উচ্চ মাধ্যমিকে ওঠার আগে আমি কখনো বাঙ্গালী চরিত্র বা বাঙ্গালী মুসলমানের চরিত্র নিয়ে চিন্তা করার অবসর পাইনি বা আমার মানসিক অভিজ্ঞতাও ছিল না। উচ্চ মাধ্যমিকে উঠে শরৎচন্দ্রের ‘ বিলাসী’ আমাকে মুগ্ধ করল। সনাতন বাঙ্গালী-চরিত্র কেমন হতে পারে, তা তাঁর চেয়ে ভালো কেউ পরিস্ফুট করতে পারেন নি। ওই সময়েই আমাদের সম্ভবত: পাঠ্য ছিল সমাজ সংস্কারক রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমেদের ‘ রিলিফ ওয়ার্ক’ স্যাটায়ার গল্পটি। গল্পটি “ফুড কনফারেন্স”(১৯৬৯)- বই থেকে নেওয়া। গল্পটিতে আমাদের জাতীয় জীবনের নৈতিক অধঃপতনের নিদারুণ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক । আবুল কালাম শামসুদ্দিনের মতে, লেখক এই গ্রন্থে বাঙ্গালি হিন্দু-মুসলমানের সাধারণ চরিত্রের দিক তুলে ধরেছেন । কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, সর্বকালেই ছিল । তাদের কথাও আবুল মনসুর বাদ দেননি । “রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদ তেমনই একটি চরিত্র । বিপন্ন মানুষের সেবা করার জন্য ত্রাণ কর্যের দলে যোগদান করে । কিন্তু সেখানে গিয়ে হামিদ দেখতে পায় দুর্বল ভুখা-নাঙ্গারা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে, আর মাত্রাতিরিক্ত খাতির আর ত্রাণ পাচ্ছে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা । হামিদের চোখে এই অনাচার বর্ণনা করেছেন লেখক ।

কালে কালে আমি মুখোমুখি হলাম হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফার লেখার সঙ্গে। বাঙ্গালী চরিত্র চিত্রণে আহমদে ছফা ও হুমায়ুন আজাদ দুইজনই আমার কাছে প্রিয়। তবে প্রিয়তম হচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ।

উচ্চমাধ্যমিকেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে সরাসরি শিক্ষক হিসাবে ঢাকা কলেজে পাই। ক্লাসের নানা কথার ফাঁকে বাঙ্গালীর উপরে ওঠার প্রবণতার দারুণ একটা রূপকল্প তুলে ধরেছিলেন। স্মৃতি থেকে লিখছি। স্যার সম্ভবত: তাঁর কোন প্রকাশিত বইয়েও লিখেছেন । উনি কয়েকজন বাঙ্গালীকে বর্ধিষ্ণু গাছের সঙ্গে তুলনা করলেন। হাতে করে কয়েকটি কলম নিয়ে দেখালেন সবগুলোর একই উচ্চতা। এখন এর মধ্যে কোন একটি গাছকে যদি সবার চেয়ে বড় হতে হয়ে দুইভাবে সেটা সম্ভব। উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি গাছকে বেশী করে আলোবাতাস নিয়ে, পরিশ্রম করে অন্য সবার চেয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। এটি কষ্টসাধ্য, সময়সাপেক্ষ।

আরেকটি সহজ উপায়ে সে নিজের মাথাকে সবার উপরে দেখাতে পারে ! তাকে নিদেনপক্ষে পাশের গাছগুলোর চেয়ে বড় দেখাবে ; হোক সেটা সমাজে , কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষায়তনে বা রাজনীতিতে। সে যদি একটু চালাকি করে বাকী গাছগুলোকে ছেঁটে দেয়। নিজেকে কষ্ট করে উচ্চতায় পৌঁছুতে হল না। অন্যদেরকে ছোট করেই সে নিজেকে বড় করে ফেলল। নিন্দুক , ফাঁকিবাজ বাঙ্গালী এই দ্বিতীয় কাজটি খুব যত্নের সাথে করতে পারে। কষ্ট করে বড় না হয়ে, সারাক্ষণ তার সহকর্মীদেরকে মালিক-পক্ষের কাছে ছোট করে নিজেকে বড় দেখায় ! আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে , মালিক-পক্ষ বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যাপারটা বুঝেও না বোঝার ভাণ করেন। দিনে দিনে তোষামোদির প্রাচুর্যে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বিষাক্ত হতে থাকে। বড় হওয়ার সহজ উপায়টি সবাই প্র্যাকটিস করতে থাকে।

