সাফল্য, প্রাপ্তিতে মাত্রাতিরিক্ত উৎফুল্ল হয়ে প্রবাহপতিত না হওয়া এবং ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তিতে অনর্থক উদ্বিগ্ন না হয়ে অপেক্ষা করা শিখতে হয়। কৈশোর উত্তীর্ণ প্রবল আবেগে যখন ভেসে যাচ্ছি, সম্ভবত রবি ঠাকুরের কোন এক লেখায় পড়লাম, জীবনের সমাধান –“ দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা ,সুখেষু বীতস্পৃহ। ” সকল দুঃখে অনুদ্বিগ্ন থাকো এবং সুখের আশা কোর না ! তো , এরকম মহামানব তো আমরা নই– এই জীবন দর্শনে কীভাবে আমাদের চলবে ! চিরন্তন সত্য হচ্ছে এই যে, নিজের শরীর মনের স্বার্থেই মাত্রাতিরিক্ত আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার অনুশীলন ভালো।
শহুরে শিশু হিসাবে বেড়ে ওঠায় তেমন কোন জীবনসংগ্রামের মুখোমুখি তো আর হতে হয়নি। তবে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার সুতীব্র সামাজিক পারিবারিক চাপ ; কখনো একতরফা কোন সুন্দরীর প্রেমে পড়ে হা হুতাশ করা, ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থতা ইত্যাদি ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে পড়াশোনার হুজ্জৎ, পরীক্ষা, পরীক্ষা , পরীক্ষা এবং অন্তহীন পরীক্ষার শেষে চাকরিজীবনে ঢোকা; সংসার-যাপন। মনে আছে, সুদূর কৈশোরের ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে দুইদিন প্রায় নাওয়া খাওয়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিল। অথচ বছর না ঘুরতেই নিজের বোকামিতে নিজেই হেসেছি। যুক্তি দিয়ে বুঝেছি। উচ্চমাধ্যমিকের পরে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমার প্রস্তুতি খুব সুবিধার ছিল না। নড়বড়ে প্রিপারেশনে যেখানে যেখানে চান্স পাওয়ার ছিল, আমি তাই পেয়েছি। এতে উদ্বিগ্ন ও হতাশ হওয়ার কী আছে !
আমার বাগদত্তা ও পরবর্তীতে সহধর্মিণীর সঙ্গে বছর দুয়েকের প্রেম ছিল। প্রেমটা যখন হয়েছিল তখন আমি চাকরি করি, আবেগ থিতু হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক বন্ধুকে কৈশোরিক ‘বাছুর-প্রেমে’বারবার পড়তে দেখেছি। কিশোরী প্রেমিকার বিরহে কেউ কেউ ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার উপক্রম করেছে। আবার একইসঙ্গে কেউ কেউ সকালে একজনের সঙ্গে ডেট করে সন্ধ্যায় আরেকজনের সঙ্গে করেছে। বিশ্বপ্রেমিকদের রোমাঞ্চের সত্যি গল্প আর জাল গল্প আমরা বুভুক্ষের মতো শুনেছি, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। প্রেমে ব্যর্থদের কাঁধে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছি। প্রেমের ব্যাপারটা বড্ডো আবেগের, আর সেখানে ইগো এতো বেশি কাজ করে যে, কে কখন কোন আচরণ করে বসে—সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। আমাদের যে ব্যর্থ প্রেমিক বন্ধুদের কেউ কেউ ভেবেছিল ‘এই জীবন লইয়া আমি কি করিব?’—সেই তারাই কিছুদিন পরে আরেক সাদাসুন্দরীকে বিয়ে করে ছানাপোনা তুলে ভুলে গেছে সেই বালখিল্যতার কথা। স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে, কৈশোরের অধিক উত্তেজনায় বলাকা ব্লেড দিয়ে কব্জিতে আঁচর দেওয়ার চিহ্ন।
বছর বিশেক আগে, আমার এক পশ্চিমা ক্রেতার কাছে শেখা। করপোরেট জীবনের প্রারম্ভিক। মনে হতো, আমার ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তাই বুঝি সারাক্ষণ আমি কী কী লেজেগোবরে করলাম সেটা টর্চলাইট জ্বালিয়ে দেখছে। যে কোন ব্যর্থতায় ভয়ঙ্কর মুষড়ে পড়তাম। তখন সেই ক্রেতা আমাকে বোঝাল, কীভাবে সমস্যায় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়।
তাঁর সঙ্গে কথোপকথন ছিল অনেকটা এরকম।
মুখোমুখি বসে বলল,
: জাহিদ এই সমস্যা আজকে দিনের শেষে কি অবস্থা হবে?
: সকালে যেমনটি ছিল, তেমনটিই। বরং সবার কাছে এই সমস্যার কথা পৌঁছে আমার উপরে অনেক বেশি প্রেসার তৈরি হবে।
: আচ্ছা, তিনদিন পরে কি হবে?
: সমস্যাটাতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে যাবে সবাই। উপরের কর্মকর্তাদের অনেকেই হয়তো যুক্ত হবেন। কেউ কেউ হয়তো সমাধানের চেষ্টা করবে।
: এক সপ্তাহ পরে কি অবস্থা হবে?
: এক সপ্তাহ পরে, হয়তো তেমন কিছুই অগ্রগতি হবে না। তবে, কোন একটা বিকল্প পথ খুঁজে পাওয়াও যেতে পারে। এবং এই একমাত্র সমস্যার সঙ্গে আরও কিছু নতুন সমস্যা এসে যুক্ত হবে। অনেকের মনোযোগ বিভিন্ন সমস্যায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
এভাবে, দুই সপ্তাহ পরে, তিন সপ্তাহ পরে এক মাস পরে কী কী হতে পারে ভাবতে বললেন।
ছয়মাস পরে ঐ দুর্বিষহ সমস্যার কথা আমি কেন, সবাই ভুলে যাবে। একবছর পরে আমি ভুলেই যাব কী ভয়ঙ্কর দিনরাতই না কেটেছে আমার!
ওঁর আগে আমাকে এভাবে কেউ চিন্তা করতে শেখায় নি।
হয়তো ওদের নানারকম অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ট্রেনিং থেকেই ওঁর ওই উপলব্ধি ছিল।
এই যে বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত চিন্তা করার ব্যাপারটা আমাকে তাৎক্ষণিক শারীরিক ও মানসিক অসম্ভব স্ট্রেস থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এখনো কোন সমস্যায় যখন চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পড়ি, উপরের দর্শনে ফিরে যাই। মানসিক ও শারীরিক স্ট্রেস অনেক ডাইলুট বা তরল করে ফেলি। যদিও পৃথিবীর সব সমস্যাকে এই ধাঁচে ফেলার চিন্তা করাটা ঠিক হবে না।
ও হ্যাঁ, কেন এই কথা বললাম, কারণ ‘মৃত্যু’ ব্যতীত সব সমস্যার একটা আপাত সমাধান আছে বলে আমার মনে হয়।
একমাত্র মৃত্যুর কোন সমাধান নেই। সে অভিজ্ঞতার কথা না হয় আরেকদিন।
সাম্প্রতিক মন্তব্য