বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি মুখী শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস সেক্টর। ঘুরে ফিরে সব পেশার ও বিষয়ের লোক এসে জড়ো হয়েছেন এখানে। বছর বিশেক আগেও বলতাম ডাক্তার – ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সবাই আছে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে ! বছর দশেক পরে সেই কথা প্রত্যাহার করতে হল। কমপ্লাইয়েন্সের ধাক্কায় মোটামুটি সব কারখানায় সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও নার্স আছে। কিছু গার্মেন্টসের তো নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ ছোটখাটো ক্লিনিক কাম হাসপাতালও আছে।স্কুল-বন্ধুদের ভিতরে, ভেবেছিলাম মেরিন ইঞ্জিনিয়াররাই বোধহয় এই সেক্টরে আসবে না। মাস-ছয়েক আগে দেখি এক মেরিনার বন্ধু বিভিন্ন গার্মেন্টসে Fire Fighting বা অগ্নি প্রতিরোধ ট্রেনিং দিয়ে বেড়াচ্ছেন !

ব্যাংক থেকে শুরু করে ইনস্যুরেন্স, ট্রান্সপোর্ট, কৃষি, খাদ্য, মোবাইল কোম্পানি এমনকি প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসাও এই সেক্টরের জড়িতদের উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

গত দশ পনের বছরে সরকারি ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল , ফ্যাশন ও গার্মেন্টসের উপরে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, চাকুরীর বাজার আগের মতো শক্তিশালী ও সহজলভ্য নেই। প্রায়শ: মুরব্বীদের বা ট্রেডের ভাইবেরাদরদের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার বা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবী আসে। উঁচু-পদে চাকরি করছি, একটা ছোটখাটো চাকরি কী আমি দিতে পারি না ! আবার আমি যে প্রতিষ্ঠানে আছি, সেখানে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হচ্ছে! আমার পক্ষে সামান্য কিছু কাপড় বা অ্যাকসেসরিজ এর ব্যবসা দেওয়া কি এতোই কঠিন ?

প্রথমত: আসি চাকরির বাজারের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। হ্যাঁ, আমার স্বল্প-পরিসরের কর্মজীবনে ডিমান্ড-সাপ্লাই চেইনের প্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য লোকের চাকরির ব্যবস্থা করতে পেরেছি। সে জন্য বাহাদুরির কিছু নেই। এখন পারছি না। কারণ, এখন যোগ্য লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডিমান্ডের তুলনায় বাজারে সাপ্লাই বেশী। আগে ফোন তুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার পদের কাউকে বললেও এন্ট্রি লেভেলের একটা চাকরি দিয়ে দিত। এখন, মালিক পর্যায়ের কাউকে বললেও , ভদ্রতার খাতিরে হয় সে ব্যাপারটা এড়িয়ে যায় অথবা তাঁর অন্যকোন ম্যানেজারকে ধরিয়ে দেন। অনুরোধ রক্ষার দায়বদ্ধতা কমে গেছে নানা কারণে। কাউকে এখন অনুরোধ করতেও বিব্রত বোধ করি। সুতরাং চাকরির ব্যাপারে নবীন গ্রাজুয়েটদেরকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী যোগ্য হতে হবে, প্রস্তুত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, যোগ্য-লোকের চাকরির অভাব হয় না।
আমাদের প্রজন্মের অনেককে একটা আপাত: সচ্ছল জীবনযাপন করতে দেখে, অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদেরকে টেক্সটাইল বা এই রিলেটেড অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন বা পড়াচ্ছেন। কিছুদিন আগেও একজন খুব স্মার্ট নবীন গ্রাজুয়েটের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁকে বেশ হতাশ মনে হচ্ছিল । তাঁকে পজিটিভলি বুঝিয়ে বললাম, এই সেক্টর যতোই সংকুচিত হোক এখনো সুযোগ আছে যথেষ্ট।

