পূর্ববর্তী প্রজন্মে প্রচলিত ধারণা ছিল ভ্রমণ হচ্ছে আনন্দের ও শিক্ষার। তাঁরা তীর্থযাত্রা বা পুণ্যস্থান ভ্রমণ বা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ভ্রমণ করত । কিন্তু যাত্রাপথের ঝক্কির জন্য অনেকাংশে ভ্রমণ ছিল ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর। আগের প্রজন্মে ভ্রমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক ছিল না , তা নয়। আগেও ছিল, সেটা ছিল উচ্চবিত্ত ও একেবারে তরুণ সম্প্রদায়ের। এঁদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য যতোটা না ভ্রমণের জন্য ছিল –তার চেয়ে বেশি ছিল জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো, কর্তব্য ফাঁকি দেওয়া এবং আত্মীয় স্বজনের উৎপাত থেকে দূরে থাকার জন্য।

মূলত: আগেও যেটা চিরন্তন সত্য ছিল, এখনও আছে ; সেটা হচ্ছে , যে এক জায়গা দশবার দেখে তার দেখা হয় সম্পূর্ণ ও সম্পন্ন। আর দশটা জায়গা যে একবার করে দেখে তার দেখা হয় অসম্পূর্ণ । আর যে দশ মিনিটে একটা জায়গা দেখে তার দেখা হয় না কিছুই !

বর্তমানে আমাদের ভোগবাদী সমাজের প্রদর্শনকামী বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের বিনোদন এবং বড় মুক্তির জায়গা বছরে তিন-চারবার ভ্রমণ। আমাদের প্রাত্যহিকতায় আমরা ক্ষয়ে যাই । জীবনের নানাবিধ যন্ত্রণার মাঝে আমাদের বিনোদন ও মুক্তির দরকার ; খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার দরকার। আমাদের মন এই নাগরিক একঘেয়েমিতে শুকিয়ে যায়। ভ্রমণের আনন্দ এক পশলা বৃষ্টির মতো আমাদেরকে সতেজ করে দেয়।
পরিবারের সবাই আমরা আবার ঘুরতে যাব এই আকাঙ্ক্ষা ও আশা আমাদের বুঁদ করে রাখে ! ভ্রমণের সময় আমরা আকাঙ্ক্ষিত উত্তেজনা প্রায়শ:ই পাই না। কিন্তু যে আনন্দ উত্তেজনাই বোধ করি না কেন – ফিরে আসার পর আমরা সেই উত্তেজনায় আরও কিছু আরোপিত প্রলেপ দিই, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি দিই। পাড়াপড়শির ঈর্ষা-কাতর চোখ আমাদের সাময়িক উত্তেজনা এনে দেয়। এর পরের দিনগুলো আমরা আবার স্মৃতিকাতর হয়ে থাকি ; প্রতিদিনের জীবিকার গ্লানিকে মেনে নিয়ে পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা করি।

এই মানসিক অবস্থাকে ঠিক নেশার সঙ্গে তুলনা করা যায় কিনা আমি জানি না। একবার একটা ডোজের আশু উত্তেজনার বিরতিতে আসক্ত ব্যক্তি যেমন নানা সুখ-কল্পনায় মেতে থাকে, কখন আবার আরেক ডোজ পাবে। ভ্রমণবাতিকগ্রস্থ অথবা ভ্রমণপিপাসু মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তদের হয়েছে সেই অবস্থা !

প্রকাশকালঃ ২রা নভেম্বর,২০১৬