(পুরনো ও প্রিয় একটি লেখা, যা এই অস্বস্তিকর বাংলাদেশের জন্য সবসময় প্রাসঙ্গিক।)

আজ সকালে কন্যাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ভাঙ্গাগাড়ীতে পুরনো সিডি খুঁজছিলাম, কিশোর কুমারের একটা বাংলা সিডিও পেলাম, চালু করতেই সেই ঐশ্বরিক দরাজ গলা বেজে উঠলো।
“তারে আমি চোখে দেখিনি , তার অনেক গল্প শুনেছি,
গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালোবেসেছি।।
আসতে যেতে ছলকিয়া যায়রে যৌবন,
বইতে পারে না তারও বিবশ মন ;
ভালোবাসার ভালো কথা শুনে নাকি শিহরিয়া যায় শুনেছি।।
চোখেতে তার স্বপ্ন শুনি ভীড় করে থাকে,
মরণ শুনেছি হাতছানি দিয়া ডাকে,
বিষের আবার ভালোমন্দ কীরে যখন আমি মরতে বসেছি !!! ”

কিশোর কুমার , মান্না দে আমাদের দুই প্রজন্ম আগের হলেও এঁদের গান আমাদেরকেও মাতিয়ে রেখেছিল। বাংলাব্যান্ডের উত্থানের সমসাময়িক সময়ে ফিতা ক্যাসেটের যুগে এঁরাই ছিলেন আমাদের সবচেয়ে কাছের।

গানের লাইনটি আবার খেয়াল করুন , ‘আসতে যেতে ছলকিয়া যায়রে যৌবন, বইতে পারে না তারও বিবশ মন !’
দৃশ্যকল্পটি কেমন? যৌবন ছল্‌কে পড়ছে, উদ্ভিন্ন বাঁকগুলো আপনাকে মুগ্ধ করছে।
যদিও আমি আমার কন্যাকে স্কুলের গেটে নামিয়ে অপেক্ষারত , তারপরেও ভণ্ডামি না করে বলতে পারি, আমার ‘পুরুষ-চোখ’ কিন্তু ঠিক ঠিকই অতিক্রম কারিণী সকলের , যাঁদের যৌবন ছল্‌কে যাচ্ছিল তাদের দেখছিল।

বর্তমানের একাধারে নারীদের উপর নিরবচ্ছিন্ন যৌন নিপীড়নের হেডলাইন দেখতে দেখতে আমি বিপর্যস্ত ও ক্লান্ত। পুরুষ হিসাবে আমি লজ্জিত। মনোবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা কুইক রেন্টাল টোটকা দিয়ে এই ভয়াবহ অসুস্থতা থেকে উঠে আসার পথ , উত্তরণের বাৎলাচ্ছেন।
কিন্তু আমার মনে হয়, পুরোপুরি উৎপাটন করা সম্ভব না হলেও এই অসুস্থতার সার্বিক নিরাময় সম্ভব। এবং সেটা শুধুমাত্র শৈশবে সঠিক যৌন শিক্ষার মাধ্যমে।

বালককে বুঝতে হবে, সে শিশ্ন-ধারী মানুষ ঠিক আছে, কিন্তু বালিকা শিশ্ন-হীন দ্বিতীয় লিঙ্গের দুর্বল কেউ না। বালককে নারীর মাহাত্ম্য বোঝাতে, নারীর মর্যাদা শেখাতে খুব বেশী সময় লাগারতো কথা না। বালকের মা আছে, বোন আছে, অন্য শ্রদ্ধেয়া আত্মীয়ারা আছেন। তাঁদের উদাহরণ দিয়ে তাকে নারীর মর্যাদা শেখাতে হবে।
রহস্যময় দৈহিক বাঁক নিয়ে যে নারী সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, সে একজন মানুষ এবং তোমার চেয়েও অধিকতম মানুষ। বংশগতির ধারা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুনরুৎপাদনের বিশাল শারীরিক যন্ত্রণার দায়িত্ব প্রকৃতি তাঁকে দিয়েছে। বালককে বুঝতে হবে , বোঝাতে হবে নারী শুধুমাত্র স্তন ও যোনীর সমষ্টি একটা ভোগের বস্তু নয় !

