স্মৃতি ২০০৫ :
২০০৫-এর ডিসেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় কোমর ভেঙ্গে হাসপাতালে। ডান হিপ জয়েন্টের ফিমার-অ্যাসিটাবুলাম গেছে ছুটে ! ভীষণ ব্যস্ত এই আমি আকস্মিক বিছানায়। দুর্বিষহ শারীরিক কষ্টের কথা বাদই দিলাম। বুড়ো হাড় ভাঙ্গলে জোড়া লাগানো যে কী কষ্টের, সে আর কহতব্য নহে !
কিন্তু, শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও মানসিক যন্ত্রণাটা ছিল অসহনীয়।

প্রথম যে প্রশ্নটা মনে পীড়া দেওয়া শুরু করলো , ‘হোয়াই মি ? আমিই কেন? ’
প্রাথমিক এক সপ্তাহ ধর্মপ্রাণ আম্মাকে বলে চললাম , ‘এটা কেমন বিচার, আমার আশেপাশের কুৎসিত ও অর্থ-লোলুপ পশুসুলভ লোকগুলো দিব্যি হেঁটে চলে ফিরে খাচ্ছে আর আমি কোমর ভেঙ্গে হাসপাতালে? এটা কেমন বিচার?’
আম্মা নানারকম সান্ত্বনার কথা বলতেন। বলতেন, ‘আল্লাহ্ ভালো মানুষের পরীক্ষা নেয় দুনিয়াতে। পাপ কাটা যাচ্ছে।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু নিজেকে নিজে কোন সান্ত্বনা দিতে পারতাম না।

কেমন করে ভুলি, আমি ও আমার স্ত্রী তখন অপেক্ষা করছি আমাদের প্রথম আরধ্য সন্তানের জন্য! অনাগত সেই মুখ দেখবো, স্ত্রীর পাশে হাসপাতালে থাকবো ; সেই কবে থেকে সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলাম। সেখানে আমি আমার অনাগত সন্তানের সেবা করবো কি, আমার সহধর্মিণীই তাঁর ওই অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় হাসপাতালে আমার সেবা করে যাচ্ছেন। একটা কথা মাঝে মাঝে শুনতাম , সংসার এমন যে, প্রয়োজনে তোমাকে তোমার অর্ধাঙ্গী বা অর্ধাঙ্গিনীর মল-মূত্রও পরিষ্কার করতে হয়। এটা স্যাক্রিফাইস আর অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপার। সেটা যে, প্র্যাকটিকালি নিজের জীবনে দেখতে হবে, কে জানতো ! আমিতো আমার স্ত্রীর জন্য সামান্য হিন্দীকেশ ছিঁড়েও আঁটি বাঁধি নাই কোনদিন। আজ তাঁকেই কিনা পরিষ্কার করতে হচ্ছে আমার মল-মূত্র ! দুর্বোধ্য , নিষ্ফল এক আক্রোশে ফুঁসতাম শুধু !

আমার চিকিৎসক বন্ধুরা, শুভানুধ্যায়ীরা একে একে সাহস দিতে লাগলেন। ডাক্তাররা বোঝালেন আমার ভগ্নদশা মেরামত ও নিরাময়যোগ্য এবং আমি আবার আগের মতো হাঁটতে চলতে পারবো। আমার অফিসও সেই সময় অসম্ভব সহানুভূতি দেখালো। বিছানার পাশে বসে সাহস দেয়া সেই সব মুহূর্তগুলোর কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।

এক চিত হয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ। পাশ ফিরতেও পারতাম না। ডান হাঁটুর নীচে হাড় ছিদ্র করে একটা লোহার রডে লাগানো হয়েছিল, সেই রডের সাথে ১৪ পাউন্ড লোহার ওজন ঝুলত। ওই বস্তুকে বলে ট্রাকশন ! দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ গোসল নাই, মল-মূত্র বিছানায়। কী যে অসহনীয় সেইদিনগুলো ; আমি এখনও ভাবলে শিউরে উঠি।

নানা ধরণের বই পড়তাম শুয়ে শুয়ে। সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাসমগ্র পড়ে ফেললাম। এবং তাঁর একনিষ্ঠ ভক্তও হয়ে গেলাম। প্রায় ৭/৮ সপ্তাহ পরে ক্র্যাচে করে আবার নতুন করে হাঁটতে শেখা। এর মাঝে আমার মেয়ে জেবার জন্ম ২০শে ফেব্রুয়ারি ২০০৬ । বুকের ওপর আম্মা ফুটফুটে একটা মনুষ্যশিশুকে শুইয়ে দিলেন। বসতেও পারিনা। ওভাবেই শুকনো চোখে আমার নীরব অশ্রুপাত।

আমেরিকান এক টেনিস খেলোয়াড় আর্থার অ্যাশ-এর একটা কথায় আমার প্রশ্নের আংশিক উত্তর পেয়েছিলাম। অন্তত আমাকে ওই বিশেষ কথাগুলো ‘হোয়াই মি? কেন আমিই ?’ এই প্রশ্নের ক্ষতে, তখনকার মতো কিছুটা হলেও একটা সান্ত্বনার প্রলেপ পড়েছিল।
আর্থার অ্যাশ ছিলেন আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম কালো খেলোয়াড় যিনি একাধারে ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়া ওপেন এবং উইম্বলডন জিতেছিলেন। আমেরিকার টেনিস ইতিহাসের কিংবদন্তি। ১৯৮৩ সালে তাঁর হৃদপিণ্ডে সার্জারি করার সময় রক্ত-বাহিত হয়ে এইডস (AIDS) আক্রান্ত হন তিনি। সারা আমেরিকা থেকে তাঁর ভক্তরা তাঁকে শুভেচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নটিও ছুঁড়ে দিতেন, ‘আপনাকেই কেন এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হলো?’

তিনি বোধকরি নিজেকেও এই প্রশ্নই করেছিলেন, ‘হোয়াই মি? কেন আমিই ?’
এক পর্যায়ে এসে আর্থার অ্যাশ নিজেকে প্রবোধ দিলেন। উনি নিজেকে বোঝালেন ৩২ কোটি আমেরিকানদের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ পাওয়া কয়েক কোটি কালোদের মধ্যে সৌভাগ্যবান তিনি একজন। ৫ লক্ষ প্রফেশনাল খেলোয়াড়দের তিনি একজন তিনি একজন। গ্র্যান্ড স্লামে পৌঁছানো শেষ পাঁচ হাজারের তিনি একজন। যে ৫০ জন উইম্বলডন পর্যন্ত গেছেন, তিনি তাদের একজন, সেমিফাইনালে শেষের চারজনের তিনি একজন এবং ফাইনাল খেলার দুইজনের একজন।
কাপ জেতার পরে বা জীবনের অন্যান্য অগুনিত সৌভাগ্যের ক্ষেত্রেই এই প্রশ্ন একবারও ওঠেনি , ‘হোয়াই মি ? আমিই কেন?’
আর আজ যখন একটা অসুস্থতা তখন কেন এই প্রশ্ন?

আর্থার অ্যাশের এই অভিজ্ঞতা পড়ার পর আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পেরেছিলাম, কিছুটা হলেও !

প্রথম প্রকাশঃ ২০১৩