বছর তিনেক আগে দেশের বাইরে ট্রেডের এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ কিছু সময় কাটাচ্ছিলাম। ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি ভালো করেছেন। উনি দীর্ঘদিন স্বতন্ত্র ব্যবসা করার পর হঠাৎ একটা বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন। যা , আমাকে ঐ সময়ে বেশ অবাক করেছিল। আড্ডার মুডে ছিলাম বলে সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,’ ভাই , ব্যাপারটা কি?’

উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি ঈশপের খরগোশ ও কচ্ছপের সেই বিখ্যাত দৌড়ের গল্পটা জানি কিনা ? আমি মৃদু হেসে বললাম, এটা বাংলাদেশের কেন বা তাবৎ পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পের একটি। ওই যে দৌড় শুরু হয়ার পরে খরগোশ গাছের তলায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ; আর ঐদিকে কচ্ছপ ধীরে ধীরে ঠিক পৌঁছে গেল ফিনিসিং লাইনে। উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন আমি গল্পটার মোরালটা জানি কিনা ? আমি সায় দিয়ে বললাম জানি, ‘Slow and Steady wins the race !’

এবার উনি নড়েচড়ে বসে আমাকে বললেন, আমি এই রূপক গল্পের পরের এক্সটন্ডেড আধুনিক ভার্সনগুলো জানি কীনা।
এবার আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করলাম, জানি না !

উনার ভাষায় বললে যা দাঁড়াচ্ছেঃ
প্রাথমিকভাবে ঈশপের গল্পের মোরালের গুরুত্বপূর্ন দিকটা আমরা মিস করি ! শুধু জয়পরাজয়ের ব্যাপারটা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। গল্পের আরেকটি অন্তঃর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কখনই আন্ডারএস্টিমেট করা উচিৎ নয় ! অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্যই ধীরগতির কচ্ছপের কাছে দ্রুতগতির খরগোশকে লজ্জাস্কর পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল।

এখন সেই প্রাচীন গল্পের পরের ভার্সনটা হচ্ছে। বনের সবার কাছে দুয়ো দুয়ো শুনতে শুনতে খরগোশ তিতবিরক্ত হয়ে আরেকবার সুযোগ চাইল দৌড় প্রতিযোগিতার। সে জানে, দৌড়ের ক্ষিপ্রতায় ও দক্ষতায় তার পরাজয়ের কোন কারন ছিল না। । সে যদি হেরে গিয়ে থাকে, সেটা তার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য হেরেছে। আরেকবার সুযোগ পেলে সেই একই ভুল সে করবে না।

এবারও বনের সবাই মহোৎসাহে আরেকটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করল। এবার আর খরগোশের কোন ভুল হল না। স্বাভাবিকভাবে কচ্ছপকে কয়েক মাইলের ব্যবধানে সে হারালো।

মোরাল অভ দি স্টোরিঃ দ্রুতগতির এবং দক্ষ কর্মী আপনার প্রতিষ্ঠানে ভালো ফলাফল এনে দেবে। দুজন কর্মীর মধ্যে একজন বিশ্বস্ত কিন্তু ধীরগতির আরেকজন দ্রুত, দক্ষ কিন্তু বিশ্বস্ততা মোটামুটি। আপনি ধরেই নিতে পারেন—বিশ্বস্ত, ধৈর্যশীল কিন্তু ধীরগতির কর্মচারীর প্রয়োজন আছে আপনার প্রতিষ্ঠানে ; কিন্তু কর্পোরেট মই বেয়ে দ্বিতীয় লোকটিই অনেক উপরে চলে যাবে।

উঁহু গল্পের এইখানেই শেষ নয়!

এবার কচ্ছপ নিজে নিজে অনেক চিন্তা করল হেরে যাওয়ার পরে। সে বুঝতে পারল, সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে , কিন্ত দৌড়ের জন্য যে রুট বা ট্র্যাক আছে সেখানে সে কোনভাবেই খরগোশের সঙ্গে দৌড়ে জিততে পারবে না । এবার সে আরেকটি প্রতিযোগিতার প্রস্তাব দিল খরগোশকে। কিন্তু এবারের রানিং ট্র্যাকে একটু ভিন্নতা আছে।

