিসকাউন্টার আছে যাদের দোকানের সংখ্যা দশ হাজার, বারো হাজার মায় কুড়ি-হাজার পর্যন্ত আছে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে এদের দোকান। গত বছর কী মনে করে আমেরিকা ও জার্মানি দুই দেশেরই কয়েকটা ডিসকাউন্টারের বড়ো বড়ো দোকান ঘুরে দেখার সুযোগ মিললো।

প্রথমে আসি , ওয়ালমার্টের কথায়। এদের কিছু সুপার শপ আছে। এই পাশ থেকে ওই পাশ দেখা যায় না। টয়লেট পেপার থেকে শুরু করে গাড়ীর চাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। কতো সস্তায় এরা পণ্য বিক্রি করছে, উদাহরণ দিয়ে বুঝাই। বাইরে ৫০০ মিলির একই ব্রান্ডের এক বোতল পানি হয়তো দেড় দুই ডলার। কিন্তু , সুপারশপে আপনি যদি এক সঙ্গে ২৪ টার এক ক্রেট পানি কেনেন তবে ওইটার দাম ৫ ডলার মানে প্রতি পিস পড়ছে ২০ সেন্ট ! ক্যাম্নে কী !

এইবার আসেন জার্মানিতে, বাইরে এক বোতল ওয়াইনের দাম ১৫ ইউরো। কিন্তু, সুপার শপে ৬টা এক সাথে কিনলে, ৪০ ইউরো।

দেখলাম , একটা গ্যাস লাইটারের বাইরে দাম ১ বা দেড় ইউরো , কিন্তু এরা ১২ টা একসাথে বিক্রি করছে ১.৭৫ ইউরোতে মানে একটার দাম ১৫ সেন্টের কাছাকাছি !একটা গ্যাস লাইটারের উৎপাদন খরচ চীনে কতো হতে পারে, আর জার্মানি পর্যন্ত এনে কেমন করে এই দামে বিক্রি করছে, সেটা বড়ো কোন গবেষণার বিষয় না। আপনি নিজেই হিসাব করতে পারবেন। ধরেন ওই গ্যাস লাইটার চীন থেকে ৫০০০ পিস কিনলে আপনি যে দামে পেতেন, তার এক দশমাংশ দামে পাবেন , যদি আপনি পাঁচকোটি গ্যাস লাইটার কেনেন একসাথে । সেক্ষেত্রে একটি গ্যাস লাইটারের দাম ৩ বা ৪ সেন্ট করে পড়বে!
এই ডিসকাউন্টারগুলো, They are simply killing and spoiling the market !

মাঝে মাঝেই গার্মেন্টস মালিকদের সাথে কথা হয়। অনেকেই বিকল্প কোন সেক্টরের কথা চিন্তা করতে বলেন বা জিজ্ঞাসা করেন , অন্যকোন ব্যবসা ক্ষেত্র আছে কীনা । ৯০ এর দশকের কোটা(Quota) কেনাবেচার আমলে গার্মেন্টসের ব্যবসায় রমরমা লাভ ছিল, আজকের বড়ো বড়ো সব গ্রুপগুলো কোটার ব্যবসা করে শত শত লাইনের আর ডজন ডজন বিল্ডিং এর মালিক। দুই টাকা যদি সিএম( কাটিং মেকিং কস্ট ) থাকতো, কোটা থেকে পেতেন কুড়ি টাকা। যারা সেই আমলের গার্মেন্টস ব্যবসা করেছেন তারা জানেন কী পরিমাণ লাভ তারা করেছে। কিন্তু পরের যুগের গার্মেন্টস উদ্যোক্তারা যে কত রকম সীমাবদ্ধতার মাঝখান দিয়ে এই সেক্টরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন , সেটা আমরা কাছ থেকে অনেকেই দেখছি।

আমাদের আসলেই একটা বিকল্প ক্ষেত্র দরকার!