লক্ষণীয় যে, আমাদের আগের প্রজন্মের অগ্রজেরা চাকরি শুরুর পাঁচ-সাত বছরের মাথায় জেনারেল ম্যানেজার , ইন-চার্জ বা এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হয়ে গেছেন ; ক্রমান্বয়ে উদ্যোগী মেধাবী কেউকেউ বড় শিল্পপতিও। আমাদের কি অবস্থা ? আমদের প্রজন্মে অগ্রজদের অবস্থানে– মানে জিএম বা ইডি পজিশনে যেতে লেগে যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ বছর। এখন যারা ঢুকছেন, কিছু ব্যতিক্রমী মেধাবী সৌভাগ্যবান ছাড়া মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় আমাদের অবস্থায় তাঁদের আসতে ১৫ থেকে ২০ বছর লাগবে। দ্রুত উন্নতি হবেনা বলে, আমরা যেমন এই সেক্টর ছেড়ে দিইনি ; নবীনদেরকেও লেগে থাকতে হবে। হ্যাঁ , সময় বেশী লাগবে কিন্তু সম্ভব।

দ্বিতীয়ত: ফেব্রিক, অ্যাকসেসরিজ, স্ক্রিন প্রিন্টিং ইত্যাদির ব্যবসাও আগের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। সব বড় গার্মেন্টস কারখানাগুলোরই ইন-হাউজ নিজস্ব প্রিন্টিং , অ্যাম্ব্রয়ডারী, টুইল-টেপ, লেবেল ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট আছে। ঘুরে ফিরে তাই অনেকের কাছ থেকে অনুযোগ আসে, ‘জাহিদ ভাই, আপনি তো আমার কোন উপকার করতে পারলেন না!’ ভাইরে, এইটা আমার ব্যর্থতা সত্য, কিন্তু সময় যে বদলে গেছে, আমার নিয়ন্ত্রণে নেই কিছুই।

তৃতীয়ত: FOB গার্মেন্টসের ব্যবসাও মুষ্টিমেয় কিছু বড় গ্রুপের কাছে চলে যাচ্ছে। আমরা অর্ডার প্লেসমেন্ট নিয়ে হিমশিম খাই। ক্রেতার নানাবিধ রিকোয়ারমেন্টের মাঝে মূল হচ্ছে – কমপ্লাইয়েন্ট হতে হবে এবং দামও কম হতে হবে (মাগনা না হলেও পানির দর হলে ভাল !) এতকিছুর মাঝে অফিস খরচ, বেতনবৃদ্ধি , ব্যাংক চার্জ, সার্ভিস চার্জ ধরে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা। অনেক খুঁজে আদর্শ পাত্রী পাওয়া গেলেও, সম্পর্ক পর্যন্ত গড়ায় না ! কারণ পাত্রী ( ফ্যাক্টরি) নিজেও আদর্শ পাত্র ছাড়া কাজ করে না !

সেদিন এক বন্ধু তাঁর ব্যবসায় সহযোগিতা চাইল । সঙ্গতঃ কারণেই নামোল্লেখ করছি না।ব্যবসা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একটা চমৎকার উদাহরণ দিল। ধরেন, ওয়ালমার্টের CEO আপনার ছোটবেলার বন্ধু। এখনো তাঁর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে.( উল্লেখ্য ওয়ালমার্টের বাৎসরিক রেভিনিউ কমবেশি ৫০০++ বিলিয়ন ডলার !) কিন্তু আপনি যখন তাঁর কাছে ব্যবসা চাইবেন, তাঁর পক্ষে হয়তো আপনার জন্য তেমন কিছুই করা সম্ভব হবে না। কারণ, ঐ কোম্পানি তাঁর সোর্সিং সিস্টেম এমন করে রেখেছে, যে স্বজনপ্রীতির জায়গা অত্যল্প।

কর্পোরেট চাকরিতে আমাদের অসহায়ত্বের ব্যাপারটা কেউ কেউ বোঝেন , বেশীরভাগই বুঝতে চান না !

প্রকাশকালঃ ৭ই অক্টোবর,২০১৬