পরিবারের কাছ থেকে শিক্ষাটা পেলে ভাল। নইলে শিক্ষায়াতনে। পরিবারের একজন পুরুষকে দেখলে প্রথমেই আমরাতো তার শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করি না !
পোশাক, জুতা, আর্থিক-সামাজিক অবস্থা হেন তেনর পরে তার বিশাল বপু বা স্থূলত্ব নিয়ে কথা হয়।

কিন্তু একজন নারীকে দেখলে কেন প্রথমেই তাঁর স্তন ও নিতম্বের দিকে জুলজুলে নজর যাচ্ছে ? সমস্যাটা কোথায় ? তাঁর অন্যসব বৈশিষ্ট্য কেন আলোচিত হয় না ? একজন কিশোরী , তরুণী আমার সামনে এসে প্রথমেই কেন তাঁর বুক আঁচল বা ওড়না দিয়ে ঢাকাঢাকি করা শুরু করে দেয়। কী তাঁকে ভীত করে তোলে, যে সামনের পুরুষটির ( হোক সে কিশোর, তরুণ , মধ্যবয়সী, বৃদ্ধ) সামনে সে ঠিক নিরাপদ বোধ করে না ! কে তাঁর মনে এই অ-নিরাপত্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে?

বাদ দিই, তাত্ত্বিক আলোচনা। সাহস বা দুঃসাহস করে যদি আমার প্রজন্মের যৌন শিক্ষার ইতিহাস আলোচনা করি , তাহলেও কী কিছুটা ধারনা পাওয়া যাবে না !

অন্য সকলের মতোই আমারও কৈশোরের অসহনীয় বয়ঃসন্ধির একাকীত্ব, দেহের অনাকাঙ্ক্ষিত বেড়ে ওঠা ছিল। ছিল মন খারাপ করা বিকেলবেলা। নিজেকে অপাঙতেয় , তুচ্ছ , অবহেলিত ভাবার দুঃসহ দিনরাত্রি। আমি মোটামুটি নজরে পড়ার মতো ভালো ছাত্র ছিলাম। পরিবারের ও শিক্ষকদের আলাদা একটা এক্সপেকটেশনের ভার আমাকে বইতে হতো। কিন্তু আমিও তো একটা কিশোর। আমার যে ছেলে বন্ধুটি , মেয়েদের স্কুলের সামনে যেয়ে সদ্য কিশোরীদের উদ্ভাসিত চাহনি, রহস্যময় বাঁক দেখে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গল্প করতো ,তাতে আমার মনটাও তো হু হু করে উঠতো।

সে ছিল এক কল্পনার রাজ্য। যদিও আমার শারীরিক মানসিক বৃদ্ধির সমানুপাত বৃদ্ধির পরিমাপ নিয়ে আমার পরিবারে দ্বিধা আছে।আমার মানসিক বৃদ্ধি শরীরের তুলনায় শ্লথ। আমি স্তন্যপায়ী ছিলাম ৬ বছর বয়স পর্যন্ত। এবং কেন জানিনা , আম্মাও আমার অত্যাচারকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন অতোগুলো বছর। বছর পাঁচেক পর্যন্ত আমার বেড়ে ওঠা নানাবাড়ি কুষ্টিয়াতে। অস্পষ্ট আবছা মনে আছে, হয়তো স্মৃতিতেই পুনঃ-নির্মিত হয়ে আছে। গ্রামের বাচ্চারা ছিল যৌনতার ব্যাপারে অকালপক্ব । সহচর-সহচরী খেলার সাথীদের হঠাৎ বাল্যবিবাহ, তাঁদের যৌনতার অভিজ্ঞতার নিষিদ্ধ আলোচনা তাদেরকে পাকিয়ে দেয়। কোনটা শিশ্ন, যোনি, স্তন, কোনটার কী কাজ, সেটা আমাদের সময়ে আমাদের গ্রামের খেলার সাথীরা ভালোই বুঝতো। পুরোপুরি নাগরিক হতে হতে ৭৯ সাল। প্রতি ঈদে পার্বণে নানাবাড়ি যেতে হোত, যৌন জ্ঞানের পার্থক্যটা তখন চোখে পড়ার মতো ছিল । মোরগ-মুরগী বা কুকুরের সংগমে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ না থাকলেও গ্রামের শিশুদের জন্য সেটা ছিল নিষিদ্ধ আনন্দ।