এই একরৈখিক একমাত্রিক পরনির্ভরতা আমাদেরকে নীচের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পশ্চিমা ক্রেতারা জানে, এই তৈরি পোশাক খাতে যারা বড়ো বড়ো বিনিয়োগ করে বসে আছেন তাঁদের অর্ডার দরকার। অনেকে শুধুমাত্র পেটেভাতে দাম মিললেও অর্ডার নিয়ে নেন। এইটাকে আমরা বলি ব্রেক ইভেন কস্ট-এ অর্ডার নেওয়া । ফ্লোর বসিয়ে রাখলে যে ক্ষতি , সস্তার অর্ডার নিয়ে ফ্লোর চালালে অন্তত আর্থিক ক্ষতিটা এড়ানো যায়। এ এক দুর্ভেদ্য দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছেন তারা। আবার নতুন উদ্যোক্তারা। ১৮% সুদে ব্যাংক লোন নিয়ে, সস্তার কাজ নিয়ে ন্যূনতম লাভ তুলতে পারছেন না।

ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, যারা ফ্যাশন ক্রেতা তারাও হুমকির মুখে আছে কিছু ডিসকাউন্টারের অতি মূল্যহ্রাসের দুষ্টচক্রে। যে ফ্যাশন ক্রেতা, সে হয়তো ৫০০০ টি-শার্ট নিবে। সে ২.৫০ বা ৩ ডলার FOB দিয়ে কিনে ৯ ইউরোতে বিক্রি করবে। তাঁদের প্রাথমিক লভ্যাংশ ৫৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ ভাগ থাকে। পরে সেল ও অফ সিজন ধরে দোকান খরচ দিয়ে পুষিয়ে যায় ।

কিন্তু, ডিসকাউন্টাররাও ওই একই টি- শার্ট ৫ লক্ষ পিস নিবে। সে কিনতে চাবে , ১.৫০ ডলারে। এখন সে যদি চায় কম লাভে ওই টি-শার্ট রিটেল মার্কেটে বিক্রি করবে, ইচ্ছা করলেই সে দেড় থেকে দুই ইউরোতে বিক্রি করতে পারবে ওইটা । সে কোন মার্ক-আপ রাখবে না। বড়ো বড়ো গ্রসারি ডিসকাউন্টার Wal-Mart, Primark, LIDL, TCHIBO, TESCO, ALDI এদের প্রধান পণ্য কিন্তু পোশাক নয়, এরা মূলত: গৃহস্থালি , শাক-সবজী, খাদ্যদ্রব্য, পানীয়ের ফাঁকে হাজার হাজার দোকানে সস্তার টি-শার্ট বা অন্য পোশাক বিক্রি করছে নামমাত্র মূল্যে। এদের সাথে তাল মিলিয়ে INDITEX, H&M এর মতো বড়ো চেইন রিটেইল গুলোও ক্রেতা আকর্ষণ করতে ডলারে কিনে সমমূল্যের ইউরোতে পোশাক বিক্রি করছে। মানে, ২ ডলারে টি-শার্ট কিনে , ২ ইউরোতে বিক্রি করে ক্রেতা আকৃষ্ট করছে।

মাঝখানে বিপদে পড়ে গেছে ওই মাঝারি মাপের ফ্যাশন রিটেলগুলো, যারা অনেক ডিজাইনার রেখে , অনেক গবেষণা করে একটা টি শার্ট ৯ ইউরোতে বিক্রি করতে চায়। দরিদ্র হিস্পানিক ও এশিয়ান ইমিগ্রান্টরা হন্যে হয়ে Wal-Mart, K-Mart, TESCO, PRIMARK এ ছুটে যাচ্ছে। মাঝখানে Wal-Mart এর Everyday Low Price থিওরির চক্করে পড়ে নাভিশ্বাস উঠছে আমাদের পোশাক প্রস্তুতকারীদের।

আর সাদা চামড়ার ওই সব খুচরা ক্রেতাদের কথা বলছেন ? তারা সোফায় বসে টিভিতে বাংলাদেশের তাজরীন বা রানা প্লাজার কথা শুনে একটু হু হা করবে হয়তো। কিন্তু পরের দিন ভোরে উঠেই ছুটবে সেই সস্তার দোকানেই ! এদের ভণ্ডামির কথা না হয় আরেকদিন বলবো।

প্রকাশকালঃ ১লা মে,২০২০