শ্রেণিবিন্যাসে ক্ষমতার অধঃক্রম অনুসারে নীচের নিয়মটি খাপছাড়া রকমের কার্যকরী।
বুঝিয়ে বলছি। ধরুন একটা বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূল মালিকের পরেই আছেন কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর, তাদের নীচে আছেন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ; ক্রমান্বয়ে জেনারেল ম্যানেজার, ডিজিএম, অপারেশন ম্যানেজার, প্রোডাকশন ম্যানেজার, এপিএম , ফ্লোর সুপারভাইজার, লাইন ইনচার্জ, অপারেটর, লেবার ইত্যাদি ইত্যাদি। অথবা আপনি একটা ছোট সংসারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ‘গিন্নী’ । আপনার নিম্নবর্তী শ্রেণীতে আছে দারোয়ান, ড্রাইভার, কাজের বুয়া ইত্যাদি।

শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে ঊর্ধ্বতর শ্রেণীর কাছে নিম্নতর শ্রেণী/শ্রেণীসমূহের কিছু ন্যায্য ও অন্যায্য দাবী-দাওয়া সবসময় থাকে। পুঁজিবাদী পৃথিবীতে কেউ সহজে সন্তুষ্ট হতে পারে না। চাহিদার শেষ নাই । হয়তো পুঁজিবাদই তা হতে দেয় না। ক্ষেত্র বিশেষে ঊর্ধ্বতর শ্রেণিকে নিম্নতর শ্রেণীর ন্যায্য দাবী মেনে নিতে হয়, নেগোশিয়েশন হয়। উভয়পক্ষের ছাড় দিয়ে একটা সমঝোতায় আসে। ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান এগিয়ে চলে। কিছুদিন পরে আবার নতুন করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি নিম্নতর শ্রেণীকে ঠেলে দেয় নতুন দাবী-দাওয়া উত্থাপনে !

অনেকসময় ঊর্ধ্বতর শ্রেণী ভেবে বসে, ট্রায়ালভিত্তিতে বা পরীক্ষামূলক ভাবে সীমিত সময়ের জন্য ( কয়েকমাস বা এক বছরের ) একটা সুবিধা দেওয়া যাক। পরে অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী না হলে ‘সুবিধা’-টা তুলে নেওয়া যাবে ! সেটা হতে পারে, সাপ্তাহিক একদিন ছুটির পাশাপাশি অল্টারনেটিভ আরেকদিন দিনে ছুটি কাটানোর সুযোগ ; হতে পারে দুপুরের ফ্রি লাঞ্চ ; কর্মচারীদের ড্রপ অ্যান্ড পিক অথবা প্রফিট বোনাস , মহার্ঘভাতা ইত্যাদি।

ওই যে প্রথমেই বলেছি, ব্যাপারটা খাপছাড়া ও হাস্যকর মনে হলেও , একটা সুবিধা একবার দেওয়ার পরে, নিম্নতর শ্রেণী যখন সেটা উপভোগ করা শুরু করে – পরবর্তীতে সেটা তুলে নিতে গেলে ভয়ংকর অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ! মূলত: মানুষের চরিত্রই এমন যে , একটা ন্যায্য-অন্যায্য বা অযাচিত সুযোগে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সে ধরেই নেয় সেটা তাঁর অধিকার, জন্মজন্মান্তরের পাওনা।

রফতানিমুখি গার্মেন্টস শিল্পে জড়িত ট্রেডিং অফিসগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি দেড়দিন হয়ে থাকে। সেটা শুক্র –শনি অথবা শনি-রবি মিলিয়ে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে দুইদিন সাপ্তাহিক ছুটির পক্ষে। ঢাকার বেশ কয়েকটি বড় সোর্সিং ও ট্রেডিং অফিসের সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন এবং তারা সবকিছু ম্যানেজ করে দিব্যি ব্যবসা করছে। অনেক অফিসে হাফ-ডে নামে যে ছুটিটা আছে, আমি সেটার ঘোরতর বিরোধী। আমি জানি , সাপ্তাহিক ছুটি সারাদেশে রবিবার হলে এই সমস্যা হত না । মাঝখানের একদিন হাফ-ডে অফিস খোলা না থাকলে পশ্চিমা ক্রেতা , ট্রেডিং অফিস, ব্যাংক এবং কারখানাগুলোর মধ্যে প্রায় ৩ দিনের কম্যুনিকেশন গ্যাপ পড়ে যায়। সেটিও কারো কাম্য নয়।
আবার আধাবেলা অফিসে গুচ্ছের মূল্যবান বিদ্যুৎ , সিস্টেম সাপোর্ট , এসির বাতাস দুপুর-বিকাল পর্যন্ত চালিয়ে যে কার্যোদ্ধার হয় তা মূলত: ঘণ্টাখানেকের কাজ। কেউ বোধহয় দ্বিমত করবেন না যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মধ্যে আধাবেলা অফিসের দিনে তাড়াহুড়ো থাকে — তাড়াতাড়ি কাজ শেষে বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করার ! সুতরাং সকাল ৯:০০ টায় ঢুকে দুপুর ১:০০ টায় বের হয়ে যাওয়ার মাঝখানে কাজের কাজ হয় সামান্যই !

আমি যে প্রতিষ্ঠানে কামলা খাটি , সেখানে ট্রায়াল বেসিস অল্টারনেটিভ শনিবার ছুটির প্রস্তাব এসেছিল। নানাকারণে আমি দ্বিমত পোষণ করি এই ট্রায়াল বেসিস সুবিধার । আমার কথা খুব স্পষ্ট ছিল — দিতে হলে ঘোষণা দিয়ে একেবারে দিতে হবে। কয়েকমাস দিয়ে এই সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার কোন মানে হয়না।

প্রতিটা ঊর্ধ্বতর শ্রেণীর কাছে নিম্নতর শ্রেণীর যেকোনো ন্যায্য বা অন্যায্য দাবী থাকুক না কেন—একবার সেটা দিয়ে, পরবর্তীতে তুলে নেওয়া মূলত: অপ্রয়োজনীয় অসন্তোষের সৃষ্টি করে । সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার আগে দীর্ঘমেয়াদে সেটার প্রভাব কী কী হতে পারে ভেবে দেখা উচিৎ।

[ প্রকাশকালঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ]