বিষয়টি  একটু স্পর্শকাতর মনে হতে পারে। যেহেতু এটি একটি বাস্তবতা এবং আমাদেরকে প্রাত্যহিক এই পরিস্থিতির সম্মুখীন সবাইকে কমবেশি হতে হয় ; তাই কয়েকটা কথা বা আমার নিজস্ব অব্‌জার্ভেশন সবার সঙ্গে শেয়ার করা মনে হয় অনুচিত হবে না।

ঢাকাকে নগর, মহানগর বা মেগাসটি বলা হলেও, এর সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এবং অত্যল্প মফঃস্বল শহর থেকে আসা জনগোষ্ঠী। যেমন আমার আব্বা ৬০-এর দশকেই জীবিকার টানে গ্রাম থেকে ঢাকাতে চলে আসেন। কিছুদিন ডেমরার মাতুয়াইলের সরকারী স্কুলের শিক্ষকতা, তারপর আবহাওয়া অফিস, এদিক সেদিক করে ৬৫/৬৬ এর দিকে চলে যান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে। আম্মার সঙ্গে বিয়ে ৬৮-তে। বিয়ের পরে আম্মা আব্বা করাচীতে বছর খানেক থাকেন। ভাইয়ার জন্ম আমাদের জেলায়। আম্মার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর ঘাঁটি গাড়েন পুরনো ঢাকার ওয়ারীতে। আমার জন্ম মাতুয়াইলে, ডেমরাতে। সেই হিসাবে আমি হচ্ছি ঢাকা শহরের গ্রাম থেকে আগতদের দ্বিতীয় প্রজন্ম।

উঠতি নিম্নমধ্যবিত্ত হিসাবে আব্বাকে কেন্দ্র করে আমাদের পুরো পরিবারের বেড়ে ওঠা। অসচ্ছলতা ও আর্থিক অনটনের পাশাপাশি আব্বা তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদেরকেও ধীরে ধীরে ঢাকা-মুখী করে তোলেন।

দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসাবে আমার স্কুলের সময়টিতে ঢাকার স্থায়ী, অস্থায়ী বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকজন মফঃস্বল আগত বন্ধু ছিল। কেউ হয়তো সদ্যই বড়ভাইয়ের বাড়িতে থেকে পড়তে এসেছে। সিংহভাগ সহপাঠী ছিল ঢাকার স্থায়ী অথবা অস্থায়ী বাসিন্দা। সেই অর্থে মফঃস্বলের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের তেমন কোন মিথষ্ক্রিয়া ছিল না।স্কুল পেরিয়ে ঢাকা কলেজে পড়তে গিয়ে জেলা শহরের দুর্দান্ত মেধাবী ছেলেদের সঙ্গে পরিচয়। সেখানেও এতো কম সময় থাকতে হয়েছে, ঠিকমতো পরিচয়ের আগেই আমাদের সবাই এখানে ওখানে ছিটকে পড়েছি। টেক্সটাইলে ভর্তি হওয়ার আগে কিছুদিন ছিলাম রসায়ন বিভাগে। প্রথম ক্লাসে শিক্ষিকার জিজ্ঞাস্য ছিল, কে কে কোথা থেকে এসেছে এবং তাঁদের জীবনের লক্ষ্য কি। মফঃস্বলের ছেলেরা বেশ সপ্রতিভ-ভাবে উত্তর দিলেও আমরা ঢাকার গুটি কয়েক আমতা আমতা করলাম। মূলত: আমাদের সবার লক্ষ্য তখনো আবার বুয়েটে পরীক্ষা দেয়া। সে কথাতো আর ম্যাডামকে বলা যায় না ! রসায়ন বিভাগ ডঃ হুমায়ূন আহমেদের মতো ছাত্র পেলেও আমাদের সময়ের পদার্থ বা রসায়ন নিতান্ত ঠেকায় না পড়লে কারো আকাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট হওয়ার কথাও না।

কেমিস্ট্রিতে পড়ার খুব সামান্য সময়ে বেশ কিছু মফঃস্বলের মেধাবী ছেলেদের সঙ্গে মিশে আমি কীভাবে যেন বুঝে ফেললাম এঁরা দারুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তবে তাঁদের সঙ্গে আমার মূল মিথষ্ক্রিয়া ও বন্ধুত্বের সুযোগ ঘটল টেক্সটাইলের শহীদ আজিজ হলে ; এঁদের সংগে দীর্ঘ ৫/৬ বছর কাছাকাছি বিছানায় ও আড্ডা মেরে সময় কাটিয়ে। ক্লাসের শুরুর দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হল সে উপজেলার দুঁদে ছাত্র। কথায় কথায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাঁর ইচ্ছে টেক্সটাইলে পড়াশোনা করে সে কিছুদিন চাকরি বাকরি করবে, তারপরে নিজেই ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হবে।পড়াশোনার পাশাপাশি টেক্সটাইলের ঘরোয়া রাজনীতি করবে সে এবং পরবর্তীতে সে জাতীয় রাজনীতিতে যোগদান করে দেশের মূল শাসন ব্যবস্থায় অংশ নেবে।

