বনফুল (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়)-এর ‘ক্যানভাসার’ নামের একটা অণু গল্প পড়েছিলাম বছর পঁচিশেক আগে। গ্রামের ক্যানভাসারের মর্মন্তুদ স্যাটায়ার। সকালবেলা মেজাজ খারাপ করা এক লোকের কাছে দাঁতের মাজন বিক্রি করার জন্য বেচারা ক্যানভাসার অনেক চেষ্টা করে। তার নিজের চকচকে দাঁত দেখিয়ে হাসে ! সম্ভাব্য ক্রেতা রাগের মাথায় এক পর্যায়ে ক্যানভাসারকে এক চড় দিলে ক্যানভাসারের বাঁধানো দুপাটি দাঁত মুখ থেকে ছিটকে পড়ে ! তারপরের ক্যানভাসারের জীবনের বেদনার কথোপকথন মনে রাখার মত। লিংক পাচ্ছি না , এই গল্পটি একটা মাস্টারপিস, ‘বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প’ বইটিতে অবশ্যই গল্পটি থাকার কথা। বন্ধু তালিকার উৎসাহী কেউ পড়ে নিতে পারেন।

তো , সেলস, প্রোডাক্ট প্রমোটর, মার্কেটিং আরও গালভরা নামের মাঝে ক্যানভাসিং এর যে অব্যক্ত বেদনা লুকিয়ে আছে তা অনেকেই বুঝতে চান না। আমি নিজে ভালো সেল্‌সম্যান নই–কারণ আমি একটু ঠ্যাঁটা কিসিমের , প্রায়শ: হুট-হাট মুখ ছুটাই। কিন্তু যারা মার্কেটিং ও সেল্‌সে আছেন তাঁদের সারাক্ষণ হাসিহাসি মুখ করে থাকতে হয়। কারো সঙ্গে চিরস্থায়ী সম্পর্ক খারাপ করার প্রশ্নই আসে না। এই অভিনয়ের বেদনা নিরন্তর! তাই আমার কাছে সেলসম্যানশিপ সহজ কোন ব্যাপার না।সেলিং অ্যাটিচুড কারো কারো জন্মগত থাকে, বাকীদের অর্জন করে নিতে হয়। এই যেমন আমি ইনস্যুরেন্স পলিসিতে বিশ্বাস করি না। গত ২০০২ সাল থেকে আমাদের অফিসে অসংখ্য লোককে ইনস্যুরেন্স করিয়েছেন এক অ্যালিকোর এক পরিচিত ভাই। উনি বেশ কয়েক বছর আমাকে লাগাতার বোঝালেন, রিস্ক অ্যানালাইসিস, ফ্যামিলি অ্যাডভান্টেজ , ফোর্স সেভিংস, মোদ্দা কথা ইনস্যুরেন্সের নানা উপকারিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপার হচ্ছে আমি কোনভাবেই বুঝি না। অবশেষে দীর্ঘ একযুগ পরে গত ২০১৩ সালে সেই বড়ভাইয়ের কাছে একটা ইনস্যুরেন্স পলিসি করেই ফেললাম। এই হচ্ছে সেলসম্যানশিপ !

বেশীরভাগ সময় যারা সেল্‌সে সরাসরি জড়িত নন –যেমন অ্যাডমিন , ফিনান্স, অ্যাকাউন্টস –তারা সেল্‌সম্যানদের গ্রাউন্ড লেভেলের সমস্যাটা বুঝতে পারেন না অথবা বুঝতে চান না । শুধু লাভক্ষতির হিসাব দিয়ে সেল্‌সম্যানেরা চলতে পারে না। নানাবিধ সীমাবদ্ধতা আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের চলতে হয়। সেল্‌সে জড়িত নন তাঁদের কাছে সবকিছু শুধু সংখ্যা দিয়ে বিচার্য ! এই অর্ডার ভালো না, ওইটা কোন কাস্টমার হল, ইত্যাদি। তো, আমি একদিন মালিক পক্ষের সামনেই একজন উচ্চপদস্থকে বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেছিলাম, ‘ ভাইরে, সেল্‌স এতো সহজ ব্যাপার না। আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি না , তবে এটুকু বলতে পারি , আপনার যেরকম চামড়া পাতলা, খুঁতখুঁতে নাক উঁচু স্বভাব –আপনাকে পক্ষে ৫০০ পিসের একটা গার্মেন্টসের অর্ডার জোগাড় করাও সম্ভব না ! সুতরাং যারা সেল্‌সে আছে, তাঁদেরকে ন্যূনতম সন্মান দিয়ে কথা বলেন !’

সেদিন আমার এক কলিগের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর কাছে এক কোম্পানির লোক দীর্ঘদিন ধরে একটা কাজ পাওয়ার আশায় নিয়মিত আসেন। বসে থাকেন, চা টা খান, কোন আশার বাণী ছাড়াই চলে যান। সেল্‌সম্যান ভদ্রলোক বুঝে ফেলেছেন আমার সহকর্মীর কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কাজ পাওয়ার কোন আশা নাই। তবুও আসেন । তো , একদিন আমার সহকর্মী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাস করলেন, ‘ভাই ক্যান্‌, এইখানে সময় নষ্ট করতাছেন ?’

সেই সেলসম্যান খুব নরম গলায় বলেছিল, ‘আমি জানি আপনার কাছে এই মুহূর্তে কোন কাজ পাব না। কিন্তু আমার কাজ হচ্ছে মার্কেটিং করা, সেল করা । অফিসের লোকেরা অ্যাট লিস্ট জানে আমি একটা বড় বায়িং হাউজে কাজের চেষ্টা করছি। সেই বা কম কিসের ! আমাকে আমার কাজতো করতেই হবে , তাই না !’

[ প্রথমপ্রকাশঃ ২৬শে অক্টোবর,২০১৬ ]