এই ধরেন, কয়েকবছর আগেও আরেক মহল্লার বন্ধু আত্মীয়রা কে কেমন ফাঁপরে আছে, কেমন যাচ্ছে দিনকাল ; সেটা জানার সহজ উপায় ছিল না। শাশুড়ির কেলানি, ননদের কূটনামি , স্বামীর সঙ্গে খিটমিট করে গিন্নীরা ডালে পাঁচফোড়ন দিত, বাচ্চাকে খাওয়াতো। আর মাঝেসাঁঝে সুযোগ পেলে বলতো, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে। ঘটক শালা থেকে শুরু করে বাপ ভাইকে শাপান্ত করতো, কোন অলক্ষুণের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে বলে ; বিড়াল পার করে আর খোঁজ নেয় না বলে। দুইবাড়ি পরের সমবয়সী কোন প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কোন এক বিকেলে দেখা হলে, খুব মেপে মেপে সেই সাধারণ কথাগুলোই শেয়ার করতো যেগুলো খুব বিপদজনক বড় মাপের না। যেগুলো সারা পাড়া ঘুরে নিজের কাছে উল্টো ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। আর রাত হলে স্বামী সোহাগে দিনের কূটকচাল, অভিমান ভুলে যেতে যেতে ভোর হলে, সেইসব গিন্নিরা আবার লেগে পড়তো সংসারে।
সদ্য কৈশোরের বয়ঃসন্ধিকালীন অস্থির , ছাত্রাবস্থায় হালকা ডাব্বা মেরে স্যারের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে পাড়ার মোড়ে বিড়ি ফুঁকত যে ছেলেগুলো। আর আড়ে ঠারে মহল্লার সুন্দরী কিশোরী কখন ব্যালকনিতে আসে সেই প্রতীক্ষায় থাকতো যে ছেলেগুলো। সেই ছেলেরাই আবার চাকরি করতে গিয়ে ট্র্যাফিক ঠেলতে ঠেলতে শাপান্ত করতো সরকারকে। অফিসে বসের ঝাড়ি খেয়ে , পকেটমার হয়ে, বাসের ভিড়ে শার্টের হাতা ছিঁড়ে, হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে দরোজায় কড়া নেড়ে প্রিয়মুখ দেখে সব যেতো ভুলে।
আমাদের চিরচেনা সেই ছেলেমেয়েদের বয়স হয়েছে। এখন তারা অবাধ , নিরবচ্ছিন্ন অনলাইন ভার্চুয়াল পৃথিবী পেয়ে চরমভাবাপন্ন হয়ে গেছে। একটা ‘অনাবশ্যক’ হুতাশন আর অস্থিরতায় কাটছে তাদের এইসব দিনরাত্রি।
মানুষতো জন্মের অব্যবহিত পর থেকেই নিজেকে প্রকাশ ও প্রমাণ করতে চায়। দেখবেন – তুচ্ছ মানবশিশু হামাগুড়ি দিলেও সারা পরিবার উচ্ছ্বসিত হয় ; হাঁটি হাঁটি পা পা করলেও সারা পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আধো আধো অর্থহীন বুলি ফুটলেও উচ্ছ্বাস, খাবার উগড়ে দিলেও উচ্ছ্বাস , হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেও , বাবা রে সোনা রে, ওরে কে রে বলে উচ্ছ্বাস। এই যে, কোন একটা কিছু করেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা ও মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানবশিশু, বড় হতে হতে যখন দেখে, সে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই; বাড়ির বাইরে তো তার আর তেমন কোন পরিচয় নেই– তখন সে একটা কিছু হওয়ার জন্যে সে উঠে পড়ে লাগে। তারপর গুচ্ছের পড়াশোনা করে উপার্জনক্ষম হলেও কোথায় যেন মনোযোগের আকাল পড়ে। পাড়ার ডাকসাইটে সুন্দরী তরুণীদের বিয়ের কয়েক-দশক কেটে গেলে চারপাশে আর কোন মুগ্ধ চোখ কিংবা অকারণ উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য থাকে না। সেটা তারা মেনে নিতে শেখে। সংসারে মন দেয়, ঘরকন্না করে, বাচ্চাদের বড় করে, বিয়ে দেয়।
ভার্চুয়াল জগতের আগের জগত ছিল কিছুটা আলোড়নহীণ। ভার্চুয়াল জগতের অনাবশ্যক ক্রমাগত বিস্ফোরক আলোড়ন আর উচ্ছ্বাস সুযোগ এনে দিয়েছে হুমড়ি খেয়ে পড়া শিশুটিকে ! সেই বয়স্ক শিশুটি পড়ে গেছে যেন তেন প্রকারে মনোযোগ পাওয়ার অভ্যস্ততার চিরন্তন চক্রে।
যা ঘটছে, আর যা আপনি ভার্চুয়ালি প্রকাশ করছেন , সেখানে কিন্তু আগেও ফাঁক ছিল। সেই ফাঁক , মাপাহাসি চাপাকান্নার সেই মেকি প্রদর্শনকামিতা ও সহানুভূতিলিপ্সা একইরকম আছে । তেমন কিছু বদলায়নি । পুঁজিবাদ, ভোগবাদিতার অন্য সব সার্বজনীন সুবিধার মতো এ শুধু সংখ্যাতেই বেড়েছে, বিশাল সেই সংখ্যা ! দেখার চোখ থাকলে, সহজেই দুঃখবিলাসী , প্রদর্শনকামী , অতিআত্মপ্রেমি, অস্থির , বিভ্রান্ত, পরশ্রীকাতর,অনাবশ্যক হতাশ, অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ঈর্ষাপরায়ণ সংখ্যাহীন মানুষকে দেখতে পাবেন।
যতোই ইমোজি থাকুক, মানুষের মৌলিক অনুভূতিগুলো কি আর বদলে যাবে এতো সহজে !
সাম্প্রতিক মন্তব্য