আর আমাদের ঢাকার কয়েকজন তখনো এই হুতাশন নিয়ে ব্যস্ত, কই আসলাম, কেন আসলাম , কোথায় যাচ্ছি—এই সব নিয়ে। পরবর্তীতে আমার ঐ বন্ধুটি ঠিকই আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বৃহত্তর প্রকৌশলীদের সংগঠনে জড়িত হয়ে পড়েছে। মাত্র কিছুদিন চাকরি করেই ব্যবসা শুরু করেছে সে এবং আমার ধারণা সে তাঁর ঠিক লক্ষ্যেই আছে। দুই যুগ আগে থেকেই সে জানত ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল তাঁকে কি কি অর্জন করতে হবে। আর আমি এখনো এই চল্লিশোর্ধ বয়সে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগে চলেছি !
মূল কথায় আসি। কর্পোরেট জগতে, ঢাকার বাসিন্দা ও মফঃস্বলের আগতদের মানসিকতা ও কাজের ধরণে একটা বড় পার্থক্য চোখে পড়েছে আমার। যেহেতু, আমি ঢাকার দ্বিতীয় প্রজন্ম , আমার কথায় পক্ষপাতিত্ব থেকে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকছেই। তবু যতোখানি পারি নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার চেষ্টা করি।

মফঃস্বলের যে মেধাবী তরুণটি আরো হাজার-খানেক ছেলেকে পিছে ফেলে ঢাকা শহরের নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসছে, সে কিন্তু তাঁর ছোট্ট পরিমণ্ডলে পরিবার ও পরিপার্শ্বের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রামের অমুকের ছেলে তমুক কি করেছে, বা জেলা শহরের আরেক মেধাবী কতখানি সাফল্য অর্জন করেছে, সেটা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। নিজের ভিতরে একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুন দপদপ করতে থাকে। আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, জেলা শহরের বা গ্রামের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটি ছিল তাঁর স্কুলের ব্যাঘ্র-শাবক। সুতরাং তাঁর হুংকার হয়তো নাগরিক রাস্তায় ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। কিন্তু নিজের আসল পরিচয় সে কোনভাবেই ভুলে যেতে পারে না।

নানাবিধ কারণে মফঃস্বলের তরুণেরা দুর্দান্ত কর্মঠ হয়। ঢাকার তরুণদের হয়তো থাকার একটা সংস্থান আছে, তাঁকে কিন্তু মেসে বা হোস্টেলে সংগ্রাম করে থাকতে হচ্ছে।

ঢাকার তরুণটির হয়তো কেউ না কেউ বড়ভাই, মামা-চাচা আছে কোন খোঁজ খবর দেওয়ার ও নেওয়ার। ঐ তরুণটিকে কিন্তু ‘এসো নিজে করি’ স্টাইলে সব নিজেকেই করতে হচ্ছে। গ্রামের বা মফঃস্বলের বাবা-মার তাঁকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার অবস্থা নেই।
মূলত: ঢাকার তরুণদের মাঝে কিছুটা গা ছাড়া উন্নাসিকতা থাকে, ‘ দেখি কী হয়’ টাইপের। তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ফোকাস থাকে চাকরি বাকরি করে মোটামুটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছানো। অমুকের মতো হতে হবে, তমুকের মতো উপরে উঠতে হবে, খুব দ্রুত একটা থাকার সংস্থান ফ্ল্যাট করতেই হবে, গাড়ী না থাকলে চলছেই না—তেমনটি ঢাকার তরুণদের কিছুটা কম থাকে।

আমার সংক্ষিপ্ত চাকরির সময়কালে, ঢাকার সংখ্যা গরিষ্ঠ ছেলেদের, আমি আবারো বলছি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেদের( ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে), ভিতরে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অ্যাগ্রেসিভনেস মফঃস্বলের তরুণদের তুলনায় কম দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মনিষ্ঠতায় , বসের আস্থা অর্জনে, কর্পোরেট মইয়ের ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মফঃস্বলের তরুণদের ডেডিকেশন থাকে প্রশ্নাতীত। এই সব ক্ষেত্রে মালিক-পক্ষ ও সিনিয়র ম্যানেজাররাও তাঁদেরকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে থাকেন, এগিয়ে যেতে দেন। বলা-বাহুল্য অনেকাংশে সবাইকে পিছে ফেলে উপরে ওঠার এই প্রবণতা ভুক্তভোগী অনেকের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যে কোন বিজয়ের জয়-রথে রাস্তার পাশের ছোটখাটো লতাগুল্মের পিষ্ট হওয়ার শঙ্কা সব ক্ষেত্রেই থাকে।

আমার কাছে মনে হয়েছে ,একইভাবে ঢাকার কোন একজন তরুণ যখন প্রবাসী হয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে বসতি গড়ে– তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ওই এলাকার স্থানীয় যে কোন তরুণদের চেয়ে বেশীই হবে। তাই আমি পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিক ও আশাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখছি।

প্রকাশকালঃ জানুয়ারি ২০১৬