আবার মহোৎসাহে দৌড় শুরু হল। বনের সবাই অধীর আগ্রহে দর্শক সারিতে। দৌড় শুরু হওয়ার পরে খরগোশ দ্রুতগতিতে দৌড়ে এগিয়ে গেল। থমকে দাঁড়াতে হল, বিশাল একটা নদীর সামনে এসে। সে হতবাক হয়ে ভাবতে থাকল , এই নদী সে কিভাবে পার হবে ! ইতোমধ্যে ধীর গতিতে কচ্ছপ নদীর ধারে এসে হাজির হল। খরগোশ দাঁড়িয়েই রইল , সে অবলীলায় নদী সাঁতরে ওপাশে পৌঁছে গেল, নদীর পরে সামান্য মাইলখানেক দূরে ফিনিসিং লাইন । সবার করতালির মধ্যে কচ্ছপের বিজয় হল। আর অনেক অনেকক্ষণ পরে খরগোশ হাচঁড়েপাচঁড়ে ফিনিশিং লাইনে পৌছাল।

মোরাল অভ দি স্টোরিঃ আপনি প্রতিযোগী হলে আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী দিকটি খুঁজে বের করুন। এবং যদি মনে হয়, খেলার মাঠ আপনার জেতার জন্য উপযুক্ত নয়, মাঠে আপনার সহায়তাকারী কিছু পরিবর্তন আনুন। আর আপনি যদি, কর্মকর্তা বা মালিক হন, লক্ষ্য করুন আপনার কর্মচারীটি কোথায় হোঁচট খাচ্ছেন। তার শক্তিমত্তা অনুযায়ী তাকে পরিবেশ তৈরী করে দিন, আশাতীত ভালো ফল পাবেন।

গল্পটি এখানে শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু গল্পের এখনো বাকী আছে।

কয়েকবার প্রতিযোগিতার পরে কীভাবে কীভাবে যেন খরগোশ ও কচ্ছপের বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
তারা দুজনেই উপলব্ধি করল যে তাদের শেষ দৌড়টা আরেকটু ভালোভাবে শেষ হতে পারত।
এইবার তারা দুজনের সম্মতিক্রমে আরেকটি দৌড়ের আয়োজন করল সেই লাস্ট ট্র্যাকে।
দৌড় শুরুর কিছুক্ষণ পরে সবাই অবাক হয়ে দেখল , ডাঙার অংশটি খরগোশ কচ্ছপকে কাঁধে নিয়ে মুহুর্তেই নদীর ধারে পৌঁছে গেল। এইবার নদীর তীরে এসে কচ্ছপ খরগোশকে কাঁধে নিয়ে সাঁতরে নদী পার হয়ে গেল। নদীর ওইপাশে আবারো কচ্ছপকে কাঁধে নিয়ে খরগোশ ফিনিসিং লাইনে পৌঁছে গেল। দ্রুততার সঙ্গে দুজন একসঙ্গে জেতায় তাদের মন এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে উঠল।

মোরাল অভ দি স্টোরিঃ স্বতন্ত্র ভাবে আপনি মেধাবী হতে পারেন, জিততেও পারেন। কিন্তু আপনি যখন টিম মেম্বার হিসাবে কাজ করছেন ; সবার আলাদা আলাদা শক্তিমত্তাকে কাজে লাগালে আপনার ফলাফল ও প্রাপ্তি অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক ভালো হবে। টিমওয়ার্ক আসলে সিচুয়েশনাল লিডারশীপের একটা বড় অংশ। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন মাফিক সিদ্ধান্ত গ্রহন। টিমের খেলোয়ারদের শক্তিমত্তা অনুযায়ী খেলতে দেওয়া এবং সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করা।

এই গল্পগুলোর এক্সটেন্ডেড ভার্সন থেকে আরো কিছু মজার শিক্ষনীয় আছে।

দেখুন, খরগোশ কিংবা কচ্ছপ কেউ কিন্তু পরাজয়ে হাল ছাড়ে নি। খরগোশ পরাজয়ের পরে দ্বিতীয় দৌড়ে চেষ্টা করেছে আরো বেশী পরিশ্রম করে জিততে। সে আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হয়ে দৌড়েছে। আবার কচ্ছপও তার সীমাবদ্ধতা জানে, সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও জেতার সম্ভাবনা না দেখে স্ট্রাটেজী বদলেছে।

জীবনে এরকম সময় আসে, যখন আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও আপনি সফল হতে পারছেন না । তখন আপনাকে খরগোশের মতো বেশী করে পরিশ্রম করতে হবে অথবা কচ্ছপের মত কর্মপন্থা বা কাজের ক্ষেত্র বদলে ফেলতে হবে। প্রায়শঃ দুইটিই একসঙ্গে করতে হতে পারে।

প্রকাশকালঃ ২৪শে অক্টোবর,২০১৬