“প্রতিটি সংস্কৃতি চায় ছেলেরা হবে সক্রিয় বা আক্রমণাত্মক , আর মেয়েরা হবে নিষ্ক্রিয়, অন্তর্মুখি বা আত্মসমর্পণাত্মক ; তাই ছেলেরা হয় মাস্তান আর মেয়েরা থাকে একটি রন্ধ্র নিয়ে বিব্রত। এটি যে সাংস্কৃতিক ব্যাপার, তা স্বীকার না ক’রে পিতৃতন্ত্র মনে করে পুরুষের পৌরুষ বাস করে তার একটি ঝুলন্ত নির্বোধ প্রত্যঙ্গে ও তার নিচের থলের ভেতরের একজোড়া অণ্ডকোষে। ”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )
তাঁকে কেন বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী লেখক বলা হয়—উপরের কয়েকটা লাইন সেটা জাস্টিফাই করার জন্য যথেষ্ট মনে হয় আমার কাছে। এই বলার ভঙ্গী এখনকার ফেসবুক সেলিব্রেটিদের কারো কারো আছে হয়তো। কিন্তু তাঁর সময়ে এটা ছিল কল্পনাতীত।
বাইবেলের হিতোপদেশ বলেছে, “ পরকীয়া স্ত্রীর ওষ্ঠ হইতে মধু ক্ষরে, তাহার তালু তৈল অপেক্ষাও স্নিগ্ধ” ; এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৬) বলেছেন, “ মৃত্যুর মতোই ব্যাভিচারের কোন চিকিৎসা নেই।”
বিয়ের সুখ কেমন? এঙ্গেলস বলেছেন, “ একপতিপত্নী বিবাহের উত্তম দৃষ্টান্তগুলির গড়পড়তা ধরলেও তা পরিণত হয় এক নিরেট একঘেঁয়েমির দাম্পত্য-জীবনে, যাকে বলা হয় দাম্পত্য সুখ।” এ বিয়ে পরিণত হয় এঙ্গেলসের মতে, স্থূল বেশ্যাবৃত্তিতে, বিশেষ করে স্ত্রীর বেলা। স্ত্রী আর পতিতা কি এক? এঙ্গেলস বলেছেন, “স্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ পতিতার পার্থক্য এইটুকু যে সে ফুরনের মজুরের মতো নিজের দেহ ভাড়া খাটায় না,পরন্তু সে দেহটা বিক্রি করে চিরকালের মতো দাসত্বে ।”
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )
আমি বিবাহ/বিয়ে নামের এই সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখি। আমি হুমায়ুন আজাদের ও এঙ্গেলসের সাথে দ্বিমত পোষণ করি , কিন্তু এঁদের মতামতকে অগ্রাহ্য করতে পারি না।
রবীন্দ্রনাথ , রুশো-রাসকিনদের মতোই, পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষ ; এবং প্রভাবিত ছিলেন ওই দুজন,ও আরো অনেককে দিয়ে। রোম্যানটিক ছিলেন তিনি, এবং ছিলেন ভিক্টোরীয়; নারী, প্রেম ,কবিতা,সমাজ, সংসার, রাজনীতি, জীবন এবং আর সমস্ত কিছু সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন তিনি পশ্চিমের রোম্যানটিকদের ও ভিক্টোরীয়দের কাছে; এবং সে-সবের সাথে মিশিয়ে চিয়েছিলেন তিনি ভারতীয় ভাববাদ বা ভেজাল। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মৌলিকতা খুবই কম; তাঁর সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )
“ রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক চিন্তার সবটাই বাতিল হওয়ার যোগ্য। ” এতো স্পর্ধিত উচ্চারণ আমি আর কারো মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। সত্যি বলতে কী , এখানে আমি হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্র বিদ্বেষে মর্মাহত ।
প্রেম ও কাম পরস্পরসম্পর্কিত, দুটিই নারীপুরুষের জীবনের বিশেষ পর্বে প্রবলভাবে দেখা দেয়, যদিও জীবনে দুটির গুরুত্ব সমান নয়। প্রেম স্বল্পায়ু, মানুষ প্রেমে বাঁচে না, জীবনে প্রেম অপরিহার্য নয় ; প্রেম বিশেষ বিশেষ সময়ে কোনো কোনো নরনারীর জীবনে জোয়ারের মতো দেখা দেয়, তাতে সব কিছু – অধিকাংশ সময় তারা নিজেরাই—ভেসে তলিয়ে যায়; তবে আজীবন মানুষ বাস করে নিষ্প্রেম ভাঁটার মধ্যে। প্রেম তীব্র আবেগ, তা ঝড় জোয়ার বন্যার স্রোত ঘুর্ণির মতোই ; ওগুলোর মতোই প্রেমও দীর্ঘস্থায়ী নয়, এবং বার বার দেখা দিতে