পৃথিবীর আর সব সাধারণ শ্রেণিবৈষম্যের মতই কর্পোরেট জগতেও ক্ষমতাবান, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত ও ক্ষমতাহীন শ্রেণি আছে। আমাদের তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতি অনুযায়ী ক্ষমতাবানদের সীমিত কয়েকজন ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করেন এবং বেশির ভাগ ক্ষমতাবানেরা সুযোগ পেলেই অপব্যবহার করেন।

যে কোন কারণেই হোক না কেন, ক্ষমতাবানদের ব্যাপারে ক্ষমতাহীনদের একটা চিরস্থায়ী ঈর্ষা কাজ করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঠিক যে যে কাজগুলো আপাত: দৃষ্টিতে তাদের কাছে দৃষ্টিকটু অসহনীয় মনে হচ্ছে ; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া- আমি নিশ্চিত ক্ষমতা পেলে ক্ষমতাহীন ব্যক্তিটি ওই একই কাজগুলো অবলীলায় করবে! এটা একটা চক্রের মতো, ‘যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ ’- টাইপ আর কী!
ক্ষমতাহীনের সান্ত্বনার জায়গা হচ্ছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করা বা অভিসম্পাত দেওয়া যাতে ক্ষমতাবানদের মধ্যে যারা অহংকারী , আস্ফালনকারী ছিল , তাঁরা খুব দ্রুত কোন একদিন যেন ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। প্রার্থনা করে এবং তাঁদের জীবদ্দশায় সেটা দেখে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। আসলে এ ছাড়া ক্ষমতাহীনদের আর বেশী কিছু করারও থাকে না। ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে ৬৩৮ বার হত্যা-প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি ৫০ বছরে শাসনের শেষে ২০০৮ সালে অবসরে যান। পরবর্তীতে ৯০ বছর বয়সে গত ১৬ সালের নভেম্বরে বার্ধক্যজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু।

ক্ষমতাহীনের প্রার্থনা ও আকাঙ্ক্ষা দেখে আমার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুল পঠিত ও আলোচিত ‘দেবদাস’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। উপন্যাসে ট্র্যাজেডির নায়ক দেবদাস। প্রধান নায়িকা একদিকে পার্বতী অন্যদিকে চন্দ্রমুখী । আমার দৃষ্টির প্রক্ষেপণ এঁদের মধ্যে প্রেমের ক্ষমতা কার বেশী ছিল সেই দিকে নয়। সেটা বহুবার কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয় ও নানা ভাষার সিনেমার পর্দায় প্রস্ফুটিত হয়েছে। আমি বরং আমার পাঠককে কর্পোরেট দুনিয়ার ক্ষমতাহীনের আকাঙ্ক্ষা ও তার পরিণতি নিয়ে কিছু কথা বলি।

বিচ্ছেদের সময়ে পার্বতী দেবদাসকে বলেছিল, তাঁকে ছাড়া সে বাঁচবে না। পার্বতী ও চন্দ্রমুখীর ত্রিভুজ প্রেমে ত্রিশঙ্কু হয়ে বেচারা দেবদাসের মর্মন্তুদ মৃত্যু হয়। তাঁর অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা আর অতিরিক্ত মদ্যপান। আর হ্যাঁ , পার্বতীও বাঁচেনি ! সম্ভবত: পার্বতী মারা গিয়েছিল, আশি বছরের অশীতিপর বৃদ্ধা হয়ে, গুচ্ছের সন্তানাদি ও নাতি নাতনি রেখে !

কি মনে করে, বহুদিন পরে উপন্যাসটাও একটু নেড়ে চেড়ে দেখলাম। উপন্যাসের শেষে শরৎচন্দ্রের কয়েক লাইন পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়ঃ
“এখন এতদিনে পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না। সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না। শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।”
পাঠকের মনোবাসনা পূর্ণ হতো যদি, দেবদাসের সঙ্গে সঙ্গে বা কাছাকাছি সময়ে পার্বতীরও মৃত্যু হোত।

সেটা আসলে হয় না। হয় না বলেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস এতো জনপ্রিয়। পার্বতীর সমস্ত জীবনের রঙ রূপ রস ভোগ করে বৃদ্ধা হয়ে মৃত্যুর মধ্যে মহিমা নেই ; নেই সাধারণ পাঠকের বা জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
আমাদের কর্পোরেট পৃথিবীতে ক্ষমতাধর কেউ কেউ থাকেন। তাঁদের ক্ষমতা , বৈধ-অবৈধ বিপুল সম্পত্তির প্রাচুর্য নিয়ে অনেকের ঈর্ষা আর কানাঘুষা থাকে। তাঁদেরকে ক্ষমতাহীনরা পছন্দ করেন না সঙ্গতঃ কারণে। আকাঙ্ক্ষা করেন, প্রার্থনা করেন তাঁদের সাম্রাজ্যের পতন হোক, তাঁদের আস্ফালনের সমাপ্তি ঘটুক।

হ্যাঁ, ঘটে ! তাঁদের সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে ! তাঁদেরও বয়স হয়, ক্ষমতা কমে যায়। কিন্তু সেই দীর্ঘ মেয়াদ শেষে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সান্ত্বনা পাওয়ার কিছু থাকে না

প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