বছর সাতেক থেকে তেরো চৌদ্দ পর্যন্ত সেই অর্থে আমার যৌন চেতনা ছিলনা। অন্তত: আমার কিছুই মনে নেই।ক্লাস ফাইভে আমার সহপাঠিনী মিতু প্রেম করা শুরু করলো বা অধুনা যেটাকে বলে ক্রাশ খেল অপু নামের জনৈক নবম শ্রেণীর উদীয়মান গায়কের সঙ্গে। ওইটা আমার মনে আছে।

ক্লাস সিক্সে স্কুলের পরিবর্তন। স্কুল পরিবর্তনের পরে , নতুন স্কুলের পোলাপানের সঙ্গে এলোমেলো সখ্যতা গড়ে উঠল। ফার্স্ট বয় থেকে লাস্ট বয় সবাই আমার বন্ধু ছিল। সবাই আমাকে আপন করে নিল।

বাসায় মামা চাচা ও গ্রামের আত্মীয়স্বজন অপর্যাপ্ত। দুই বেডরুম,ডাইনিং বাসাতে মাসের বেশীরভাগ দিন আমাকে নিজের বিছানা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরিং করতে হোত। দেশের বাড়ির কেউ না কেউ, হয় চিকিৎসা নয় এয়ারপোর্ট বা চিড়িয়াখানা দেখতে বাড়িতে জিইয়ে থাকত।

বাসায় মামা , চাচা কেউ না কেউ যাওয়া আসার মধ্যে থাকতোই। তাদের ফিসফিসে নারীদেহ নিয়ে কথাবার্তা কানে বাজতো। হ্যাঁ, নারীর নগ্নদেহের ছবি একটা শিরশিরে অনুভূতি এনে দিত। মামা-চাচাদের কারো না কারো অসাবধানে বিছানার তোষকের তলায় ফেলে রাখা নিউজপ্রিন্ট ছাপার পর্ণ পত্রিকা হাতে পড়লো। বেশ কয়েকদিন লুকিয়ে লুকিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সম্ভবত: অর্ধ-নগ্ন ছবির একসেট প্লেয়িং কার্ডও লুকিয়ে লুকিয়ে কিছুদিন দেখেছিলাম। তো, প নামের এক নতুন স্কুল-বন্ধু স্বমেহনের ব্যাপারটা কেমন করে যেন মাথায় ঢুকিয়ে দিল। আমি জানি না, আমার সব বন্ধুদের সবাই, হয়তো নিজে নিজেই স্বমেহনের আনন্দ পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু, এটা কেই আমরা একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করতাম না। এর মাঝে কেউ কেউ স্বমেহন যে খারাপ তা বলে তীব্র অপরাধ-বোধ ঢুকিয়ে দিল। এটা খুব খারাপ, পাপ হবে, শরীর শুকিয়ে খারাপ হয়ে যাবে, স্মৃতিশক্তি নষ্ট হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্লাস সেভেন বা ক্লাস এইট পর্যন্ত যৌনমিলনের ব্যাপারে আমার জ্ঞানের পরিধি ছিল এই যে, শারীরিক মিলনে পুরুষাঙ্গ ও নারীর পায়ুপথ ব্যবহৃত হয়। অবশ্য এইটের শেষের দিকে ক্লাসের অভিজ্ঞ ডেঁপো ছেলেদের জ্ঞান বিতরণে মানব-মানবীর শারীরিক মিলনের সব কিছু সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল !

কিন্তু পড়াশোনার চাপে চিঁড়েচ্যাপটা , কৈশোরের একাকীত্ব স্বমেহনের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল আমাকে ও আমাদেরকে।
এসএসসি পরীক্ষার পরপরই আমরা ঘোষণা দিয়ে বড়ো হয়ে গেলাম। এখন আমরা সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরতে পারব। আমরা কলেজ ছাত্র। এবং ‘জ’ নামের এক বন্ধুর বাড়িতে আমাদের প্রথম দলবেঁধে পর্ণ-ছবি দেখা। ঢাকা কলেজে ভয়ঙ্কর মেধাবী মেধাতালিকার বন্ধুদের ছড়াছড়ি। আমরা মিরপুরের ছেলেপেলে ছিলাম নিতান্ত মফস্বলী মফু । গভর্নমেন্ট ল্যাব: বা ধানমণ্ডি বয়েজের পেন্টিয়াম ভার্সনের পোলাপানের কাছে আমরা ছিলাম ডজ মুডের কম্পিউটার। একদিন কেউ একজন আমাদের মিরপুরবাসীকে জিজ্ঞাস করলো আমরা বাংলা পর্ণ বা চটি পড়েছি কীনা। নেতিবাচক উত্তর পেয়ে সে বললো , তোরা তো এখনও শিক্ষিতই হস্ নাই, আয় তোদের শিক্ষিত করি। তো ওই চটি পড়ে আমরা অদ্ভুতুড়ে কিছু পশ্চিমবঙ্গীয় যৌনাঙ্গের ও মিলন পদ্ধতির নাম শিখলাম। বেশীরভাগ পুস্তিকা বটতলায় ছাপানো, নীলক্ষেত উত্তম ভাঁড়ারঘর ছিল সকল কলেজ-গামী ছাত্রদের কাছে।

আমার ধারনা, আমাদের মানসিক গঠনে, ওই সামান্য তথ্য বিকৃতি তেমন দীর্ঘমেয়াদী ছাপ ফেলতে পারে নাই। সমাজ ও পরিবারের এক্সপেকটেশনের চাপ আমাদেরকে অনেকটা একমুখী করে রেখেছিল( স্বমেহনের ব্যাপারটা ছাড়া। পরবর্তীতে আমি পড়াশোনা করে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি, স্বমেহন অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। পাপ আর স্বাস্থ্যভঙ্গের ভুল বিকৃত তথ্য যদিও আমার কৈশোরের একটা অংশ বিষময় করে দিয়েছিল। )

বয়েজ স্কুলে পড়লেও নানা কারণে কোচিং ও মহল্লার ভালো ছাত্র হওয়ার বদৌলতে সতীর্থ সমবয়সী বান্ধবী ছিল। কিন্তু ওদের মানসিক পরিপক্বতা ছিল আমার বা আমদের চেয়ে বছর দশেক এগিয়ে। সম্পর্কটা ছিল নিতান্তই বড়বোন-ছোটভাই টাইপের। বিকৃতিহীন স্বাস্থ্যকর।

টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির জীবনে নতুন করে কোন তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক জ্ঞানের সম্ভাবনা ছিল না।
যথারীতি কয়েকজন প্লেবয় বন্ধু ছিল, যাদের ব্যবহারিক জ্ঞান ওই পর্ণ-পত্রিকার গল্পের চেয়েও উত্তেজক ছিল। তারা তাদের যৌন অভিজ্ঞতার কথা বলত। আমরা অবদমিত মন নিয়ে তাদের রোমাঞ্চের ও মৈথুনের শীৎকার শুনতাম ও দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। তারপরে তো বিবাহিত জীবন, ‘দারা পুত্র পরিবার , তুমি কার কে তোমার !’

স্কুলকলেজের ডেঁপো বন্ধুদের কেউ কেউ, ভিড়ের বাসে আরেকজনের সাথে ধাক্কা খেয়েছে বা ধাক্কা না খেয়েই কল্প গল্প বানিয়ে বলেছে এটা বোঝা মুশকিল ছিল । যৌনতার ব্যাপারে ওই বয়সটা ছিল, সবকিছু বিশ্বাস করার, হা করে শোনার।

আমাদের প্রজন্মের মধ্যবিত্ত পরিবারের বেড়ে ওঠা অ্যাভারেজ একটা ছেলের যৌন-জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেকটা আমার মতোই। ছোটখাটো ভুল তথ্য ,স্বমেহন বা পর্ণ ছাড়া আমি কোন বিকৃতি দেখিনা।

কিন্তু এর মাঝে মধ্যবর্তী নতুন একটা বিকৃত প্রজন্ম এসেছে ; যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের শ্লীলতাহানি করছে, বা মাইক্রোবাসে তরুণীকে অপহরণ করে ধর্ষণ করছে, তাদেরকে আমি চিনি না। দুর্ভাগ্য, এই বিকৃতদের সাথেই প্রতিমুহূর্ত বসবাস করতে হচ্ছে আমাকে আমাদেরকে !

[ প্রকাশকালঃ ১৪ই জুন,২০১৫ ]