আমার শৈশব কেটেছে অবাঙ্গালি-বিহারী অধ্যুষিত মিরপুর ১১ নাম্বারের সোসাইটি ক্যাম্পের ঠিক সামনে। আমাদের গলির মাথায় আনিসের মনোহারি মুদি দোকান ছিল। পুরো মহল্লার বাঙালী সমাজের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিল আনিসের দোকান। মেহমান এসেছে হুট করে , যা তো আনিসের দোকানে ! আব্বার মাস শেষে টাকা পয়সার ঘাটতি, আনিসই ভরসা।
কিছুদিন পরে মহল্লায় বড় মাপের কনফেকশনারী দোকান চলে আসল। ফ্রিজ আসল, সেই ফ্রিজে ঠাণ্ডা কোক-ফান্টা পাওয়া যেতে লাগল। আর অধুনা প্রতিটি মহল্লা আর রাস্তায় বড়বড় সুপার স্টোর এসে তো ঢাকাকেই ঢেকে ফেলেছে ! আনিসের দোকানের মতো ছোট পুঁজির, নিম্নমধ্যবিত্তের নগদ-বাকীর ভরসাস্থল ওয়ান-স্টপ সার্ভিস দোকানগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ওর দোকানে কাঁচামরিচ, মাছ-মাংস ছাড়া- হেন জিনিষ নেই পাওয়া যেত না ! শুকনো বাজারের পুরোটাই ( চাল,ডাল,আলু,পিঁয়াজ,তেল-লবণ,ডিম, চিনি,গরমমসলা, ইত্যাদি) থাকত ওর কাছে।
দশ ফিট বাই দশ ফিট দোকানে এতো বিশাল ব্যাপ্তির প্রোডাক্ট রেঞ্জ সে কীভাবে গুছিয়ে রাখত , এবং চাহিবামাত্র সে কোন এক চিপার ভিতর থেকে গ্রাহকের চাহিদামত ইসবগুলের ভুষি বা রান্নার পাঁচফোড়ন বের করে দিত– সেটা আমার কাছে সেই সময়ে বিস্ময় ছিল, এখনো আছে !
একটা ব্যাপার নিয়ে আমি প্রায়শ: বিরক্ত হতাম। বাকীতে নিই বা নগদে, আমি ছিলাম আনিসের বড় খরিদ্দারদের একজন। কোন বারই ৫০ বা ১০০ টাকার নীচে সদাই-পাতি করতাম না। অথচ দেখা যেত, আমাকে রেখে অবাঙ্গালী বিহারী খরিদ্দারকে সে আগে সার্ভিস দিচ্ছে। দেখা গেল কোন ছোট বিহারী বাচ্চা এসে আট আনা বা এক টাকার কিছু কিনছে, তাকে সে আগে বিদায় করত। একদিন আনিসকে জিজ্ঞাস করলাম। ‘মামা, কাহিনী কি এইটা তো ঠিক না। আমি আগে আসছি। আমার সদাই-পাতি বেশী , আমাকে আগে বিদায় কর!’ কেন সে ওঁদেরকে আগে সার্ভিস দেয় সেটা একদিন সে আমাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দিল।
হয়েছে কী , একদিন আমি আনিসকে বাজারে ফর্দ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একটা একটা করে ওজন করছে আনিস। ঠিক সেই সময় এক পিচ্চি বিহারী এসে, এক টাকার নোট খুব মুডের সাথে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ অ্যা মোদী, এক রুপাইয়াকে মুরালি দে !’ আনিস আমার মাল-পত্র গোছাচ্ছিল। এর ফাঁকেই কয়েক সেকেন্ডের মাথায় বেশ উত্তপ্ত গলায় ,’ এ মোদী ! কাব তাক খাড়া রাহুঙ্গা,এক রুপাইয়া কি মুরালি কে লিয়ে? ’ আনিস আমার জিনিসপত্র রেখে তাড়াহুড়ো করে ঐ পিচ্চিকে এক টাকার মুরালি কাগজে মুড়িয়ে বিদায় দিল।
আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, ‘ মামা, আপনি আমার বড় গাহাক, আপনার সদাই-পাতি অনেক। আপনি জানেন, আপনার সময় লাগবে ; আপনি সেইটা বুইঝাই অপেক্ষা করবেন, তাড়াহুড়া করবেন না ! কিন্তু এই হালার খুচরা গাহাকগুলা–কিনব আটআনার জিনিষ, কিন্ত গরম দ্যাখলে মনে হইব লাখ টাকার সদাই করতে আইছে!’
ইদানীং নানা বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে বড়বড় ক্রেতাদের যথেষ্ট আস্থা আছে বাংলাদেশের উপরে। যেহেতু তারা তাঁদের সোর্সিং-এর বড় একটা অংশ চীন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে বছর বিশেক হল; বাংলাদেশের যে কোন পরিস্থিতিতে এঁদের মাথা ঠাণ্ডা থাকে। অপেক্ষা করে অবস্থার উন্নতির জন্য । চিৎকার চেঁচামেচি মাথা গরম করে, খুচরা ক্রেতারা। দেড় টাকার টি-শার্ট কিনবে , তাও ১৫০০ পিসের MOQ( Minimum Order Quantity) – কিন্তু কমপ্লাইন্সের গরম আর নানাবিধ চাহিদার বহর দেখলে আমার সেই বিহারী পিচ্চির কথাই মনে পড়ে !
অনুসিদ্ধান্ত: ক্রেতার চাহিদা ও মেজাজ তাঁর ক্রয় ক্ষমতার ব্যস্তানুপাতিক। যতো ছোট
ক্রেতা-ততো বেশী মেজাজ !
[ প্রকাশকালঃ ৭ই অক্টোবর,২০১৬ ]
সাম্প্রতিক মন্তব্য