আমি খুব বেশী বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বাৎসরিক কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে বেতন বোনাস ও পদোন্নতি কীভাবে হয় , দেখার সুযোগ পাইনি।যাঁদের এই ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা বা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী আছে, অথবা যারা ব্যাংক বীমা বা আরও বৃহৎ পরিসরের কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তাঁরা আলোকপাত করতে পারেন।

আমার স্বল্প কর্মজীবনের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যা দেখেছি , তা হচ্ছে কর্মচারীর মূল্যায়ন মালিকের অথবা সিনিয়র ম্যানেজারদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। একেক প্রতিষ্ঠানে একেক রকমভাবে ।কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই ‘ থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় ’ । কোথাও আত্মীয়তার প্রায়োরিটি তো কোথাও মুখ-চেনাদের , কোথাও তৈল-সিক্তদের। ফাঁকে ফোকরে কিছু যোগ্য লোকের মূল্যায়নও হয় বটে!

আবার এটাও ঠিক, যে পদ্ধতিতেই মূল্যায়ন করা হোক না কেন ; সকল কর্মচারীকে সন্তুষ্ট করা মালিক বা কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকসময় যথাযথ মূল্যায়িত কর্মচারীও চারপাশে বলে বেড়ায়–তাঁকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার মনে হয়, মালিক ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের জন্য এটা একটি কঠিন কাজ ।

মুশকিল হয়, যখন দেখা যায় কোন একজন কর্মচারী তাঁর নিকট অতীতে সংঘটিত নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড, আচরণ বা অন্যকোন একটি সামান্য ইস্যুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে অবমূল্যায়িত হতে থাকেন। একবছরে বঞ্চিত হয়ে , হয়তো সেই কর্মচারী ভালো বেতন বোনাসের আশায় দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেও দেখেন তাঁর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের মূল্যায়ন এক বিন্দুও বদলায়নি। মূলত: মালিক বা সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট দিনশেষে রক্তমাংসের একজন বা একাধিক মানুষ। এবং বেশিরভাগ মানুষ জাজমেন্টাল হয়ে থাকে। কেউ একবার ‘ডান নজরে’ থাকলে , তাঁর হাজার দোষত্রুটি যেমন চোখে পড়ে না। তেমনি একবার কেউ ‘বাঁ নজরে’ পড়ে থাকলে তাঁর কোন দক্ষতাই মূল্যায়িত হয় না।

আরও সমস্যা হয়, যখন মালিক তাঁর অধস্তনদের মূল্যায়নের জন্য গোপনে তথ্য সংগ্রহ করেন। যাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তাঁর ব্যাপারে, তাঁর অধীনস্থদের কাউকে ডেকে গোপনে কৌশলে তথ্য নেওয়া হয়। এখন বাঙালি চরিত্র সহজবোধ্য ; কে কাকে ল্যাং মেরে উপরে উঠবে সেটাই বাঙালির কাছে মুখ্য। কোন অধস্তন যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের সম্মুখীন হয়, তাও আবার তাঁর ঊর্ধ্বতন বসের ব্যাপারে—প্রথমেই, সে যে কাজটি করে– মালিককে বোঝানোর চেষ্টা করে তাঁর ঊর্ধ্বতন আসলে সারাদিন কয়েকটা সামান্য কাজ ছাড়া কিছুই করেন না। যা করার অধীনস্থ হিসাবে তিনি নিজেই করছেন। মোদ্দা কথা, ম্যানেজমেন্টকে বোঝানো হয়, ওই ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি ছাড়াই প্রতিষ্ঠান চলবে। খামোখা এতো বেতন বোনাস দিয়ে শুধুমাত্র ‘ অভিজ্ঞ’ এই নিরর্থক গুণের জন্য গুচ্ছের টাকা খরচ করার মানে হয় না।
এই বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় শেষ পদ্ধতিতে দু’টি ব্যাপার প্রকট ও দৃষ্টিকটু ।

প্রথমত: মূল্যায়ন অধীনস্থদের গোপন আলাপচারিতার ভিত্তিতে করলে ফলাফল সর্বদাই এক আসে। সেটা যে লেভেলেই করা হোক না কেন।

দ্বিতীয়ত: অধীনস্থ দিয়ে মূল্যায়ন করার এই পদ্ধতি মালিক ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা, সেটা স্বীকার না করে নিজেদেরকে তাঁরা খুব দক্ষ ও জ্ঞানী ভাবা শুরু করেন। অবমূল্যায়িত কর্মচারীকে তাঁরা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেন, তাঁর ব্যাপারে মালিক-পক্ষের কাছে অনেক ‘ তথ্য’ আছে ! আসলে তাঁদের যে মূল্যায়নের ব্যাপারে যোগ্যতার ঘাটতি আছে সেটা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান। নিজেদের অদক্ষতাকে ঢাকতেই অদ্ভুতুড়ে পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। দুঃখজনক হচ্ছে , যাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে ; সে বেচারা জানতেও পারেন না তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বনাশ কে কে বা কারা কারা করল ! অনেকসময় ব্যাপারটা রীতিমত নোংরামির পর্যায়ে চলে যায়। প্রায়শ: ড্রাইভার, পিওনদের কথা শুনে কারো ব্যক্তিগত খোঁজখবর নেওয়া হয় এবং মূল্যায়নে সেই ‘গোপন’ তথ্য মূল ভূমিকা রাখে !

যাই হোক, বেদনা দিয়েই আজকের অব্‌জার্ভেশন শেষ করতে হচ্ছে।
আমার মতামত, মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মূল্যায়ন পদ্ধতি আমাদের দেশে এখনো শিশুতোষ পর্যায়ে রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির আশু পরিবর্তন হওয়ার আমি কোন সম্ভাবনা দেখছি না।

প্রকাশকালঃ জানুয়ারি,২০১৬