হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা একটা বিশদ বিশ্লেষণ ফেসবুকে শেয়ার করে কিছুটা হতাশ হয়েছি। বড় লেখা দেখলে ইদানীং কেউ পড়েও দেখতে চান না মনে হচ্ছে ! পরে ভেবে নিলাম, আমার বন্ধু-তালিকায় হুমায়ূন ভক্তের সংখ্যা সম্ভবত: নগণ্য। আমি আশা করেছিলাম নবীন প্রজন্মের ভক্তকুলের একাংশ আমার শেয়ার দেওয়া এই বিশদ লেখাটা পড়ে হয়তো তাঁদের মতামত জানাবেন। কিন্তু তা হয় নি । আমি ধারণা করছি, বন্ধু-তালিকার বন্ধুরা শুধুমাত্র ২ মিনিটের ম্যাগী নুডলস্‌ টাইপের একটু হাইকু টাইপ স্ট্যাটাসের সঙ্গে একখানি ছবি টাইপ ‘আরামদায়ক’ স্ট্যাটাস দেখলে দুই এক সেকেন্ড সময় দেন। একটু বড় লেখা হলেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। যাই হোক বন্ধু-তালিকার অনুজ এক ছোটবোনের মন্তব্য ধরে আবার আরেকটি লেখার সূচনা হচ্ছে।

আমি দ্বিধা-হীনভাবে বলতে পারি হুমায়ূন আহমেদ অসম্ভব মেধাবী ও ক্ষমতাধর লেখক ছিলেন। শক্তিমত্তার বিচারে আমাদের এক্সপেকটেশন লেভেল তাঁর কাছে আরও একটু বেশী ছিল ; যেটা তিনি নানা কারণে পূরণ করেননি বা করতে পারেন নি। লেখালেখির বাইরে, নাটক, গান সিনেমা নানাবিধ বাজারি অর্থকরী ব্যাপারে উনি তাঁর মেধাকে ব্যয় করেছেন। ওপার বাংলার কবি, উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাপারেও নানা কথা প্রচলিত আছে। সুনীল সস্তা লেখক, ফর্মা ধরে লেখেন, ইত্যাদি। কিন্তু সুনীল ‘ পূর্ব-পশ্চিম’ ‘সেই সময়’ ‘প্রথম আলো’-এর মতো অসাধারণ কিছু লেখা লিখে সর্বজন-শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছেন । আমাদের একই আকাঙ্ক্ষা ছিল হুমায়ূন আহমেদের প্রতি। বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় মাপের কিছু লেখা আশা করেছিলাম আমরা। সেটা নানা কারণে হয় নি। আমরা তাঁর প্রাথমিক ভক্তরা কিছুটা-তো আশাহত হয়েছি !

ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে–বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে হুমায়ূন আহমেদের ব্যাপারে সবার একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ বা ঈর্ষা কাজ করত । ভদ্রলোক ছিলেন নিখাদ বিজ্ঞানের লোক। মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া দুর্দান্ত একজন ছাত্র। রসায়নের মতো একটা নিরস বিষয়ে ডক্টরেট করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তাঁর না ছিল সাহিত্যের কোন অভিভাবক, না ছিল কোন সাহিত্য-গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা। তাঁর এই অভূতপূর্ব লেখক-খ্যাতি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনের প্রথিতযশা অনেকেই ঠিক ভালোভাবে নিতে পারেননি ! তাঁকে তুচ্ছ করে দেখানোর, বাজারি, সস্তা লেখক হিসাবে দেখানোর একটা প্রচলিত ধারা এখনো বিদ্যমান। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, হুমায়ূন আহমেদের বিশ্বসাহিত্যের পড়াশোনা ছিল ব্যাপক। তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলোর মাধ্যমেই আমাদের প্রজন্মের অনেকে পশ্চিমা নানা খ্যাতনামা লেখকের লেখার কথা জানতে পেরেছিলাম।

তাঁর মিসির আলী , হিমু সিরিজের পাশাপাশি সবচেয়ে অনন্য একটা কাজ ছিল বাংলাদেশের সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে জনপ্রিয় করে তোলা। তাঁর আগে পরে অনেকে সেটা করেছেন, তাঁর মতো করে পারেননি!

সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রসঙ্গেই আসি। সুনীল হুমায়ূন আহমেদের কাছের ছিলেন। হুমায়ূনকে সুনীলের মাধ্যমেই পশ্চিমবঙ্গের অনেকে চিনেছেন কিনা জানিনা। তবে, ‘দেশ’-এর মতো প্রধানতম কুলীন পত্রিকায় পরপর ৮ বছর শারদীয় সংখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ ভক্তদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি বলেই মনে করি। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরপরই উনি এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। ইউটিউবে আছে। আমি তাড়াহুড়ো করে শুনে শুনে পুনর্লিখন করেছি। আমি সুনীলের সঙ্গে একমত পোষণ করি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যতো তর্ক-বিতর্কই থাক না কেন ; হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বাংলা ভাষায় তাঁর স্থান করে নিয়েছেন ,এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন।
সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশঃ

সুনীল: তাঁর বুদ্ধিমত্তা তাঁর পড়াশোনা আর লেখার মধ্যে যে হিউমার জ্ঞান , এই সব দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি , আমি তাঁর অনেক লেখা পড়েছি । আর মানুষ হুমায়ূন তো আমার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল।

প্রশ্ন: হুমায়ূন আহমেদের লেখার কোন দিকটা আপনার কাছে বেশী প্রাধান্য পেত? কারণ তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাসতো অনেক নাম করেছিল , যেমন নন্দিত নরকে —

সুনীল: আরে ‘নন্দিত নরকে’র সম্পর্কে আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় যখন লিখেছিলাম, তখন ওঁকে আমি চিনতামও না। ওঁকে আমি তখন চোখেও দেখিনি, শুধু বইটা পড়েই ভালো লেগেছিল । তারপরে হুমায়ূনকে বাংলাদেশের অনেকে বলত চিপ পপুলার লেখক টেখক কীসব বলত। আমি কিন্তু বইগুলো পড়ে দেখেছি , তাঁর মধ্যে যেমন একটা রসজ্ঞান আছে ,তেমনি অনেক বিষয়ে ওর অনেক গভীর যে পড়াশুনো ছিল , সেটিও জানতে পারা যায় । এগুলি আমার কারোর লেখায় বেশী ভালো লাগে না। হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা কত ছিল সবই আমি জানি। আমাদের দেশে শরৎচন্দ্রের একসময় জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁকেও হুমায়ূন ছাড়িয়ে গেছে।

প্রশ্ন: হুমায়ূন আহমেদের যেসব উপন্যাসগুলো ছিল, সেগুলো পাঠক যখন পড়তেন , তাঁরা একটানা পড়ে যেতেন। এবং বলা হত, হুমায়ূন আহমেদের লেখা পাঠককে ধরে রাখতে পারত। এর বৈশিষ্ট্যটা কি ? কেন ?

সুনীল: এটা কিন্তু ভাষার জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। অনেকে যাঁদের ভাষাজ্ঞান কম, তাঁরাই নিজের লেখাকে জটিল করে তোলে। আর যারা, ভাষার আদ্যোপান্ত জানেন, তাঁদের লেখা কিন্তু অতো জটিল হয় না,সহজবোধ্য হয়, রসসিক্ত হয়। কারণ খুব সহজভাবে যারা লেখেন– ওটা মোটেও সহজ কাজ না !

প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যের বিচারে যদি আপনি দেখেন ,ধরেন গত পঞ্চাশ বছরের কথাই যদি ধরি এখানে হুমায়ূন আহমেদকে আপনি কোথায় রাখবেন, কোন অবস্থানে বিচার করবেন ?

সুনীল: আমি হুমায়ূন আহমেদকে বেশ একটা উঁচু জায়গায় রাখব এবং আশা করব ভবিষ্যতের পাঠক এবং গবেষকরা তাঁর কৃতিত্বটা ঠিক ঠিক আরও চিনতে পারবেন ও বুঝতে পারবেন। হুমায়ূন সত্যিই একজন খুব বড় লেখক , বাংলা ভাষার গর্ব, আমি তাই মনে করি।

[ প্রকাশকালঃ ২৬শে নভেম্বর ২০১৬ ]