পারে। ———-প্রেমের থেকে কামের আশ্লেষের আয়ু অনেক বেশী ; কাম দোলনা থেকে কবর চিতা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। অপ্রেম জীবন দশকপরম্পরায় যাপন করে মানুষ, অধিকাংশের জীবনেই কখোনই প্রেমের ছোঁয়া লাগে না ; কিন্তু কামহীন জীবন অসম্ভব। যাদের কাম অচরিতার্থ, যারা সঙ্গী পায় না কামের, তারাও একান্ত কামযাপন করে। প্রেম বলতে গত আড়াইশো বছর ধরে পশ্চিমের পৃথিবী যা বোঝে , এবং পশ্চিম থেকে ঋণ করে আমরা যা বুঝি এক শতাব্দী ধরে, তা রোম্যানটিকদের আবিষ্কার।
পুরোনো পৃথিবীতে প্রেম ছিলোনা ; আজ আছে একটি বড়ো কিংবদন্তি হয়ে। যে- আবেগ প্রেম নামে নরনারীর মনে জেগে ওঠে বিপরীত লিঙ্গের কারো জন্যে, কিশোরতরুণের কাছে যা রক্তমাংসের অনেক ওপরের কোন স্বপ্ন বলে মনে হয়, তা আসলে মাংসের জন্য মাংসের সোনালী ক্ষুধা।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )
আমার জন্য বহুশ্রুত, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রায়শঃ বলে থাকেন আমি বহুবার শুনেছি। ‘প্রেম এমনই এক তীব্র আবেগ যা এভারেস্টের চূড়ার মতো; সেখানে একই সময়ে একজনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। একসঙ্গে দুজনের জায়গা হয়না সেখানে!’
বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্য প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হতে বলে সুগৃহিনী ও সুমাতা, তাঁর কাছে দাবী করে সতীত্ব ও পাতিব্রত্য। ————–নারীর গর্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ। নারীকে কি চিরকালই ধারণ করে যেতে হবে গর্ভ, পালন করে যেতে হবে পশুর ভুমিকা? গর্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুর মতো, দৃশ্য হিসাবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক। একদিন হয়তো গর্ভধারণ গন্য হবে আদিম ব্যাপার বলে, মানুষ বেছে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায় ; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তাঁর জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গর্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা পেলে আনন্দে তা গ্রহণ করবে ; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই। একসময় নিয়ত গর্ভিনী থাকাই ছিল নারীর কাজ ; এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয়নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গর্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ বলে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।
——- নারীর ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করে নিতে হবে নিজেকেই। পুরুষ তার ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করবে না। নারীর ভবিষ্যৎ মানুষ হওয়া, নারী হওয়া নারী থাকা নয়।
হুমায়ুন আজাদ ( নারী ১৯৯২ )
হুমায়ুন আজাদের বিশাল ক্যানভাসের “ নারী ” গ্রন্থটি আমার মোটেও মৌলিক কিছু মনে হয় নি। এটি মূলতঃ নারীবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অসংখ্য গ্রন্থের একটি সম্মীলন । লেখক গ্রন্থপঞ্জীতে প্রায় আড়াইশো বিভিন্ন ভাষার বইয়ের তালিকা দিয়েছেন, যেগুলো তাঁকে পড়তে হয়েছে, গবেষণা করতে হয়েছে দিনের পর দিন ; এই ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
পুরো গ্রন্থের যে বিশেষ দিকগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছে আমাকে আলোড়িত করেছে আমি তারই পুনরাবৃত্তি করলাম মাত্র।
প্রকাশকালঃ এপ্রিল, ২০১৫
সাম্প্রতিক মন্তব্য