বাঙ্গালী চরিত্রের যথার্থ রূপকার হুমায়ুন আজাদ-এর কিছু বাণী চিরন্তনী সবার জ্ঞাতার্থে দিয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে আমারও স্মৃতি ধরে রাখা হল।

বাঙ্গালী চরিত্র নিয়ে হুমায়ুন আজাদ-এর প্রিয় প্রবচনগুচ্ছ:

১। বাঙালি যখন সত্য কথা বলে তখন বুঝতে হবে পেছনে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে।
২।পা, বাঙলাদেশে, মাথার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পদোন্নতির জন্যে এখানে সবাই ব্যগ্র, কিন্তু মাথার যে অবনতি ঘটছে, তাতে কারো কোনও উদ্বেগ নেই।
৩। এখানে অসতেরা জনপ্রিয়, সৎ মানুষেরা আক্রান্ত।
৪। বাঙালি একশো ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়। পঞ্চাশ ভাগ সৎ হ’লেই বাঙালিকে পুরস্কার দেয়া উচিত।
৫। নিন্দুকেরা পুরোপুরি অসৎ হ’তে পারেন না, কিছুটা সততা তাঁদের পেশার জন্যে অপরিহার্য; কিন্তু প্রশংসাকারীদের পেশার জন্যে মিথ্যাচারই যথেষ্ট।
৬। যতোদিন মানুষ অসৎ থাকে, ততোদিন তার কোনও শত্রু থাকে না; কিন্তু যেই সে সৎ হয়ে উঠে, তার শত্রুর অভাব থাকে না।
৭। আমাদের সমাজ যাকে কোনও মূল্য দেয় না, প্রকাশ্যে তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করে, আর যাকে মূল্য দেয় প্রকাশ্যে তার নিন্দা করে। শিক্ষকের কোনও মূল্য নেই, তাই তার প্রশংসায় সমাজ পঞ্চমুখ; চোর, দারোগা, কালোবাজারি সমাজে অত্যন্ত মূল্যবান, তাই প্রকাশ্যে সবাই তাদের নিন্দা
করে।
৮। স্তব স্তুতি মানুষকে নষ্ট করে। একটি শিশুকে বেশি স্তুতি করুন, সে কয়েকদিনে পাক্কা শয়তান হয়ে উঠবে। একটি নেতাকে স্তুতি করুন, কয়েকদিনের মধ্যে দেশকে সে একটি একনায়ক উপহার দেবে।
৯। গণশৌচাগার দেখলেই কেনো যেনো আমার বাঙালির আত্মাটির কথা বারবার মনে পড়ে।
১০। বিনয়ীরা সুবিধাবাদী, আর সুবিধাবাদীরা বিনয়ী।
১১। কোন কালে এক কদর্য কাছিম দৌড়ে হারিয়েছিলো এক খরগোশকে, সে-গল্পে কয়েক হাজার ধ’রে মানুষ মুখর। তারপর খরগোশ কতো সহস্রবার হারিয়েছে কাছিমকে, সে-কথা কেউ বলে না।
১২। স্বার্থ সিংহকে খচ্চরে আর বিপ্লবীকে ক্লীবে পরিণত করে।
১৩। সৎ মানুষ মাত্রই নিঃসঙ্গ, আর সকলের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।
১৪। মৃত সিংহের থেকে জীবিত গাধাও কতো জ্যোতির্ময় উজ্জ্বল !
১৫। আপনি যখন হেঁটে যাচ্ছেন তখন গাড়ি থেকে যদি কেউ খুব আন্তরিকভাবে মিষ্টি হেসে আপনার দিকে হাত নাড়ে, তখন তাকে বন্ধু মনে করবেন না। মনে করবেন সে তার গাড়িটার দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে আপনাকে কিছুটা পীড়ন ক’রে সুখী হ’তে চায়।
১৬। টাকাই অধিকাংশ মানুষের একমাত্র ইন্দ্রিয়।
১৭। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে বাঙালির ওপর বিশ্বাস রাখা বিপজ্জনক।

প্রকাশকালঃ২৬শে অক্টোবর,২০১৬